বেসরকারি খাতে দেয়া কারখানায় ‘হরিলুট’
‘কোনোভাবেই কারখানা বন্ধ রাখা যাবে না। বদল করা যাবে না কারখানার ধরন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করতে হবে যাবতীয় পাওনা। জমি, পাছপালা ও যন্ত্রপাতিসহ কারখানার যে কোনো সম্পদ বিক্রি বা মালিকানা হস্তান্তর করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে’- এমন শর্ত সাপেক্ষে প্রায় ৩৫ বছর আগে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ৬৯টি বস্ত্র ও পাটকল। কিন্তু মিল মালিকরা এসব শর্ত শুধু লংঘনই করেননি, রীতিমতো সরকারি সম্পদে ‘হরিলুট’ চালিয়েছেন তারা। ওইসব মিল মালিকের কাছে সরকারের পাওনা প্রায় সাড়ে ১৩শ’ কোটি টাকা পরিশোধ তো দূরের কথা, উল্টো কারখানা বন্ধ রেখে আবাসন কোম্পানির কাছে মিলের জমি বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। কোনো কোনো মিলের জমিতে বাসাবাড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে ভাড়া। বদল হয়েছে কোনো কোনো মিলের মালিকানারও। বিক্রি করা হয়েছে মিলের যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গাছপালাও। মন্ত্রণালয় গঠিত টাস্কফোর্সের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে লুটপাটের উল্লিখিত সব ভয়াবহ চিত্র। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানেও মিলেছে এসব তথ্যের সত্যতা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার ওই ৬৯টি মিল ফিরিয়ে (টেক-ব্যাক) নিচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বুধবার নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, চুক্তির শর্ত লংঘন করে বন্ধ রাখা ৬৯টি বস্ত্র ও পাটকলের নিয়ন্ত্রণ নেবে সরকার।
ইতিমধ্যে ঢাকা জুট মিলস, নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া জুট মিলস, মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলস, চট্টগ্রামের দ্য এশিয়াটিক কটন মিলস, জলিল টেক্সটাইল মিলস, ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলস, সাভারের আফসার কটন মিলস লিমিটেড এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোকিল টেক্সটাইল মিলস সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে নেয়া হবে। চুক্তি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে মির্জা আজম বলেন, সব কারখানা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বস্ত্র ও পাট খাতের বেশকিছু কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। এরপর ১৯৮২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে উল্লিখিত শর্তসাপেক্ষে বেসরকারি খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৩৪টি বস্ত্র ও পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে ৬৯টি কারখানার (পাটকল ৩৫টি ও বস্ত্রকল ৩৪টি) বিরুদ্ধে সম্পত্তি বিক্রিসহ শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। এসব কারখানার জমিতে এখন গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্থাপনা। অনেক স্থানে কারখানার সাইনবোর্ডও সরিয়ে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট মালিকরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া চুক্তি লংঘনকারী কারখানা ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। ওই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব কারখানা ফিরিয়ে (টেক-ব্যাক) নেয়া হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীতে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। ১৯৭২ সালে এটি জাতীয়করণ করা হয়। এর ১৩ বছর পর ১৯৮৫ সালের ১ জুন মিলটিকে শর্তসাপেক্ষে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়।
সরকার ও ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করে মিল বন্ধ রেখে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। বিটিএমসির দেনা-পাওনা পরিশোধ না করেই আইপিওর মাধ্যমে এবং শেয়ার সরাসরি অন্য মালিকানায় বিক্রি করা হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হল মিলটির মোট জমির পরিমাণ ২৫ দশমিক ৮৭ একর। এর মধ্যে ২১ দশমিক ৯৪ একর জমিই সরকারের অনুমতি ছাড়া বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৭৫ একর জমি নন্দন হাউজিং সোসাইটি, ৬ দশমিক ৪৩ একর জমি আলফা রিয়্যাল এস্টেট লিমিটেড এবং ১১ দশমিক ৬৫ একর জমি মেসার্স মোস্তফা হাকিম রিয়্যাল এস্টেটের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আলফা এস্টেট কোম্পানি আবাসন প্লট বানিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করেছে। এতে তৈরি হয়েছে আবাসিক ভবন। মোস্তফা হাকিম রিয়্যাল এস্টেট গোডাউন বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে। মিলের দখলে রয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৯৩ একর জমি। যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার জানান, শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানাধীন উত্তর কাট্টলী এলাকায় অবস্থিত ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্বপাশে সড়ক থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে সিটি গেটের কাছে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে এই স্টিল মিল। চার একর জায়গাজুড়ে বাউন্ডারির ভেতরে স্টিল মিল থাকলেও এর আশপাশে মিলের অব্যবহৃত জায়গা ও স্টাফ কোয়ার্টারসহ বিপুল পরিমাণ জায়গা বিক্রি হয়ে গেছে ব্যক্তিমালিকানায়।আলফা রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি গড়ে তুলেছে ‘নন্দন হাউজিং সোসাইটি।’ মোস্তফা-হাকিম গ্রুপও এখানে গড়ে তুলেছে হাউজিং। এসব হাউজিংয়ের সাইনবোর্ডও ঝুলানো হয়েছে।
নন্দন হাউজিং রীতিমতো বিশাল তোরণের মতো গেট বানিয়ে রেখেছে। দেয়া হয়েছে প্লটের সীমানা দেয়াল। মিলের অব্যবহৃত এসব জায়গা অনেক আগেই বিক্রি হয়েছে। প্লট ও ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে এসব জায়গা। ২০০৬ সালে টেক্সটাইল মিল চালানোর জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মোস্তফা হাকিম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী এম মনজুর আলম এই মিলের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন। অভিযোগ আছে, টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন তথা মিল চালানোর কথা বলে এটি কেনা হলেও কয়েক বছর চালিয়ে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। এই মিলকে বিভিন্ন পণ্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চাল, গম, প্লাস্টিক পণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের গুদাম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছিল বিশাল এই মিলটি। সরেজমিন গিয়ে টেক্সটাইল মিলের সামনে দেখা গেছে, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের সারি। আরএফএলের পাইপসহ গুদামজাত করা বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য নেয়ার জন্যই এসব ট্রাক অপেক্ষমাণ ছিল। তবে শর্ত অনুযায়ী মিল না চালানোর কারণে গত সপ্তাহে ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল কর্পোরেশন (বিটিএমসি)। আলফা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘নন্দন হাউজিং সোসাইটি’ নামে যে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে সেটি টেক্সটাইল মিলের স্টাফ কোয়ার্টারের জায়গায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও ক্ষুুদ্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ওবায়দুল হক (৬০) যুগান্তরকে বলেন, টেক্সটাইল মিলের স্টাফ কোয়ার্টারের জায়গাসহ মিলের অব্যবহৃত জায়গাতেই আলফা রিয়েল এস্টেট আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলফা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক এসকে সেনগুপ্ত।
তিনিই নন্দন হাউজিং সোসাইটি গড়ে তুলেছেন। এ বিষয়ে জানার জন্য আলফা রিয়েল এস্টেটের সাইনবোর্ডে দেয়া সাইট অফিসের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ফোনটি বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মিলের শেয়ার ক্রয় ও মোস্তফা হাকিম ভ্যালি নামে হাউজিং সোসাইটি গড়ে তোলা প্রসঙ্গে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের কর্ণধার ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘২০০৬ সালে সিকিউরিটি অব স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে আমরা মিলটির ৭০ ভাগ শেয়ার ক্রয় করি। মিলের ৪৫ কোটি টাকার দায়দেনা পরিশোধ করি। বিপুল বিনিয়োগে মিলটি চালু করেছিলাম। কিন্তু নীরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ না পাওয়ার কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। পুরনো মেশিনে উৎপাদন চালাতে গিয়ে পণ্যের গুণগত মানও ছিল খারাপ। এ কারণে পণ্য উৎপাদন হলেও তা বাজারজাত করতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়ি। সাম্প্রতিক সময়ে চায়না থেকে উন্নত মানের মেশিনারিজ আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ার বসানোর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মিলের একটি নাটবল্টুও নড়চড় হয়নি। মিলের জায়গায় মিল আছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার (১১ মে) সরকার তথা বিটিএমসি মিলটি তাদের নিয়ন্ত্রণে (টেক-বেক) নিয়ে নেয়। আমরা এ জন্য উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। এখন আইনগতভাবে যা হয় তাই হবে।’ মিলের জায়গায় হাউজিং আবাসন প্রতিষ্ঠান কীভাবে গড়ে তোলা হল- এ প্রসঙ্গে মনজুর আলম বলেন, ‘এই মিল ও মিল সন্নিহিত জায়গার মালিক ছিলেন সুলতানুর রশীদ নামে এক বিহারি (বোম্বেঅলা)।
তাদের কাছ থেকে সরকার মিলটি একবার ফেরত নিলেও পরবর্তী সময়ে আবার ফেরত দেয়। এর পর তারা শেয়ারের মাধ্যমে মিলের জায়গা বিক্রি করে। মিলের অপ্রয়োজনীয়, অব্যবহৃত ও অকেজো জায়গা মালিকপক্ষ টেন্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। আমরা টেন্ডারের মাধ্যমে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় এসব জায়গা কিনে সেখানে আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলসেও হয়েছে লুটপাট। সরকার ও ব্যাংকের দেনা-পাওনা পরিশোধ না করেই মিলের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করেছে। এমনকি মিলের যন্ত্রপাতিও তারা খুলে খুলে বিক্রি করেছে। মিলের স্থাপনা ভেঙে প্লট বানানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মিলটি বন্ধ রেখে হাজার হাজার শ্রমিককে বঞ্চিত করার পাশাপাশি সরকারের উৎপাদন ব্যাহত করে চুক্তি লংঘন করেছে। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, ঢাকা জুট মিলসের মেশিন-যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোর কিছুই অবশিষ্ট নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে দুটি ভবন ও একটি শ্রমিক কলোনি। ২৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ মিলটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। জমি বিক্রি করা না হলেও সেখানে ১০০ পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে। মিল মসজিদের সংলগ্ন ১২-১৩টি কক্ষ তৈরি করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। মিলের দুটি পুকুর থাকলেও কোনো দেয়াল না থাকায় তা বেদখল হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এমনকি মিলটিতে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের মনিটরিং নেই। সর্বশেষ ১৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোকিল টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, বেসরকারি খাতকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে দেশের জাতীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন কর্তৃক রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে প্রতিষ্ঠিত কোকিল টেক্সটাইল মিলস্ লি. বিক্রি করা হয়। দীর্ঘদিন পার হলেও ক্রেতা মিলটি চালু করেনি। ফলে সরকারের মিল বিক্রয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে। পাশাপাশি পাওনা পরিশোধ করা হয়নি।
No comments