বইয়ের বন্ধুত্ব সীমানা ছাড়িয়ে by মাজহারুল ইসলাম

আজ ১ সেপ্টেম্বর কলকাতার রবীন্দ্র সদনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে ১০ দিনব্যাপী বাংলাদেশ বইমেলা কলকাতা । ষষ্ঠবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই বইমেলা। এবারের মেলার প্রতিপাদ্য বইয়ের বন্ধুত্ব সীমানা ছাড়িয়ে । সত্যিই তো, জ্ঞানের আধার যে বই, সে তো কোনো ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই বইমেলা? এই প্রশ্নের উত্তরে এককথায় বলা যায়, বাংলাদেশের বই এবং লেখকদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন। এটা তো দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গের বই ও পত্রিকা বাংলাদেশে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরাও এ দেশের পাঠকদের কাছে পরিচিত। প্রবীণ কথাসাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক তো বটোই; পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ছোট কাগজ এবং পত্রিকাগুলোর শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত নতুন কোনো লেখকের লেখা ভালো লাগলে এ দেশের পাঠক আগ্রহভরে বইয়ের স্টলগুলোতে তাঁদের বইয়ের খোঁজ করেন। এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে বাংলাদেশের বই ও পত্রিকা সহজলভ্য নয়। বাংলাদেশের হাতে গোনা অল্প কয়েকজন কথাসাহিত্যিক, কবি ও প্রাবন্ধিক পরিচিত ওখানকার পাঠকদের কাছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা যাতে বাংলাদেশের বই সহজে পেতে পারেন এবং এ দেশের নবীন-প্রবীণ লেখকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন বা একটি ধারণা পেতে পারেন—এই উদ্দেশ্যেই মূলত বাংলাদেশ বইমেলা কলকাতা র আয়োজন করা হচ্ছে। এই আয়োজন তখনই সফল হবে,
যদি আমরা গ্রন্থসেতু নির্মাণ করতে পারি। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখক, পাঠক, প্রকাশক, সমালোচক ও নীতিনির্ধারকদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে। বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা যদি পরস্পরের লেখা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন এবং তা স্বদেশের পাঠকদের জানান, তাহলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখক এবং তঁাদের বইয়ের একটি পরিচিতি গড়ে উঠবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, গত শতকের সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে সেই সময়ের উদীয়মান তরুণ লেখক হুীমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস পড়ে ভালো লাগার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বইটি সম্পর্কে দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একইভাবে এ দেশের গল্পকার হাসান আজিজুল হক সম্পর্কেও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সমালোচকেরা নানা সময়ে নানা লেখা লিখেছেন। ফলে এই দুজন কথাসাহিত্যিকের অনুরাগী পাঠকগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠেছে। প্রকাশকদের ভূমিকা সম্পর্কে বলা যায় যে তাঁদের পেশাদার ও আন্তরিক হতে হবে। এমন কোনো কাজ বা কর্মকাণ্ড তাঁরা করবেন না, যাতে বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের মূল প্রকাশকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। একসময় গত শতকের সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের বটতলার প্রকাশকেরা পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় লেখকদের (ফাল্গুনী, নীহার, আশুতোষ, নিমাই, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ) অসংখ্য নকল বই প্রকাশ করেছিলেন। পাশাপাশি আবার ওই সময়েই নওরোজ সাহিত্য সংসদের (নসাস) মতো পেশাদার প্রকাশক সত্যজিৎ রায়ের বই তাঁর অনুমতিক্রমে প্রকাশ করেছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তখন অসাধু প্রকাশকের অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্প্রতি এমন প্রকাশকের কথা আমরা জানি, যিনি বিনা অনুমতিতে হুেমায়ূন আহমেদ, গোলাম মুরশিদসহ কয়েকজন লেখকের বই প্রকাশ করেছেন এবং সেসব বই দেদার বিক্রি হচ্ছে কলেজ স্ট্রিট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত। এতে বইগুলোর মূল প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের বইয়ের প্রকাশকেরা কলকাতার সেই প্রকাশককে সতর্ক করলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকদের সচেতন হতে হবে এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নীতিনির্ধারকদেরও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে দুই বাংলার বইয়ের বাজার প্রসার ও লেখকদের পাঠকের কাছে পরিচিত করার বিষয়ে। বাংলাদেশে অবশ্য ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের বাজার গড়ে উঠেছে। এ দেশের ঈদসংখ্যায়ও পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় লেখকদের লেখা ঠাঁই পায়। কবিতা উৎসবসহ নানা সাহিত্য আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গের কবি-লেখকদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাঁদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে ঋদ্ধ হন এ দেশের লেখক ও পাঠকেরা। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পশ্চিমবঙ্গের নীতিনির্ধারকেরও অনেক ক্ষেত্রে তা করছেন। বিশেষত বাংলাদেশ বইমেলা কলকাতা আয়োজনে তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে এবং যাচ্ছে। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ বইমেলা কলকাতা প্রতিবছর আয়োজন করা সম্ভব হতো না।
উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছর বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সহযোগিতায়, কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় এবং বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির আয়োজনে বাংলাদেশ বইমেলা কলকাতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রায় ৫০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণ করছে। এবারের বইমেলার উদ্বোধক ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। প্রধান অতিথি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাধ্যমিক ও স্কুল শিক্ষামন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সম্মানীয় অতিথি বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক শঙ্খ ঘোষ। অন্যান্যবারের মতো এবারও প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেলার মঞ্চে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করবেন। মেলার সময়টায় রবীন্দ্র সদনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সব সময়েই পরিণত হয় একখণ্ড বাংলাদেশে। এবারের মেলায় পাঁচটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। বাঙালি জাতি ও জাতীয় নায়ক , গ্রন্থসেতু নির্মাণ: লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা , প্রসঙ্গ: লালনসংগীত , প্রকাশনায় নারী এবং দুই বাংলার শিশুসাহিত্য: রহস্য, রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চার । আশা করছি, এবারও মেলার ১০টি দিন বইপ্রেমীদের পদচারণে আনন্দমুখর হয়ে থাকবে।
মাজহারুল ইসলাম: বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সহসভাপতি ও অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী।

No comments

Powered by Blogger.