চালসঙ্কট মারাত্মক
দেশে চলমান চালসঙ্কট ক্রমেই মারাত্মক রূপ ধারণ করছে। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পরও সরকারি গুদামে চাল সরবরাহে রাজি হচ্ছেন না মিলমালিকেরা। সারা দেশে জোরেশোরে ধান কাটা চললেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ছে না। উল্টো এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে সবধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা এবং এক বছরের ব্যবধানে ১৫ থেকে ২০ টাকা বৃদ্ধির ঘটনাকে বিশ্লেষকেরা স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না। পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা টের পেয়ে সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানির প্রক্রিয়া জোরদার করলেও সঙ্কটের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করছে না। হাওরে ভয়াবহ বন্যা এবং দেশের অন্যান্য এলাকায় মড়কের কারণে ধান উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশে এ বছর খ্যাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে গবেষণা সংস্থাগুলো। নতুন করে বেড়েছে ৫ টাকা : রাজধানীর পাইকারি চালের আড়ত ঘুরে দেখা যায়, বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে নতুন চাল আসছে। এ সময় দাম কমার কথা অথচ বাড়ছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মোটা চালের দর বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা এবং সরু ও মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে গড়ে ২০০ টাকা। বাজারে বর্তমানে মিনিকেট চালের বস্তা ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা, গুটি ও স্বর্ণা ১ হাজার ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা, পারিজা ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকা, লতা ও বিআর-২৮ চাল ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বাজারে ৫০ টাকার নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকায়। এ ছাড়া স্বর্ণা চাল ৪২ টাকা, পারিজা ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা উন্নত মানের মিনিকেট ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা, বিআর আটাশ চাল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা, উন্নত মানের নাজিরশাইল ৫৭ থেকে ৫৯ টাকা, হাস্কি নাজির ৪৪ টাকা, বাসমতি ৫৮ থেকে ৬২ টাকা, কাটারিভোগ ৭৮ থেকে ৮০ টাকা এবং পোলাও চাল ১০০ (পুরাতন), নতুন ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সঙ্কটের মূলে হাওরে বন্যা : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযাযী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের ল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। হাওরের পরিস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিøষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এবার বোরো মওসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ থেকে ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের ল্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তা কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। হাওরের ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। সেখান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের আশা করেছিল অধিদফতর। তবে সেখানকার বড় অংশের ধানই নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের। যদিও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেছেন হাওর ডুবে গেলেও চালের কোনো ঘাটতি হবে না। তার দাবি, বাংলাদেশে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। হাওরে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হলেও কোনো ঘাটতি হবে না। ভালো নেই চালকল মালিকেরাও দেশে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষই প্রথমত দায়ী করছেন চালকল মালিকদের।
খুচরা-পাইকারি ব্যবসায়ীদের আঙুলও তাদের দিকে। তারাই ধানের মওসুমে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য না দিয়ে সস্তায় ধান কেনেন, আবার কৃষকের ঘর খালি করার পর সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ান। বাস্তবতা হলো, তারাও ভালো নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রায় ১ হাজার ৬০০ চালকল রয়েছে। নানামুখী সঙ্কটে এগুলোর অর্ধেকই বর্তমানে বন্ধ। বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় অধিকাংশ চালকলের মালিক ধান কেনা শুরুই করতে পারেননি। তারা জানান, বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দামে ধান কিনে তা ভাঙিয়ে চাল করে বাজারে বিক্রি করে তাদের পোষাচ্ছে না। ফলে গত আমনের সময় মজুত থাকা ধান দিয়ে কোনোমতে ৫০০ চালকল চালু রয়েছে, বাকিগুলো বন্ধ। তাদের দাবি, বাজার থেকে ধান কিনে তা ভাঙিয়ে সরকারি গুদামে চাল দিতে গেলে প্রতি কেজিতে তিন থেকে চার টাকা লোকসান হবে। অবাস্তব পরিসংখ্যান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চলতি মওসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ২২ টাকা। চালে খরচ পড়ছে ৩১ টাকা। চলতি মওসুমের জন্য ধান ও চালের সরকারি ক্রয়মূল্য ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। এবার ৭ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। চাল কেনা হবে ৮ লাখ টন। ঘোষণা অনুযায়ী আজ ২০ মে’র মধ্যে চাল সরবরাহকারী মিলমালিকদের সাথে সরকারের চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ১০ শতাংশ চাল সরবরাহের চুক্তিও হয়নি বলে জানা গেছে। কারণ হিসেবে মিলমালিকেরা জানান, সরকারি দামে চাল সরবরাহ করতে চাইলে মিলমালিকদের প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা লোকসান গুনতে হবে।
সরকার এ বছর প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। চালের দাম ৩৪ টাকা। গত বছর ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় ২৩ টাকা দরে ধান এবং ৩২ টাকা দরে চাল ক্রয় করে সরকার। কিন্তু ক্রয়নীতিতে দুর্বলতা এবং দলীয় লোকদের মধ্যস্বত্ব ভোগের কারণে কৃষক এ দাম পায়নি। সরকার ৯২০ টাকা দর বেঁধে দিলেও মওসুমের শুরুতে কৃষক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এ কারণে এ বছর অনেক কৃষক জমিতে ধানচাষ থেকে বিরত থেকেছেন বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, সরকারের পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। মিল নেই মোট চাহিদা, উৎপাদন, জোগান এবং জনসংখ্যার হিসেবেও। অবস্থানে অনড় এনবিআর চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে শুল্ক বৃদ্ধিজনিত কারণে আমদানি কমে যাওয়ার কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার পর আমদানি কমে যায়। আমদানি শুল্ক কমানোর বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও তাতে এনবিআরের সাড়া মিলছে না। বাধ্য হয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিজেই বিদেশ থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডর (এনবিআর) হিসেবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে প্রায় দুই লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন। সরকারি হিসেবে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে মোট দেশজ চাহিদার অতিরিক্ত। স্বাভাবিক কারণেই সরকারিভাবে চাল রফতানির ঘোষণার বাস্তবায়নও দেখেছে দেশবাসী। অবশ্য আমদানিকারকেরাও বসে নেই। এক বছরে আমদানি করা হয়েছে ৮ লাখ টনের মতো। নিজস্ব তথ্যউপাত্ত ঘেঁটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই। অথচ এক মাস ধরে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অত্যাবশ্যকীয় এ পণ্যটির দাম বেড়েই চলেছে। সরকারিভাবে ১০ টাকায় চাল বিক্রির কার্যক্রম চললেও সাধারণ মানুষকে প্রতি কেজি চালের জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫৮ টাকা পর্যন্ত।
No comments