লঞ্চশ্রমিকদের কাছে অসহায় যাত্রীরা
লঞ্চশ্রমিকদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা। প্রতিনিয়ত যাত্রীদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। শ্রমিকেরা চাইলেই যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছে অতিরিক্ত ভাড়া। আবার মালামালের জন্য মালিকদের পক্ষ থেকে নির্ধারিত কোনো ভাড়া না থাকায় শ্রমিকেরা তাদের ইচ্ছেমতো মালামালের ভাড়া আদায় করছে। ডেক যাত্রীদের কাছ থেকে টিকিটের অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে নানা অজুহাতে। অতিরিক্ত টাকা আদায়ে ব্যর্থ হলেই যাত্রীদের তারা শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় সদরঘাটে দফায় দফায় লঞ্চ যাত্রীদের ওপর হামলা ছাড়াও নিয়ম লঙ্ঘন করে ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো ও নদীতে লঞ্চগুলোর বেপরোয়া প্রতিযোগিতা নৌযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে কিছু শ্রমিক। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রায় প্রতিটা লঞ্চের শ্রমিকদের হাতে যাত্রী লাঞ্ছিত হয়েছে। এসবের যারা প্রতিবাদ করছে তাদের লঞ্চশ্রমিকেরা লাঠি, রড দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। লঞ্চে বছরের পর বছর এহেন ঘটনা ঘটলেও নীরব থাকছে বিআইডব্লিউটিএ। এ দিকে গত ১১ জুলাই পারাবত-১২ লঞ্চের ২১৮ নম্বর কেবিন নেন ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানা ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি তানভির। তার ও অন্যদের রুমের সামনে তোষক বিছিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ৫ শ’ টাকা ভাড়া বাবদ নিয়ে সিট করে দিচ্ছে লঞ্চশ্রমিকেরা। প্রতিবাদ করায় তাকে শারীরিক লাঞ্ছিত করে কিছু শ্রমিক। তানভির এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। ছুটিতে বাড়ি থাকলেও জরুরি কাজে ঢাকায় যেতে হবে তাকে। পারাবত-১২ লঞ্চে উঠেন এবং ২১৮ নম্বর কেবিনে সিট নেন তিনি। প্রতিটা রুমের সামনেই তোষক বিছানো দেখে ও চলাফেরার জায়গা না থাকায় প্রতিবাদ করলে ওই লঞ্চশ্রমিকেরা তেড়ে যায় তার দিকে। তিনি বলেন, পরে সকাল ৭টায় লঞ্চ থেকে নামার সময়ে নিচে গেটের সামনে ম্যানেজার তাকে ডাক দিয়ে বলে লঞ্চের বিষয়ে কোনো মন্তব্য কিংবা প্রতিবাদ করলে মেরে ফেলা হবে। এমন আচারণের প্রতিবাদ করলে পারাবতের ম্যানেজার ও তার দলবল কিলঘুষি মারে তাকে। তা ছাড়া ম্যানেজার আরো বলে যে, এই লঞ্চের মালিক মন্ত্রীর বেয়াই। তোর মতো ছাত্রলীগকে মেরে নদীতে ফেলে দিলেও কিছু হবে না বলে হুমকি দেয় ম্যানেজার বলে জানান তানভির। গত ২৫ জুন এমভি টিপু লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই হয়ে যাওয়ায় কয়েকজন যাত্রী লঞ্চটি ছাড়ার জন্য মাস্টারকে অনুরোধ জানালে লঞ্চশ্রমিকদের চরম অসৌজন্য মূলক আচরণের শিকার হন যাত্রীরা। এ সময় কয়েকজন যাত্রী প্রতিবাদ করলে লঞ্চশ্রমিকেরা লাঠি, রড নিয়ে কয়েকজন যাত্রীকে পিটিয়ে আহত করে ও একজন নারী যাত্রীকে পানিতে ফেলে দেয়। গত ২৩ জুলাই একই লঞ্চের শ্রমিকেরা যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়। এসব হামলা সম্পর্কে টার্মিনালে দায়িত্বরত নৌপুলিশ হাসনাবাদ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো: শহিদুল আলম বলেন, লঞ্চে যাত্রী ও লঞ্চশ্রমিকদের মারামারির ঘটনায় সাথে সাথে নৌপুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং যাত্রীদের নিরাপদে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। স্টাফদের কেবিন বাণিজ্য ও কেবিন বয়দের নারী বাণিজ্য লঞ্চের পরিবেশকে কলুষিত করে তুলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া লঞ্চের কেবিনগুলোতে মাদকের আড্ডা বসে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতা মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, পরিবার নিয়ে যাওয়ার জন্য সুন্দরবন লঞ্চে ওঠে কেবিন না পেয়ে দোতলায় ডেকে দেখেন সব জায়গায় বিছানা ফেলা। কিছু যাত্রী ডেকে মালামাল নিয়ে বিছানায় বসে থাকলেও বিছানা খালি থাকা সত্ত্বেও অনেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দালালরা বিছানা নিয়ে দাম হাঁকছে ৩ শ’ থেকে ৫ শ’ টাকা। পরে তিনি একজনকে অনেক অনুরোধ করে ২ শ’ টাকায় একটি বিছানা কেনেন বলে জানান। সেলিম নামে বরিশালের এক যাত্রী জানান, একটি লঞ্চে বরিশাল থেকে আসার পথে একজন কেবিন বয় কোনো গার্লফেন্ড লাগবে কি না জিজ্ঞাসা করে। ফিরোজ আলম নামে চাঁদপুর থেকে মিতালী লঞ্চে ঢাকায় আসা যাত্রী এ প্রতিবেদককে বলেন, পবিত্র রমজানে রাতে কেবিনে বসে মুরগির গোশত দিয়ে সেহরি খাওয়ার অর্ডার দেন তিনি। এ সময় কেবিন বয় এক পচা মুরগির গোশত এনে দেয়। গত ২১ জুন ঘাটে বার্থিং করতে এসে এমভি জাহিদ-৮ নামের লঞ্চটি এমভি গ্লোরি অব শ্রীনগর লঞ্চকে ধাক্কা দিয়ে মুচড়ে দেয়। এ কারণে নৌপরিবহন অধিদফতরের কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই লঞ্চকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে। ঠিক একই দিনে পানামা লঞ্চে যাত্রী উঠানো হয়। পরে যাত্রীদের জানিয়ে দেয় হয় যে, আগামীকাল ভোরে লঞ্চ ছাড়বে। এ নিয়ে যাত্রীদের সাথে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে মারধর ও যাত্রীদের কোপানো হয়েছে। একাধিক আনসার সদস্য, পুলিশ ও স্থানীয় দোকানিরা এ প্রতিবেদককে জানান, ২১ জুন রাত ১০টায় পানামা লঞ্চে যাত্রীদের কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিশেষ দিনগুলো কিংবা ঈদ কোরবানিতে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। তাই একটু আতটু কথাকাটাকাটি হতে পারে। তবে কোনো লঞ্চ মালিক কিংবা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে যাত্রী পরিবহন সংস্থা ব্যবস্থা নেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর মোজাম্মেল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ঈদে কোনো যাত্রী হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া কোনো লঞ্চ মালিক কিংবা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েকদিন আগে কির্ত্তন খোলা লঞ্চ মালিককে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং মাস্টারকে জেলে দেয়া হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন লঞ্চের বিরুদ্ধে মেরিন কোর্টে মামলাও করা হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো লঞ্চ মালিক কিংবা শ্রমিকের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগের সত্যতা মিলে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
No comments