সেই মহাউত্থানের দিনে by অজয় দাশগুপ্ত
এমনই
একটি দিন, যেন পহেলা মার্চ! এমন দিন বিশ্বের কোন দেশে কোথায় মিলবে? ১৯৭১
সালের ১ মার্চ সকাল থেকে ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের মধুর
ক্যান্টিনে। দুপুর ১টার দিকে ঢাকা রেডিও থেকে ঘোষণা করা হলো- ৩ মার্চ ঢাকায়
জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসার কথা ছিল, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত
করেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। মধুর ক্যান্টিনে তখন
শ'খানেক ছাত্রছাত্রী। তারা জয় বাংলা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ
স্বাধীন করসহ বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমে আসে। আমিও ছিলাম এই দলে।
কলাভবন থেকে ফুলার রোড ধরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছানোর মধ্যে গোটা
রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। কার্জন হল ও ফজলুল হক হলের পাশ দিয়ে
গুলিস্তানের দিকে যাওয়ার সময় আমাদের পথে পড়ে একটি লাকড়ি বিক্রির পাইকারি
ব্যবসা কেন্দ্র। শত শত লাকড়ির মুট রাখা ছিল বিক্রয়ের জন্য। স্বাধীনতাকামী
হাজার হাজার জনতার হাতে হাতে সে লাকড়ি মুহূর্তে পৌঁছে গেল। এর আগে
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের রেলিং ভাঙতে দেখেছি একদল তরুণকে। বেশ পুরু লোহা
দিয়ে তৈরি রেলিং থেকে কীভাবে যে রডগুলো আলাদা করা হলো কেবল গায়ের জোরে,
তাকে কেবল অলৌকিক বলা চলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন মতিঝিলের
পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে অবস্থান করছেন। তিনি আগের রাতেই
ধারণা পেয়েছেন, পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত পরিষদের অধিবেশন
অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হচ্ছে। কেন এ পদক্ষেপ? কারণ পাকিস্তান
জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের
ছয় দফা দাবি থেকে এক চুলও সরে আসতে রাজি হননি। তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব
মানুষকে এর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। ১ মার্চ দুপুরে ইয়াহিয়া খান
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি- বাংলাদেশ
চলেছে স্বাধীনতার পথে। প্রকৃতপক্ষে সেদিন থেকেই পাকিস্তানের পূর্বাংশে
স্বাধীন সত্তায়। এখানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, পাকিস্তানের
সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের নির্দেশ মুহূর্তে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
২ মার্চ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ স্বাধীন দেশের পতাকা
উত্তোলন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা ...' নির্ধারিত হয়
জাতীয় সঙ্গীত। ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মওলানা
আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, নূরুল আমীন ও আতাউর
রহমান খানের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এদের কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন
না। পাকিস্তান পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা।
জনগণ তাকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। কিন্তু দেশ যেহেতু স্বাধীনসত্তায় আবির্ভূত হতে
চলেছে, এক পাকিস্তানের ধারণা অতীত হতে চলেছে- তেমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু
সবার মতামত চেয়েছেন। কেমন সেই নতুন পরিস্থিতি? এ বিষয়ে ভারতের গবেষক
শ্রীনাথ রাঘবন তার '১৯৭১' গ্রন্থে লিখেছেন, 'ইয়াহিয়ার ঘোষণার কয়েক মিনিটের
মধ্যে হাজার হাজার মানুষ ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। সরকারি অফিসার ও
কর্মচারীরা ধর্মঘট করে, ব্যাংক ও বাণিজ্যিক অফিসের কর্মীরা কাজ বন্ধ করে
দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আদালতপাড়া খালি হয়ে যায়। পাকিস্তান ও
কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে ক্রিকেট খেলা চলছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে, সেখানে খেলা
বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভকারীদের হাতে বাঁশের লাঠি ও লোহার রড। তারা স্লোগান
দিচ্ছিল স্বাধীনতার জন্য। বলছিল সশস্ত্র সংগ্রামের কথা।... তিনি পূর্বাণী
হোটেল থেকে জানান, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার যা বলার বলবেন।' ইয়াহিয়া
খানের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ড. জি ডব্লিউ চৌধুরী তার 'দি লাস্ট ডে'জ অব
ইউনাইটেড পাকিস্তান' গ্রন্থে লিখেছেন, রেডিওতে ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন
অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় প্রতিক্রিয়া হয়
ভায়োলেন্ট, মুজিব তার ভাষায় 'অহিংস অসহযোগ আন্দোলন' শুরু করেন। কিন্তু এটা
গান্ধীর মতো 'অহিংস অসহযোগ' আন্দোলন ছিল না। মুজিব প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা
করেন, যা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের জন্য একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার শামিল।
মুজিবের নির্দেশে কার্যত প্যারালাল সরকার কাজ করতে থাকে। ৩ থেকে ২৫ মার্চ
পর্যন্ত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর ছিল
না। 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' গ্রন্থে রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম লিখেছেন, শেখ
মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন, 'এটা নীরবে সহ্য করা যায় না। ষড়যন্ত্রকারীদের
সুবুদ্ধি ফিরে না এলে ইতিহাস তার নিজস্ব পথেই চলবে।' প্রতিবাদের বিক্ষুব্ধ
ঢেউয়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তান যেন ডুবে গেল। প্রকৃতই এমন বিদ্রোহ কখনও দেখেনি
কেউ। ১ মার্চ দুপুর থেকে পরের কয়েকটি ঘণ্টা গোটা বাংলাদেশে কত শহর, বন্দর ও
গ্রামে কত সমাবেশ হয়েছে, কত মানুষ অংশ নিয়েছে, সে হিসাব রাখার কেউ ছিল না।
সামান্য খবরই এসেছে সে সময়ের সংবাদপত্রে। যেখানে যেভাবে পেরেছে মিছিল,
সমাবেশ করেছে। কোনো গবেষক দল যদি আনুমানিক হিসাবও বের করতে পারেন, দেখা
যাবে একটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সম্ভবত একসঙ্গে এত মিছিল-সমাবেশ বিশ্বে আর
কখনও দেখা যায়নি। জনগণ প্রতিবাদ জানিয়েছে পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে।
অস্ত্র তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছে। ৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে নবতর পর্যায়ের
আন্দোলন-অসহযোগিতা। বেতার-টেলিভিশন চলে এসেছে জনগণের নিয়ন্ত্রণে। একই সঙ্গে
বঙ্গবন্ধু এবং তার সহকর্মীদের সর্বোচ্চ মাত্রায় সচেতন থাকতে হয়েছে- যেন এ
আন্দোলনকে কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। ৭ মার্চ তিনি
যদি ঘোষণা দিতেন ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করো- হয়তো সেটাই করা হতো। কিন্তু
তাতে আমাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে বিশ্বের সমর্থন লাভ কঠিন হতো। আমরা
চিহ্নিত হতাম বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে। কিন্তু ২৫ মার্চের পর দেখা গেল,
পাকিস্তানের শাসকরাই অভিযুক্ত একটি জনপদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা রক্তের
বন্যায় দমিয়ে রাখার জন্য ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র প্রয়োগের কারণে। আর বঙ্গবন্ধু
বিশ্বের চোখে পরিণত হয়েছেন নিপীড়িত একটি জনগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রামের
মহানায়কে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেবেন, তার নানা
ব্যাখ্যা এখন বিশ্বব্যাপী চলছে। তিনি এ ভাষণে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তা সব
শ্রেণি-পেশার মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
জি ডব্লিউ চৌধুরী লিখেছেন,
মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি; কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে (৬ মার্চ
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন- ২৫ মার্চ অধিবেশন বসবে) যোগদানের জন্য
চারটি শর্ত ঘোষণা করেন। শ্রীনাথ রাঘবন লিখেছেন, একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা
করা হলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেটাকেই বাঙালিদের ওপর হামলার অজুহাত
করত- এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সচেতন ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ
ঘোষণা মেনে নেবে কিনা সেটাও নিশ্চিত ছিল না। শেখ মুজিব স্বাধীনতার লক্ষ্য
নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্ট চার দফা দাবি উপস্থাপন করেন। তিনি স্বাধীনতা
ঘোষণা করেননি; কিন্তু তার ১৭ মিনিটের ভাষণ was a master piece of oratory’.
তিনি লিখেছেন, মুজিবের বক্তব্য ও দাবি ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। পশ্চিম
পাকিস্তানেরও অনেক নেতা তার প্রতি সমর্থন জানান। ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার
আলী ভুট্টো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ইয়াহিয়া খান
১৫ মার্চ ঢাকা আসেন। এর আগে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, বাঙালিরা অতিথিপরায়ণ।
ইয়াহিয়া খান আমাদের অতিথি। তাকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানানো হবে। এভাবে
তিনি স্পষ্ট করে দেন, ইয়াহিয়া খান পদার্পণ করছেন একটি 'স্বাধীন দেশে'।
ইয়াহিয়া খান ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কীভাবে রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে আসবেন,
সেটা নিয়ে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কারণ
ফার্মগেটে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেনাবাহিনীর চলাচল বন্ধ রাখার জন্য চেকপোস্ট
ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকার
এসপি তাদের জানান, 'প্রেসিডেন্টের গাড়িবহর যেন বাঙালি স্বেচ্ছাসেবকদের
চেকপোস্টে আটকে রাখা না হয়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন।' ১৫ মার্চ
থেকে পরের কয়েকটি দিন ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের যে আলোচনা হয়েছে তাতে কিন্তু
বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশের সরকারপ্রধান হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরতে
পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি জাতির ভাগ্য কীভাবে প্রভাবিত
করেছিল, সেটা আমাদের জানা। এখন এটা মানবজাতির সম্পদ। এবারের ৭ মার্চ দিনটি
নতুন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। এদিন দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সব
শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একই সময়ে এ ভাষণের তাৎপর্য নিয়ে
আলোচনার ব্যবস্থা কি করা যায় না- যেখানে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী,
ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী-সংস্কৃতিসেবীসহ সমাজের সব অংশের প্রতিনিধিরা অংশ
নেবেন?
সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments