উন্নয়নের অনুষঙ্গ হোক দেশাত্মবোধক গান by সালাহ্ উদ্দিন নাগরী
মানুষের
মনে অনুরণিত সুর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠাই সংগীত বা গান। গান মনের
কথা বলে, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলে, জীবনযুদ্ধে হতাশাগ্রস্ত মানুষকে
নতুন করে হালখাতা খোলার প্রেরণা দেয়। সেজন্য সব কালে পৃথিবীর সব দেশ
জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে গান জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
উইকিপিডিয়ামতে প্রাগৈতিহাসিক কাল অর্থাৎ প্রায় অর্ধ লাখ বছর আগে আফ্রিকায়
সংগীতের উদ্ভব। প্রাগৈতিহাসিক সংগীতের হাত ধরে প্রাচীন কাল, বাইবেলের যুগ
(Biblical period), মধ্যযুগ অতিক্রম করে সংগীত আজকের পর্যায়ে এসেছে।
গণমানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে সুখ-দুঃখ,
হাসি-আনন্দ, ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম এই সংগীত। আমাদের এ জনপদেও সংগীতের
ইতিহাস অনেক দীর্ঘ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত। জনশ্রুতি আছে, মোগল আমলে সম্রাট আকবরের
দরবারের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। আমাদের
বাংলা গান যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি,
রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, বিভিন্ন উপজাতির গান ও দেশাত্মবোধক গানের সমহারে
বাংলা গান ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বিভিন্ন যুগসন্ধিক্ষণে, সংকটকালে
দেশাত্মবোধক গান আমাদের সাহস, শক্তি জুগিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী সব আন্দোলন,
’৪৭-এর দেশভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর
মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি অর্জনে দেশাত্মবোধক গান অভূতপূর্র্ব অবদান রেখেছে।
রবিঠাকুরের ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’, দ্বিজেন্দ্রলাল
রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’, অতুল প্রসাদের ‘মোদের গোরব মোদের আশা, আ-মরি
বাংলা ভাষা’ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস
হয়েছে। রজনীকান্তের ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়’ স্বদেশী আন্দোলনে, ব্রিটিশ পণ্য
বর্জনে জনমত গঠনে, নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’,
‘দুর্গম গিরি কান্তর মরু’,
‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’ গানগুলো ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে ও
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। দেশাত্মবোধক গানের
পরতে পরতে দেশপ্রেম থাকায় ওইসব গানের ভাণ্ডার থেকে বেছে নেয়া হয় জাতীয়
সংগীত। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবিঠাকুরের লেখা
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত। ১৯১১ সালে ব্রিটিশরাজ পঞ্চম
জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষে ‘জন গণ মন’ গানটি ১৯৫০ সালে ভারতের কনস্টিটুয়েন্ট
অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। একটি পরাধীন জাতির
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার
ক্ষেত্রে এ গানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পরাধীন জাতি-গোষ্ঠীর
তখন একমাত্র প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির লক্ষ্যেই তাদের
সব চিন্তা-মেধামনন নিবেদিত ছিল। সময়ের দাবি বিবেচনায় দেশাত্মবোধক গানের
বিষয়বস্তু যেমনটি হওয়া উচিত ছিল, ঠিক তেমনটিই হয়েছিল। তখনকার সামাজিক,
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণমানুষের মনের কথা, আকাক্সক্ষার কথা, চাহিদার কথা
যথাযথভাবেই ফুটে উঠেছিল ওইসব গানে। যে গান দেশের কথা বলে, দেশের মানুষের
কথা বলে, দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলে, অশুভ শক্তিকে পরাভূত করার
কথা বলে সেটাই দেশাত্মবোধক গান। অশুভ শক্তিকে অতিক্রমের জন্য যুদ্ধযাত্রার
জন্য, যুদ্ধজয়ের জন্য গান মানুষকে বাড়তি শক্তি দেয়। এখানেই দেশাত্মবোধক
গানের সার্থকতা। অস্ত্র হাতে যুদ্ধের সময় আমরা অতিক্রম করেছি। যুদ্ধের
ময়দানে জয়যুক্ত হয়ে লাল-সবুজের পতাকা অর্জন করেছি। তাহলে কি আমাদের যুদ্ধ
শেষ হয়ে গেছে? একাত্তরের যুদ্ধজয় আমাদের সামনে অজস্র যুদ্ধক্ষেত্র উন্মুক্ত
করে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে দেশাত্মবোধক গানগুলো শুনে আমাদের দেশকে সব দেশের
সেরা হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি। এ ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করতে হবে।
২. ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো তাদের এমন যুদ্ধ ময়দানের সিংহভাগ অংশ বহু আগেই দখল করে নিয়েছে। পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো সে ময়দানে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরাও যুদ্ধ ময়দানে অবতীর্ণ সব পক্ষকে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি- তোমাদের মনোপলির আমরাও অংশীজন। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব হ্রাস, স্বকর্মসংস্থানে উৎসাহ দান, শতভাগ শিক্ষিত জনসমষ্টি তৈরি ও কর্মমুখী শিক্ষার বিস্তার, তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাত্মক প্রয়োগ, শিল্প উন্নয়ন, রফতানিমুখী বাণিজ্য ব্যবস্থা, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রস্তুতি ও ভূমিকম্প প্রতিরোধ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে জয়যুক্ত হতে হবে। এসব কর্মকাণ্ডে ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়’ নীতি অনুসরণ করে প্রত্যেককে যুদ্ধের ময়দানে জয়লাভের জন্য প্রস্তুত করতে হবে, সজ্জিত করতে হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ-ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন (এমডিজি) লক্ষ্য অর্জনে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। গত দু’দশকে উপরে আলোচিত খাতগুলোয় যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনেও সফলকাম হতে হবে। ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪১ সালে আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই এ ব্যাপারে সবার পরিপূর্ণ ধারণা ও তথ্য নেই। তথ্য জানা না থাকলে নিজেকে প্রস্তুত করা যায় না এবং কাক্সিক্ষত সাফল্যও অর্জন করা যায় না। দেশকে উন্নতির একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে, কিভাবে সে ঘাটতি পূরণ করা যায় এ তথ্যগুলো জনগণকে জানাতে হবে। এমডিজিতে আমরা যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছি এবং যেসব খাতে যথাযথ সাফল্য আসেনি সে তথ্য জনগণকে জানাতে হবে, যেন নিজেকে আরও সংগঠিত করতে পারে। ভূমিকম্প সামাল দেয়ার জন্য আমাদের করণীয় ও প্রস্তুতির বিষয়াদি জানতে হবে। এসডিজির অভীষ্ট অর্জনে আমরা প্রতিবছর কতটুকু অগ্রসর হচ্ছি এবং আরও দক্ষতার সঙ্গে কিভাবে সময়মতো অভীষ্ট অর্জিত হবে এ বিষয়গুলোর তথ্য জনগণকে দিতে হবে। জাতীয় জীবনে আমাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে। আমাদের গড় আয়ু ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও জন্ম বিরতিকরণ কার্যক্রমে আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছি, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি। ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। আনন্দের এ খবরগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন ও নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দর্শনীয় স্থানগুলোর পরিচিতি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা যায়। গার্মেন্ট, চা, চামড়াসহ বিভিন্ন দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। এ দেশের জনবল বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে পুষ্ট করছে। এসব কিছু আমাদের দেশেরই গর্ব। এ বিষয়গুলোতে আরও ভালো করার জন্য সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটাও সবাইকে জানাতে হবে। তথ্য শুধু গবেষক, চিন্তক, নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। ছোট কর্মচারী, পান দোকানদার, কুলি-মজুর সবার জন্যই উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যারা ওয়েব সার্চ করতে জানে না, বই বা খবরের কাগজ পড়ে না, তাদেরও তথ্য জানাতে হবে। তাদের কাছ থেকেও কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান পাওয়া যেতে পারে। আমার মনে হয়, জনগণকে বর্ণিত বিষয়ে ধারণা ও তথ্য দেয়ার জন্য গানই হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। গানকে অবাধ তথ্যপ্রবাহের পাইপলাইন হিসেবে বেছে নেয়া যায়। চার লাইনের গদ্য আমরা সাধারণত মনে রাখতে পারি না। কিন্তু ১৫/২০ লাইনে পদ্য অনায়াসে আওড়াতে পারি। আর সেটাতে যদি সুরের মিশ্রণ ঘটানো যায়, তাহলে তা মনের অজান্তে গুনগুনিয়ে বাজতে থাকে। তাই গানের এই সুবিধাটুকু গ্রহণ করে দেশাত্মবোধক গানকে দেশ-উন্নয়নের অনুষঙ্গে পরিণত করা যায়। দেশগড়ার কঠিন মন্ত্র সহজভাবে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ও উপস্থাপন করার জন্য গানকেই বেছে নেয়া যায়। গান শোনার জন্য সাধারণত কোনো প্রস্তুতি লাগে না। শোয়া, বসা, দাঁড়ানো যে কোনো অবস্থায় গান শোনা যায়। তাই আমরা দেশ-উন্নয়নের কৌশল, কর্মপন্থা গানে গানে, ছন্দে ছন্দে ছড়িয়ে দিতে পারি। এতে আমাদের একমাত্রিক দেশাত্মবোধক গানে বহুমাত্রিকতা আসবে।
৩. আমাদের সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের কোনো বিশেষ দিনকে উদযাপনে সেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, অর্জন ও চলমান কার্যক্রমকে হাইলাইট করে থিম সং তৈরি হচ্ছে। দিনের অনুষ্ঠান শেষে সেসব গান তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলছে। এ গানগুলোর কথা, সুর, কম্পোজে আরও মনোযোগী হতে হবে, যেন এর আবেদন সে প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে গান যেন সত্যিকার অর্থে গান হয়ে উঠতে পারে, জনগণের মুখে মুখে যেন তা অনুরণিত হতে পারে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা গানের অনুষ্ঠান দেশাত্মবোধক গান দিয়ে শুরু হয় এবং সেক্ষেত্রে প্রায়ই পুরনো দিনের গান বেছে নেয়া হয়। আমাদের এখনকার দেশাত্মবোধক গানের কথা, সুর, তাল, লয় গায়কী ঢং এমন হওয়া দরকার যেন এ গানগুলো পুরনো দিনের দেশাত্মবোধক গানের চেয়েও বেশি আবেদন ও বৈচিত্র্য নিয়ে আসে এবং মনকে উদ্বেলিত করতে পারে। দেশের এখনকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, আমাদের অর্জন এবং ভবিষ্যতে আর যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং আমাদের যেভাবে প্রস্তুত হতে হবে, সে বিষয়গুলোতে দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার দিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গান তৈরি করতে হবে, যেন তা মানুষের মনে দাগ কাটে, দীর্ঘস্থায়ী হয়, মানুষকে দেশগড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পারে। দেশ-জাতির কোনো বড় অর্জনকে ভাষায় প্রকাশের জন্য দেশাত্মবোধক গানের কোনো বিকল্প নেই। সেজন্যই হয়তো ভারতের প্রথম মহাকাশচারী ‘উপর থেকে ভারতকে কেমন লাগল’- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কবি ইকবালের ভারত নন্দিত দেশাত্মবোধক গানের ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন- ‘সারে জাহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা’। যে গান উন্নয়নের কথা বলে, উন্নয়নের হালনাগাদ তথ্য দেয়, উন্নয়নের ঘাটতিগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তা পূরণ করার তাগিদ দেয়, দেশের প্রত্যেক মানুষকে উন্নয়নের লড়াকু সৈনিক হওয়ার প্রেরণা দেয়, দেশগড়ার জন্য মনের মধ্যে ঘুমন্ত মানুষটিকে জাগিয়ে তোলে- আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর থেকে ভালো দেশাত্মবোধক গান আর কী হতে পারে!
সালাহ্ উদ্দিন নাগরী : সরকারি কর্মকর্তা
snagari2012@gmail.com
২. ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো তাদের এমন যুদ্ধ ময়দানের সিংহভাগ অংশ বহু আগেই দখল করে নিয়েছে। পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো সে ময়দানে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরাও যুদ্ধ ময়দানে অবতীর্ণ সব পক্ষকে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি- তোমাদের মনোপলির আমরাও অংশীজন। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব হ্রাস, স্বকর্মসংস্থানে উৎসাহ দান, শতভাগ শিক্ষিত জনসমষ্টি তৈরি ও কর্মমুখী শিক্ষার বিস্তার, তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাত্মক প্রয়োগ, শিল্প উন্নয়ন, রফতানিমুখী বাণিজ্য ব্যবস্থা, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রস্তুতি ও ভূমিকম্প প্রতিরোধ ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে জয়যুক্ত হতে হবে। এসব কর্মকাণ্ডে ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়’ নীতি অনুসরণ করে প্রত্যেককে যুদ্ধের ময়দানে জয়লাভের জন্য প্রস্তুত করতে হবে, সজ্জিত করতে হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ-ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন (এমডিজি) লক্ষ্য অর্জনে প্রশংসনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। গত দু’দশকে উপরে আলোচিত খাতগুলোয় যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনেও সফলকাম হতে হবে। ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪১ সালে আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই এ ব্যাপারে সবার পরিপূর্ণ ধারণা ও তথ্য নেই। তথ্য জানা না থাকলে নিজেকে প্রস্তুত করা যায় না এবং কাক্সিক্ষত সাফল্যও অর্জন করা যায় না। দেশকে উন্নতির একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে, কিভাবে সে ঘাটতি পূরণ করা যায় এ তথ্যগুলো জনগণকে জানাতে হবে। এমডিজিতে আমরা যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছি এবং যেসব খাতে যথাযথ সাফল্য আসেনি সে তথ্য জনগণকে জানাতে হবে, যেন নিজেকে আরও সংগঠিত করতে পারে। ভূমিকম্প সামাল দেয়ার জন্য আমাদের করণীয় ও প্রস্তুতির বিষয়াদি জানতে হবে। এসডিজির অভীষ্ট অর্জনে আমরা প্রতিবছর কতটুকু অগ্রসর হচ্ছি এবং আরও দক্ষতার সঙ্গে কিভাবে সময়মতো অভীষ্ট অর্জিত হবে এ বিষয়গুলোর তথ্য জনগণকে দিতে হবে। জাতীয় জীবনে আমাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে। আমাদের গড় আয়ু ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও জন্ম বিরতিকরণ কার্যক্রমে আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছি, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি। ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। আনন্দের এ খবরগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন ও নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দর্শনীয় স্থানগুলোর পরিচিতি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা যায়। গার্মেন্ট, চা, চামড়াসহ বিভিন্ন দ্রব্য বিদেশে রফতানি করে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। এ দেশের জনবল বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে পুষ্ট করছে। এসব কিছু আমাদের দেশেরই গর্ব। এ বিষয়গুলোতে আরও ভালো করার জন্য সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটাও সবাইকে জানাতে হবে। তথ্য শুধু গবেষক, চিন্তক, নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। ছোট কর্মচারী, পান দোকানদার, কুলি-মজুর সবার জন্যই উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যারা ওয়েব সার্চ করতে জানে না, বই বা খবরের কাগজ পড়ে না, তাদেরও তথ্য জানাতে হবে। তাদের কাছ থেকেও কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান পাওয়া যেতে পারে। আমার মনে হয়, জনগণকে বর্ণিত বিষয়ে ধারণা ও তথ্য দেয়ার জন্য গানই হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। গানকে অবাধ তথ্যপ্রবাহের পাইপলাইন হিসেবে বেছে নেয়া যায়। চার লাইনের গদ্য আমরা সাধারণত মনে রাখতে পারি না। কিন্তু ১৫/২০ লাইনে পদ্য অনায়াসে আওড়াতে পারি। আর সেটাতে যদি সুরের মিশ্রণ ঘটানো যায়, তাহলে তা মনের অজান্তে গুনগুনিয়ে বাজতে থাকে। তাই গানের এই সুবিধাটুকু গ্রহণ করে দেশাত্মবোধক গানকে দেশ-উন্নয়নের অনুষঙ্গে পরিণত করা যায়। দেশগড়ার কঠিন মন্ত্র সহজভাবে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া ও উপস্থাপন করার জন্য গানকেই বেছে নেয়া যায়। গান শোনার জন্য সাধারণত কোনো প্রস্তুতি লাগে না। শোয়া, বসা, দাঁড়ানো যে কোনো অবস্থায় গান শোনা যায়। তাই আমরা দেশ-উন্নয়নের কৌশল, কর্মপন্থা গানে গানে, ছন্দে ছন্দে ছড়িয়ে দিতে পারি। এতে আমাদের একমাত্রিক দেশাত্মবোধক গানে বহুমাত্রিকতা আসবে।
৩. আমাদের সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের কোনো বিশেষ দিনকে উদযাপনে সেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, অর্জন ও চলমান কার্যক্রমকে হাইলাইট করে থিম সং তৈরি হচ্ছে। দিনের অনুষ্ঠান শেষে সেসব গান তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলছে। এ গানগুলোর কথা, সুর, কম্পোজে আরও মনোযোগী হতে হবে, যেন এর আবেদন সে প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে গান যেন সত্যিকার অর্থে গান হয়ে উঠতে পারে, জনগণের মুখে মুখে যেন তা অনুরণিত হতে পারে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা গানের অনুষ্ঠান দেশাত্মবোধক গান দিয়ে শুরু হয় এবং সেক্ষেত্রে প্রায়ই পুরনো দিনের গান বেছে নেয়া হয়। আমাদের এখনকার দেশাত্মবোধক গানের কথা, সুর, তাল, লয় গায়কী ঢং এমন হওয়া দরকার যেন এ গানগুলো পুরনো দিনের দেশাত্মবোধক গানের চেয়েও বেশি আবেদন ও বৈচিত্র্য নিয়ে আসে এবং মনকে উদ্বেলিত করতে পারে। দেশের এখনকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, আমাদের অর্জন এবং ভবিষ্যতে আর যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং আমাদের যেভাবে প্রস্তুত হতে হবে, সে বিষয়গুলোতে দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার দিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গান তৈরি করতে হবে, যেন তা মানুষের মনে দাগ কাটে, দীর্ঘস্থায়ী হয়, মানুষকে দেশগড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পারে। দেশ-জাতির কোনো বড় অর্জনকে ভাষায় প্রকাশের জন্য দেশাত্মবোধক গানের কোনো বিকল্প নেই। সেজন্যই হয়তো ভারতের প্রথম মহাকাশচারী ‘উপর থেকে ভারতকে কেমন লাগল’- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কবি ইকবালের ভারত নন্দিত দেশাত্মবোধক গানের ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন- ‘সারে জাহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা’। যে গান উন্নয়নের কথা বলে, উন্নয়নের হালনাগাদ তথ্য দেয়, উন্নয়নের ঘাটতিগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তা পূরণ করার তাগিদ দেয়, দেশের প্রত্যেক মানুষকে উন্নয়নের লড়াকু সৈনিক হওয়ার প্রেরণা দেয়, দেশগড়ার জন্য মনের মধ্যে ঘুমন্ত মানুষটিকে জাগিয়ে তোলে- আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এর থেকে ভালো দেশাত্মবোধক গান আর কী হতে পারে!
সালাহ্ উদ্দিন নাগরী : সরকারি কর্মকর্তা
snagari2012@gmail.com
No comments