দেশের মর্যাদা, অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে: শেখ হাসিনা
আমি
প্রথমেই শ্রদ্ধা জানাই মহান ভাষা আন্দোলনে সকল শহীদকে যাঁরা বুকের তাজা
রক্ত দিয়ে আমাদেরকে মা বলে ডাকার অধিকার দিয়ে গেছে। শ্রদ্ধা জানাই আমাদের
মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের প্রতি। যিনি বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার আন্দোলন
শুরু করেছিলেন এবং যাঁর আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র
বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, আমাদের জাতীয় চার নেতা এবং
৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনকে। জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি
প্রথম প্রহর ১২.০১ মিনিটে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, '১৯৫২
সালের আন্দোলন কেবল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল
সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।'
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে ঘোষণা দেওয়া
হলো, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল করে তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়েছিল
প্রতিবাদ জানাতে। সেখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
আইন বিভাগের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সভা ডাকলেন। তমুদ্দুন মজলিসসহ
কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন মিলে সিদ্ধান্ত নিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ
গঠনের, 'ভাষা দিবস' হিসেবে ১১ মার্চ ঘোষণা দেওয়া হলো। তারও পূর্বে ১৯৪৮
সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগ গঠন করেছিলেন। ১১ মার্চ
ধর্মঘট করতে গিয়ে অনেক নেতা গ্রেফতার হন, সেখানে জাতির পিতাও ছিলেন।
আমাদের এখানে দীপু মনির বাবা ওদুদ সাহেবসহ প্রায় ৭০ জনের মতো তখন গ্রেফতার
হন অথবা পুলিশের লাঠির বাড়িতে আহত হয়। এরপর মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন
সাহেবের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনা হয়। তিনি ওয়াদা দিয়েছিলেন,
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পার্লামেন্টে তুলবেন। ১৬ মার্চ
বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সভা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব।
সেখানে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণ দেওয়া হয়। এই রাষ্ট্রভাষা বাংলার
দাবিতে যাতে জনমত সৃষ্টি করা এবং সংগ্রাম গড়ে তোলার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু
ফরিদপুরে যেয়েও গ্রেফতার হন, আবার মুক্তি পান। পরে ঢাকায় ১৯৪৯ সালের
অক্টোবর মাসে ভুখা মিছিল হয়। তখন লিয়াকত আলী খান পূর্ববঙ্গে আসার কথা, সেই
সময় এই আন্দোলনে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তারপর অনেকে মুক্তি পেয়েছে,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তি পাননি। কারাগারে থেকেও তিনি যখনই কোর্টে অথবা
চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসতেন, তখনই ছাত্রনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ
করতেন। ছাত্রলীগের তখন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নইমউদ্দীন সাহেব ও
খালেক নেওয়াজ, তাঁদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়,
একুশে ফেব্রুয়ারি তখন প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট সেশন বসবে, তখন পার্লামেন্ট
বসত জগন্নাথ হলের যে হলটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল- আপনাদের মনে আছে ১৫ অক্টোবর,
সেখানে প্রাদেশিক পরিষদের বৈঠক হতো। যেহেতু ছাত্রদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে
হবে সেই ধরনের নির্দেশনা দেন। সেই সাথে সংগ্রাম পরিষদ আবার গঠন করা হয় ১৯৫২
সালে এবং সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যেন সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়, সে
নির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন। তিনি দাবি আদায়ের জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন
করা শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের ন্যাপের মহিউদ্দিন সাহেব (পরবর্তীকালে
আওয়ামী লীগের নেতা) অনশন করেন। অনশনরত অবস্থায় তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে
যাওয়া হয়। ওই সময় ওয়াইজ ঘাট থেকে স্টিমার ছাড়ত, নারায়ণগঞ্জে থামত। তিনি
আগেই খবর দিয়েছিলেন যে, নারায়ণগঞ্জের নেতৃবৃন্দ যেভাবে হোক ওনার সঙ্গে যেন
দেখা করে। সেখানে অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হয়, সেখানেও নির্দেশ দিয়ে যান
আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। '৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন মিছিল বের হয়, গুলি
চলে এবং আমাদের শহীদরা রক্ত দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে একটা জায়গায় নিয়ে যান।
এরপর নির্বাচন হয়। যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও সেই সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে
পারেনি। পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে সেই সরকার বাতিল
করিয়ে ৯২/ক ধারা দিয়ে ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান আবার গ্রেফতার হন। এরপর '৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, হোসেন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি পাকিস্তানের জন্য
প্রথম সংবিধান রচনা করেন। এই সংবিধানে উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা দেয়। '৫৮ সালে
আইয়ুব খান মার্শাল ল' জারি করেন। তিনি একাধারে সেনাপ্রধান, সেই সাথে নিজেকে
রাষ্ট্রপতিও ঘোষণা দেন। সে সময় বলা হয়, বাংলা ভাষা চর্চা করা যাবে না,
বাংলায় কথা বলা যাবে না। কবিতাগুলোকেও মুসলমানি ভাষা দিতে হবে; মানে সকালে
উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। সেটাকে করা হয়েছিল,
ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি, সারাদিন আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি। এমনকি কবি
নজরুলের সেই কবিতা- সজীব করিব মহাশ্মশান, এই মহাশ্মশান থাকতে পারবে না,
সেখানে বসানো হলো গোরস্থান। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যাবে না, রবীন্দ্রনাথ
পড়া যাবে না। আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা, রফিক স্যার উপস্থিত
আছেন, তখন শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেছিলেন। আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের হেড
ছিলেন আবদুল হাই স্যার, তাঁকে ডেকে মোনায়েম খান বলেন, রবীন্দ্রনাথকে বাদ
দেওয়া হয়েছে, তাতে কি আছে? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কি চলে না ভাষা? হাই স্যারকে
ডেকে মোনায়েম খান সাহেব বললেন- কী মিয়ারা, আপনারা বসে খালি রবীন্দ্রসঙ্গীত,
রবীন্দ্রসঙ্গীত করেন। ২-৪ খান রবীন্দ্রসঙ্গীত নিজে লিখে ফেলতে পারেন না!
হাই সাহেব খুব ভদ্রলোক ছিলেন- বিনয়ের সাথে বলেছিলেন, স্যার, সেটা তো
রবীন্দ্রসঙ্গীত হবে না, আমি লিখলে ওটা তো হাই সঙ্গীত হয়ে যাবে। এই আঘাতটা
কিন্তু সেই আমাদের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত, বারবার দেখেছি- কখনও রোমান হরফে
বাংলা লিখতে হবে, কখনও আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে। জাতির পিতা যে কথাটা
বলেছিলেন, ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য নয়; এখানে আমাদের সামাজিক,
রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ আন্দোলন ছিল। তিনি যে ৬ দফা
দিয়েছিলেন, সেটা ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সোপান। ৬ দফা
দেবার সাথে সাথে তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে, তাঁকে ফাঁসি দিয়ে
হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রসমাজ, জনগণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে
আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটিয়েছিল এবং বাধ্য করেছিল এই মামলা প্রত্যাহার করে
তাঁকে মুক্তি দিতে। তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ ৭ মার্চের, যে ভাষণ আজকে
বিশ্বঐতিহ্য প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথে
তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা বিজয় অর্জন করলাম '৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর। এরপরে জাতির পিতা মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে
ফিরে এলেন।
একটা প্রদেশ ছিল বাংলাদেশ, সেটাকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা।
ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে শুরু করেছে, দেশ
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। মানুষের ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে
শুরু করেছে। এই বাংলাদেশে তারা গণহত্যা চালিয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়েছে। ৩ কোটির
ওপর মানুষ গৃহহারা ছিল। প্রতিটি শহীদ পরিবার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, আহত
মুক্তিযোদ্ধা, লাঞ্ছিত মা-বোন; তাদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা সব ব্যবস্থা অতি
অল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। মিত্রশক্তি ভারতের সেনাবাহিনী যারা
আমাদের সাথে ছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, জাতির পিতার অনুরোধে
ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে ফেরত নিয়ে যান। বাংলাদেশ একটু অর্থনৈতিকভাবে
স্বাবলম্বী, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগ পর্যন্ত অর্জন করতে সক্ষম হই-
দুর্ভাগ্য, যে ঠিক তখনই আঘাতটা এলো, জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
একই সাথে গোটা পরিবারের সাথে আমার মেজো ফুপু, সেজো ফুপু, ছোট ফুপু
প্রত্যেকের বাড়িতে আক্রমণ করল, প্রতিটি বাড়ির সদস্যকে হত্যা করল। জেলখানায়
জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করল। ১৫ আগস্টের পর প্রথমে বাংলাদেশকে ইসলামিক
রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। যখন বুঝল, এটা মানুষ গ্রহণ করবে না, তখন
সেটা দ্বিতীয়বার উচ্চারিত হয়নি। এরপর ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে
পারেনি, যারা এসেছিল তারা তো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। তারা ওই আইয়ুব খানের
পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ক্ষমতায় এসেছে। তারা যেই শক্তিকে আমরা পরাজিত বললাম,
তাদেরই প্রতি খোষামোদী, তোষামোদী চাটুকারিতা আমরা দেখেছি। যে
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন, সেই বিচার মার্শাল
অর্ডিন্যান্স দিয়ে বন্ধ করে তাদেরকে মুক্ত করে দল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
অনেকে বলেন, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিল। তাদের বহুদলীয়
গণতন্ত্র মানেই তো ওই যুদ্ধাপরাধীদের দল করার সুযোগ দেওয়া, যাদের সাজা
হয়েছিল তাদের মুক্ত করা। কাউকে প্রধানমন্ত্রী, কাউকে মন্ত্রী, কাউকে
উপদেষ্টা, তাদের হাতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেওয়া। জাতির
পিতার হত্যাকারীদের বিচার না করে পুরস্কৃৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি
দেওয়া। ২১ বছর পর আমরা সরকারে আসি। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস। আমরা যখন ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, বহু দেশের বহু জাতির মাতৃভাষা
হারিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সেই মাতৃভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করা, সেই মাতৃভাষাগুলোর
চর্চা করা, নমুনা রাখা- একটা ভাষা জাদুঘর, আমরা সেই জাদুঘর তৈরি করেছি। এই
প্রতিষ্ঠানটার আমি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি; কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে
আমার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তৈরি হতে দেয়নি। ২০০৯ সালে সরকারে
আসার পর আবার সেটা প্রতিষ্ঠা করি। ভাষা জাদুঘর করে দিয়েছি। মনে হয়, সারা
বিশ্বব্যাপী আজকে বাংলাদেশেরই দায়িত্ব পড়েছে মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করার।
বাংলায় আমরা যখন অনার্স করতাম, তখন ছিল সাবসিডিয়ারি- এখন বলে মেজর আর
মাইনর। কিন্তু বাংলা ভাষা নাকি শেখা যায় না, নেওয়া যায় না। আমার মনে হয়, এ
বিষয়ে ইউজিসির সাথে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আলোচনা করতে হবে- বাংলা
ভাষার প্রতি এই অবহেলা কেন? আর আমরা ব্যাপকহারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
দিয়েছি; কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষা শিক্ষা হবে না, বাংলা সাহিত্য শিক্ষার
ব্যবস্থা থাকবে না- এটা তো হতে পারে না। কিছুদিন আগে আমাকে একজন একটা বিয়ের
কার্ড দিলেন। তিনি সচিব ছিলেন। আমি ধন্যবাদ জানালাম, কার্ডটা বাংলায় রচনা
করেছে। এখানে আমার স্যার বা সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সাহেব যা বলেছেন- বিয়ের
কার্ড হয় ইংরেজি ভাষায়। অনেকে যখন নিয়ে আসত আমি জিজ্ঞেস করতাম, ইংরেজি
ভাষায় কেন? এটা একটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এই দৈন্যতা কেন দেখাতে হবে?
আমার শ্রদ্ধেয় স্যার রফিক সাহেব ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সাহেব অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে গেছেন। আমি নোট করে নিয়েছি, অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
অন্য ভাষা শিখতে হবে। বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখতে গেলে আমাকেও অন্য ভাষা
শিখতেই হবে। কিন্তু অন্য ভাষা না শিখতে পারলে উন্নত হতে পারব না, এটা
বিশ্বাস করি না। জাপানিজরা জাপানিজ ভাষায় কথা বলে। তারা সারাবিশ্বে একসময়
সব থেকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলেছিল। আমাদের
ভাষা শহীদরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা দিয়ে গেছে, আমরা সেটা শিখব না
কেন? ওনারা ঠিকই বলেছে, সাইনবোর্ডগুলো লেখা হয় ইংরেজিতে। এটা ভাষারই একটা
নিয়ম- আদান-প্রদান এটা হয়। কিন্তু মাতৃভাষার চর্চটা তো থাকতে হবে।
যেমন কথা
হচ্ছে- উচ্চ আদালতের রায় ইংরেজিতে লেখা হয়। অনেক সাধারণ লোক ইংরেজি ভালো
জানে না, তার যে উকিল সাহেব থাকে রায় পড়ে যেটা বোঝায়, সেটাই বুঝতে হয়।
এখানে অনেক আইনজীবী আছেন, তারা যেন কিছু মনে না করেন। এখন নিম্ন আদালতে
ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাংলা ভাষায় রায় দেয়ার। উচ্চ আদালতেও, আশা করি,
নিশ্চয়ই সেটা লিখবে। আরেকটা বিষয়,বাংলা ভাষায় কথা বলি কিন্তু বাংলা অনেকটা
ইংরেজি টোনে বলা, কেমন যেন একটু বিকৃত করে বলার একটা চর্চা শুরু হয়ে গেছে।
আমরা (দুই বোন) ১৯৭৫-এর পর ৬ বছর বিদেশের মাটিতে থাকতে হয়েছিল।
ছেলেমেয়েগুলো বিদেশেই লেখাপড়া শিখতে বাধ্য হয়েছিল, যেখানে বাংলা শেখার
এতটুকু সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমি রেহানা, আমাদের ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে
পড়াশোনা করেছে, প্রতি সপ্তাহে বাংলায় চিঠি লিখতাম; ছুটিতে এলে বাংলা শেখাতে
চেষ্টা করতাম। তারা বিদেশে লেখাপড়া শিখেও যতটুকু বাংলা বলতে পারে, আমরা তো
দেখি যে, বাংলাদেশে থেকে হয়তো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তারাও যেন বাংলা বলতেই
চায় না, বলতেই পারে না; একটু বিকৃত করে বলে। আমি আবারও বলছি, আমি কিন্তু
ভাষা শেখার পক্ষে। সব দেশেই এটা আছে, একটি মাতৃভাষা শিক্ষা আর একটি দ্বিতীয়
ভাষা শিক্ষা। এখন দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ
করেছি। গ্রামে বসেই ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন দেশের ভাষা শিখে, অনলাইনে অর্থ
উপার্জন করছে। সেই সুযোগটা সৃষ্টি করতে হবে; কিন্তু সাথে সাথে আমার মায়ের
ভাষার চর্চা তো থাকতে হবে। পরিবার থেকে উৎসাহিত করতে হবে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১
পর্যন্ত আমরা যে কাজগুলো করি, মাঝখানে পথ হারিয়ে যায় ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত।
আবার সরকারে আসার পর, আজকে বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত
রাখা, মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের কাহিনী বলা। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা বলতে
সাহস পেতেন না। সরকারি চাকরির জন্য মুক্তিযোদ্ধা লিখতে সাহস পেতেন না।
তাহলে চাকরি পাবে না। কী দুর্ভাগ্য! তখন ছিল রাজাকারদের দাপট। ৯ বছর সরকারে
থাকার পরে অন্ততপক্ষে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আজকে মানুষ
গর্ববোধ করে, এখন আর ভীতসন্ত্রস্ত হয় না। এই আত্মবিশ্বাসটা যেন হারিয়ে না
যায়। এমন কোনো অন্ধকারে যেন আবার আমরা না পড়ি যে, আবার আমাদেরকে সেই
অন্ধকারে চলে যেতে হবে, আবার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে হবে,
সেই পরিবেশ যেন আর কোনোদিন বাংলার মাটিতে না আসে, সে ব্যাপারে সবাইকে
সচেতন থাকতে হবে। কারণ যাদের হৃদয়ে পাকিস্তান, থাকে বাংলাদেশে, সবরকম
আরাম-আয়েশ, ফল ভোগ করবে এই দেশে, আর অন্তর আত্মাটা পড়ে থাকবে ওই দেশে,
তাদের জন্য আবার কাঁদে পাকিস্তান, পেয়ারে পাকিস্তান! এই পেয়ারে
পাকিস্তানওলাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করে চলতে হবে। এটাই
আমার আবেদন দেশবাসীর কাছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৫ আগস্টের খুনিদেরকেও
পার্লামেন্টে ভোট চুরি করে বসানো হয়েছিল। আর যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে
বিচার হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে, সাজা কার্যকর হয়েছে, তাদেরকে যারা মন্ত্রী
বানিয়েছিল, লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তাদের হাতে যারা তুলে দিয়েছিল,
জাতি যেন কোনোদিন তাদেরকে ক্ষমা না করে। যারা আমার মা-বোনকে রেপ করেছে,
যারা গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাট করেছে সেই যুদ্ধাপরাধী আর
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, তাদের বিচারের রায় আমরা
কার্যকর করেছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমরা
নিম্নআয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলাম, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে
স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি অর্থাৎ একধাপ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। বাঙালি
জাতি আজকে মর্যাদা পেয়েছে। এই অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে, শহীদদের প্রতি
এটা আমাদের অঙ্গীকার, এই অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখবো।
No comments