বিপিন রাওয়াতের বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য by আবু সাঈদ খান

ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বক্তব্য বিস্ময়কর। ইতিমধ্যে যা বাংলাদেশ ও ভারতে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। "জেনারেল রাওয়াত বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮) দিল্লিতে এক সেমিনারে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, 'ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবেই পাকিস্তান উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশে মদদ দিচ্ছে। আর সে কাজে তাদের সাহায্য করছে চীন।' বাংলাদেশ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের পাঠানোর ফলে আসামে বছর কয়েক আগেও মাত্র পাঁচটি জেলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, এখন সে রাজ্যে আট থেকে নয়টি জেলা সে অবস্থায় চলে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।" (বিবিসি, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। জেনারেল রাওয়াতের কথায় মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও জনগণ যেন পাকিস্তানের হুকুম-আহকামে চলছে! তিনি অবহিত না থাকলেও তার পূর্বসূরি মার্শাল শ্যাম মানেক শ, লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব, লে. জেনারেল জগৎ সিং অরোরা, মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানসহ একাত্তরে যারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, রণাঙ্গনে আমাদের হয়ে লড়েছিলেন; তারা বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতার সঙ্গে অবহিত ছিলেন। এখনও মিত্র যোদ্ধাদের অনেকেই বেঁচে আছেন, তাদের কাছে জেনারেল রাওয়াত পাকিস্তান সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতার কথা জানতে পারবেন। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করছে, সোশাল মিডিয়ায় একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দাবি তুলছে। এটি সবারই বোঝা দরকার, আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি, পাকিস্তানের নির্দেশ তামিলের জন্য নয়। তাই পাকিস্তানের মদদে বাংলাদেশি মুসলমানরা আসামে অনুপ্রবেশ করেছে- এর চেয়ে হাস্যাস্পদ আর কী হতে পারে! প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ আসামে কেন যাবে? বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমান এখন আসামের চেয়ে অনেক ভালো। বাংলাদেশ জীবনমানের কোনো কোনো সূচকে ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে আছে; সে প্রশংসা অমর্ত্য সেনসহ অনেকে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ-সমাজবিদরা করছেন। এ প্রসঙ্গে সিটমহল বিনিময়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি সিটমহলে ৪৫ হাজার ৪৭১ জনের বসবাস ছিল। যাদের ভারতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ ছিল; তা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে মাত্র ৯৮০ জন ভারতে গেছে। আর অবশিষ্টরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এখানে থেকে যায়। যাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে। এটি সত্য, ব্রিটিশ ভারতে বাঙালিসহ ভারতের নানা রাজ্যের লোক আসামে বসতি গড়েছিলেন, আসামের ভূমিকে আবাদযোগ্য করে তুলেছিলেন। সেটি নিশ্চয়ই অনুপ্রবেশ ছিল না।
তখন আসাম ও পূর্ববঙ্গের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়াও ছিল না। তাছাড়া ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বরাক অববাহিকায় অবস্থিত আসামের করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দি ছিল সিলেটের অন্তর্গত। আর উনিশ শতকেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় আসামের চার জেলা ধুবরি, গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড় ও বঙ্গাইগাঁও ছিল রংপুরের অংশ। ১৮২২ সালে এটিকে রংপুর থেকে পৃথক করে নর্থ ইস্ট রংপুর জেলা করা হয়, যা এখন আসামের চার জেলা। তাছাড়া মেঘালয়ের গারো হিল জেলাটি ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত গোয়ালপাড়ার অংশ। এসব তথ্য গোয়ালপাড়া জেলা আদালতের ওয়েবসাইটে জাজ্বল্যমান। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দুই দেশের যাতায়াতে কোনো ছেদ পড়েনি। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত চাঁদপুর-গুয়াটি জাহাজ চলাচল করত। এমন সঙ্গত কারণেই অনেক পরিবার আছে- যাদের একাংশ বাংলাদেশে, অপরাংশ আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ বা সীমান্তবর্তী অন্যান্য রাজ্যে। এ জেলাগুলোতে বাঙালিরা বহিরাগত নয়, তারাই আদিবাসী। আমার বিশ্বাস, এ সত্য জেনারেল রাওয়াতের না জানার কথা নয়। না জানার কথা নয় বিজেপি সরকারের- যারা নাগরিকত্ব নিবন্ধনে তাদের 'বাংলাদেশি' বলে চিহ্নিত করতে চাইছে। বাংলাদেশি বিতাড়নের স্লোগানের হোতা হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। অতি আশাবাদী কেউ কেউ বলেন, এটি ফাঁকা আওয়াজ, নির্বাচনী কৌশল। তাদের যুক্তি, ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি এক কোটি বাংলাদেশি হটানোর ধুয়া তুলেছিল। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবারও নির্বাচনের সামনে এসব বলা হচ্ছে। কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। এ ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়া হলেও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আসামসহ ভারতের নানা রাজ্যের সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। বিজেপির শাসনামলে গোরক্ষার নামে মানুষ হত্যা, 'লাভ জেহাদ' প্রতিরোধ, 'ঘর ওয়াপাসি'সহ নানা হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রমে মুসলমান ও দলিতরা ভীতসন্ত্রস্ত। তার ওপর দেশত্যাগের হুমকি সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে. তাদেরকে দিশেহারা করেছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের বিষয়। আমরা জানি না, ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত কী করবে? তবে এতদিন যা কিছু হচ্ছিল তা রাজনীতির খেলা বলে মনে করা যেত। কিন্তু যখন সেনাপ্রধান একই সুরে কথা বলেছেন, তখন এটিকে নেহাত রাজনীতির কৌশল বলে মানা যায় না। আমাদের বিশ্বাস ছিল, রাজনীতিতে যাই হোক, ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র অর্থাৎ প্রশাসন-সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ। বিপিন রাওয়াতের এ বক্তব্য তাতে চিড় ধরাল। যদিও বলা হচ্ছে, এটি সরকারের বক্তব্য নয়। তবে সেনাপ্রধান সরকারের বাইরে, তা কী করে বিশ্বাস করি? আর সে দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিজয় কুমার সিংহ সেনাপ্রধানের বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন, 'সেনাপ্রধান যা বলতে চান, তা বলতে পারেন। আমাদের দোষ হলো, সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি খুঁজি।' জেনারেল রাওয়াতের এ বক্তব্যের পর বিজেপির পালে বাতাস লেগেছে। দলটির অনেক নেতাই তাকে বাহবা দিচ্ছেন। জানি না, জেনারেল রাওয়াতের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রতি কোনো উষ্ফ্মার প্রকাশ কিনা! ভারতের পত্রপত্রিকায় এসেছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা, বিশেষ করে চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয়ে ভারত অসন্তোষ্ট। যদিও বাংলাদেশকে তার সমুদ্র সীমানার নিরাপত্তার প্রয়োজনে এটি কিনতে হয়েছে। এটি সবারই বোধগম্য, নৌশক্তি বাড়াতে বাংলাদেশকে চীন, রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যাওয়ার বিকল্পও নেই। ভারতকে তার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে পরাশক্তির সাহায্য নিতে হয়েছিল, এখন নিতে হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সমস্যা আছে। তাই বলে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানামুখী সহযোগিতা কার্যক্রম থেমে নেই। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ চীনের সহায়তায় কক্সবাজারের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের উদ্যোগ নিতে পারেনি। চীন বাংলাদেশের সাড়া না পেয়ে সেটি মিয়ানমারের রাখাইনে করছে। সেটি নির্মিত হলে বাংলাদেশকে সঙ্গত প্রয়োজনেই রাখাইনের কাওয়াকফু সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহার করতে হবে। হয়তো ভারতকেও ওই সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহার করতে হবে। আমাদের কষ্ট, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর হলে বাংলাদেশ মহাজন থাকত, আর তাওয়াকফু সমুদ্রবন্দরে হতে হবে ফড়িয়া। বলা বাহুল্য, সোনাদিয়ায় চীনের বিনিয়োগ থাকলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশটি বাংলাদেশের পাশে সক্রিয় থাকত। এখন চীন নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষে থাকছে; ভারতও বাংলাদেশের হয়ে কিছু করছে না। এটি সবাইকে মানতে হবে, একটি বন্ধুরাষ্ট্রের পক্ষে আরেকটি বন্ধুরাষ্ট্রের একশ' ভাগ মন জুগিয়ে চলা সম্ভব নয়। আর এমন মতপার্থক্য মানে বন্ধুত্বের অবসান নয়। মুত্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত। এ সরকারের আমলে তা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। শেখ হাসিনার সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতের কাছে তুলে দিয়েছে। নিশ্চিত করছে, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কখনও বাংলাদেশে আশ্রয় পাবে না। ভারতকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সহজশর্তে ট্রানজিট দিয়েছে। ভারতও বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা করছে। দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হলে উভয়কে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে, কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি নয়। আশার কথা, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বড় শক্তি দুই দেশের নাগরিক সমাজ। বাংলাদেশকে তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর পানির হিস্যা প্রদানে ভারতের নাগরিক সমাজ বরাবরই সোচ্চার। আসাম থেকে 'বাংলাদেশি' হটানোর বিরুদ্ধে ভারতের সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছে। প্রতিবাদ জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি কড়া ভাষায় বলেছেন, তারা এ অন্যায় কিছুতেই মেনে নেবেন না। আসাম থেকে বাংলাভাষীদের তাড়িয়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় দেবেন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির এ অবস্থান আমাদের আশ্বস্ত করে। আশাবাদী হই যে, ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন নীতি কাজ করবে না।
ask_bangla71@yahoo.com
সাংবাদিক ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.