সিরিয়ার শিশুদের রক্ত কত খাবে যুদ্ধ–জুয়াড়িরা? by ফারুক ওয়াসিফ
ভাইটিকে কোলে নিয়ে আকাশপানে খোদার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ মরে গেছে বোনটি |
‘আমি
খোদার কাছে সব বলে দেব’ বলে অসম্ভব অভিমানে মরে গিয়েছিল এক সিরীয় শিশু।
আরেক সিরীয় শিশু ভাবছিল, মরে যাওয়াই ভালো। কেননা, বেহেশতে তো না খেয়ে মরতে
হবে না। এখন আবার আসছে গ্যাস হামলায় মৃত শিশুদের ছবি। কিশোরী বোন দুধের
বাচ্চা ভাইটিকে কোলে নিয়ে আকাশপানে খোদার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ মরে গেছে।
তখনো একমাত্র গ্যাস মাস্কটা ভাইয়ের মুখে ধরা; যাতে ভাইটি অন্তত বাঁচে।
বিজ্ঞান জানিয়েছে, মৃত্যুর পরও মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ কাজ করে। তার প্রমাণ এই
ছবিটা। কোমল বোনটি মারা যাবে জেনেও অক্সিজেনের নলটা নিজে না নিয়ে ছোট
ভাইটির মুখে লাগিয়ে রেখেছিল, মরে যাওয়ার পরও তার হাত সরেনি! মস্তিষ্কের
যেসব কোষ থেকে ভালোবাসার রস ঝরে বলে অন্যের জন্য ত্যাগী হতে পারে মানুষ,
সেসব কোষ তখনো ভাইটিকে বাঁচানোর নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটির হাতকে।
১৯৭১-এর কথা। পাকিস্তানি সেনাদের থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচুরিপানার
একটা বহর ধরে পালাতে যাচ্ছিল এক পরিবার। কিন্তু কচুরির দঙ্গলটা ছোট থাকায়
ডুবে যাচ্ছিল সবাই। তখন কচুরিভেলার ওপর চাপ কমাতে কিশোরী বোনটা হাত ছেড়ে
দেয়। টাইটানিকের নায়কের মতো নীরবে ডুবে যায় সে। বেঁচে যায় তার পরিবার।
আরাকান থেকে ইয়েমেন, ফিলিস্তিন থেকে সিরিয়ায় শিশুহত্যার উৎসব। যত রকমভাবে
মানুষের শিশুহত্যা সম্ভব, এরা তার সবকিছুরই শিকার। সিরীয় শিশুরা যখন
শরণার্থী নৌকায় পানিতে ডুবে মরছিল, তখন ইয়েমেনের শিশুরা মরছিল সৌদি-মার্কিন
কোয়ালিশনের বোমায়। সিরীয় শিশুরা যখন আইএস-বিদ্রোহী-পশ্চিমা জোট আর সিরীয়
সরকারি বাহিনীর ক্রসফায়ারে মরছিল, তখন ইয়েমেনের শিশুরা তিলে তিলে মরছিল
দুর্ভিক্ষে। ক্লাস্টার বোমা, রাসায়নিক বোমা, বিমানের বোমা, কামানের বোমা,
ড্রোনের বোমাসহ যত রকম বোমা আবিষ্কার করেছে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, তার সবই
প্রয়োগ হয়েছে দেশ দুটিতে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ঘৃণা করেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ঘৃণা
করেন কুর্দি নেতাদের, আসাদ ঘৃণা করেন তাঁর প্রতিপক্ষকে। তাই তাঁরা যুদ্ধ
করেন। আর মারা যায় শিশুরা, মারা যায় শিশুদের বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধুরা।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ন্যায়যুদ্ধেরও প্রধান শিকার শিশুরা। যুদ্ধে যারাই মারা
যায়, তারা কোনো না কোনো শিশুর বাবা-মা-ভাই-বোন এবং মরে তারা নিজেরাও। যুদ্ধ
সেই প্রাচীন জুয়াড়ি, সে থামতে পারে না। যতই হারে ততই আরও বড় বাজি সে ধরে।
যতই তার জেতার ইচ্ছা, ততই সে হারে। যতক্ষণ না সব হারায়, ততক্ষণ খেলারাম
খেলে যায়। আমেরিকার চেয়ে বড় যুদ্ধের জুয়াড়ি আর কে? টুইন টাওয়ার ধ্বংস থেকে
এর শুরু।
কে করেছে তার অকাট্য প্রমাণ নেই, কিন্তু ধ্বংস হলো আফগানিস্তান
এবং এর শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যৎ। সাদ্দামের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকুক বা
না থাকুক, ইরাক শেষ! গণতন্ত্র আসেনি, ইরাক পেয়েছে মাইলের পর মাইল ছড়ানো
বধ্যভূমির গণতন্ত্র, যেখানে সাম্যবাদী কায়দায় সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির মানুষের
লাশ একসঙ্গে শুয়ে থেকে থেকে পচে গেছে মাটিতে। এরপর আরব বসন্তের ছলাকলায়
মধ্যপ্রাচ্য তছনছ হলো। ইরাককে ধ্বংস করল মার্কিন আর ব্রিটেন। লিবিয়ায় বিমান
হামলা করল ফ্রান্স আর ব্রিটেন, তাদের দোসর সন্ত্রাসীরা হত্যা করল
গাদ্দাফিকে। গাদ্দাফি, সাদ্দাম ছিলেন সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের নেতা।
তাঁরা ইঙ্গ-মার্কিন-জায়নবাদী গ্রাস থেকে যাঁর যাঁর দেশকে অনেক দিন বাঁচিয়ে
গেছেন। পরিণামে তাঁরাও স্বৈরাচারী হয়ে গিয়েছিলেন। এর বিচার তার দেশের জনগণ
করবে, কিন্তু সেই সুযোগ তাদের দেয়া হলো না। ইতিহাসের সিজারিয়ান করলে
গর্ভপাতই হয়। যুদ্ধ করে শান্তি যে আনা যায় না, পশ্চিমারা তা কবে বুঝতে
পারবে? সিরিয়ায় গণহত্যা চলছেই। প্রথমে নামল ‘মডারেট রেবেল’ নামের
বিদ্রোহীরা। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে সিআইএ খরচ করেছিল ৫০০ মিলিয়ন ডলার। তারপর
সৌদি-ইসরায়েলি মদদে নামল আইএস নামের জল্লাদেরা। রাশিয়া আর বাশার সরকার যখন
তাদের উচ্ছেদ করল, তখন হাতে রইল কেবল কুর্দি বিদ্রোহীরা। কিন্তু সিরীয়
কুর্দিরা ইরাকি কুর্দিদের মতো নয়। তারা স্বায়ত্তশাসনই চেয়েছে, স্বাধীনতা
নয়। তাই এ মাসের গোড়ায় সিরীয় সরকারি বাহিনী কুর্দি শহর আফরিনে এসে হাজির
হলে গুলির বদলে তাদের স্বাগত জানাল ফুলের ডালি। কারণ, আরও বড় ভয় তুরস্কের
নতুন সুলতান এরদোয়ান। স্বপ্নে তিনি নিজেকে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের নয়া সুলতান
ভাবা শুরু করেছেন। আমেরিকার মদদে আর সিরিয়ার দুর্বলতার সুযোগে কুর্দিরা
যদি সিরিয়ার কিছু এলাকায় স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করে ফেলে? তুরস্কের ভয়
সেখানেই। এটা ঘটলে তুরস্কের কুর্দিদের দমানো কঠিন হবে।
ইরাক-ইরান-তুরস্ক-সিরিয়ার কুর্দিদের নিয়ে পশ্চিমাদের তথাকথিত স্বাধীনতার
খেলা যদি শুরু না হতো, তাহলে কুর্দিদের দুর্ভাগ্য হয়তো আরও কমত। আর তা হলে
এরদোয়ানেরও কুর্দি দমনের নামে সিরিয়ার ভেতর বাহিনী পাঠানোর সুযোগ আসত না।
এর মধ্যে দিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদেরই জয় হলো। তিনি প্রমাণ
করতে পারলেন, সিরিয়া অখণ্ড ও স্বাধীন দেশ। আর আফিরিনের কুর্দিরা টের পেল
দামেস্কের ছাতার নিচে সিরীয় নাগরিক হিসেবেই তারা নিরাপদ। কিন্তু মানজিব শহর
এখন ত্রিমুখী বিপদের সামনে। এক দিকে তুর্কি বাহিনী, আরেক দিকে সিরীয় সেনা।
শহরের মাঝখানে বসে আছে মার্কিন বাহিনী। স্পষ্টত, সিরিয়ায় শেষ লড়াই হবে
মার্কিন জোট ও রুশ সমর্থনপুষ্ট সিরীয় বাহিনীর মধ্যে। ওদিকে ইসরায়েলের কিংকং
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর গদি টলমল। তাঁর দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথে চলছে
বিক্ষোভ। এমন সময় একটা ‘সুন্দর সংক্ষিপ্ত’ যুদ্ধ তাঁকে জনপ্রিয়তা দিতে
পারে। একই চিন্তা ট্রাম্প, পুতিন, এরদোয়ান, সবারই। চার পাগলের এই মেলা হলে
সংক্ষিপ্ত যুদ্ধটা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। ইসরায়েলও তাতে নিরাপদ থাকবে
না। এ রকম উত্তেজনার মধ্যে পশ্চিমা গণমাধ্যমে এল গ্যাস হামলায় সিরীয়
শিশুদের মৃত্যুর দৃশ্য। খবরটা সরবরাহ করেছে পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট হোয়াইট
হেলমেট বা সিরীয় ডিফেন্স এজেন্সি। তাদের অভিযোগ, ঘৌথা শহরে সিরীয় বিমান
হামলারই ফল এসব রাসায়নিক মৃত্যু। কিন্তু পেন্টাগন এখন পর্যন্ত জাতিসংঘে
স্পষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি। এই হোয়াইট হেলমেট এর আগেও সিরীয় সরকারের
বিরুদ্ধে রাসায়নিক হামলার অভিযোগ তুলেছিল্ পরে প্রমাণ হয় সেটা ছিল
বিদ্রোহীদের নিজেদেরই কাজ। বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ঘৌথা শহর দখলে রেখেছে তিনটি
মৌলবাদী বাহিনী। তাদের প্রধানতম জইশ-ই-মোহাম্মদ নামের মার্কিন-ব্রিটিশ
সাহায্যপুষ্ট দল। ভিডিও প্রমাণ দেখায়, নর-নারীদের খাঁচায় পুরে মানবঢাল
হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। আছে হরকত নুর আদ্দিন জঙ্গি আন্দোলন। শিশুদের
জবাই করার ভিডিও ছড়ানোয় এরা প্রভূত আনন্দ পেত। আরো আছে হায়াত তাহরির আল শাম
নামের সিরিয় আল-কায়েদা। আছে সৌদি অর্থপুষ্ট হরকত আহরার আল শাম আল
ইসলামিয়া। সিরিয়া যখনই বিদ্রোহীদের কোনো ঘাঁটি উচ্ছেদ করে, তখনই আসে
রাসায়নিক হামলার অভিযোগ। এবারেও সরাসরি মার্কিন হামলার বৈধতা তৈরির জন্য
এমন নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি না, তা নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া বোঝা যাবে না।
কিন্তু বড় আকারের মার্কিন বিমান হামলা হয়তো আসতে যাচ্ছে। আমেরিকা যদি
সিরিয়াকে সিরিয়ার মতো থাকতে দেয়, তাহলে এই যুদ্ধ কালই থেমে যাবে। ইসরায়েল
যদি শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশীর আচরণ করে, সিরিয়ার গোলান হেইটসের দখল ছেড়ে দেয়,
ইরানের সঙ্গে শত্রুতা বন্ধ করে, তাহলে পরশুর যুদ্ধটা ঘটবে না। সিরিয়ায়
আমরা গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই, কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন চাই, কিন্তু তার
জন্য কোনো বিদেশি মাতবর আসার দরকার নেই। জনগণকে সুযোগ দিলে তারাই নিজেদের
ভাগ্য তৈরি করে নিতে পারে। কিন্তু আমেরিকা মনে হয় এমন এক জুয়াড়ি, শেষ
বাজিটি না হারলে জুয়ার বোর্ড ছেড়ে সে উঠবে না। পৃথিবীতে সভ্যতা বলে কিছু
নেই, এটা মেনে নিয়েই আমাদের সব যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের নিহত ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাংকের ডায়েরি আমাদের আজও কাঁদায়।
কিন্তু কত কত আনা ফ্রাংক ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনে মরে
যাচ্ছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আনা ফ্রাংকে যদি আমেরিকা শরণার্থী হিসেবে
ভিসা দিত, তাহলে ওই মেয়েটিসহ অনেকেই বেঁচে যেত। আমরা মনে রাখছি,
আমেরিকা-ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্য ভোগের বাসনাই অজস্র শিশুর অসহনীয় মৃত্যুর
আদি কারণ। সেদিকে না তাকিয়ে বিশ্বনেতারা দাভোসে পার্টি করছেন, বেড়াচ্ছেন,
হাসছেন। কিন্তু আমরা তো আর নিতে পারছি না! শিশুরা মর্ত্যের দুনিয়ায় আসা এক
টুকরা স্বর্গ, বিশুদ্ধ মানবতার মন, প্রাপ্তবয়স্কদের মানবিক রাখার
প্রেরণা—তাদের হত্যা মেনে নিলে মানবতার ধ্বংস অনিবার্য। সিরিয় শিশুদের এই
মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখেছেন জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হক। তার শেষটা এই:
‘ট্রাম্প চাচ্চু, আমাকে হত্যা করো, প্লিজ
পুটিন আংকেল, আমার ঠিক মাথার ওপরে বোমা ছুড়তে বলো ওদের
লক্ষ্য যেন ভ্রষ্ট না হয়
আমাকে কবরে শুইয়ে দাও
আমাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দাও
বেহেশতে আমার জন্য রুটি আছে
বেহেশতে আমার জন্য ঘুম আছে
বেহেশতে আমার জন্য নিরাপত্তা আছে
আব্বু আমাকে মেরে ফেলো
আম্মু আমাকে মেরে ফেলো
চাচ্চুরা আমাকে হত্যা করো...
করুণা করো করুণা করো করুণা করো
দোহাই করুণা করে আমাকে মারো
মেরে আমাকে বাঁচাও!’
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
‘ট্রাম্প চাচ্চু, আমাকে হত্যা করো, প্লিজ
পুটিন আংকেল, আমার ঠিক মাথার ওপরে বোমা ছুড়তে বলো ওদের
লক্ষ্য যেন ভ্রষ্ট না হয়
আমাকে কবরে শুইয়ে দাও
আমাকে বেহেশতে পাঠিয়ে দাও
বেহেশতে আমার জন্য রুটি আছে
বেহেশতে আমার জন্য ঘুম আছে
বেহেশতে আমার জন্য নিরাপত্তা আছে
আব্বু আমাকে মেরে ফেলো
আম্মু আমাকে মেরে ফেলো
চাচ্চুরা আমাকে হত্যা করো...
করুণা করো করুণা করো করুণা করো
দোহাই করুণা করে আমাকে মারো
মেরে আমাকে বাঁচাও!’
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
No comments