চট্টগ্রামে গুদাম থেকে পাচার হল কয়েকশ’ টন চাল
সোমবার রাত ৯টা ৩৩ মিনিট। নগরীর হালিশহর সেন্ট্রাল সাপ্লাই ডিপো (সিএসডি) বা গুদামের প্রধান ফটকের লাইটগুলোর বেশির ভাগই নেভানো। তবে সতর্ক অবস্থানে ছিল নিরাপত্তারক্ষীরা। কয়েকজন প্রধান সড়কে পায়চারী করছিলেন আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। পথচারীদের ওপর ছিল তাদের কড়া নজর। গেটের পাশের চায়ের টংঘরটিও বন্ধ করে দেয়া হয় আগেভাগেই। সোমবার সকালে যুগান্তরের কাছে তথ্য ছিল রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে ২০ থেকে ২২টি ট্রাকে করে সরকারি চাল ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) ছাড়াই বের হয়ে যাবে। একই তথ্য ছিল র্যাব-৭ এর কাছেও। অভিযানের প্রস্তুতি পাকা করে র্যাব। পুরো ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার জন্য রাত সোয়া ৯টায় সিএসডি এলাকায় অবস্থান নেন যুগান্তরের এ প্রতিবেদক। সোমবার বিকাল ৪টার পরই কয়েকটি খালি ট্রাকের সিএসডিতে প্রবেশের খবর আসে। শেষ পর্যন্ত গুদাম থেকে রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে চাল বোঝাই প্রথম বিশাল ট্রাকটি (যশোর ট-১১-১০৩৩) নির্বিঘেœ বের হয়ে যায়। রাতভর ২০-২২টি ট্রাক চাল বোঝাই করে সিএসডি এলাকা ত্যাগ করলেও র্যাব দৌড়ঝাঁপ করে সাতটি ট্রাক আটক করতে পেরেছে। উদ্ধার করা চালের পরিমাণ ১৫৫ মে.টন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় সিএসডির ব্যবস্থাপক প্রণয়ন চাকমাকে তার সরকারি বাসভবন থেকে আটক করেছে র্যাব। আটকের জন্য অভিযান চালানো হয়েছে সিএসডির সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুল আলম মানিকের হালিশহর এক্সেস রোডের সালাম ভ্যালির বাসায়। খবর পেয়ে তিনি আগেই পালিয়ে যান। এছাড়া সাতটি ট্রাকের চাল ও হেলপারদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে খাদ্য বিভাগে। আটক ট্রাকগুলো ১৮ টনি, ১২ টনি এবং ৭ টনি। র্যাব-৭ এর সহকারী পুলিশ সুপার রুহুল আমিন মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, পাচারের সময় সোমবার মধ্যরাতেই অভিযান চালিয়ে সরকারি চালভর্তি ৬টি ট্রাক আটক করা হয়েছে। পরে আরও একটি আটক করা হয়। আটক করা হয়েছে সিএসডির ব্যবস্থাপককেও। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে। সোমবার রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে দু’জন দারোয়ান সিএসডির প্রধান গেট খুলে দিলে প্রথম ট্রাক চাল বোঝাই বের হয়ে আসে এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। ট্রাকটি কোথায় যায় তা প্রত্যক্ষ করার কৌতূহল নিয়ে যুগান্তরের এ প্রতিবেদক মোটরবাইকে করে ট্রাকটির পিছু নেন এবং ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর ট্রাক শহর ছেড়ে চলে যায়। চালভর্তি এ ট্রাকটি সিটি গেটের ১০০ গজ সামনে গিয়ে ৩ জন শ্রমিককে তুলে নেয়। র্যাব এ ট্রাকটি আটক করতে পারেনি।
এরপর ৯টা ৪৪ মিনিটে চট্টমেট্রো-ট ১১-৪৪৪৫ নম্বরের আরেকটি ট্রাক বের হয়ে যায়। এটি কর্নেল হাটের দিকে যেতে দেখা যায়। এভাবে ৯টা ৪৯ মিনিটে চট্টমেট্রো ট ১৩-১৫৪৭ নম্বর ট্রাক, ৯টা ৫৩ মিনিটে ঢাকামেট্রো-১৪ ৩০৭০ নম্বর ট্রাক, ৯টা ৫৮ মিনিটে ১১-০৮২৫ নম্বর, ১০টা ৮মিনিটে চট্টমেট্রো ট-১১-০৩৬৫ নম্বর, ১০টা ১৭ মিনিটে ঝিনাইদহ ট-০২-১৯০ নম্বর, ১০টা ২৭ মিনিটে ঢাকামেট্রো ট-১৪-৪১৫৯ নম্বরের ট্রাক চালবোঝাই করে সিএসডি থেকে বের হতে দেখা যায়। এছাড়া ১০টা ৪৩ মিনিটে ঢাকামেট্রো-ট-১৪-১৯৪০ এবং ১০টা ৪৬ মিনিটে চট্টমেট্রো ট-১১-৩৩৯৬ ট্রাকটি চাল ভর্তি করে বের হয়ে যায়। পরে একে একে চট্টমেট্রো ট-০৫-০৯৩৯ নম্বর এবং চট্টমেট্রো ট-০৫-০১৭১ নম্বরের ট্রাকটি বের হয়ে আসে। প্রায় রাতভর থেমে থেমে চাল বোঝাই করে সিএসডি এলাকা ত্যাগ করে চালবোঝাই ট্রাক। সূত্র বলছে, চালবোঝাই প্রায় ২০-২২টি ট্রাক সিএসডি থেকে বের হয়ে যায়। তবে ঠিক কী পরিমাণ চাল পাচার করা হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। তবে র্যাব চট্টগ্রাম নগরীর স্থানে অভিযান চালিয়ে ট্রাকগুলোর মধ্যে সাতটি আটক করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলো র্যাব-৭ এর সদর দফতর পতেঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদ্ধার চালের পরিমাণ প্রায় ১৫৫ মে.টন (৩ হাজার ৯৬ বস্তা) বলে সূত্র জানিয়েছে। র্যাব জানায়, চালবোঝাই ট্রাকগুলো নগরীর আগ্রাবাদের হাজীপাড়া এলাকা থেকে একটি, হালিশহর নয়াবাজার হক্কানী পেট্রুল পাম্পের সামনে থেকে চারটি ও হাটহাজারীর সরকার হাট এলাকা থেকে একটি আটক করা হয়। পরে আরও একটি ট্রাক আটক করা হয়। এ সময় ট্রাক চালক ও হেলপারসহ ১২ জনকে আটক করা হয়। আটক ওসমান আলী (৫০), আবদুল হাই (৩৪), রাজু খান (২৪), সোহেল (২৩), সুকুমার (৩২) র্যাবের কাছে সিএসডি গুদাম থেকে চাল বোঝাই করে ট্রাক নিয়ে বের হওয়ার কথা স্বীকার করেছন। কোনো কাগজপত্র না থাকার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন। এক ট্রাকচালক পরে র্যাবকে জানিয়েছেন, স্যার আমরা তো প্রায়ই এভাবে চাল নেই। আগেও আপনারা ধরেননি। অভিযানে নেতৃত্ব দেন র্যাব-৭ এর কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার আশিকুর রহমান। মঙ্গলবার ভোরে অভিযান চালিয়ে চাল পাচারের ‘হোতা’ হিসেবে পরিচিত সিএসডির ব্যবস্থাপক প্রণয়ন চাকমাকে আটক করা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘গুদাম থেকে বের হওয়া মালগুলোর দায়ভার আমার ও সহকারী ম্যানেজারের। বেশির ভাগ সময় সহকারী ম্যানেজার আমার পক্ষ হয়ে স্বাক্ষর করে থাকেন।’ তিনি র্যাব সদস্যদের সামনেই অকপটে সব দোষ স্বীকার করে নেন। বলেন, চালভর্তি ট্রাকগুলো অবৈধভাবেই সিএসডি থেকে বের হয়েছে। সরকারি চাল বের করার নেপথ্যে : হালিশহর সিএসডি একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দিন আগে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব সিএসডি পরিদর্শন করেন। এ সময় গুদামে সংরিক্ষত চালের হিসাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে বেশ গরমিল বা ঘাপলা দেখতে পান। ক্ষুব্ধ ঐ কর্মকর্তা গুদামের ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ম্যানেজার ফখরুল আলম মানিককে শাসান। চট্টগ্রাম ত্যাগের আগে তিনি বলেন, ‘আপনাদের যা খুশি করেন, যা ইচ্ছে হয় করেন, আমি চলে গেলাম।’ এরপর সিএসডির ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ম্যানেজার ফখরুল আলম মানিকসহ আরও কয়েক কর্মকর্তা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে ঠিক করেন সিএসডি গুদামে হিসাবের অতিরিক্ত থাকা কয়েকশ’ টন চাল সরিয়ে ফেলতে হবে। না হলে সামনে আরও বিপদ। সে অনুযায়ী সহকারী ম্যানেজার মানিক ও কয়েক ঠিকাদার মিলে ট্রাকগুলো ভাড়া করা হয়। শেষ পর্যন্ত সোমবার মধ্যরাতে গুদাম থেকে হিসাবের অতিরিক্ত চাল পাচার বের করে দেন। এর আগেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সাধারণত বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তারা কৌশলে গুদামে চাল কম দেখিয়ে পরে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেন। র্যাব-৭ এর কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আশিকুর রহমান যুগান্তরকে জানান, এসব চাল কীভাবে সরকারি গুদাম থেকে বের হয়েছে তার সপক্ষে দালিলিক প্রমাণ নিয়ে পতেঙ্গা র্যাব অফিসে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে খাদ্যগুদামের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। কিন্তু ঘটনাস্থলে ট্রাক চালকরা যেমন বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তেমনি মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈধ কোনো কাগজপত্র নিয়ে আসতে পারেননি খাদ্য গুদামের কর্মকর্তারাও। এ ঘটনার নেপথ্যে যদি আর কেউ থেকে থাকেন তাহলে তদন্তে তা বের হয়ে আসবে। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে জানার জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলামকে ফোন করলে যুগান্তরের রিপোর্টার পরিচয় দেয়ার পর তিনি লাইন কেটে দেন। পরে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
No comments