অদ্ভুত আঁধার এক!
১৯৬২ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য ড. মো. ওসমান গণি প্রধান অতিথি হিসেবে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, ‘সম্ভবত শিক্ষকতাই একমাত্র পেশা, যাকে দার্শনিক দিক থেকে যুগে যুগে গৌরবান্বিত করে তোলা হয়েছে এবং বৈষয়িক দিক থেকে করা হয়েছে চরম অবহেলা।’ আজ একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রয়াত ড. মো. ওসমান গণির এ মূল্যবান কথাগুলো আমার খুবই মনে পড়ছে। যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আগ্রহ ও নির্দেশে সেসব উপজেলায় একটি করে কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকাল, অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যানুপাত এবং বিগত বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল- এ সবকিছুর ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেই চূড়ান্ত অনুমোদনটি দেয়া হয়। সরকারিকরণের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গত বছর দফায় দফায় তালিকাভুক্ত অন্তত তিনশ’ কলেজের পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশক্রমে কলেজে কলেজে এখন চলছে ‘ডিড অব গিফট’ বা দানপত্র সম্পাদনের কাজ। বোধ করি তা-ও চলতি মে মাসেই সম্পন্ন হয়ে যাবে। এর পরই জারি হবে সরকারি আদেশ (জিও)। যে কোনো স্তরেরই হোক আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে শত রকমের আর্থিক দৈন্যদশা, দান-অনুদান, অভাব-অভিযোগ, বৈষম্য, অনিশ্চয়তা এবং দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা। মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা স্তরে একসঙ্গে এত অধিকসংখ্যক প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করা আমাদের দেশে এই প্রথম। এমন একটি মহতী উদ্যোগ ও কার্যক্রমে কেবল বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী নয়, বলা যায় সর্বস্তরের মানুষের মাঝেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়েছে। আনন্দ-উল্লাস ও উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি সরকারীকরণের খবরে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে অনেকের মনেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুর্ভাবনাও কিন্তু দেখা দিয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুর্ভাবনার প্রধান কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। এমনও নজির আছে কলেজ সরকারীকরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালে, সরকার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পদ-সম্পত্তির দানপত্র সম্পাদন এবং সে আলোকে সরকারি আদেশও (জিও) জারি হয়েছে; অথচ আজ পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়ন না হওয়ায় তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন হিসেবে এমপিও বাবদ প্রাপ্ত টাকাটা উত্তোলন করতে সক্ষম হলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে কলেজপ্রদত্ত অংশের টাকা এক বছর ধরে উত্তোলন করতে পারছেন না। এরূপ দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে তাদের মাঝে বিরাজ করছে নানা ধরনের দুর্ভাবনা।
এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী সরকারি চাকুরেদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৯। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারি সুবিধাদিসহ ৬০ বছর এবং বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি বেতনভাতা ছাড়া ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। অনেকেরই বর্তমানে ৫৭, ৫৮ কিংবা ৫৯ বছর চলছে। সবার সঙ্গে প্রতীক্ষার প্রহর গুনলেও নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন। অন্যদিকে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর গত বছরই জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়োগ নিষেধাজ্ঞাসহ অর্থব্যয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। অনেক কলেজে নিয়মিত অধ্যক্ষ নেই। একইভাবে উপাধ্যক্ষ পদ শূন্য। আবার অনেক কলেজে একই সঙ্গে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ দুটি পদই শূন্য। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে কোনোরকমে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব কারণে শিক্ষাদান ও দাফতরিক কার্যক্রম ভীষণভাবে বিঘিœত হচ্ছে। আবার না সরকারি, না বেসরকারি অবস্থানে থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের মনোবলও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে সরকারীকরণের তালিকাভুক্ত বহু কলেজে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বকেয়ার পরিমাণটি হাজার হাজার নয়, ব্যক্তিগতভাবে এক একজন শিক্ষকেরই কয়েক লাখ টাকা করে হয়ে যাবে। শত রকমের দৈন্যদশার মাঝ দিয়ে দিনাতিপাত করলেও তাদের মনে সুদৃঢ় আশা, একদিন না একদিন তারা যার যার বকেয়া টাকা পেয়ে যাবেন। শুধু কি তাই, বেতনভাতা হিসেবে বকেয়া পড়ে রয়েছে আট/দশ, এমনকি পনের/বিশ বছর আগে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদেরও লাখ লাখ টাকা। এ নিয়ে বিপত্তি দেখা দিয়েছে সরকারীকরণ প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে। সরকারের পক্ষ থেকে নাকি বলা হচ্ছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতনাদি পরিশোধ করা যাবে না। অথচ প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে রয়েছে পর্যাপ্ত টাকা। শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতনভাতা পরিশোধের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি জেনে কেবল ছাপোষা ভুক্তভোগী শিক্ষক নন, সচেতন সবাই হতবাক হয়ে পড়েছেন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ কী আজব ব্যবস্থা! নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেও লাখ লাখ টাকার কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা যাবে না! এ যে দেখছি কুক্ষণে দুষ্টগ্রহের মতো আবির্ভূত হয়ে ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ গ্রাস করতে বসেছে হাজার বছর ধরে লালিত বাঙালির বিবেককে! প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সামর্থ্য যখন ছিল না, তখন শিক্ষকরা নিজেদের অসুবিধা ও কষ্ট হলেও বাকি বকেয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তহবিলে পর্যাপ্ত টাকা স্থিতি থাকার পর এখন তাদের এ সবকিছু মেনে নিতে হবে কোন যুক্তিতে? বিশেষ করে আর্থিক সামর্থ্য যেখানে রয়েছে এবং সরকারীকরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে? পাকিস্তান আমলে, এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরও সরকারি তহবিল থেকে বেসরকারি একজন কলেজ শিক্ষককে অনুদান হিসেবে দেয়া হতো মাসিক সামান্য ক’টি টাকা, যার পরিমাণ একশ’ টাকারও কম। বাকি-বকেয়াধারীদের তালিকায় তারাও রয়েছেন। অবসর জীবনে থাকা ওইসব শিক্ষকের সরকারীকরণের ফলে কোনোরকমের আর্থিক সুবিধা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ কোনো এলাকা নয়, সারা দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানে বিরাজ করছে একই পরিস্থিতি। একজন শাসক যত সহৃদয়, সৎ, দক্ষ ও কৌশলীই হোন না কেন, তার একার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসন করা সম্ভব নয়। কৌটিল্য যথার্থই বলেছেন- এক চাকায় যেমন রথ চলে না, সে-রূপ রাজ্য পরিচালনা রাজার একার দ্বারা সম্ভব হয় না। তার জন্য প্রয়োজন মন্ত্রী, সেনাপতি, সৈন্যসামন্ত ও পরিষদবর্গের। সবাই মিলে রাজাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে বলেই রাজার পক্ষে সম্ভব হয় সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা করা। যে কোনো ভালো কাজে সরকারকে সবার সহযোগিতা করা দরকার। আমরা চাই প্রকৃত পরিস্থিতিটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসুক। সত্যিকার অর্থে এখন এ নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এক একজন যার যার মতো করে এক এক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন। আমরা চাই কেবল ভুক্তভোগী শিক্ষকদের স্বার্থে নয়, সরকারেরও স্বার্থে শিক্ষকদের বকেয়া বেতনভাতাদি পরিশোধের ব্যবস্থা করা হোক। শিক্ষকরা না জাতির মেরুদণ্ড? তারা না জাতি গঠনের কারিগর? তাহলে সামান্য কিছু টাকার জন্য সরকার দুর্নাম কুড়াতে যাবে কেন?
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক
No comments