সন্তানদের দেওয়ার মতো সময় কোথায়? by উম্মে মুসলিমা
প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের পর এসবের কারণ ও ফলাফল নিয়ে নতুন নতুন গবেষণা ও বিশ্লেষণ উঠে আসে। এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে জঙ্গি তৎপরতা। সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়া কিশোর-তরুণদের অবস্থা ও অবস্থান, তাদের মানসিকতা, শিক্ষা, বন্ধুত্ব, পরিবারের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে আলোচনার ঝড় উঠেছে। সন্তান সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্যকেও দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে উন্নয়ন-শিল্পায়ন-বিশ্বায়নের এ যুগে নাগরিক জীবনে অণু পরিবার ব্যবস্থা যেখানে প্রায় অবশ্যম্ভাবী, সেখানে সন্তানদের সঙ্গদানের জন্য সময় দেওয়া বাস্তবে কতটা সম্ভব? যৌথ পরিবারের ভালো ও মন্দ দিক দুটোই রয়েছে। যৌথ পরিবার ভাঙনের শুরুতে আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল বলে প্রফুল্ল রায় তাঁর নাটকে বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করেছেন। তাঁর সে নাটকের মঞ্চায়নের সফলতা বা দর্শকপ্রিয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে কি ভাঙন ঠেকানো গেছে? গ্রাম পুড়লে দেবালয় এড়ায়? এককালে যৌথ পরিবারে বাস করা আজকের প্রবীণদের অনেকেই পুরোনো দিনের কথা মনে করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। বলেন আহা! কী দিন কাটিয়েছি আমরা! দুপুরে একসঙ্গে পঁচিশটা পাত পড়ত। ঈদে-উৎসবে পুরো বাড়ি যেন মেলার ময়দান। মনে আছে, আমাদের যৌথ পরিবারে বিবাহিত ফুফুরা একসঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসতেন। ফুফাতো ভাইবোনদের আগমনবার্তার আনন্দেই আমাদের রাতে ঘুম হতো না।
আসার পর তো আর কথাই নেই। ফুফুরা বাপের বাড়ি নাইওরে আসতেন দু-এক মাস আরাম করার জন্য। আমরা খেলাধুলা, গল্পগুজব, গান, নাটক, গল্পের বই নিয়ে মেতে থাকতাম। কিন্তু ওই রাবণের গুষ্টির রান্নার আয়োজন, রান্না, খাওয়ানো, গোছানো, পিঠে পুলি তৈরি এমনকি শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে ফুফুদের জন্য চিড়া-মুড়িমুড়কি-নাড়ু-আচার-মসলা বানিয়ে বস্তা বাঁধতে হতো আমাদের মা-চাচিদের। তাঁরা চলে যাওয়ার পর মা-চাচিরা রীতিমতো শয্যাশায়ী হয়ে পড়তেন। আবার অন্যদিকে ফুপুরাও শ্বশুরবাড়িতে তাঁদের ননদদের জন্য প্রাণপাত করতেন। তার মানে যত মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সবই নারীর। প্রফুল্ল রায় যতই কান্নাকাটি করুন, সময়ের প্রয়োজনে অণু পরিবার বানের জলের মতো অবিরল গতিতে নগরজীবনে প্রবেশ করেছে এবং অনবরত করছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। তৈরি পোশাকশিল্প খাতে ৩০ লাখ শ্রমিকের ৯০ শতাংশই নারী, যাঁরা শহরে বাস করেন। কর্মজীবী বিবাহিত নারীদের সন্তানেরা শিক্ষার্থী। যেসব নারী রোজগেরে নন, তাঁরা সন্তানদের স্কুলে ঢুকিয়ে মাদুর বিছিয়ে ছুটি পর্যন্ত বসে থাকেন, যাঁরা কাছেপিঠে থাকেন তাঁরা বাসার কাজ সেরে নিতে আসেন। অফিস বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম, সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়া করা বাবার সংখ্যা আরও কম। কারণ, বাবাদের অফিস-আদালতে কাজ করতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়।
বাড়ি ফিরে তাঁদের একটু আরাম না করলে চলে? কিন্তু কর্মজীবী নারীর সে উপায় নেই। সমাজসৃষ্ট শ্রম বিভাজনের জাঁতাকলে পড়ে তাঁকে ঘরে-বাইরে সবখানেই কাজ করতে হয়। তাহলে সন্তানদের সময় দেবেন কারা? সময় দেওয়ার কী আছে? টিভি, কার্টুন, স্মার্টফোন, ট্যাব, ইন্টারনেট আছে না? এগুলো নিয়েই তো তারা দিব্যি আছে। তা ছাড়া স্কুল আর কোচিং করেই তারা হাঁপিয়ে ওঠে, মা-বাবার সঙ্গে কাটানোর মতো সময় কোথায় তাদের? ফেসবুকের বদৌলতে গণমাধ্যমে না আসা সংবাদও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী একটা প্ল্যাকার্ড হাতে বাবা-মা, এবারের ঈদের কেনাকাটায় টাকা চাই না, সময় চাই লিখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে মা-বাবাদের এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলেন, টাকাপয়সা কামাই করছি তো ওদের জন্যই। শুধু সময় খেলে পেট ভরবে? আবার সব বয়সের ছেলেমেয়েই মা-বাবার অতিরিক্ত সময় দেওয়াটাকে ভালোভাবে নেয়, তা-ও বলা যাবে না। কারণ, সমবয়সী বন্ধুর চাহিদা মেটানো মা-বাবার পক্ষে সম্ভব নয়। দেখা গেল, মা সন্তানের সামনে বসে বেদবাক্য আওড়ে যাচ্ছেন, আর সন্তান মোবাইল বা আইপ্যাডে চোখ রেখে ক্রমাগত হুঁ-হাঁ করে যাচ্ছে। একদিন বিকেলে এক মা তাঁর চার-পাঁচ বছরের শিশুকে নিয়ে হাঁটছিলেন। শিশুটি মাকে ক্রমাগত এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে। মায়ের এক কানে মোবাইল, আরেক হাতে তসবি। তাঁর মনোযোগ নষ্ট করে দেওয়ার জন্য তিনি মাঝে মাঝেই সন্তানের মাথায় চাঁটি মারছিলেন।
কর্মজীবী মা বলবেন, সারা দিন খেটেখুটে বাড়ি ফিরে আবার রাঁধতে বসি। তারপর খাওয়ানো, ধোয়াধুয়ি। বাচ্চাদের সময় দেব কখন? গৃহব্যবস্থাপক মায়েরা বলেন, যাদের সময় দেব তাদেরই-বা সময় কোথায়? তাদের হয় স্কুল, নয় কোচিং, নয় প্রাইভেট। বাবারা কী বলেন? বাচ্চারা মায়ের সঙ্গেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বাবাদের সান্নিধ্য ওদের এমন পছন্দ নয়। কিন্তু সময় বের করা আসলে কঠিন নয়। রবীন্দ্রনাথকে শুধু লেখালেখি ছাড়াও হাজারো সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংশ্লিষ্ট থাকতে হয়েছে। তাই বলে কি তিনি কখনো লেখালেখির সময় পাচ্ছিনে বলেছেন? খ্যাতিমান এক লেখকের লেখা আদায় করে নেওয়ার জন্য জনৈক প্রকাশক সব ব্যয় বহন করে তাঁকে কোনো নিরিবিলি স্বাস্থ্যকর স্থানে পাঠিয়েছিলেন। দুই মাস পর লেখা আদায় করতে গিয়ে এক পাতা লেখাও পাননি। নিরবচ্ছিন্ন অবসরও সৃষ্টিশীলতার অন্তরায়। আমরা বাঙালি জাতি আড্ডাপ্রিয়। নির্ভেজাল আড্ডা মারি। অবশ্য আড্ডা থেকে তাৎক্ষণিক লাভ না হলেও সৃষ্টিশীল মানুষ তঁাদের শিল্প-সাহিত্যের জন্য অনেক রসদ পেয়ে যান বলে দাবি করেন। কয়েক দিন আগে এ দেশে বেড়াতে আসা মেলিসা টেনিসন নামের মার্কিন এক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে আড্ডার জন্য বাসায় ডাকলাম। সবাই গোল হয়ে বিছানায় বসে আড্ডার প্রস্তুতি নিচ্ছি, মেলিসা তার জাদুর ঝুলি খুলে বসল। হাত-কান-গলার গয়না বানানোর হাজারটা খুচরো জিনিস মেলে ধরল। সবাইকে বলল যে যার খুশিমতো হাতে গয়না বানাও আর মুখে আড্ডা পেটাও।
প্রবাদে আছে, সাধারণ মানুষ সময় কাটায় আর বুদ্ধিমানেরা সময় ব্যবহার করে । প্রথম আলোয় গত ২৫ আগস্ট প্রকাশিত মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ক্লাস লেখাটি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে সম্পৃক্ত হতে ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করতে হবে। কেবল জিপিএ–৫ পাওয়ার জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়তে না দিলে যত ভালো রেজাল্টই হোক, প্রত্যাশিত উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মানবিক বিকাশের সহায়ক। মানবিকতাহীন পাণ্ডিত্য সমাজের সম্পদ না হয়ে আপদে পরিণত হয়। একইভাবে উগ্র ধর্মান্ধ মানুষের মধ্যেও ধর্মজ্ঞানের পাণ্ডিত্য তাকে মানবিকতার দীক্ষা থেকে বঞ্চিত করে। এ ব্যস্ততার যুগে প্রয়োজনের বাইরে এতসব করার সময় কোথায় যাঁরা বলেন, বিখ্যাত লেখক এইচ জ্যাকসন ব্রাউন তাঁদের বলেন, বোলো না যে তুমি সময় পাও না। কারণ, প্রতিদিন তুমি যে কয় ঘণ্টা সময় পাও, ঠিক সে কয় ঘণ্টাই পেয়েছিলেন হেলেন কেলার, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, মাদার তেরেসা, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, টমাস জেফারসন ও আলবার্ট আইনস্টাইন। পরিবারে সন্তানদের গুণগত সময় দেওয়ার কথাও বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। আবার কেবল সন্তানদেরই সময় দিয়ে সংস্কৃতিমান করে তুললে হবে না, বাবা-মা বা অভিভাবকদের পারস্পরিক সম্পর্কেও সুসময় বিরাজ রাখা বাঞ্ছনীয়।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
muslima.umme@gmail.com
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
muslima.umme@gmail.com
No comments