পানির জন্য হাহাকার
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ ও রমজানের কারণে পানির চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু পানির সরবরাহ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে। অনেক এলাকায় রান্না, ধোয়ামোছাসহ জরুরি কাজ কিছুই ঠিকভাবে হচ্ছে না। কোনো কোনো এলাকায় মসজিদেও পানির সংকট তৈরি হয়েছে। মুসল্লিরা অজু করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। মহল্লায় মহল্লায় পানির জন্য হাহাকার চলছে। পানির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও পাম্প ঘেরাও করছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সুযোগে ওয়াসার একশ্রেণীর অসাধু কর্মচারী পানি বাণিজ্য শুরু করেছে। এক গাড়ি পানির দাম ৫শ’ টাকা হলেও দেড় হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে কোনো কোনো এলাকায়। পানি না পেয়ে অনেকে মিনারেল বোতলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। অনেকেই গোসলসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আসছেন আত্মীয়র বাসা থেকে। হাতিরঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন পুকুর এবং লেকেও গোসল করতে দেখা গেছে অনেককে। পানির এমন সংকটের কারণে রাজধানীবাসীর অসন্তোষ বাড়ছে। ঢাকা ওয়াসার কাছে পানি সংকটের সমাধান না পেয়ে প্রায় প্রতিদিনই নগরীতে বিক্ষোভ, রাস্তা ও পানির পাম্প অবরোধ এবং ভাংচুরের মতো ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে অনেক এলাকায় দিনে দু’একবার পানি সরবরাহ হলেও তাতে দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকায় পান করা যাচ্ছে না। পানির এমন পরিস্থিতিতে অনেকে ডায়রিয়াসহ নানাবিধ পেটের পীড়ায় ভুগছেন। পানি নিয়ে এমন নাকাল অবস্থা চললেও সংকট স্বীকার করতে রাজি নন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বর্তমান সরবরাহ বেশি। দৈনিক রাজধানীতে চাহিদা ২৩০ কোটি লিটার। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা ২৪৫ কোটি লিটার। লোডশেডিং, জেনারেটরের অকার্যকারিতা এবং পানির স্তর নেমে গেলে কখনও কখনও অবশ্য উৎপাদন কমে। তবে বর্তমানে উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি। যেসব এলাকায় সংকট সেখানে সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা আছে। তাই পানি যাচ্ছে না। তবে আমরা গাড়িতে করে পানি সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি। তিনি এই সমস্যাকে ‘সামান্য’ হিসেবে মনে করেন। ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে চাহিদার ৭৮ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ। বাকি ২২ শতাংশ পানি রাজধানীর পাশের বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নিয়ে শোধন করে কিছু কিছু এলাকায় সরবরাহ করা হয়। সায়েদাবাদ-১, সায়েদাবাদ-২ ও চাঁদনীঘাটে তিনটি শোধনাগার এবং ৭৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে মোট চাহিদার পানি উৎপাদন করা হয়। বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে নদী দুটির পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দূষণের মাত্রা বেড়েছে। তাই শোধন করার ক্ষমতা কমেছে। বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে পানি উত্তোলনে সমস্যা হচ্ছে।
এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলনও কমেছে। ফলে চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে। যে কারণে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। তবে তার এই বক্তব্যের সঙ্গে খোদ ওয়াসার অন্য কর্মকর্তারাই একমত নন। নাম প্রকাশ না করে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ২৩০ কোটি লিটার পানির চাহিদা হলেও ২০৫ থেকে ২১০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হচ্ছে। বাকি ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি আছে। এর সঙ্গে সিস্টেম লস যোগ করলে ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি। রাজধানীর শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, মুগদা, মাদারটেক, মানিকনগর, মাণ্ডা, যাত্রাবাড়ী, নয়াপল্টন, রাজারবাগ, শান্তিনগর, মগবাজার, চামেলীবাগ, টিকাটুলি, হাজারীবাগসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, বাড্ডা, কুড়িল, শাহজাদপুর, পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোড, সতীশ সরকার লেন, মুরগিটোলা, মিরহাজীরবাগ, জুরাইন, পোস্তগোলা, সুরিটোলা, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ১৫ দিন থেকে প্রায় এক মাস ধরে চলছে তীব্র পানি সংকট। খিলগাঁওয়ের (বি ব্লক) বাসিন্দা ওয়াহিদুজ্জামান জানান, প্রায় এক মাস ধরে তার এলাকায় পানির তীব্র সংকট চলছে। পানির জন্য ওয়াসার স্থানীয় অফিসে গিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। অফিস থেকে বলা হয়, বেশির ভাগ গাড়ি নষ্ট। এই সংকট দেখিয়ে ৫শ’ টাকার এক গাড়ি পানির দাম দেড় হাজার টাকা নেয়া হয়। এছাড়া কখনও বলা হয়, ভিআইপিদের পানি দিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগে গভীর রাতে এক-দেড় ঘণ্টার জন্য সামান্য সরবরাহ হতো। কিন্তু তিন-চার দিন ধরে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বাড়িতে দু’দিক থেকে পানির লাইন নেয়া আছে। সেসব বাড়িতেও পানির সংকট আছে বলে জানা গেছে। এলাকার হাজার হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। উত্তর শাহজাহানপুরের উত্তরা ব্যাংক গলির বাসিন্দা ওবায়দুল হক বলেন, অন্তত ২৫টি বাড়িতে প্রায় এক মাস ধরে পানি নেই। পানির জন্য ওয়াসার ৬ নম্বর মডস জোনে গেলে বলা হয়, বিদ্যুৎ সংকট এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি জানান, টাকা দিয়ে গাড়িতে করেও ওয়াসা থেকে পানি মিলছে না। পানির সংকটের কারণে তিন দিনে একদিন গোসল করতে হচ্ছে। রান্না আর বাচ্চার গোসলের জন্য বোতলের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। হাজারীবাগের বাসিন্দা হুমায়ুন আহমেদ মন্টু জানান, ১৫ দিন ধরে পানির সংকটের কারণে ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এ অবস্থায় রোববার কয়েকশ’ মানুষ কলস-বালতি নিয়ে মিছিল বের করে। এটি হাজারীবাগ বোরহানপুর ১০নং গলি থেকে শুরু হয়ে হাজারীবাগ পার্কের পাম্প অফিস ঘেরাও করে। তিনি বলেন, ওই এলাকায় হাজারীবাগ ও কালুনগর পাম্প থেকে পানি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু উভয় পাম্পই বর্তমানে নষ্ট। এ কারণে হাজারীবাগের মনেশ্বর ২য় লেন, কাজীরবাগ, কুলাল মহল, বাড্ডা নগর লেন, কালুনগর, এনায়েতগঞ্জ, হাজারীবাগ রোড, নিলাম্বর সাহা রোড, ভাগলপুর এলাকায় ১৫ দিন যাবৎ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে রাজধানীর অন্যান্য এলাকা থেকেও বাসিন্দারা টেলিফোনে পানির সংকট নিয়ে নিজেদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। মিরহাজীরবাগ এলাকার বাসিন্দা কাজী এমাদউদ্দিন বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে পানির সমস্যা হচ্ছে। সারাদিনে এক বেলা পানি পাওয়া যায়। মিরবাগের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেইন রবিন বলেন, এক মাস ধরে পানির সংকটে আছি। গাড়িতে করেও ওয়াসার সরবরাহ যথেষ্ট নয়। যখন গাড়ি আসে, কাউকে এক বালতি বা কলসের বেশি পানি দেয়া হয় না। এ অবস্থায় এই এলাকার অনেকেই হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজের কাছে গিয়ে গোসল সেরে আসে। মিরপুরের মনিপুরিপাড়ার বড়বাগ এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান পলাশ বলেন, কয়েকদিন আগে একটানা তিন দিন পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল। বলা হয়েছিল, পাম্প নষ্ট। পরে ঠিক করেছে। কিন্তু পানি প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত।
No comments