‘স্বপ্নে আইয়া ছ্যাঁকা দিব শইল কাটব’
‘মা নদী আর ফিররা আইবে না। মোরে হে জেম্মে কইররা এস্তারি দিয়া ছ্যাঁক দেছে, ব্লেড দিয়া শইলের হগল জায়গায় কাটছে। হেম্মে কইররা হেরে ছ্যাঁক দিবনি। হেম্মে কইররা ব্লেড দিয়া কাডবনি। হে কী আর মোর স্বপ্নে আইব, স্বপ্নে আইয়া মাইরব, শইল কাটব।’ একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে মা সাফিয়া বেগমকে বারে বারে এ প্রশ্নই করছিল আদুরী। রায় কী বোঝে না সে, তাকে নির্যাতনের অনুরূপ সাজা গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে দেয়া হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন তার। ছাড়া পেলে নদী কী আবারও তার ওপর নির্যাতন চালাবে? চার বছর ধরে আদুরী পটুয়াখালীতে নিজ গ্রামে মায়ের সঙ্গে থাকে। কিন্তু ঢাকায় নির্যাতনের বিভীষিকা এখনও ভুলতে পারেনি সে। প্রতি রাতে স্বপ্নে তাকে মারতে আসে গৃহকর্ত্রী নদী। কেঁপে উঠে ঘুম ভাঙে তার। এজন্যই এত প্রশ্ন। আর কী করে ভুলবে- ক্ষতগুলোতে এখনও যে ব্যথা হয়। ছ্যাঁকায় পুড়ে ছোট হয়ে যাওয়া জিহ্বা যে তাকে স্পস্ট করে কথা বলতে দেয় না। ভুলে যায় পড়া, দরকারি কাজ। সে কারণেই সম্প্রতি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েও ক্লাস করা হচ্ছে না তার। তবু সে স্বপ্ন দেখে- ‘বড় হইয়া আমি (নির্যাতিত) মাইনষের পাশে খাড়ামু। পুলিশ আমাগো বহু সাহায্য করছে, তাগো মতো হমু। না অইলে আপাগো (আইনজীবী) মতো হমু। হেরাও অনেক সাহায্য করছে। হের জন্য যত খাটন (অধ্যবসায়) লাগে খাটমু।’ ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বারিধারা ডিওএইচএস তেলের ডিপোসংলগ্ন ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় অচেতন আদুরীকে। কঙ্কালসার শরীরে ভয়াবহ নির্যাতনের ক্ষত। এর দায়ে ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার গৃহকর্ত্রী নদীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। আদুরীর মা সাফিয়া বেগম জানান, বিচারের রায় শুনতে আদালতে এসেছে আদুরীসহ সাত স্বজন। পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি থেকে লঞ্চে সোমবার সকালে ঢাকায় আসেন। রাতে বাড্ডায় এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলেন। মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকেই কোর্টে আসেন। আদুরী ও তার স্বজনদের সঙ্গে কোর্ট চত্বর ও পরে আগারগাঁওয়ে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অফিসে প্রায় আড়াই ঘণ্টা কথা হয় এ প্রতিবেদকের। আদুরী জানায়, রাতে মায়ের বুকে ঘুমালেও আতংকে ঘুম আসে না। শরীরের প্রচণ্ড ব্যথায় কাঁদে। গরম লোহা দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়ায় জিহ্বাহ কিছুটা ছোট হয়ে গেছে। ফলে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। মাথা, হাত, পা, গলাসহ সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্নগুলো দেখে সে এখনও আতকে উঠে। সব সময় ভাবে, এই বুঝি রাক্ষসটা (নদী) এসে মারধর শুরু করবে। সাফিয়া বেগম বলেন, রাতে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে, ‘না, না আর মাইরেন না, আমি মইরা যামু। মোরে ছাইরা দেন’। আইনজীবী সমিতির অফিসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল আদুরী। ভাত খেতে খেতে বলে, নদী তাকে কোনো দিন পেট ভরে খেতে দেয়নি। গলায় পারা দিয়ে ব্লেড হাতে নিয়ে মাথা, গলা ও গাল কাটত। এসব কথা বলতে বলতে ভেঙে পড়ে কান্নায়। সাফিয়া বেগম জানান, শুরুতে মামলা মীমাংসা করতে বহুবার নদীর আত্মীয়রা টাকা নিয়ে তার বাসায় গেছেন। কখনও কখনও ভয়ভীতিও দেখিয়েছেন। মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা কোনো চাপে নত হইনি। তিনি আরও বলেন, আদুরী যত বড় হচ্ছে ততই চিন্তা হচ্ছে। এ মেয়েকে কী করে বিয়ে দেবেন। মেয়ে এখনও ভালোভাবে হাঁটতে পারে না। ৫/৭ মিনিট হাঁটার পর পড়ে যায়। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করালেও পড়া মুখস্ত হয় না বলে আর কথা ঠিকমত বলতে পারে না বলে সেখানে যাওয়া বন্ধ। তার চিকিৎসারই বা কী হবে! বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী জানান, আদুরী এখনও ভীষণ অসুস্থ। বিশেষ করে তার মনে ভয়ভীতি বাসা বেঁধে আছে। সে এখনও পরিবারের সদস্য ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রায়ের বিষয়ে সালমা আলী বলেন, এ রায় ইতিহাস হয়ে থাকবে। ভবিষৎতে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনকারী যত বড় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হোক, আইনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। আদুরীকে আইনি সহায়তাকারী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির ফাহমিদা আক্তার রিংকি যুগান্তরকে বলেন, আদুরী আরও পড়ালেখা করতে চায়। এক্ষেত্রে আদুরীর আর্থিক সাপোর্ট জরুরি। কোনো একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হলে আদুরীর পড়ালেখার বিষয়টি নিশ্চিত হতো। আদুরীর মামা নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার পর পরই (২০১৩ সালে) ডিএমপি পুলিশের পক্ষ থেকে আদুরীর জন্য সাতটি রিকশা দেয়া হয়েছিল। রিকশাগুলো কিছুদিন পরেই নষ্ট হয়ে যায়। ছয়টি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আর একটি রিকশা ভাড়ায় দেয়া হয়। এছাড়া ওই সময়েই সরকারের পক্ষ থেকে আদুরীর জন্য চার কাঠা জমি দেয়া হয়। যার দুই কাঠা আদুরীর নামে ও দুই কাঠা আদুরীর মায়ের নামে। আর্থিক সমস্যা আদুরীর পরিবারের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বড় পরিবারের খরচ মেটাতে হিমশিম আমরা। আদুরীকে আমরা পড়ালেখা করাতে চাই। আর ওরও (আদুরী) পড়ালেখার প্রতি বেশ আগ্রহ। সরকার ছাড়া আমাদের আর গতি নাই।
No comments