ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ঐতিহাসিক মূল-এর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে by বদরুদ্দীন উমর
মানব
ইতিহাসে সমাজ শ্রেণি-বিভক্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই অল্পসংখ্যক শোষক
বিপুল অধিকাংশ শোষিতের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার উদ্দেশ্যে ধর্মের
ব্যবহার শুরু করে। ধর্মের এই ব্যবহারের আদি যুগে মাইথলজি (Mythology) উদ্ভব
হয়। সব শ্রেণি-বিভক্ত সমাজেই ধর্ম এবং মাইথলজির ব্যবহার দেখা যায়। এর সব
থেকে বড় উদাহরণ হলো গ্রিক ও ভারতীয় মাইথলজি। এ দুই মাইথলজির মধ্যে এক
আশ্চর্য মিল দেখা যায়। এই মিল বা সাদৃশ্য কীভাবে ঘটেছিল এই নিয়ে বিশেষ কোনো
ঐতিহাসিক গবেষণা দেখা যায় না। যদিও এই সাদৃশ্য খুবই লক্ষণীয় এবং
উল্লেখযোগ্য। তবে এ সাদৃশ্য সত্ত্বেও এই দুই মাইথলজির বিবর্তনের মধ্যে খুব
তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য লক্ষণীয়। সংক্ষেপে এ বিষয়ে বলা যায় যে, প্রাথমিক
পর্যায়ে গ্রিক দেব-দেবতাদের সত্যিকারের দেব-দেবতা হিসেবে ধরে নেওয়া
সত্ত্বেও পরে গ্রিকরা মাইথলজি ও ইতিহাসকে পৃথক করেছিল। তাদের সাহিত্যে
মাইথলজির ব্যবহার হলেও পাশাপাশি ইতিহাস চর্চা শুরু হওয়ার কারণে গ্রিসে
মাইথলজি থেকে ইতিহাসকে পৃথকভাবে দেখা ও একটি পৃথক শৃঙ্খলা হিসেবে বিকশিত
করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডটাসকে (Herodotus) বলা
চলে লিখিত ইতিহাসের জনক। তার বিখ্যাত বই Historis-এ প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে
কিছু গালগল্প মিশ্রিত থাকলেও তার মধ্যে ইতিহাসের উপাদান যথেষ্ট ছিল। তার
পরই থুকিডিডিস (Thukididis) লিখেছিলেন, Hitory of the peloponesion ঘটনা।
তাকেই বলা চলে এমন একজন ইতিহাসবিদ যার লেখার মধ্যে অনৈতিহাসিক-অবাস্তব কোনো
উপাদান ছিল না। পেলোপনোসিয়ার যুদ্ধ ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা এবং তার
পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থুকিডিডিস তার এই গ্রন্থে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সঙ্গে
লিপিবদ্ধ করেছিলেন। হেরোডটাস ইতিহাস রচনার সূত্রপাত করলেও এদিক দিয়ে
থুকিডিডিসকেই বলা চলে বিজ্ঞানসম্মত লিখিত ইতিহাসের পথপ্রদর্শক। তাদের সঙ্গে
যুক্ত হয়েছিলেন জেনোফন(Zenophon), যার বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ ছিলMarch of
the ten thousand.. গ্রিসে লিখিত ইতিহাস এভাবে শুরু হওয়াই ছিল মাইথলজি থেকে
ইতিহাসের পৃথককরণের মূল কারণ।
এর ফলে গ্রিকরা তাদের মাইথলজিকে মাইথলজি
হিসেবেই দেখেছিল। ইতিহাসের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলে গ্রিক দেব-দেবতাদের
পূজার কোনো ব্যাপার গ্রিক সমাজে আর থাকেনি। এদিক দিয়ে প্রাচীন ভারতীয়দের
অবস্থার খুব বড় রকম, এমনকি মৌলিক পার্থক্য। প্রাচীন ভারতে এবং ভারতে
মুসলমানদের আগমনের আগে ভারতে লিখিত ইতিহাস বলে কিছু ছিল না। কৌটিল্যের
'অর্থশাস্ত্র', বাৎসায়নের 'কামসূত্র', অশ্ব ঘোষের 'বুদ্ধচরিত', বানভট্টের
'হর্ষচরিত'-এর মতো বইয়ে ইতিহাসের কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলোকে ইতিহাস বলা
চলে না। ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও কমিউনিস্ট নেতা হীরেন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায় তার 'ভারতবর্ষের ইতিহাস'-এর ভূমিকাতে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে
বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতে লিখিত ইতিহাস বলে কিছু ছিল না। আরবদের দ্বারাই
ভারতে লিখিত ইতিহাসের শুরু। সেই থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষায় মুসলমানরা
মধ্যযুগের প্রথম থেকে মোগল শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত লিখেছিলেন অসংখ্য
ইতিহাসের বই, যার তালিকা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হলো,
প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত হিন্দুরা কোনো লিখিত ইতিহাস চর্চা
না করার কারণে হিন্দু মাইথলজি ও ইতিহাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনি।
কাজেই মাইথলজিই পরিণত হয়েছে ইতিহাসে। এর ফলে রামায়ণ মহাভারতকে ভারতীয়
হিন্দুরা বাস্তবত অনৈতিহাসিক ব্যাপার এবং মাইথলজি হিসেবে না দেখে ইতিহাস
হিসেবে দেখায় রাজনীতি ক্ষেত্রে অনেক বিড়ম্বনা ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি
হয়েছে। হিন্দুরা যদি রামায়ণকে ইতিহাসগ্রন্থ বলে মনে না করত, তাহলে
অযোধ্যার বাবরি মসজিদকে রাম জন্মভূমি বলে মনে করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা
তুঙ্গে তুলে এই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে ধ্বংসের প্রশ্ন দেখা দিত না।
মাইথলজি কীভাবে হিন্দু সমাজকে প্রভাবিত করেছে তার এক অতি সাম্প্রতিক উদ্ভট
দৃষ্টান্ত হলো নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর
ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে এ কথা বলেন যে, প্রাচীন ভারতে অতি
উন্নত এক আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা ও সার্জারি ছিল, যার প্রমাণ হলো দেবতা
গণেশ। তার মতে, হাতির মুণ্ডু সার্জারির দ্বারা বিচ্ছিন্ন করে মানুষের মাথায়
বসাতে প্রাচীন ভারতীয়রা সক্ষম ছিল! মাইথলজির সঙ্গে ইতিহাসকে অভিন্নভাবে
উপস্থিত করার এর থেকে হাস্যকর ও বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? নরেদ্র
মোদি কর্তৃক এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার মতো পরিস্থিতি যদি ভারতের হিন্দু
সমাজের মধ্যে না থাকত, তা হলে তিনি অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে অথবা
সাম্প্রদায়িক মতলববাজির কারণে এ রকম বক্তব্য কোনোভাবেই দিতে পারতেন না।
কিন্তু এ প্রসঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, ভারতে সুস্থ, সভ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত
চিন্তা করার মতো মানুষ এবং ইতিহাসবিদের অভাব হিন্দু সমাজের মধ্যে নেই।
কাজেই নরেন্দ্র মোদির এই উদ্ভট ও নির্বোধ বক্তব্যের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ
জানিয়ে অনেক স্বনামধন্য হিন্দু ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী এবং বুদ্ধিজীবী বিবৃতি
দিয়েছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মাইথলজি এবং ইতিহাস ভারতের হিন্দু সমাজের একটা
বড় অংশের মধ্যে একাকার হয়ে থাকা ভারতে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার যে জোয়ার
দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে যেমন শোষক-শাসকরা
ধর্মকে ব্যবহার করে, তেমনি সব ধরনের শোষক-শাসকরা ব্যবহার করে ইতিহাসকেও।
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ইংরেজরা ইতিহাস ও
ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ইতিহাস ও ধর্মকে কীভাবে
ব্যবহার করেছে, তার এক বড় উদাহরণ হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ
কর্মচারী, বিখ্যাত পণ্ডিত এবং ইতিহাসবিদ জেমস মিলের (Jams Mill) ভারতবর্ষের
ইতিহাস। এর বইয়ে তিনি ভারতের ইতিহাসকে তিনটি মূল পর্বে ভাগ করেছেন :
হিন্দু, মুসলিম এবং ব্রিটিশ। এই অপকর্ম যে তিনি তাদের সাম্রাজ্যবাদী
চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি কার্যকর করার উদ্দেশ্যেই করেছিলেন, এতে
সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা দরকার যে, প্রাচীন ভারতের অধিবাসীরা
'হিন্দু' নামে পরিচিত ছিলেন না। বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ, ব্রাহ্মণ, রামায়ণ,
মহাভারত কোথাও হিন্দু বলে কোনো শব্দ নেই। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করে
পাঞ্জাব দখলের পর গ্রিকরা সিন্ধু নদীকে বলত ইন্ডাস Indus)) এবং ইন্ডাসের
থেকেই তারা এই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলত ইন্দু (Indu)। পরে মুসলমানরা ভারতে
এসে ইন্দুকে বলত 'হিন্দু'। তার থেকে ভারতের অধিবাসীকে তারাই প্রথম 'হিন্দু'
নামে আখ্যায়িত করে এবং ভারতের নাম দেয় হিন্দুস্থান। এটা এক অকাট্য
ঐতিহাসিক সত্য। কাজেই জেমস মিল ভারতের প্রাচীন ইতিহাসকে হিন্দুদের ইতিহাস
বলে উপস্থিত করে ইতিহাসের এক চরম বিকৃতি সাধন করেছিলেন। এ ছাড়া অন্য
ব্যাপারও আছে। তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু ইতিহাস এবং পরবর্তীকালে
মধ্যযুগের মুসলমান শাসনামলকে মুসলিম ইতিহাস বললেও ব্রিটিশ আমলকে খ্রিষ্টান
হিসেবে আখ্যায়িত না করে আখ্যায়িত করেছিলেন অধর্মীয় নামে! এর মধ্যে
সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদনীতির মাধ্যমে
ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি রচনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
জেমস মিল কর্তৃক এভাবে ইতিহাস বিকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয়
ইতিহাসবিদরা ভারতবর্ষের ইতিহাস এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রচনা করেছিলেন। এর ফলে
এখন নরেন্দ্র মোদির মতো বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ভারতকে শুধু নিজেদের
দেশ বলে প্রচার করে মুসলমানদের ভারত থেকে বহিস্কারের কথা পর্যন্ত বলে
থাকেন। তারা 'বিদেশি' আক্রমণকারী হিসেবে মুসলমানদের আখ্যায়িত করে তাদের
সমগ্র কীর্তি ভারত থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত। এমনকি এখন তারা
তাজমহলকেও শত্রুদের কীর্তি বলে প্রচার করে এখন তা ধ্বংস করার আওয়াজ পর্যন্ত
তুলতে অসুবিধাবোধ করছে না। সরকারি ক্ষমতায় থাকায় নরেন্দ্র মোদি এ কাজ নিজে
সরাসরি না করলেও তাদের 'সঙ্ঘ পরিবারের' শরিকদের দিয়ে এই বর্বর কর্মকাণ্ডে
উৎসাহের জোগান দিচ্ছেন এবং এই বর্বরতাকে প্রতিহত করার কোনো চেষ্টাই করছেন
না। এ প্রসঙ্গে আরও বলা দরকার, যে আর্যদের প্রাচীন ভারতের অধিবাসী বলে তারা
অনার্য নিম্নশ্রেণির মানুষদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই আর্যরাও
ভারতের আদি অধিবাসী ছিল না। তারাও ছিল বিদেশি অনুপ্রবেশকারী ও দখলদার।
ভারতে সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে আজ মাথাচাড়া দিয়েছে তার ঐতিহাসিক মূল সম্পর্কে
সঠিক ধারণার অভাবে অনেক সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ হিন্দুও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে
সাম্প্রদায়িকতার শিকারে পরিণত হচ্ছেন। কাজেই ভারতে সাম্প্রদায়িকতার
বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে এসব দিকে গভীর মনোযোগ না দিয়ে ও
বিচার-বিশ্নেষণ না করে শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বললে ও তার
প্রতিবাদ করলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম যে সঠিকভাবে
পরিচালিত হবে এর কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতির বিকাশের
সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস বিষয়ে সচেতনতার শুরুতে এদিক থেকে খাটো করে দেখার কোনো
সুযোগ নেই।
No comments