সিরিয়া : মানবতার মৃত্যু by আহমেদ বায়েজীদ
ফর্সা
মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাজা রক্ত। দুই পা ব্যান্ডেজে মোড়ানো, হাতে
ব্যান্ডেজ করছেন এক ডাক্তার ও তার সহকারী। নিষ্পাপ মুখে একই সাথে ভর করে
আছে যন্ত্রণা আর আতঙ্কের ছায়া। তিন দিন ধরে সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে
এক কিশোরের এমন একটি ছবি। দশ বছর বয়সী শিশুটির নাম ওমর। সিরিয়ার পূর্ব গৌতা
এলাকার বাসিন্দা এ শিশুটি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে সরকারি বাহিনীর বর্বর
বোমা হামলা থেকে। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওমরের সাথে একই বিছানায় শুয়ে
আছে তার সাত বছর বয়সী ছোট বোন মানার, পাশের আরেকটি বিছানায় তার বাবা। তাদের
দু’জনের শরীরেরও বিভিন্ন স্থানে রক্তমাখা ব্যান্ডেজ। ওমরের পরিবার সিরিয়ার
পূর্ব গৌতা এলাকার বাসিন্দা। দশ দিন ধরে এ এলাকাটিতে বিদ্রোহীদের বিতাড়িত
করার নামে ভয়াবহতম বোমা হামলা শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের
সরকারি বাহিনী ও তাদের সমর্থনে যুদ্ধে নামা রাশিয়া ও ইরানের বাহিনী।
রাশিয়ার যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হয়েছে ওমরদের বাড়ি।
ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে বাবাসহ ওমর আর তার বোনকে যখন অস্থায়ীভাবে
নির্মিত হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, তার মাসহ পরিবারের অন্যদের তখন নিয়ে যাওয়া
হয়েছে কবরস্থানে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কিংবা ধসে পরা বিল্ডিংয়ে চাপা পড়ে
তারা চিরমুক্তি পেয়েছে সব বর্বরতা আর যন্ত্রণা থেকে। ধূসর চুল, কালো আর
হলুদ রঙের সোয়েটার পরা একটি শিশু ঘুমিয়ে আছে কম্বল গায়ে। কেউ জানে না
শিশুটির পরিচয় কী, তার পরিবারের অন্যরা কেউ বেঁচে আছে কি না, থাকলে কোথায়
আছে? সুন্দর মুখমণ্ডলে লেগে আছে হালকা রক্তের ছাপ, চেহারায় শিশুসুলভ কোমলতা
নেই, আছে ভয় আর ক্লান্তি। ঘুম নয়, ছবিটি যখন তোলা হয় তখন সে ছিল অচেতন
অবস্থায়। সে যেখানে শুয়ে আছে সেটি একটি অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র। তাকে আনা
হয়েছে অন্য একটি হাসপাতাল থেকে। সিরিয়ার পূর্ব গৌতার ওই হাসপাতালটিতেও বোমা
হামলা হয়েছে গত সপ্তাহে। ভবনের অর্ধেকটা বিধ্বস্ত হয়েছে, ১০টি
অ্যাম্বুলেন্স পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রোগীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে আশপাশের
হাসপাতাল ও অস্থায়ীভাবে নির্মিত চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোয়। তাদেরই একজন এই
শিশুটির বয়স এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে। চিকিৎসকেরা বলছেন, শরীরে বড় ধরনের
কোনো জখম না থাকলেও মারাত্মক মানসিক আঘাত পেয়েছে শিশুটি, যা কাটিয়ে উঠতে
অনেক সময় লাগবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক হামজা
হাসান বলেছেন, এ শিশুটি ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে হয়তো। আমরা জানি না, তার
বাবা-মা কোথায় আছে, আদৌ তারা বেঁচে আছে কি না। এমন আরো অনেক শিশুকে নিয়ে
আসা হচ্ছে আমাদের কাছে যাদের অভিভাবকদের ব্যাপারে কিছু জানা যাচ্ছে না।
সিরিয়ার গৌতা এলাকার আরেক বাসিন্দা বায়ান রেহান। সরকারবিরোধী শান্তিপূর্ণ
আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মী। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায়
বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পর স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন অন্য
লোকদের বানানো ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে। বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে
বাঁচতে এখানে এসেছে তার মতো আরো অনেক পরিবার। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তার এক
লেখায় ফুটে উঠেছে সিরিয়ার গৌতা এলাকার ভয়াবহতা। ওই এলাকায় কী ঘটছে তা
বোঝার জন্য শুধু লেখার শিরোনামটিই যথেষ্ট। রেহানের লেখার শিরোনাম, ‘আমাদের
মারতে চাইলে দ্রুত মারো, মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে ক্লান্ত আমরা।’ ওপরের
চিত্রগুলো উদাহরণ মাত্র। সিরিয়ার পূর্ব গৌতা এলাকার প্রতিটি প্রতিটি
মহল্লা, প্রতিটি গলি আর বাড়ির চিত্র এখন এমনই। খুব কম বাড়িই এখনো মাথা উঁচু
করে দাঁড়িয়ে আছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের কেউ হাত-পা হারিয়েছে, কেউ সারা
গায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আর
যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মৃত্যু ও বোমার স্পিøন্টার থেকে তারা
ধ্বংসস্তূপে খুঁজছে স্বজনের লাশ, কেউ বা লাশ নিয়ে যাচ্ছে কবরস্থানে। ১০৪
বর্গকিলোমিটার আয়তনের পূর্ব গৌতা এলাকাটিতে প্রায় চার লাখ লোকের বাস।
বাসিন্দাদের অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ বছরের নিচে, অর্থাৎ শিশু-কিশোর। রাজধানী
দামেস্ক থেকে ১০ কিলেমিটারের মধ্যের এই এলাকাটি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ঘাঁটি
হিসেবে পরিচিত। ২০১৩ সাল থেকে এলাকাটি অবরোধ করে রেখেছে বাশার আল আসাদের
সরকারি বাহিনী। এবার এলাকাটির দখল নেয়ার জন্য সিরীয় সেনাবাহিনী একযোগে
হামলা শুরু করেছে। তাদের সরাসরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া ও ইরান। বিদ্রোহীদের
বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরপরাধ বেসামরিক
লোকদের। গত দশ দিনে নিহত হয়েছে পাঁচ শ’র বেশি লোক। এটি শুধু বিভিন্ন
সংস্থার হিসাব। ধারণা করা হচ্ছে, আরো অনেক মৃত্যুর হিসাব নথিবদ্ধ করা সম্ভব
হয়নি। ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর নিচে চাপা পড়ে আছে অনেক লাশ। কিংবা ভূগর্ভের
বাংকারে আশ্রয় নেয়া লোকেরা হয়তো বিষাক্ত গ্যাস হামলায় নীরবে সেখানেই
মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, কেউ তাদের খোঁজ পায়নি। কোনো দেশের সরকার নিজ
দেশের জনগণকে মারার জন্য ভিনদেশী বাহিনী ডেকে আনেÑ এমন নজির বিশ্বে সম্ভবত
এই প্রথম। রাশিয়া তাদের নতুন নতুন সব মারণাস্ত্রের কার্যকারিতা প্রয়োগের
জন্য বেছে নিয়েছে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রকে। তাদের সর্বাধুনিক স্টিলথ
প্রযুক্তির ফাইটার প্লেন সু-৫৭ ইতোমধ্যেই আনা হয়েছে সিরিয়ায়। এই বিমানটি
রাশিয়ার সর্বাধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তির একটি পণ্য, যা এই প্রথম সরাসরি
যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে তারা কয়েক ধরনের অত্যাধুনিক
ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে সিরিয়ার নিরীহ জনগণের ওপর। বিশ্লেষকেরা বলছেন,
শূন্য মরুভূমিতে যুদ্ধাস্ত্র পরীক্ষার পরিবর্তে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে তা
ব্যবহার করছে রাশিয়া। সিরিয়ার নিরীহ জনগণের মৃত্যুর হিসাবের চেয়েও তাদের
কাছে অস্ত্র পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার যুদ্ধে বাশার সরকারের আরেকটি
নির্মম কৌশল হচ্ছে অবরোধ। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো তারা বছরের পর বছর
অবরোধ করে রেখে সেখানে খাদ্য, পানি, ত্রাণ এমনটি ওষুধ সরবরাহের পথ বন্ধ
করে দেয়। ফলে না খেয়ে মারা যায় অনেক লোক, শিশুরা ভোগে পুষ্টিহীনতায়।
রুগ্ণ-জীর্ণ শরীরের কোনো শিশুর ছবি হয়তো ভাইরাল হয়, কিন্তু ক’দিন পর বিশ্ব
ভুলে যায় তাদের কথা। ফলে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে সরকারের এই হত্যাযজ্ঞ।
এর আগে আলেপ্পোর মাদায়া, ফোয়া ও ফারিয়া শহরের সরকারি অবরোধের চিত্র ছিল
ভয়াবহ। সেখানে খাবারের অভাবে মানুষ গাছের ডাল-পাতা এমনকি পোষা বিড়ালের মাংস
খেয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে মাদায়ার অবস্থা ছিল ভয়াবহ,
শহরটিতে ২০১৬ সালের অবরোধে না খেয়ে মারা গেছে কয়েক শ’ মানুষ। প্রায়ই
রাস্তায় পড়ে থাকত অনাহারি মানুষের লাশ। পূর্ব গৌতায়ও একই ধরনের পরিস্থিতি
সৃষ্টি করতে চাইছে বাশার সরকার। ২০১৩ সাল থেকে অবরুদ্ধ থাকা এলাকাটিতে এখন
খাদ্যদ্রব্যের চরম সঙ্কট চলছে। ২৮ বছর বয়সী আছিয়া বিবিসিকে জানিয়েছেন,
কাজের সন্ধানে যাওয়ার সময় তার স্বামী নিহত হয়েছেন বিমান হামলায়। তিন সন্তান
নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন একটি ভূগর্ভের আশ্রয় কেন্দ্রে। একটি সন্তান
অসুস্থ তার জন্য ওষুধ ও খাবার কিছুই জোগান দিতে পারছেন না। প্রথম দিকে
অবরোধ সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা গোপন পথে কিছু খাবার আমদানি করতেন; কিন্তু বিমান
হামলা বৃদ্ধির কারণে এই পথও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো দোকানে একটি রুটি পাওয়া
গেলে তা বিক্রি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ২২ গুণ বেশি দামে। এ মার্চ মাসেই
আট বছরে পড়বে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। ২০১১ সালে গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের
স্বাধীনতার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু করেছিল সাধারণ জনতা, তার দায় এখন তাদের
শোধ করতে হচ্ছে জীবন দিয়ে। আর এই যুদ্ধে নিষ্ঠুরতার যত প্রক্রিয়া আছে তার
সবই প্রয়োগ করছে সরকার। প্রায়ই বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস ছোড়া হচ্ছে আবাসিক
এলাকাগুলোয়। কোনো জখম, রক্তপাত ছাড়াই নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষ।
আহত লোকদের চিকিৎসা দেয়ার পথও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। নির্বিচারে বোমা হামলা
চালানো হচ্ছে হাসপাতালগুলোয়। গত এক মাসে ২৯টি হাসপাতাল ও অস্থায়ী
চিকিৎসাকেন্দ্রে বোমা ফেলা হয়েছে বিমান থেকে। মারা গেছে অনেক রোগী।
হাসপাতালের সামনে পার্কিং করে রাখা অ্যাম্বুলেন্স ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে
বোমায়। গত দশ দিনে ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স ধ্বংস হয়েছে রাশিয়ার বিমান হামলায়।
মারা গেছে অন্তত ১০ জন ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মী। ক্রমেই ইতিহাসের সব
বর্বরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাশার আল আসাদের এ নিষ্ঠুরতা। ক্ষমতার লোভে
নাগরিকদের হত্যার এই মহোৎসবে তাকে সরাসরি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে
রাশিয়া আর ইরান। যার ফলে সাত বছর শেষ হলেও থামানো যাচ্ছে না তাকে।
No comments