প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও অভিবাসন সংকট by মোহাম্মদ জমির
দায়িত্ব
গ্রহণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুটো
প্রেক্ষিতের ব্যাপারে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। একটি অবশ্যই 'আমেরিকা
ফার্স্ট'। অপরটি হচ্ছে গুরুতর নানা পরিস্থিতিতে টুইটারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক
ও অপ্রচলিত ঢঙের প্রতিক্রিয়া। এ দুটি বিষয় একই সঙ্গে যেমন আন্তর্জাতিক
মহলে গুরুতর অস্বস্তি তৈরি করেছে, তেমনই অভ্যন্তরীণ শাসন কাঠামোতে সৃষ্টি
করেছে জটিলতা। সৌদি আরব, ইসরায়েল, ফ্রান্স ও চীন সফরের সময় এবং ইউরোপ,
জাতিসংঘ ও দূরপ্রাচ্যে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সভাগুলোতে অংশগ্রহণকালে তার এসব
বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও সুইজারল্যান্ডের দাভোস সফর এ ক্ষেত্রে তার
খানিকটা পরিবর্তিত অবস্থানের সাক্ষী হয়ে আছে। সেখানে ছাড়াও তার স্টেট অব
ইউনিয়ন ভাষণে যে পরিবর্তনটি চোখে পড়েছে, তা হলো টেলিপ্রম্পটার থেকে দেখে
বক্তৃতা দেওয়া। এর একটি কারণ হতে পারে, ভাষণের বিষয় ছিল অর্থনীতি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণ দিয়েছেন জানুয়ারির ৩০ তারিখ।
ভাষণটি দিতে তিনি ক্যাপিটাল হিলের ডায়াসে উঠেছিলেন প্রথম মেয়াদে সবচেয়ে কম
জনপ্রিয়তায় থাকা প্রেসিডেন্টদের একজন হিসেবে। এখন জনপ্রিয়তার মাত্রা সেখান
থেকে খানিকটা বেড়েছে; কিন্তু তার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের
প্রচারণায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্ত প্রক্রিয়ায় তার প্রেসিডেন্সি
এখনও মেঘাচ্ছন্ন। প্রেক্ষিতটি বিশ্নেষণ করতে গিয়ে সিএনএনের ক্রিস সিলিজ্জা
একটি তথ্য তুলে ধরেছেন- ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ৮০ মিনিটের ওই ভাষণের প্রথম
ঘণ্টায় কেবল অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে কথা বলেছেন- যেমন কর হ্রাস, অর্থনীতি,
বাণিজ্য, আইনি সংস্কার ও অভিবাসন। আন্তর্জাতিক পরিসরে আমেরিকার ভূমিকার কথা
সেখানে সামান্যই উল্লেখ ছিল। সেখানে তিনি স্টক মার্কেটের ধারাবাহিক
প্রবৃদ্ধি ও কর্মহীনতার নিম্নহারসহ দায়িত্ব পালনের প্রথম বছরে অর্থনৈতিক
সাফল্য তুলে ধরাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি সবচেয়ে উচ্চকিত ছিলেন কর
হ্রাসের বড় একটি প্যাকেজ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিলে স্বাক্ষর করে আইনে পরিণত
করার বিষয়ে। ঘোষণা করেন, আইনি সংস্কারের ফলে শিল্প খাতে উন্নতি দেখা দেবে।
তিনি আরও ইঙ্গিত দেন, তার আর্থিক বাজারমুখী পদক্ষেপ সফল হয়েছে এবং ৩ দশমিক
২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে তার প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির
ট্রাম্প বর্ণিত এই ত্রিমুখী উল্লম্ম্ফন অবশ্য ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে
মিইয়ে গেছে এবং ইউএস স্টক মার্কেটে চরম অস্থিতিশীলতা ফুটে উঠেছে। স্টেট অব
ইউনিয়ন ভাষণের সুযোগ ব্যবহার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তার বলয়ের বাইরে থাকা রিপাবলিকানদেরও একহাত
দেখে নিয়ে বলেন, 'তারা সব খেয়ে ফেলেছে'। ক্রিস সিলিজ্জা বলছেন, তিনি
ইতিমধ্যে ডিএসিএ (শিশুকালে যুক্তরাষ্ট্রে আসাদের নাগরিকত্ব প্রক্রিয়া) ছুড়ে
ফেলে দিয়েছেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার গৃহীত নীতি বাতিল করে
দিয়েছেন। আর এই ভাষণের সময় গুয়ানতানামো বে কারাগার চালু রাখার ঘোষণা
দিয়েছেন। বারাক ওবামা কারাগারটি বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি দীঘদিন ধরে দিয়ে
দীর্ঘদিন ধরেই ব্যর্থ হয়ে আসছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে
তা পুরোপুরি ভেস্তে গেল। এটাও উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, ট্রাম্প
কিউবার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা নতুন করে আরোপ করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্নেষক
অধ্যাপক জুলিয়ান জেলিজার অবশ্য মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন এইদিকে যে
ডেমোক্র্যাটদের উচিত হবে না কিছু সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া। একটি হচ্ছে
ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার সম্ভাব্য নিম্নগতি, অপরটি হচ্ছে রিপাবলিকান পার্টির
মধ্যেই ট্রাম্পবিরোধী বিদ্রোহ। তিনি মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন
'রাজনৈতিকভাবে ফিরে আসার' সর্বোচ্চ চেষ্টার মধ্যে রয়েছেন। আর গত ডিসেম্বর
থেকে ১০ শতাংশ বেড়ে তার অনুমোদিত বিলগুলোর প্রতি জনসমর্থন ৪২ শতাংশে
পৌঁছেছে। সন্ত্রাসবাদী হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা নিরাপদ- এ ব্যাপারে
আস্থা বেড়ে ৫০ শতাংশ থেকে ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
হচ্ছে, ভোক্তাদের আস্থা গত ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায়। এই যুক্তিও
প্রদর্শিত হচ্ছে যে, স্টক মার্কেট খানিকটা নিম্নগতি পেলেও এখনও এটা
ঐতিহাসিক উচ্চহারে রয়েছে। এটাও বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরে কর হ্রাস বিল পাস
হওয়ার প্রভাবে নতুন বছরের প্রথম তিন মাসে শ্রমিকদের মজুরি খানিকটা বেশি
বাড়বে। এসব চিত্র দেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বক্তাদেরও সতর্ক
হওয়ার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি উঠে আসছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট
নির্বাচন চলাকালেও তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। অধ্যাপক
জেলিজার বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প গৃহীত অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো পাশ হওয়ার সময়
চরম অজনপ্রিয় হলেও এখন সেগুলো থেকে সুফলই পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে অনেকে এখন
প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ১৯৮৪ সালের পদক্ষেপগুলোর কথা নজির আকারে
আনছেন এবং তার সেই উক্তি 'আমেরিকায় আবার সকাল' স্মরণ করছেন। রিপাবলিকানরা
প্রত্যাশা করছে, অর্থনীতিতে এই ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের লাখ
লাখ মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে প্রভাব ফেলবে এবং ২০১৮
সালের শেষদিকে অনুষ্ঠিতব্য মধ্যবর্তী নির্বাচনে সুফল বয়ে আনবে। ডোনাল্ড
ট্রাম্প তার অভিবাসন-সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে
দৃশ্যত বিভাজন তৈরি করতে পেরেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, তিনি প্রেসিডেন্টের
দায়িত্ব গ্রহণের আগে পূর্বসূরি বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের
শিশু সন্তানদের সুরক্ষা দিতে যে 'ড্রিমার' কর্মসূচি নিয়েছিলেন, তা
বাস্তবায়ন করতে হয়েছিল নির্বাহী আদেশের মধ্য দিয়ে। বস্তুত ট্রাম্পের 'নিউ
ডিল' প্রক্রিয়ার কেন্দ্রেই রয়েছে বিষয়টি। এর মধ্য দিয়ে তিনি যদিও
অবরোধপন্থি অভিবাসন পরিকল্পনার কট্টর সমর্থকদের হাত শক্তিশালী করতে
চেয়েছিলেন, একই সঙ্গে গোটা কর্মসূচি বাতিল করে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে একটি
কৃত্রিম সংকটও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। একা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হিসেবে
না নিয়ে তিনি এটাকে আইনসভার মাধ্যমে পাশ করতে গিয়ে ডেমোক্র্যাটদেরও যুক্ত
করে এক ধরনের বাজিও ধরেছিলেন। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে যারা সরকার ব্যবস্থার
সচলতা ও সুশাসনে বিশ্বাস করেন, তারা দ্রুতই অস্থায়ী বাজেটের ব্যাপারে
অবস্থান নিয়ে নিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ধরনের চুক্তিতে
গিয়ে নিজের অবস্থান আরও সংহত করেছেন। অবশিষ্ট অভিবাসীদের ওপর আরও কড়া
পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি তিনি এখন কুখ্যাত 'মেক্সিকান ওয়াল' তৈরিতে আরও
বেশি জোর দিতে পারছেন।
এর ফলে ডেমোক্র্যাটরা এখন নিজেদের কঠিন অবস্থানে
নিয়ে গেছে। তাদেরই এখন ড্রিমার কর্মসূচি ও অভিবাসন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে
কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। যদিও সরকারের কোনো অংশে আর তাদের নিয়ন্ত্রণ
নেই। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি
করেছেন, যেখানে একদিকে ড্রিমার কর্মসূচি, অন্যদিকে লাখ লাখ অভিবাসী, যারা
আমেরিকায় গমনপ্রত্যাশী। এর মাঝখানে রয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। আর অবৈধ
অভিবাসীদের নাগরিকত্বের সম্ভাবনার পথই ডোনাল্ড ট্রাম্প সরিয়ে ফেলতে
পেরেছেন। এই যখন চিত্র, অনেকের প্রশ্ন করার সুযোগ হয়েছে যে ভবিষ্যতে
অভিবাসী পরিকল্পনার উদারীকরণের কোনো সুযোগই কি আদৌ আছে? মনে করা হচ্ছে,
বর্তমানে যে ধারায় আলোচনা হচ্ছে, সেই ধারাই যদি ডেমোক্র্যাটরা পরিবর্তন
করতে না পারে, তারা একটি 'লুজ লুজ' পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। হয় তাদের
'ড্রিমার' প্রকল্পের অবসানের দায় নিতে হবে, যার ফলে দলটির মূল ভিত্তিই
নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে; অথবা আইনসভায় তাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে
বিপুল বিজয়ে ভূমিকা রাখতে হবে, যা ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রার্থিতার পথ
কার্যত প্রশস্ত হয়ে যাবে। তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যবর্তী নির্বাচনের
প্রচারণায় গিয়ে গলা ফুলিয়ে বলতে পারবেন যে তিনি 'গ্রান্ড বার্গেইনিং' জয়
করতে সক্ষম। এসব বিবর্তন ও সম্ভাবনা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
রাজনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্তই থাকবেন। তার রাজনৈতিকভাবে 'ফিরে আসা' নিয়ে যে
সম্ভাবনা, তাও খানিকটা নাজুক। এ বছর অক্টোবরের মধ্যে তার ভাগ্যে যা ঘটবে,
তা এ বছরের শেষ দিকের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির ভাগ্যও
নির্ধারণ করবে। এর মধ্যেই আমরা দেখছি, একটি বৃহদায়তন সামরিক প্যারেডের
আয়োজনের নির্দেশ দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন একটি ধারা তৈরি করতে চাচ্ছেন।
তিনি আশা করেন, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে আমেরিকান নেতৃত্ব পুনঃনিশ্চিত হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত
muhammadzamir0@gmail.com
সাবেক রাষ্ট্রদূত
muhammadzamir0@gmail.com
No comments