দুদককে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে
ঘটনাটি খুব আগের নয়। গত বছরের জানুয়ারির। জেনারেল বুদি গুনাওয়ান ইন্দোনেশিয়ার পুলিশপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগের দশ দিন না পেরোতেই ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। দেশটির দুর্নীতি দমন সংস্থা কেপিকের কমিশনার বামবাং উইদান্তোকে গ্রেফতার অভিযানে নামে তার বাহিনী। কারণ এর বছরখানেক আগে কেপিকে গুনাওয়ানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। তদন্ত করতে গিয়ে তার ব্যাংক হিসেবে ৪৩ লাখ ডলারের খোঁজ পায় কেপিকে। এ টাকা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমেই গুনাওয়ান অর্জন করেছে, তদন্তে এর প্রমাণও হাজির করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। অথচ রাষ্ট্রপতি উইদাদো এমন একজনকেই পুলিশপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন, যিনি শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই নন, দায়িত্ব পেয়েই নিজের ক্ষোভ মেটাতে খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন কেপিকের বিরুদ্ধে। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষ। চুপ না থেকে ‘সেভ কেপিকে’ স্লোগানের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন আন্দোলনে। শেষ পর্যন্ত সরকার জনতার আন্দোলনের চাপে পুলিশপ্রধান হিসেবে গুনাওয়ানের নিয়োগ বাতিল করতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমে কেপিকের প্রধান আব্রাহাম সামাদ ও সদস্য বামবাং উইদান্তোর মর্যাদা ফিরিয়ে দিতেও বাধ্য হন রাষ্ট্রপতি য়োকো উইদাদো।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা কেপিকের ওপর ইন্দোনেশিয়ার জনগণের এত আস্থার কারণ কী? কেনইবা তারা কেপিকে’কে বাঁচাতে এভাবে মাঠে নেমে পড়েন। এ ক্ষেত্রে কিছু তথ্যের দ্বারস্থ হলেই হয়তো বিষয়টি খোলাসা হবে। ২০০৪ থেকে ২০০৯- এই পাঁচ বছরে যাদের দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত, বিচার ও অভিযোগ প্রমাণ করেছে সংস্থাটি, তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক রথী-মহারথী, প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা কারা? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জেনে হয়তো পিলে চমকাবে? এর মধ্যে ছিলেন সেদেশের ‘৪৫ সংসদ সদস্য, আট মন্ত্রী, আট প্রাদেশিক গভর্নর, একজন গভর্নর, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের তিন প্রসিকিউটর, তিন রাষ্ট্রদূত, চার কাউন্সিল জেনারেল এবং একজন পুলিশপ্রধান।’ এজন্যই বলা হয়ে থাকে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে এশিয়ার শক্তিশালী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম ইন্দোনেশিয়ার কেপিকে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন সংস্থা দুদকের অবস্থান কী? দুদকের ক্ষেত্রে সরকারি এমন কোনো চাপ এলে কি জনতা ঢাল হবে? টিআইবির সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, শতকরা মাত্র ৯.১ ভাগ মানুষ মনে করে দুদক ভালো কাজ করছে। বাকি ৮২.৯ ভাগ মানুষের আস্থা নেই প্রতিষ্ঠানটির ওপর। তারা মনে করে, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বিবেচনা করে দুদক ব্যবস্থা নেয়।
গত মার্চে কমিশন পুনর্গঠনের আগে প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি দেয়ার হিড়িক পড়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, এর মাধ্যমে শুধু রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য নয়, কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও লাভবান হয়েছেন। এ কারণে সে সময় দুদককে অনেকেই দায়মুক্তি কমিশন বলতেও ছাড়েননি। আস্থার চরম সংকটের মাঝেই সাবেক আমলা ইকবাল মাহমুদের নিয়োগ চেয়ারম্যান হিসেবে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি জনতার দিল জিততে চান- এমন অঙ্গীকার করেছেন। শুরু করেছেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান। এখানেই থেমে থাকেননি। দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রতিরোধ কার্যক্রমের ওপর। তাই প্রথমবারের মতো দুদকের ৫ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়নে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সুশীলসমাজ, এনজিও ও দাতাসংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদাভাবে ছয়টি মতবিনিময় সভা করেছেন দুদকের নতুন চেয়ারম্যান। এতে দুর্নীতি প্রতিরোধে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ বেরিয়ে এসেছে। এসব মতবিনিময়ে প্রধানত দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে আস্থার সংকট থেকেই যাবে। এছাড়া বিভিন্ন সময় দুদককে কার্যকর করতে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্র“পের কর্মশালায় ৭৭টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছিল। এতেও গুরুত্ব পেয়েছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুদকের খসড়া কর্মপরিকল্পনায় কতটা স্থান পেয়েছে দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘রাজনীতিকদের’ কাজে লাগানোর বিষয়টি? পরিকল্পনায় রাজনীতিকদের যুক্ত করে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা কোনো মতবিনিময়ও করেনি দুদক। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধের অন্যতম চলক মনে করেন ‘রাজনীতিকদের’। ‘দুর্নীতি, দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনের চালকরা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে তিনি বলছেন, ‘দুর্নীতির ওপর কার্যকর আক্রমণ দরকার।’ এজন্য ‘দুর্নীতি দমনের প্রতি দায়বদ্ধ একদল রাজনৈতিক নেতা’ তৈরি করতে হবে। তার মতে, ‘একজন নেতা সমমনা সমর্থক বা সহকর্মীদের নিয়ে সাহসে বলীয়ান হয়ে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হবেন এবং পরিবর্তনের দাবি তুলবেন। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং একটি উন্নত শাসনব্যবস্থার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নেতা তৈরি করতে পারে অথবা নিজের রূপকল্প বাস্তবায়নে নেতারা দৃশ্যপটে হাজির হয়ে পারিপার্শ্বিকতা তৈরি করতে পারেন।’ এরকম রাজনীতিকদের প্রয়োজনীয়তা কেন? ড. নুরুল ইসলাম বলছেন, যদি সামনের দিকের রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ না হন অথবা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তবে নিচের সারির নেতারা দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। যখন নেতারা/নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতির প্রতি নির্লিপ্ত থাকেন অথবা নিজেরা দুর্নীতিতে অংশ নেন তখন সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি লাগামহীন হয়।’
সৎ রাজনীতিকরাই ভারতের গুজরাট রাজ্যের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারেন। দুর্নীতিবিরোধী নাগরিক গোষ্ঠীর আন্দোলনের নেতা থেকে আম আদমি পার্টি গঠন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনীতিক হিসেবে দিল্লির মসনদে বসে তিনি কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্যতম ‘চলক’ হিসেবেই কাজ করছেন। গত অক্টোবরে ঘুষের অভিযোগে নিজের মন্ত্রিসভার খাদ্য ও পরিবেশমন্ত্রী অসীম আহমেদ খানকে বরখাস্ত করতে কোনো কার্পণ্য করেননি। এ সিদ্ধান্ত দেয়ার পর দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানও যদি এমন কাজ করে, তবে আমি ছাড়ব না।’ বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী এমন রাজনীতিক কি বিরল? একেবারেই না, অধস্তনরা ঘুষ নিয়েছেন কিন্তু নিজ উদ্যোগে তা ফেরত দিয়েছেন এমন এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান ও মেয়র কিন্তু এ দেশে আছেন। দুদককে তাদের খুঁজে বের করে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজে লাগাতে হবে। কর্মপরিকল্পনায় বিষয়টি যোগ করতে হবে।
এত গেল দুর্নীতিবিরোধী রাজনীতিকদের কাজে লাগানোর আলোচনা। কিন্তু যারা দুর্নীতির সহায়ক, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের ক্ষেত্রে দুদকের অবস্থান কী হবে? আইনে-বিধানে এ ক্ষেত্রে দুদক স্বাধীন হলেও কাজেকর্মে সংস্থাটির অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ। গত মার্চে শুরু হওয়া গ্রেফতার অভিযানের ৬ মাসে ২৬৮ জনের মতো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কেউ ব্যাংকার, কেউ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিক বলতে গেলে নেই। আলোচিতদের মধ্যেও কেউ নেই। তাহলে কি বলা যায়, রাজনীতির মানুষরা দুর্নীতি করেন না? যদিও এ সময়েই কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অবস্থান ধরি মাছ না ছুঁই পানি। অন্যদিকে যেসব দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই গোঁফে তা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিশেষ করে বেসিক ব্যাংক দুর্নীতির ক্ষেত্রে যাকে মূল হোতা বলা হচ্ছে তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই শুধু কর্মপরিকল্পনা নয়, এসব ক্ষেত্রে সাহসী হতে হবে দুদককে। আবার সরকারি ও বিরোধী মতের রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে দুদকের দ্বিমুখী অবস্থানও খোলাসা করতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা কেপিকের মতো জনতার মন জয় করতে হলে দল-মত নির্বিশেষে রাজনীতিক-আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।
দুদকের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আয়োজিত ছয়টি মতবিনিময় সভায় সুপারিশ করা হয়েছে, রাজনীতিক-আমলাদের সম্পত্তির বিবরণী জমা এবং তা মনিটরিং ও যাচাই-বাছাইয়ের। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দুদক তার অবস্থান স্পষ্ট করেনি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘সম্পত্তির হিসাব খতিয়ে দেখা বিশাল বিষয়। এটা কারা মনিটর করবে, কীভাবে করবে, দুদক এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবে না।’ প্রাথমিক তথ্য ও তদন্তের ভিত্তিতে দুদক আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি নিজে যে কোনো ব্যক্তির সম্পত্তির বিবরণী খতিয়ে দেখতে পারে। আবার দুদক যদি মনে করে এর জন্য আলাদা একটি স্বাধীন তদারকি কমিশন গঠন করা উচিত কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারে, তা নির্ধারণ করাও জরুরি। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য এ ক্ষেত্রে সোজাসাপ্টা। তার মতে, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের নাম প্রকাশ করে তাকে লজ্জায় ফেলার সম্ভাবনা থাকলে দুর্নীতির আশংকা কমে।’ এ ক্ষেত্রে অ্যাডাম স্মিথকে কোট করেছেন তিনি, ‘প্রশংসাযোগ্য হওয়াই আমাদের নৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষকে সত্যিই প্রশংসা করলে সে উৎসাহিত হয়, ঠিক যেমন নিন্দা তাকে প্রতিহত করে।’
‘দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই বিব্রত হতে হবে, লজ্জায় পড়তে হবে’- এমন কথা খোদ দুদক চেয়ারম্যানও বলেছেন। এ ক্ষেত্রে কথা ও কাজের মিল থাকলেই কেবল দুর্নীতি দমনে দুদকের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে। তখন সরকারি সেবা পেতে বা ব্যবসায় কাউকে ঘুষ দিতে হবে না। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক সুবিধা ঘুষ ছাড়াই ভোগ করতে পারবে সাধারণ মানুষ। তবে এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন একদিনে হবে না। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের মতে, এ ক্ষেত্রে কাজ হবে ‘স্নোবল ইফেক্টে’র মতো। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী নুড়ি আকারের ছোট ছোট বরফখণ্ড ঢালু পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বিশালাকার ধারণ করে। একইভাবে দুর্নীতিবিরোধী ছোট ছোট কর্মকাণ্ডের যোগফল মোড় ঘুরিয়ে বড় ফল এনে দিতে পারে। এভাবে ৫৩টি দেশে ২০০টি প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নের উদাহরণ রয়েছে। এটি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আংশিকভাবে হলেও দুর্নীতি প্রতিরোধে সফলতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
almswapn45@gmail.com
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা কেপিকের ওপর ইন্দোনেশিয়ার জনগণের এত আস্থার কারণ কী? কেনইবা তারা কেপিকে’কে বাঁচাতে এভাবে মাঠে নেমে পড়েন। এ ক্ষেত্রে কিছু তথ্যের দ্বারস্থ হলেই হয়তো বিষয়টি খোলাসা হবে। ২০০৪ থেকে ২০০৯- এই পাঁচ বছরে যাদের দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত, বিচার ও অভিযোগ প্রমাণ করেছে সংস্থাটি, তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক রথী-মহারথী, প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা কারা? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জেনে হয়তো পিলে চমকাবে? এর মধ্যে ছিলেন সেদেশের ‘৪৫ সংসদ সদস্য, আট মন্ত্রী, আট প্রাদেশিক গভর্নর, একজন গভর্নর, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের তিন প্রসিকিউটর, তিন রাষ্ট্রদূত, চার কাউন্সিল জেনারেল এবং একজন পুলিশপ্রধান।’ এজন্যই বলা হয়ে থাকে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে এশিয়ার শক্তিশালী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম ইন্দোনেশিয়ার কেপিকে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন সংস্থা দুদকের অবস্থান কী? দুদকের ক্ষেত্রে সরকারি এমন কোনো চাপ এলে কি জনতা ঢাল হবে? টিআইবির সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, শতকরা মাত্র ৯.১ ভাগ মানুষ মনে করে দুদক ভালো কাজ করছে। বাকি ৮২.৯ ভাগ মানুষের আস্থা নেই প্রতিষ্ঠানটির ওপর। তারা মনে করে, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা বিবেচনা করে দুদক ব্যবস্থা নেয়।
গত মার্চে কমিশন পুনর্গঠনের আগে প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি দেয়ার হিড়িক পড়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, এর মাধ্যমে শুধু রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য নয়, কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও লাভবান হয়েছেন। এ কারণে সে সময় দুদককে অনেকেই দায়মুক্তি কমিশন বলতেও ছাড়েননি। আস্থার চরম সংকটের মাঝেই সাবেক আমলা ইকবাল মাহমুদের নিয়োগ চেয়ারম্যান হিসেবে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি জনতার দিল জিততে চান- এমন অঙ্গীকার করেছেন। শুরু করেছেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান। এখানেই থেমে থাকেননি। দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রতিরোধ কার্যক্রমের ওপর। তাই প্রথমবারের মতো দুদকের ৫ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়নে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সুশীলসমাজ, এনজিও ও দাতাসংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদাভাবে ছয়টি মতবিনিময় সভা করেছেন দুদকের নতুন চেয়ারম্যান। এতে দুর্নীতি প্রতিরোধে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ বেরিয়ে এসেছে। এসব মতবিনিময়ে প্রধানত দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে আস্থার সংকট থেকেই যাবে। এছাড়া বিভিন্ন সময় দুদককে কার্যকর করতে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্র“পের কর্মশালায় ৭৭টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছিল। এতেও গুরুত্ব পেয়েছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুদকের খসড়া কর্মপরিকল্পনায় কতটা স্থান পেয়েছে দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘রাজনীতিকদের’ কাজে লাগানোর বিষয়টি? পরিকল্পনায় রাজনীতিকদের যুক্ত করে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা কোনো মতবিনিময়ও করেনি দুদক। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধের অন্যতম চলক মনে করেন ‘রাজনীতিকদের’। ‘দুর্নীতি, দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনের চালকরা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে তিনি বলছেন, ‘দুর্নীতির ওপর কার্যকর আক্রমণ দরকার।’ এজন্য ‘দুর্নীতি দমনের প্রতি দায়বদ্ধ একদল রাজনৈতিক নেতা’ তৈরি করতে হবে। তার মতে, ‘একজন নেতা সমমনা সমর্থক বা সহকর্মীদের নিয়ে সাহসে বলীয়ান হয়ে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হবেন এবং পরিবর্তনের দাবি তুলবেন। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং একটি উন্নত শাসনব্যবস্থার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নেতা তৈরি করতে পারে অথবা নিজের রূপকল্প বাস্তবায়নে নেতারা দৃশ্যপটে হাজির হয়ে পারিপার্শ্বিকতা তৈরি করতে পারেন।’ এরকম রাজনীতিকদের প্রয়োজনীয়তা কেন? ড. নুরুল ইসলাম বলছেন, যদি সামনের দিকের রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ না হন অথবা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তবে নিচের সারির নেতারা দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। যখন নেতারা/নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতির প্রতি নির্লিপ্ত থাকেন অথবা নিজেরা দুর্নীতিতে অংশ নেন তখন সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি লাগামহীন হয়।’
সৎ রাজনীতিকরাই ভারতের গুজরাট রাজ্যের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারেন। দুর্নীতিবিরোধী নাগরিক গোষ্ঠীর আন্দোলনের নেতা থেকে আম আদমি পার্টি গঠন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনীতিক হিসেবে দিল্লির মসনদে বসে তিনি কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্যতম ‘চলক’ হিসেবেই কাজ করছেন। গত অক্টোবরে ঘুষের অভিযোগে নিজের মন্ত্রিসভার খাদ্য ও পরিবেশমন্ত্রী অসীম আহমেদ খানকে বরখাস্ত করতে কোনো কার্পণ্য করেননি। এ সিদ্ধান্ত দেয়ার পর দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানও যদি এমন কাজ করে, তবে আমি ছাড়ব না।’ বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী এমন রাজনীতিক কি বিরল? একেবারেই না, অধস্তনরা ঘুষ নিয়েছেন কিন্তু নিজ উদ্যোগে তা ফেরত দিয়েছেন এমন এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান ও মেয়র কিন্তু এ দেশে আছেন। দুদককে তাদের খুঁজে বের করে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজে লাগাতে হবে। কর্মপরিকল্পনায় বিষয়টি যোগ করতে হবে।
এত গেল দুর্নীতিবিরোধী রাজনীতিকদের কাজে লাগানোর আলোচনা। কিন্তু যারা দুর্নীতির সহায়ক, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের ক্ষেত্রে দুদকের অবস্থান কী হবে? আইনে-বিধানে এ ক্ষেত্রে দুদক স্বাধীন হলেও কাজেকর্মে সংস্থাটির অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ। গত মার্চে শুরু হওয়া গ্রেফতার অভিযানের ৬ মাসে ২৬৮ জনের মতো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কেউ ব্যাংকার, কেউ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিক বলতে গেলে নেই। আলোচিতদের মধ্যেও কেউ নেই। তাহলে কি বলা যায়, রাজনীতির মানুষরা দুর্নীতি করেন না? যদিও এ সময়েই কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অবস্থান ধরি মাছ না ছুঁই পানি। অন্যদিকে যেসব দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই গোঁফে তা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিশেষ করে বেসিক ব্যাংক দুর্নীতির ক্ষেত্রে যাকে মূল হোতা বলা হচ্ছে তিনি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই শুধু কর্মপরিকল্পনা নয়, এসব ক্ষেত্রে সাহসী হতে হবে দুদককে। আবার সরকারি ও বিরোধী মতের রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে দুদকের দ্বিমুখী অবস্থানও খোলাসা করতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা কেপিকের মতো জনতার মন জয় করতে হলে দল-মত নির্বিশেষে রাজনীতিক-আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।
দুদকের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আয়োজিত ছয়টি মতবিনিময় সভায় সুপারিশ করা হয়েছে, রাজনীতিক-আমলাদের সম্পত্তির বিবরণী জমা এবং তা মনিটরিং ও যাচাই-বাছাইয়ের। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দুদক তার অবস্থান স্পষ্ট করেনি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘সম্পত্তির হিসাব খতিয়ে দেখা বিশাল বিষয়। এটা কারা মনিটর করবে, কীভাবে করবে, দুদক এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবে না।’ প্রাথমিক তথ্য ও তদন্তের ভিত্তিতে দুদক আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি নিজে যে কোনো ব্যক্তির সম্পত্তির বিবরণী খতিয়ে দেখতে পারে। আবার দুদক যদি মনে করে এর জন্য আলাদা একটি স্বাধীন তদারকি কমিশন গঠন করা উচিত কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারে, তা নির্ধারণ করাও জরুরি। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য এ ক্ষেত্রে সোজাসাপ্টা। তার মতে, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের নাম প্রকাশ করে তাকে লজ্জায় ফেলার সম্ভাবনা থাকলে দুর্নীতির আশংকা কমে।’ এ ক্ষেত্রে অ্যাডাম স্মিথকে কোট করেছেন তিনি, ‘প্রশংসাযোগ্য হওয়াই আমাদের নৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষকে সত্যিই প্রশংসা করলে সে উৎসাহিত হয়, ঠিক যেমন নিন্দা তাকে প্রতিহত করে।’
‘দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই বিব্রত হতে হবে, লজ্জায় পড়তে হবে’- এমন কথা খোদ দুদক চেয়ারম্যানও বলেছেন। এ ক্ষেত্রে কথা ও কাজের মিল থাকলেই কেবল দুর্নীতি দমনে দুদকের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে। তখন সরকারি সেবা পেতে বা ব্যবসায় কাউকে ঘুষ দিতে হবে না। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক সুবিধা ঘুষ ছাড়াই ভোগ করতে পারবে সাধারণ মানুষ। তবে এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন একদিনে হবে না। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের মতে, এ ক্ষেত্রে কাজ হবে ‘স্নোবল ইফেক্টে’র মতো। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী নুড়ি আকারের ছোট ছোট বরফখণ্ড ঢালু পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বিশালাকার ধারণ করে। একইভাবে দুর্নীতিবিরোধী ছোট ছোট কর্মকাণ্ডের যোগফল মোড় ঘুরিয়ে বড় ফল এনে দিতে পারে। এভাবে ৫৩টি দেশে ২০০টি প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়নের উদাহরণ রয়েছে। এটি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আংশিকভাবে হলেও দুর্নীতি প্রতিরোধে সফলতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
almswapn45@gmail.com
No comments