নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান করতে হবে ইসিকেই
বাংলাদেশ ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসে স্বাক্ষর করেছে। এর ধারা ২৫ অনুযায়ী দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ভোট প্রদানের এবং নির্ধারিত সময়ের পর সুষ্ঠু ও সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার প্রদানে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। সার্বজনীন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ২১ ধারা অনুযায়ীও আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রত্যক্ষ, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ভোটারদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সঠিক বলা যায়। এ ধরনের নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তি অনুযায়ী সুষ্ঠু ও সঠিক নির্বাচনের পূর্ব শর্ত হল, দেশের যেসব নাগরিক প্রার্থী হতে আগ্রহী তারা যাতে প্রার্থী হতে পারেন এটা নিশ্চিত করতে হবে। ভোটারের সামনে অনেক বিকল্প প্রার্থী থাকবে এবং নির্বাচন হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ; ভোট প্রদানে আগ্রহীরা যাতে নির্বিঘ্নে এবং স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন এটা নিশ্চিত করতে হবে। ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য। তাহলে নির্বাচনটি ভোটার এবং দেশীয়-আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথ সুগম হয় এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। গণতন্ত্র মানেই হল জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ সবসময়ই প্রত্যাশা করে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হোক, গণতন্ত্রের যাত্রাপথ অব্যাহত থাকুক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচন সামনে রেখে বেশ আগে থেকেই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে জোরালো বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপির দাবি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং সহায়ক সরকারের রূপরেখা কি হবে তা নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা কাজ করছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার কথা বলছেন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ২০১১ সালের ১১ মে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেন। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা সরে এসেছে বলা যায়।
তবে প্রয়োজনীয় বিধান সংশোধন করে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাইরে রেখে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যাবে বলে ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এ প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের বাইরে রেখে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে অন্য কোনো রূপরেখা তৈরি করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার পথ খোলা আছে। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হলে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের পরিপন্থী হবে। তাই সংবিধান অনুযায়ী ১০ শতাংশ টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। ১০ শতাংশ কোটায় বিএনপি নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করে নির্বাচনকালীন ছোট সহায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। মন্ত্রিসভায় বিএনপি থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মন্ত্রী নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। হয়তো এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একই প্রস্তাব দিতে পারে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন কমিশনই মূল দায়িত্ব পালন করার কথা, কিন্তু বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা অনেকদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ যা খুবই হতাশাজনক। পক্ষান্তরে নির্বাচনী গণতন্ত্রে ভারতের সুনাম বিশ্বব্যাপী। ভারতের নির্বাচন কমিশনকে কতখানি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার বেশকিছু উদাহরণ ভারতের বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেইশি তার রচিত বই আনডকুমেন্টেড ওয়ান্ডার : দ্য মেকিং অফ দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ইলেকশন বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ভারতের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যেভাবে বিন্যাস করা হয়েছে, অনুরূপভাবে আমাদের সংবিধানে একই বিষয় সংযোজিত হয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। ভারতের এবং বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের তুলনামূলক চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয়, নির্বাচন পরিচালনায় আমাদের কমিশন, অন্তত আইনের দিক থেকে উপমহাদেশের অন্যান্য কমিশন থেকে শক্তিশালী। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন ভারতীয় কমিশনের অনুরূপ ক্ষমতা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোথাও কোথাও একটু বেশিই ক্ষমতা রাখে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু আইন দ্বারাই সুরক্ষিত নয়, ক্ষমতা প্রয়োগে এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে উচ্চ আদালতসহ দেশের রাজনৈতিক দল এবং সব নির্বাহীর সহযোগিতার প্রয়োজন হয় যার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যই আইনি এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। সে তুলনায় আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন ততটা কার্যকর এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে কি? এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দশটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। ১৯৭৩ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার, ১৯৭৯ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বিএনপি এবং ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচন হয়েছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির অধীনে। নির্বাচনগুলোর ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলগুলো অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছে। দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার সবক’টিতেই ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হয়েছে। তাহলে কি দলীয় সরকার নিরপেক্ষ আচরণ করে না? নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দেয় না? বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাও ভারতের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীনির্ভর তবে ভারতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতখানি দলের অনুগত থাকে না, যতখানি আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকে। এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দায়িত্ব পালনে সরকার, রাজনৈতিক দল তেমন হস্তক্ষেপ করে না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে এ চিত্রটি ততটা সুখকর নয়। তাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এক দল কর্তৃক আরেক দলকে নিঃশেষ করে দেয়ার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার স্থায়ী সমাধান নির্বাচন কমিশনকেই করতে হবে। বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ ভারত, তাদের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারলে আমাদের দেশেও তা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক দেশের প্রায় নয় কোটি ভোটার এবং ৫০/৬০ হাজার ভোট কেন্দ্র তদারক করার ক্ষমতা এককভাবে নির্বাচন কমিশনের নেই। কমিশনকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহায়তা গ্রহণ করতেই হবে। সহায়তা গ্রহণ করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কর্মীর। কালো টাকা এবং সন্ত্রাসের আগ্রাসনমুক্ত রাখতে হবে নির্বাচনকে। সারা দেশে নিরপেক্ষতার আবহ সৃষ্টি করতে হবে এবং সেটা করতে হবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারপ্রধানকেই। ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, কানাডা প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আমরা অনুসরণ করতে পারি। এরা জাতি হিসেবে উন্নত ও গণতান্ত্রিক চর্চায় দায়িত্বশীল এবং নিরপেক্ষ আচরণ করে। তাদের নির্বাচনকালীন সরকার সত্যিকারের নিরপেক্ষ সরকারে পরিণত হয়। আমাদের দেশেও তা-ই হোক। সাইফ আহমেদ : সিনিয়র প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (গভর্ন্যান্স), দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ
No comments