ভারত কার মা, কার কাকিমা?
দেশদ্রোহী? ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি। ছবি: পিটিআই |
ভারতে
বিজেপি ক্ষমতায় এসে একটি সরল সমীকরণের চল করেছে: কেউ দেশের নিন্দে করলেই,
সে দেশদ্রোহী। আর দেশদ্রোহীকে ধরা-মারা হবে, আশ্চর্য কী? বিজেপি-র এক
সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় জেএনইউ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যারা ভারতে থেকে
পাকিস্তানের গুণ গায়, তাদের জিভ টেনে ছিঁড়ে নেওয়া যায় না?’ পরে আপশোস
করেছেন, অবশ্য না, এটা তো গণতন্ত্র। এ যে কতটা খেদের বিষয়, এই উদ্ভট
তন্ত্রটি এসে শয়তানদের উচিত-শাস্তি দেওয়া থেকে পবিত্র দেশপ্রেমিকদের বিরত
রাখছে, তা নিয়ে এঁদের মুহুর্মুহু দীর্ঘশ্বাস। এঁরা ভারতকে গরগরে
গণধোলাইধর্মী রাষ্ট্র করে তুলতে চান।
স্মৃতি ইরানি মেলোড্রামার লাইন নিয়েছেন। ‘এরা আমার মা’কে অপমান করেছে!’ ভারত কার মা, কার কাকিমা, প্রশ্নটা কিন্তু তা নয়। বরং, এই ‘মা, মা’ নাটুকে সম্বোধনটা বারবার আবৃত্তির মধ্যে একটা খুব বিপজ্জনক ফতোয়া নিহিত আছে। তা হল: ভারত যেহেতু আমাদের মা, সেহেতু তার নামে কিচ্ছুই বলা চলবে না। ধরা যাক, কারও মা পকেটমার। বা বিচ্ছিরি রকমের অভদ্র। বা খুনি। সে ক্ষেত্রে সন্তানের কর্তব্য কি হাতজোড় করে তাঁকে পুজো করা ও বলা, ‘মা যেমনই হোক, যা-ই করুক, আমি তবু মা’কে ভালবেসে চলব’? না কি, প্রকৃত সন্তানের কর্তব্য, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলা, ‘মা, তোমার এই কাজগুলো আমার ভাল লাগছে না, এগুলো করলে কিন্তু আমি তোমাকে আর শ্রদ্ধা করতে পারব না।’ সন্তানের কাজ কি মা’কে নিঃশর্ত প্রেম ও শ্রদ্ধা করা, মা’র কাজ কি নয় সন্তানের প্রেম ও শ্রদ্ধার যোগ্য হয়ে ওঠা? আসলে, এক বার বদন ভরে ‘মা’ বলে দিলেই একটা আবেগ-থরথর চারিয়ে দেওয়া যায়। হাওয়ায় হিস্টিরিয়া বেড়ে যায়। এটা সচেতন ভাবে করা হয়, যাতে এই উত্তেজনাটা কাজে লাগিয়ে, অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো চেপে দেওয়া যায়, আর সমালোচকদের ওপর অত্যাচারটা জাস্টিফাই করে নেওয়া যায়।
জেএনইউ-এর কিছু ছাত্র কী করেছেন? আফজল গুরুর ফাঁসির প্রতিবাদ করেছেন, ভারতের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের সমর্থনে স্লোগান দিয়েছেন। কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দাও, এ স্লোগানও তোলা হয়েছে। তাতে ঝামেলাটা কোথায়? আমি যদি ভারতকে ভীষণ ভালবাসি, তা হলেও তার যাচ্ছেতাই নিন্দে করতে পারি। তাকে আরও ভাল করে তোলার জন্য, শোধরানোর জন্য, আমার মতে তাকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, রোজ তার তুমুল নিন্দে করে চিৎকার জুড়তে পারি। অনেকে বলছেন, ‘যেখানকার ভাত খেয়েছ, সেখানটাকে অপমান করছ কেন?’ আরে, এখানকার ভাত খেয়েছি খাচ্ছি খাব বলেই তো সেই ভাতে পোকা পড়লে চেঁচাবার অধিকার আমার সবচেয়ে বেশি! আমার বাড়ির সামনে নর্দমা খোলা থাকলে আমি চেঁচামেচি করব না তো কে করবে? আমার দেশ যদি বদ হয়, অসভ্য হয়, অসৎ হয়, অপদার্থ হয়, বা আমার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, আমি রে-রে করে উঠব না? অবশ্যই করব। ভাত খেয়েছি বলে দাসখত লিখে দিইনি। আমি দেশের চাকর নই। আমি দেশের দায়িত্ববান নাগরিক। নাগরিকের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল, দেশের ভুল দেখলে, তা নিয়ে সরব হওয়া। যাঁরা উদ্ধত ভাবে বলছেন, ‘হয় চুপ করে থাক, নইলে পাকিস্তানে চলে যা!’, তাঁরা ভাবছেন, অন্ধ ভাবে সরকারের হ্যাঁ-য়ে হ্যাঁ মিলিয়ে যাওয়াকে বলে দেশপ্রেম। আর চারিদিকে চেয়ে দেখে ভুল ধরাকে বলে দেশদ্রোহিতা। বরং উলটো। দেশপ্রেম মানে স্তাবকতা নয়। ফেল করা ছেলেকে যে লোক পিঠ চাপড়ে ‘বহুত অাচ্ছা’ বলে, সে তার উন্নতি চায় না, অধঃপাতের রাস্তাটাই সুগম করে। দেশ খারাপ কাজ করলে, তার নিন্দে না করে চুপ করে থাকাটাও অনেক সময় দেশদ্রোহ। দেশের নিন্দে করা আর দেশকে না-ভালবাসা এক নয়।
আবার, দেশকে না-ভালবাসার অধিকারও আমার আলবাত আছে। ভারতে থেকে আমি ভারতকেও ভালবাসতে পারি, ভারত এবং ব্রাজিলকে ভালবাসতে পারি, আবার ভারতকে না ভালবেসে শুধু বেলজিয়ামকে ভালবাসতে পারি। আবার, কোনও দেশকে না ভালবেসে, সব দেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত থাকতেও পারি। আমি কাকে ভালবাসব, আর কাকে ভালবাসব না, তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ‘এক্ষুনি ভালবাস বলছি, নইলে পেটাব’— এ তো ধর্ষকের উচ্চারণ। ভারতে থেকে আমি যদি পাকিস্তানকে ভালবেসে গলা ফাটাই, তা আমার অধিকার। নিজের মতো ভাবনার অধিকার। মত প্রকাশের অধিকার, বাক্স্বাধীনতার অধিকার। আমেরিকা যখন ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, সারা পৃথিবীর কোটি কোটি লোক আমেরিকার বিরুদ্ধে চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছে। আমেরিকার মধ্যেও লাখ লাখ আমেরিকান, আমেরিকার বিরুদ্ধে চিৎকার করেছে। ‘যুদ্ধবাজ, দাদাগিরি-করা, জঘন্য রাষ্ট্র’ বলে গাল দিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ যদি বলত, ‘আমি আমেরিকায় থাকব বটে, কিন্তু এর কাজকম্ম দেখে আমার ভালবাসা ঘুচে গেছে, আজ থেকে একে প্রাণ দিয়ে ঘেন্না করব’, তাতে অন্যায় কী? ঠিকই, একটা জায়গায় জন্মে গেলে, লোকে সাধারণত সেই জায়গাটাকে ও চারপাশের লোকজনকে ভালবেসে ফেলে। বাচ্চা প্রথম থেকে বাবা-মা’কে দেখে, তাদের ভালবেসে ফেলে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক বলেই বাধ্যতামূলক হবে কেন? সন্তানকে এই ফতোয়া দেওয়া যায় কি, ‘মা-বাবাকে না ভালবাসলে তোর মুন্ডু ছিঁড়ে নেব’? বড়জোর বলা যায়, ‘বুড়ো বয়সে মা-বাবাকে তোমায় দেখতেই হবে।’ অর্থাৎ, অনুশাসনটা কর্তব্য বিষয়ে, ভালবাসা বিষয়ে নয়। আমি যদি নাগরিকের যা যা কর্তব্য সব পালন করি, ট্যাক্স দিই, দেশের সম্পত্তি নষ্ট না করি, অন্য নাগরিককে না মারি-ধরি, তা হলে আমি ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’ শুনে কাঁদছি, না, ‘যত্ত প্যানপেনে আদিখ্যেতা’ বলে খ্যালখ্যাল হাসছি, তা দেখে সরকারের লেঠেল তো আমায় তাড়া করতে পারে না।
আরও: স্রেফ কাছ-ঘেঁষাঘেঁষির চোটে যে ভালবাসা, তার চেয়ে বুঝেশুনে যে ভালবাসা, তা কি অ-কুলীন? আমি যদি অনেকগুলো দেশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে ওজন বিশ্লেষণ বিচার করে, তার পর মনে করি সুইডেনই পৃথিবীর সেরা দেশ, তা হলে সুইডেনের প্রতি আমার যে ভালবাসা, তা হল জেনে, দেখে, ভেবে ভালবাসা। আর সিঁথির মোড়ে জন্মেছি বলেই সিঁথির মোড়ের প্রতি আমার যে ভালবাসা, তা বরং একটু মাঠো, সংকীর্ণ, প্রতিবর্ত-ক্রিয়া টাইপ ভালবাসা। ভাবা দরকার: ওটা ভালবাসা তো, নাকি স্রেফ একটা অভ্যাস, রোজ ন’টায় বাথরুম যাই বলে শরীর ন’টাতেই ‘বেগ এসেছে’ বলে ওঠে যে রকম। কেউ ভৌগোলিক গণ্ডি নির্ধারিত ভালবাসাকে উড়িয়ে দিয়ে বলতেই পারে, আমি সারা পৃথিবীর সম্তান, কোনও নির্দিষ্ট দেশের প্রতি আমার আনুগত্য নেই, যখন যেটাকে ভাল দেখব, ভালবাসব, যা খারাপ দেখব, খারাপ বলব। ভারতের সব, সমস্ত জিনিসকে আমার খারাপ লাগে, তবু আমি এখানে থাকব। কারণ এটা পৃথিবীর একটা অংশ, আমি থাকতেই পারি। আমাকে এখান থেকে উৎখাত করার গা-জোয়ারি যে দেখাবে, সে গুন্ডা। অন্য জায়গায় যাচ্ছি না কেন? হয়তো সামর্থ্য নেই। একটা এঁদো ড্যাম্প দশ ফুট বাই দশ ফুট বাড়িতে থাকি বলে প্রতি দিন নিয়ম করে ‘ইস, সাউথ সিটির তেত্রিশ তলা এর চেয়ে অনেক ভাল’ বলতে পারব না?
কেউ বলতেই পারেন, বাপু, দেশে থেকে দেশকে যাচ্ছেতাই নিন্দে করার অধিকার যদি তোমার থাকে, তোমার ওপর ভয়াবহ রেগে যাওয়ার অধিকারও তো আমার আছে। আমি দেশকে ভালবাসি, তা তো আমার অপরাধ নয়। অবশ্যই নয়। দেশকে আপনি উন্মত্ত ভালবাসতে পারেন, এবং জেএনইউ-এর স্লোগান-দেওয়া ছাত্রদের প্রতি প্রকাণ্ড রেগে যা-তা বলতে পারেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মিছিল করুন, মিটিং করুন, কাগজে চিঠি লিখুন, টিভিতে ইন্টারভিউ দিন। তাঁরা যত চিৎকার করেছেন তার দশ গুণ চিৎকার করুন। এও তো বাক্স্বাধীনতাই। কিন্তু পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হল কেন? ছাত্র সংসদের নেতাকে গ্রেফতার করা হল কেন? দেশদ্রোহের চার্জ আনা হচ্ছে কেন? দেশের নিন্দে ও অন্য দেশের সমর্থন মানে তো দেশদ্রোহ নয়। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর শিখদের এক সভায় খালিস্তানের সমর্থনে স্লোগান তোলা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে তা-ও সিডিশন বা দেশদ্রোহ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। আইন অনুযায়ী: হিংসা বা গণ-বিশৃঙ্খলায় প্ররোচনা দিলে, তবেই তা দেশদ্রোহ। অর্থাৎ, কেউ যদি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়, সেটা দেশদ্রোহ। কেউ যদি বলে, চলুন এই মিছিলের সবাই মিলে গিয়ে এক্ষুনি অমুক সম্প্রদায়ের বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগাই, এবং সবাইকে তা করতে উসকানি দেয়, তা হলে সেটা দেশদ্রোহ।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, উসকানি কাকে বলে? কতটা ওসকালে তবে ‘সিডিশন’? কেউ বলতেই পারে, আফজল গুরুর ফাঁসির বিরুদ্ধে স্লোগান তোলাও এক রকম উসকানি, তা থেকে অনেকের মনে ভারতবিরোধী আবেগ জেগে উঠতে পারে, আর তারা সবাই হিংসাত্মক হয়ে দেশের মানুষ ও সম্পত্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তা পারে, কিন্তু ওই রকম ভাবে দেখতে গেলে তো কেউ যদি বলে ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভাল লাগে না’, তা হলে তা থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে কেউ বিশ্বভারতীতে আগুন লাগিয়েও দিতে পারে। সেই আশঙ্কায় রবীন্দ্রনিন্দুকটিকে এক্ষুনি দমকলের লোক গিয়ে পেটাতে শুরু করতে পারে কি? পৃথিবীর যে কোনও মতামতের মধ্যেই কাউকে চটিয়ে দেওয়ার উপাদান থাকতে পারে, রাজনৈতিক মতামতের মধ্যে তো বটেই। পৃথিবীর যে কোনও উঁচু-গলায় নিন্দে বা স্লোগানের মধ্যে এই ইচ্ছেও নিহিত আছে: অনেক লোক আমার এই মতকে সমর্থন করুক। আভিধানিক ভাবে প্রতিটিকেই প্ররোচনা ভাবা যায়। ব্যাপারটা এত ভাসা-ভাসা বলেই আমাদের দেশে চমৎকার নিয়ম: কংগ্রেস বাক্স্বাধীনতার দুর্দান্ত সমর্থক যত ক্ষণ তা বিজেপিকে কামড়ে দিচ্ছে, বিজেপি বাক্স্বাধীনতার পেল্লায় সমর্থক যত ক্ষণ তা তৃণমূলকে ল্যাং মারছে, তৃণমূল বাক্স্বাধীনতার সোল্লাস সমর্থক যত ক্ষণ তা সিপিএমের গায়ে কালি ছেটাচ্ছে। নিজের গায়ে আঁচ লাগলেই তখন দ্রোহ-র সংজ্ঞাটা হঠাৎ খুব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর প্রশাসনের লাঠিসোটা কাজে লাগিয়ে লোকটার টুঁটি টিপে ধরার মধ্যে কোনও অন্যায়ই দেখা যাচ্ছে না। অসীম ত্রিবেদী যখন ২০১২ সালে কার্টুনে আঁকছেন ভারতমাতাকে গণধর্ষণ করছে নেতা ও আমলা, ইউপিএ সরকার তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করছে। আর বিজেপি নেতা আডবাণী অবাক হয়ে বলছেন, এ তো ইমার্জেন্সির চেয়েও খারাপ! আবার, হিন্দু মহাসভা যখন নাথুরাম গডসের মূর্তি গড়তে পয়সা তুলেছে, গাঁধী-বিরোধী স্লোগান দিয়েছে, তখন বিজেপির মাথায় দেশদ্রোহের অভিযোগ আনার কথা আসেইনি।
আসলে, এই গোছের ধরপাকড় সব সভ্য দেশ তুলেই দিয়েছে। ভারতে কিছু ক্ষমতাওয়ালা আছে, গণতন্ত্রের মানেটাই জানে না, অশিক্ষা ও জঙ্গিপনা মিলিয়ে ক্ষমতার কেক কামড়ায়, আর বিরোধিতা দুরমুশ করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে, এগুলো প্রয়োগ করে। এদের আবার হাতে-গরম পাবলিক-খেপানো মন্তরটি হল: ‘পাকিস্তানকে ঘেন্না করো। পাকিস্তানকে ভালবাসা মানেই দেশদ্রোহ।’ এটাই ভারতের দেশপ্রেমের ঠিক সংজ্ঞা, কারণ তা প্রেম দিয়ে নয়, ঘেন্না দিয়েই নির্ধারিত। (তাই তা তুমুল তীব্রতায় ফোটে ভারত-পাক ম্যাচের সময়, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে থাকা দেশবাসীকে বাঁচাবার বেলায় এর টিকিটি মেলা ভার)। কিন্তু তা হলে তো বলতে হয়, কেউ যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে, কিচ্ছুটি না-বলেকয়ে, আচমকা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে হাসি-হাসি মুখে হাজির হয়ে যান, দেশদ্রোহের অভিযোগে প্রথমে তাঁকেই হাতকড়া পরিয়ে জেলে পুরে দেওয়া উচিত!
সুত্র- আনন্দবাজার
স্মৃতি ইরানি মেলোড্রামার লাইন নিয়েছেন। ‘এরা আমার মা’কে অপমান করেছে!’ ভারত কার মা, কার কাকিমা, প্রশ্নটা কিন্তু তা নয়। বরং, এই ‘মা, মা’ নাটুকে সম্বোধনটা বারবার আবৃত্তির মধ্যে একটা খুব বিপজ্জনক ফতোয়া নিহিত আছে। তা হল: ভারত যেহেতু আমাদের মা, সেহেতু তার নামে কিচ্ছুই বলা চলবে না। ধরা যাক, কারও মা পকেটমার। বা বিচ্ছিরি রকমের অভদ্র। বা খুনি। সে ক্ষেত্রে সন্তানের কর্তব্য কি হাতজোড় করে তাঁকে পুজো করা ও বলা, ‘মা যেমনই হোক, যা-ই করুক, আমি তবু মা’কে ভালবেসে চলব’? না কি, প্রকৃত সন্তানের কর্তব্য, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলা, ‘মা, তোমার এই কাজগুলো আমার ভাল লাগছে না, এগুলো করলে কিন্তু আমি তোমাকে আর শ্রদ্ধা করতে পারব না।’ সন্তানের কাজ কি মা’কে নিঃশর্ত প্রেম ও শ্রদ্ধা করা, মা’র কাজ কি নয় সন্তানের প্রেম ও শ্রদ্ধার যোগ্য হয়ে ওঠা? আসলে, এক বার বদন ভরে ‘মা’ বলে দিলেই একটা আবেগ-থরথর চারিয়ে দেওয়া যায়। হাওয়ায় হিস্টিরিয়া বেড়ে যায়। এটা সচেতন ভাবে করা হয়, যাতে এই উত্তেজনাটা কাজে লাগিয়ে, অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো চেপে দেওয়া যায়, আর সমালোচকদের ওপর অত্যাচারটা জাস্টিফাই করে নেওয়া যায়।
জেএনইউ-এর কিছু ছাত্র কী করেছেন? আফজল গুরুর ফাঁসির প্রতিবাদ করেছেন, ভারতের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের সমর্থনে স্লোগান দিয়েছেন। কাশ্মীরকে স্বাধীনতা দাও, এ স্লোগানও তোলা হয়েছে। তাতে ঝামেলাটা কোথায়? আমি যদি ভারতকে ভীষণ ভালবাসি, তা হলেও তার যাচ্ছেতাই নিন্দে করতে পারি। তাকে আরও ভাল করে তোলার জন্য, শোধরানোর জন্য, আমার মতে তাকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, রোজ তার তুমুল নিন্দে করে চিৎকার জুড়তে পারি। অনেকে বলছেন, ‘যেখানকার ভাত খেয়েছ, সেখানটাকে অপমান করছ কেন?’ আরে, এখানকার ভাত খেয়েছি খাচ্ছি খাব বলেই তো সেই ভাতে পোকা পড়লে চেঁচাবার অধিকার আমার সবচেয়ে বেশি! আমার বাড়ির সামনে নর্দমা খোলা থাকলে আমি চেঁচামেচি করব না তো কে করবে? আমার দেশ যদি বদ হয়, অসভ্য হয়, অসৎ হয়, অপদার্থ হয়, বা আমার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, আমি রে-রে করে উঠব না? অবশ্যই করব। ভাত খেয়েছি বলে দাসখত লিখে দিইনি। আমি দেশের চাকর নই। আমি দেশের দায়িত্ববান নাগরিক। নাগরিকের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল, দেশের ভুল দেখলে, তা নিয়ে সরব হওয়া। যাঁরা উদ্ধত ভাবে বলছেন, ‘হয় চুপ করে থাক, নইলে পাকিস্তানে চলে যা!’, তাঁরা ভাবছেন, অন্ধ ভাবে সরকারের হ্যাঁ-য়ে হ্যাঁ মিলিয়ে যাওয়াকে বলে দেশপ্রেম। আর চারিদিকে চেয়ে দেখে ভুল ধরাকে বলে দেশদ্রোহিতা। বরং উলটো। দেশপ্রেম মানে স্তাবকতা নয়। ফেল করা ছেলেকে যে লোক পিঠ চাপড়ে ‘বহুত অাচ্ছা’ বলে, সে তার উন্নতি চায় না, অধঃপাতের রাস্তাটাই সুগম করে। দেশ খারাপ কাজ করলে, তার নিন্দে না করে চুপ করে থাকাটাও অনেক সময় দেশদ্রোহ। দেশের নিন্দে করা আর দেশকে না-ভালবাসা এক নয়।
আবার, দেশকে না-ভালবাসার অধিকারও আমার আলবাত আছে। ভারতে থেকে আমি ভারতকেও ভালবাসতে পারি, ভারত এবং ব্রাজিলকে ভালবাসতে পারি, আবার ভারতকে না ভালবেসে শুধু বেলজিয়ামকে ভালবাসতে পারি। আবার, কোনও দেশকে না ভালবেসে, সব দেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত থাকতেও পারি। আমি কাকে ভালবাসব, আর কাকে ভালবাসব না, তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ‘এক্ষুনি ভালবাস বলছি, নইলে পেটাব’— এ তো ধর্ষকের উচ্চারণ। ভারতে থেকে আমি যদি পাকিস্তানকে ভালবেসে গলা ফাটাই, তা আমার অধিকার। নিজের মতো ভাবনার অধিকার। মত প্রকাশের অধিকার, বাক্স্বাধীনতার অধিকার। আমেরিকা যখন ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, সারা পৃথিবীর কোটি কোটি লোক আমেরিকার বিরুদ্ধে চিৎকার করে গলা ফাটিয়েছে। আমেরিকার মধ্যেও লাখ লাখ আমেরিকান, আমেরিকার বিরুদ্ধে চিৎকার করেছে। ‘যুদ্ধবাজ, দাদাগিরি-করা, জঘন্য রাষ্ট্র’ বলে গাল দিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ যদি বলত, ‘আমি আমেরিকায় থাকব বটে, কিন্তু এর কাজকম্ম দেখে আমার ভালবাসা ঘুচে গেছে, আজ থেকে একে প্রাণ দিয়ে ঘেন্না করব’, তাতে অন্যায় কী? ঠিকই, একটা জায়গায় জন্মে গেলে, লোকে সাধারণত সেই জায়গাটাকে ও চারপাশের লোকজনকে ভালবেসে ফেলে। বাচ্চা প্রথম থেকে বাবা-মা’কে দেখে, তাদের ভালবেসে ফেলে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক বলেই বাধ্যতামূলক হবে কেন? সন্তানকে এই ফতোয়া দেওয়া যায় কি, ‘মা-বাবাকে না ভালবাসলে তোর মুন্ডু ছিঁড়ে নেব’? বড়জোর বলা যায়, ‘বুড়ো বয়সে মা-বাবাকে তোমায় দেখতেই হবে।’ অর্থাৎ, অনুশাসনটা কর্তব্য বিষয়ে, ভালবাসা বিষয়ে নয়। আমি যদি নাগরিকের যা যা কর্তব্য সব পালন করি, ট্যাক্স দিই, দেশের সম্পত্তি নষ্ট না করি, অন্য নাগরিককে না মারি-ধরি, তা হলে আমি ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’ শুনে কাঁদছি, না, ‘যত্ত প্যানপেনে আদিখ্যেতা’ বলে খ্যালখ্যাল হাসছি, তা দেখে সরকারের লেঠেল তো আমায় তাড়া করতে পারে না।
আরও: স্রেফ কাছ-ঘেঁষাঘেঁষির চোটে যে ভালবাসা, তার চেয়ে বুঝেশুনে যে ভালবাসা, তা কি অ-কুলীন? আমি যদি অনেকগুলো দেশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে ওজন বিশ্লেষণ বিচার করে, তার পর মনে করি সুইডেনই পৃথিবীর সেরা দেশ, তা হলে সুইডেনের প্রতি আমার যে ভালবাসা, তা হল জেনে, দেখে, ভেবে ভালবাসা। আর সিঁথির মোড়ে জন্মেছি বলেই সিঁথির মোড়ের প্রতি আমার যে ভালবাসা, তা বরং একটু মাঠো, সংকীর্ণ, প্রতিবর্ত-ক্রিয়া টাইপ ভালবাসা। ভাবা দরকার: ওটা ভালবাসা তো, নাকি স্রেফ একটা অভ্যাস, রোজ ন’টায় বাথরুম যাই বলে শরীর ন’টাতেই ‘বেগ এসেছে’ বলে ওঠে যে রকম। কেউ ভৌগোলিক গণ্ডি নির্ধারিত ভালবাসাকে উড়িয়ে দিয়ে বলতেই পারে, আমি সারা পৃথিবীর সম্তান, কোনও নির্দিষ্ট দেশের প্রতি আমার আনুগত্য নেই, যখন যেটাকে ভাল দেখব, ভালবাসব, যা খারাপ দেখব, খারাপ বলব। ভারতের সব, সমস্ত জিনিসকে আমার খারাপ লাগে, তবু আমি এখানে থাকব। কারণ এটা পৃথিবীর একটা অংশ, আমি থাকতেই পারি। আমাকে এখান থেকে উৎখাত করার গা-জোয়ারি যে দেখাবে, সে গুন্ডা। অন্য জায়গায় যাচ্ছি না কেন? হয়তো সামর্থ্য নেই। একটা এঁদো ড্যাম্প দশ ফুট বাই দশ ফুট বাড়িতে থাকি বলে প্রতি দিন নিয়ম করে ‘ইস, সাউথ সিটির তেত্রিশ তলা এর চেয়ে অনেক ভাল’ বলতে পারব না?
কেউ বলতেই পারেন, বাপু, দেশে থেকে দেশকে যাচ্ছেতাই নিন্দে করার অধিকার যদি তোমার থাকে, তোমার ওপর ভয়াবহ রেগে যাওয়ার অধিকারও তো আমার আছে। আমি দেশকে ভালবাসি, তা তো আমার অপরাধ নয়। অবশ্যই নয়। দেশকে আপনি উন্মত্ত ভালবাসতে পারেন, এবং জেএনইউ-এর স্লোগান-দেওয়া ছাত্রদের প্রতি প্রকাণ্ড রেগে যা-তা বলতে পারেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মিছিল করুন, মিটিং করুন, কাগজে চিঠি লিখুন, টিভিতে ইন্টারভিউ দিন। তাঁরা যত চিৎকার করেছেন তার দশ গুণ চিৎকার করুন। এও তো বাক্স্বাধীনতাই। কিন্তু পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হল কেন? ছাত্র সংসদের নেতাকে গ্রেফতার করা হল কেন? দেশদ্রোহের চার্জ আনা হচ্ছে কেন? দেশের নিন্দে ও অন্য দেশের সমর্থন মানে তো দেশদ্রোহ নয়। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর শিখদের এক সভায় খালিস্তানের সমর্থনে স্লোগান তোলা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে তা-ও সিডিশন বা দেশদ্রোহ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। আইন অনুযায়ী: হিংসা বা গণ-বিশৃঙ্খলায় প্ররোচনা দিলে, তবেই তা দেশদ্রোহ। অর্থাৎ, কেউ যদি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়, সেটা দেশদ্রোহ। কেউ যদি বলে, চলুন এই মিছিলের সবাই মিলে গিয়ে এক্ষুনি অমুক সম্প্রদায়ের বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগাই, এবং সবাইকে তা করতে উসকানি দেয়, তা হলে সেটা দেশদ্রোহ।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, উসকানি কাকে বলে? কতটা ওসকালে তবে ‘সিডিশন’? কেউ বলতেই পারে, আফজল গুরুর ফাঁসির বিরুদ্ধে স্লোগান তোলাও এক রকম উসকানি, তা থেকে অনেকের মনে ভারতবিরোধী আবেগ জেগে উঠতে পারে, আর তারা সবাই হিংসাত্মক হয়ে দেশের মানুষ ও সম্পত্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তা পারে, কিন্তু ওই রকম ভাবে দেখতে গেলে তো কেউ যদি বলে ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভাল লাগে না’, তা হলে তা থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করে কেউ বিশ্বভারতীতে আগুন লাগিয়েও দিতে পারে। সেই আশঙ্কায় রবীন্দ্রনিন্দুকটিকে এক্ষুনি দমকলের লোক গিয়ে পেটাতে শুরু করতে পারে কি? পৃথিবীর যে কোনও মতামতের মধ্যেই কাউকে চটিয়ে দেওয়ার উপাদান থাকতে পারে, রাজনৈতিক মতামতের মধ্যে তো বটেই। পৃথিবীর যে কোনও উঁচু-গলায় নিন্দে বা স্লোগানের মধ্যে এই ইচ্ছেও নিহিত আছে: অনেক লোক আমার এই মতকে সমর্থন করুক। আভিধানিক ভাবে প্রতিটিকেই প্ররোচনা ভাবা যায়। ব্যাপারটা এত ভাসা-ভাসা বলেই আমাদের দেশে চমৎকার নিয়ম: কংগ্রেস বাক্স্বাধীনতার দুর্দান্ত সমর্থক যত ক্ষণ তা বিজেপিকে কামড়ে দিচ্ছে, বিজেপি বাক্স্বাধীনতার পেল্লায় সমর্থক যত ক্ষণ তা তৃণমূলকে ল্যাং মারছে, তৃণমূল বাক্স্বাধীনতার সোল্লাস সমর্থক যত ক্ষণ তা সিপিএমের গায়ে কালি ছেটাচ্ছে। নিজের গায়ে আঁচ লাগলেই তখন দ্রোহ-র সংজ্ঞাটা হঠাৎ খুব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর প্রশাসনের লাঠিসোটা কাজে লাগিয়ে লোকটার টুঁটি টিপে ধরার মধ্যে কোনও অন্যায়ই দেখা যাচ্ছে না। অসীম ত্রিবেদী যখন ২০১২ সালে কার্টুনে আঁকছেন ভারতমাতাকে গণধর্ষণ করছে নেতা ও আমলা, ইউপিএ সরকার তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করছে। আর বিজেপি নেতা আডবাণী অবাক হয়ে বলছেন, এ তো ইমার্জেন্সির চেয়েও খারাপ! আবার, হিন্দু মহাসভা যখন নাথুরাম গডসের মূর্তি গড়তে পয়সা তুলেছে, গাঁধী-বিরোধী স্লোগান দিয়েছে, তখন বিজেপির মাথায় দেশদ্রোহের অভিযোগ আনার কথা আসেইনি।
আসলে, এই গোছের ধরপাকড় সব সভ্য দেশ তুলেই দিয়েছে। ভারতে কিছু ক্ষমতাওয়ালা আছে, গণতন্ত্রের মানেটাই জানে না, অশিক্ষা ও জঙ্গিপনা মিলিয়ে ক্ষমতার কেক কামড়ায়, আর বিরোধিতা দুরমুশ করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে, এগুলো প্রয়োগ করে। এদের আবার হাতে-গরম পাবলিক-খেপানো মন্তরটি হল: ‘পাকিস্তানকে ঘেন্না করো। পাকিস্তানকে ভালবাসা মানেই দেশদ্রোহ।’ এটাই ভারতের দেশপ্রেমের ঠিক সংজ্ঞা, কারণ তা প্রেম দিয়ে নয়, ঘেন্না দিয়েই নির্ধারিত। (তাই তা তুমুল তীব্রতায় ফোটে ভারত-পাক ম্যাচের সময়, কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে থাকা দেশবাসীকে বাঁচাবার বেলায় এর টিকিটি মেলা ভার)। কিন্তু তা হলে তো বলতে হয়, কেউ যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে, কিচ্ছুটি না-বলেকয়ে, আচমকা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে হাসি-হাসি মুখে হাজির হয়ে যান, দেশদ্রোহের অভিযোগে প্রথমে তাঁকেই হাতকড়া পরিয়ে জেলে পুরে দেওয়া উচিত!
সুত্র- আনন্দবাজার
No comments