মুসলিম তরুণদের উদ্দেশে খোলা চিঠি by রামজি বারুদ
যখন
ছোট্ট বালক ছিলাম, স্বপ্ন দেখতাম- গাজার উদ্বাস্তুশিবিরের দুঃখ-দুর্দশা
থেকে দূরে যেন আমার পুনর্জন্ম ঘটে। যেন ভিন্ন কোনো সময় ও স্থানে আমি আবার
জন্মগ্রহণ করি, যেখানে নেই সৈন্য ও সামরিক দখলদারি; নেই বন্দিশিবির আর
নিত্যদিনের যাতনা। আমার বাবা তার সন্তানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়েছেন,
আর কঠিন পরিশ্রম করেছেন জীবনের দুঃখকষ্ট আর অব্যাহত ভালোবাসার মধ্যে
ভারসাম্য রাখার জন্য।
যখন বড় হলাম ও শৈশবের ওই সব ফ্যান্টাসির কথা স্মরণ করলাম, আমি উপনীত হলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উপসংহারে। যদি পারতাম, আমার অতীতের পুনরাবৃত্তি করতাম, এই অতীতকে বদলাতাম না কোনোভাবেই, অতীত যতই কঠিন হোক না কেন। অতীত দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে আলিঙ্গন করতাম। প্রতিটি অশ্রুবিন্দু আর প্রত্যেক ক্ষতির পুনরাবৃত্তি ঘটাতাম। প্রতিটি বিজয় আবার উদযাপন করতাম, সে বিজয় যত ক্ষুদ্র হোক।
যখন বয়স থাকে কম, তখন আমাদের বলা হয় না যে, ব্যথাবেদনা ও দুঃখ-যাতনাকে ভয় করা উচিত নয়। শেখানো হয় না যে, একজন মানুষের পরিচিতির বিকাশ, জীবনের লক্ষ্যবোধ ও মানবিক চেতনার মুক্তির ক্ষেত্রে অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না। দাসত্বকে কখনো হজম করতে নেই, কিংবা ভুক্তভোগী হয়ে থাকাও উচিত নয়। দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও অবিচারের প্রতিরোধ হচ্ছে আরো অর্থবহ অস্তিত্ব এবং উন্নততর জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক প্রয়োজনীয় শর্ত।
এটা বলছি, কারণ আমি বুঝি তোমাদের অনেকে কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছ। উদ্বাস্তুশিবিরবাসীদের মধ্যে যায় আমাদের প্রজন্ম, তারা এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আর তখন কেমন সহিংসতা বিরাজ করছিল, তা তোমরা কখনো কল্পনাও করতে পারবে না। মানবজাতির বেশির ভাগেরই জন্যই এখন বছরগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জ বটে। তবে এ কথাটা বেশি সত্য, বিশেষ করে তোমাদের মতো তরুণ মুসলমানদের বেলায়। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান রাজনীতিকদের বর্ণবাদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী মনোভাবে পৃথিবীর বেশির ভাগই প্লাবিত। এ ক্ষেত্রে, স্বার্থপর ব্যক্তিরা জঘন্য অ্যাজেন্ডা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা মানুষের ভীতি ও অজ্ঞতা নিয়ে খেলছে। সহিংসতা ও পাল্টা সহিংসতা (নিজেদের মুসলমান বলে দাবিদার কিছু গ্রুপ জড়িত) তাদের পুঁজি। এমন এক অবস্থায় তোমরা নিজেদের দেখছ ফাঁদে পড়া অবস্থায় এবং গতানুগতিকতা, মিডিয়ার ঘৃণা প্রচার ও সহিংসতার কারাগারে বন্দী হিসেবে। তোমরা দেখছ যে, তোমাদের টার্গেট করা হয়েছে; বিশেষ কোনো তকমা এঁটে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের ভীতির পাত্র বানানো হয়েছে অন্যায়ভাবে।
তোমাদের বেশির ভাগই জন্মগ্রহণ করেছে এবং বড় হয়েছে ওই সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্দিত্বের মধ্যে। এমন কোনো সময়ের কথা তোমাদের মনে পড়ে না, যখন জীবন কিছুটা স্বাভাবিক ছিল; যখন তোমরা দুনিয়ার বেশির ভাগ ভ্রান্তির ক্ষেত্রে ‘বলির পাঁঠা’ হয়ে যাওনি। বাস্তবে তোমাদের স্বভাবচরিত্র গঠিত হয়েছে এই পক্ষপাতদুষ্ট বাস্তবতার ভিত্তিতে। তোমাদের বেঁচে থাকতে হয় দুর্ব্যবহারজনিত ক্রোধ, আত্মরক্ষার মরিয়া প্রয়াস, পরিবারের দেখাশোনা এবং নিজের কমিউনিটি, কালচার ও ধর্মের সপক্ষে দাঁড়ানোর মধ্যে।
সবচেয়ে গুরুত্ববহ হচ্ছে, তোমাদের প্রতিদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য। যেসব সমাজে তোমরা নিজেদের দেখতে পাও প্রত্যাখ্যাত ও বর্জিত হিসেবে, সেখানে নাগরিকত্ব অর্জনের সংগ্রাম করতে হয়। ‘ওরা’ চায়, ওদের সমাজে তোমরা মিশে যাও। কিন্তু যখন তোমরা তাদের কাছে যাও, তারা ঠেলে তোমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। তাই মনে হয়, তোমাদের কাজটা অসম্ভব হয়ে উঠছে। ভুলভাবে তোমাদের তুলে ধরা এবং তোমাদের ধর্মের মহান মূল্যবোধগুলোর ভুল উপস্থাপনের বিরুদ্ধে তোমাদের ধাক্কা দেয়ার কাজটি এখনো বাকি। ওদের বর্ণবিদ্বেষ দিন দিন বাড়ছে মনে হয়। তোমরা তাদের বোঝানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেও তাদের ঘৃণার প্রতিটি বেপরোয়া তীরের টার্গেট হচ্ছে ইসলাম।
প্রথম কথা হলো- কেন ইসলামের প্রসঙ্গ এনেছি, তোমরা কদাচিৎ তা উপলব্ধি করে থাকো। ইসলাম কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করার জন্য যেতে আমন্ত্রণ জানায়নি। তোমাদের সভ্যতার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে মুসলমানদের দুর্দশা সৃষ্টি করতেও বলা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে।
মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বাইরে গিয়ে গুয়ান্তানামো বন্দিশিবির তৈরি করার সময়ে ইসলামে পরামর্শ কী তা জানতে চাওয়া হয়নি। সম্পূর্ণরূপে আত্মস্বার্থ প্রণোদিত রাজনৈতিক মতলবে বিবদমান পক্ষগুলো সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধে লিপ্ত। সেখানে ইসলাম মোটেও সম্পৃক্ত নয়।
ইহুদিবাদী মিলিশিয়া ব্রিটিশের সহায়তায় ফিলিস্তিনকে পদানত করেছে। পরে তা করা হয়েছে আমেরিকার সাহায্য নিয়ে। এতে বিগত শতাব্দীর বেশির ভাগ সময়েই পবিত্রভূমি পরিণত হয়েছে রণাঙ্গনে। স্থায়ী যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের পাদপীঠে পর্যবসিত হয়েছে অঞ্চলটি। ইসলাম তো এ সব কিছুর জন্য দায়ী নয়।
এমন বহু নজিরই তুলে ধরা যায়, যা জেনে তোমরা নিজেরাও বিস্মিত হয়ে থাকো। উপনিবেশবাদে ও সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের উদ্ভাবন নয়। বরং ইসলাম এশিয়া, আফ্রিকা ও আরবের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে এসব নিষ্ঠুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। পাইকারি হারে দাস বানানোর পথ তো ইসলাম দেখায়নি। অথচ, আমেরিকা-ইউরোপে কয়েক মিলিয়ন দাস ছিল মুসলমান।
ওদের এসব কথা জানাতে চেষ্টা করো। জোর দিয়ে বলো, আইএসের মতো ভয়াবহ গ্রুপগুলোর জন্ম ইসলাম দেয়নি। বরং এগুলো জন্ম নিয়েছে সহিংসতা, লোভ এবং বিদেশের হস্তক্ষেপের বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে। কিন্তু ‘ওরা’ এসব কথায় কান না দিয়ে পবিত্র গ্রন্থ থেকে সুবিধামতো কিছু কথা ব্যবহার করে থাকে। অথচ, এই আয়াতগুলো দিয়ে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বোঝানো হয়েছিল। কুরআন শরিফের এমন আয়াতও তোমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছ যাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘যদি কেউ একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল এবং যদি কেউ একটি জীবন বাঁচায়, যেন সে গোটা মানবজাতির জীবন বাঁচিয়েছে’ (সূরা আল মায়িদাহ; আয়াত ৩২)। তোমার ধর্মে মানুষের জীবনের পবিত্রতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; তার কিছু উপলব্ধির আশা করা যায় এই আয়াত তুলে ধরে। তবে দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন আজো আসেনি।
তাই তোমরা হতাশা বোধ করো- তোমাদের অন্তত কেউ কেউ। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বসবাসকারী কেউ কেউ অন্যদের জানাতে চায় না যে, তারা নিজেরা মুসলমান। সেসব দেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা ক্রমে বাড়ছে। তাই তারা এমন কোনো কথাবার্তা এড়িয়ে চলে, যা তাদের সমাজচ্যুত করতে পারে। অপর দিকে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর কিছু লোক দুঃখজনকভাবে ঘৃণার জবাব দিচ্ছে ঘৃণা দিয়ে।
আমি যেমন ছোটবেলায় ভাবতাম, সম্ভবত তোমরাও ভেবে থাকো, ভিন্ন সময় ও স্থানে তোমরা বাস করলে কেমন হতো। কিন্তু এ সব কিছু সত্ত্বেও আমাদের এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, জীবনের বোঝাগুলো ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক বিকাশের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষা দিতে পারে। অবশ্যই তোমাদের বুঝতে হবে, একদল মানুষ ইতিহাসের ‘সামষ্টিক পরীক্ষা’ দেয়া থেকে বেঁচে গেছে। তারা নির্যাতন, বর্ণবাদ, অব্যাহত যুদ্ধবিগ্রহ, জাতিগত নিমূল অভিযানেরও শিকার হয়নি। মুসলমানেরা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা পর্যন্ত সর্বত্র এসব কিছুর শিকার হচ্ছে।
এসব কষ্ট ও যাতনা অতিক্রমের জন্য তোমাদের অবশ্যই প্রথমে জানতে হবে- তোমরা কারা। নিজেদের মূল্যবাধ ও পরিচয়ের জন্য তোমাদের হতে হবে গর্বিত। ঘৃণার মোকাবেলায় ভালোবাসা থেকে কখনো বিরত হওয়া চলবে না। তোমাদের পৌঁছতে হবে অন্যদের কাছে। শিক্ষা দিতে ও সচেতন করতে হবে অন্যদের। কারণ, তোমরা যদি বসে থাকো, বর্ণবিদ্বেষ জয়ী হবে এবং তোমরা এই অনন্য সুযোগ হারিয়ে ফেলবে।
মাঝে মধ্যে ওদের জন্য আমার করুণা হয়, যারা অনেক সুযোগ-সুবিধার মধ্যে জন্ম নিয়েছে। যদিও তাদের আর্থিক ও বৈষয়িক সুবিধা আছে, তাদের সে অভিজ্ঞতা নেই, যা পাওয়া যায় অভাব ও দুর্ভোগ থেকে। দুঃখ ও বেদনা যে জ্ঞান দেয়, তার সাথে কিছুই তুলনীয় নয়।
যখন তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা জন্ম নেয়, তখন স্মরণ করতে চেষ্টা করো, আল্লাহ ‘কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৬)
যখন বড় হলাম ও শৈশবের ওই সব ফ্যান্টাসির কথা স্মরণ করলাম, আমি উপনীত হলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উপসংহারে। যদি পারতাম, আমার অতীতের পুনরাবৃত্তি করতাম, এই অতীতকে বদলাতাম না কোনোভাবেই, অতীত যতই কঠিন হোক না কেন। অতীত দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে আলিঙ্গন করতাম। প্রতিটি অশ্রুবিন্দু আর প্রত্যেক ক্ষতির পুনরাবৃত্তি ঘটাতাম। প্রতিটি বিজয় আবার উদযাপন করতাম, সে বিজয় যত ক্ষুদ্র হোক।
যখন বয়স থাকে কম, তখন আমাদের বলা হয় না যে, ব্যথাবেদনা ও দুঃখ-যাতনাকে ভয় করা উচিত নয়। শেখানো হয় না যে, একজন মানুষের পরিচিতির বিকাশ, জীবনের লক্ষ্যবোধ ও মানবিক চেতনার মুক্তির ক্ষেত্রে অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না। দাসত্বকে কখনো হজম করতে নেই, কিংবা ভুক্তভোগী হয়ে থাকাও উচিত নয়। দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও অবিচারের প্রতিরোধ হচ্ছে আরো অর্থবহ অস্তিত্ব এবং উন্নততর জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক প্রয়োজনীয় শর্ত।
এটা বলছি, কারণ আমি বুঝি তোমাদের অনেকে কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছ। উদ্বাস্তুশিবিরবাসীদের মধ্যে যায় আমাদের প্রজন্ম, তারা এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আর তখন কেমন সহিংসতা বিরাজ করছিল, তা তোমরা কখনো কল্পনাও করতে পারবে না। মানবজাতির বেশির ভাগেরই জন্যই এখন বছরগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জ বটে। তবে এ কথাটা বেশি সত্য, বিশেষ করে তোমাদের মতো তরুণ মুসলমানদের বেলায়। মার্কিন ও ইউরোপিয়ান রাজনীতিকদের বর্ণবাদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী মনোভাবে পৃথিবীর বেশির ভাগই প্লাবিত। এ ক্ষেত্রে, স্বার্থপর ব্যক্তিরা জঘন্য অ্যাজেন্ডা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা মানুষের ভীতি ও অজ্ঞতা নিয়ে খেলছে। সহিংসতা ও পাল্টা সহিংসতা (নিজেদের মুসলমান বলে দাবিদার কিছু গ্রুপ জড়িত) তাদের পুঁজি। এমন এক অবস্থায় তোমরা নিজেদের দেখছ ফাঁদে পড়া অবস্থায় এবং গতানুগতিকতা, মিডিয়ার ঘৃণা প্রচার ও সহিংসতার কারাগারে বন্দী হিসেবে। তোমরা দেখছ যে, তোমাদের টার্গেট করা হয়েছে; বিশেষ কোনো তকমা এঁটে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের ভীতির পাত্র বানানো হয়েছে অন্যায়ভাবে।
তোমাদের বেশির ভাগই জন্মগ্রহণ করেছে এবং বড় হয়েছে ওই সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্দিত্বের মধ্যে। এমন কোনো সময়ের কথা তোমাদের মনে পড়ে না, যখন জীবন কিছুটা স্বাভাবিক ছিল; যখন তোমরা দুনিয়ার বেশির ভাগ ভ্রান্তির ক্ষেত্রে ‘বলির পাঁঠা’ হয়ে যাওনি। বাস্তবে তোমাদের স্বভাবচরিত্র গঠিত হয়েছে এই পক্ষপাতদুষ্ট বাস্তবতার ভিত্তিতে। তোমাদের বেঁচে থাকতে হয় দুর্ব্যবহারজনিত ক্রোধ, আত্মরক্ষার মরিয়া প্রয়াস, পরিবারের দেখাশোনা এবং নিজের কমিউনিটি, কালচার ও ধর্মের সপক্ষে দাঁড়ানোর মধ্যে।
সবচেয়ে গুরুত্ববহ হচ্ছে, তোমাদের প্রতিদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য। যেসব সমাজে তোমরা নিজেদের দেখতে পাও প্রত্যাখ্যাত ও বর্জিত হিসেবে, সেখানে নাগরিকত্ব অর্জনের সংগ্রাম করতে হয়। ‘ওরা’ চায়, ওদের সমাজে তোমরা মিশে যাও। কিন্তু যখন তোমরা তাদের কাছে যাও, তারা ঠেলে তোমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। তাই মনে হয়, তোমাদের কাজটা অসম্ভব হয়ে উঠছে। ভুলভাবে তোমাদের তুলে ধরা এবং তোমাদের ধর্মের মহান মূল্যবোধগুলোর ভুল উপস্থাপনের বিরুদ্ধে তোমাদের ধাক্কা দেয়ার কাজটি এখনো বাকি। ওদের বর্ণবিদ্বেষ দিন দিন বাড়ছে মনে হয়। তোমরা তাদের বোঝানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেও তাদের ঘৃণার প্রতিটি বেপরোয়া তীরের টার্গেট হচ্ছে ইসলাম।
প্রথম কথা হলো- কেন ইসলামের প্রসঙ্গ এনেছি, তোমরা কদাচিৎ তা উপলব্ধি করে থাকো। ইসলাম কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করার জন্য যেতে আমন্ত্রণ জানায়নি। তোমাদের সভ্যতার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে মুসলমানদের দুর্দশা সৃষ্টি করতেও বলা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে।
মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বাইরে গিয়ে গুয়ান্তানামো বন্দিশিবির তৈরি করার সময়ে ইসলামে পরামর্শ কী তা জানতে চাওয়া হয়নি। সম্পূর্ণরূপে আত্মস্বার্থ প্রণোদিত রাজনৈতিক মতলবে বিবদমান পক্ষগুলো সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধে লিপ্ত। সেখানে ইসলাম মোটেও সম্পৃক্ত নয়।
ইহুদিবাদী মিলিশিয়া ব্রিটিশের সহায়তায় ফিলিস্তিনকে পদানত করেছে। পরে তা করা হয়েছে আমেরিকার সাহায্য নিয়ে। এতে বিগত শতাব্দীর বেশির ভাগ সময়েই পবিত্রভূমি পরিণত হয়েছে রণাঙ্গনে। স্থায়ী যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের পাদপীঠে পর্যবসিত হয়েছে অঞ্চলটি। ইসলাম তো এ সব কিছুর জন্য দায়ী নয়।
এমন বহু নজিরই তুলে ধরা যায়, যা জেনে তোমরা নিজেরাও বিস্মিত হয়ে থাকো। উপনিবেশবাদে ও সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের উদ্ভাবন নয়। বরং ইসলাম এশিয়া, আফ্রিকা ও আরবের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে এসব নিষ্ঠুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। পাইকারি হারে দাস বানানোর পথ তো ইসলাম দেখায়নি। অথচ, আমেরিকা-ইউরোপে কয়েক মিলিয়ন দাস ছিল মুসলমান।
ওদের এসব কথা জানাতে চেষ্টা করো। জোর দিয়ে বলো, আইএসের মতো ভয়াবহ গ্রুপগুলোর জন্ম ইসলাম দেয়নি। বরং এগুলো জন্ম নিয়েছে সহিংসতা, লোভ এবং বিদেশের হস্তক্ষেপের বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে। কিন্তু ‘ওরা’ এসব কথায় কান না দিয়ে পবিত্র গ্রন্থ থেকে সুবিধামতো কিছু কথা ব্যবহার করে থাকে। অথচ, এই আয়াতগুলো দিয়ে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বোঝানো হয়েছিল। কুরআন শরিফের এমন আয়াতও তোমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছ যাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘যদি কেউ একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল এবং যদি কেউ একটি জীবন বাঁচায়, যেন সে গোটা মানবজাতির জীবন বাঁচিয়েছে’ (সূরা আল মায়িদাহ; আয়াত ৩২)। তোমার ধর্মে মানুষের জীবনের পবিত্রতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; তার কিছু উপলব্ধির আশা করা যায় এই আয়াত তুলে ধরে। তবে দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন আজো আসেনি।
তাই তোমরা হতাশা বোধ করো- তোমাদের অন্তত কেউ কেউ। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বসবাসকারী কেউ কেউ অন্যদের জানাতে চায় না যে, তারা নিজেরা মুসলমান। সেসব দেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা ক্রমে বাড়ছে। তাই তারা এমন কোনো কথাবার্তা এড়িয়ে চলে, যা তাদের সমাজচ্যুত করতে পারে। অপর দিকে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর কিছু লোক দুঃখজনকভাবে ঘৃণার জবাব দিচ্ছে ঘৃণা দিয়ে।
আমি যেমন ছোটবেলায় ভাবতাম, সম্ভবত তোমরাও ভেবে থাকো, ভিন্ন সময় ও স্থানে তোমরা বাস করলে কেমন হতো। কিন্তু এ সব কিছু সত্ত্বেও আমাদের এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, জীবনের বোঝাগুলো ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক বিকাশের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষা দিতে পারে। অবশ্যই তোমাদের বুঝতে হবে, একদল মানুষ ইতিহাসের ‘সামষ্টিক পরীক্ষা’ দেয়া থেকে বেঁচে গেছে। তারা নির্যাতন, বর্ণবাদ, অব্যাহত যুদ্ধবিগ্রহ, জাতিগত নিমূল অভিযানেরও শিকার হয়নি। মুসলমানেরা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা পর্যন্ত সর্বত্র এসব কিছুর শিকার হচ্ছে।
এসব কষ্ট ও যাতনা অতিক্রমের জন্য তোমাদের অবশ্যই প্রথমে জানতে হবে- তোমরা কারা। নিজেদের মূল্যবাধ ও পরিচয়ের জন্য তোমাদের হতে হবে গর্বিত। ঘৃণার মোকাবেলায় ভালোবাসা থেকে কখনো বিরত হওয়া চলবে না। তোমাদের পৌঁছতে হবে অন্যদের কাছে। শিক্ষা দিতে ও সচেতন করতে হবে অন্যদের। কারণ, তোমরা যদি বসে থাকো, বর্ণবিদ্বেষ জয়ী হবে এবং তোমরা এই অনন্য সুযোগ হারিয়ে ফেলবে।
মাঝে মধ্যে ওদের জন্য আমার করুণা হয়, যারা অনেক সুযোগ-সুবিধার মধ্যে জন্ম নিয়েছে। যদিও তাদের আর্থিক ও বৈষয়িক সুবিধা আছে, তাদের সে অভিজ্ঞতা নেই, যা পাওয়া যায় অভাব ও দুর্ভোগ থেকে। দুঃখ ও বেদনা যে জ্ঞান দেয়, তার সাথে কিছুই তুলনীয় নয়।
যখন তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা জন্ম নেয়, তখন স্মরণ করতে চেষ্টা করো, আল্লাহ ‘কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৬)
ড. রামজি বারুদ |
[কাউন্টার কারেন্টস ডট অর্গ-এর সৌজন্যে]
লেখক : ড. রামজি বারুদ ২০ বছর ধরে লিখছেন মধ্যপ্রাচ্যের ওপর। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কলামিস্ট, গ্রন্থকার ও মিডিয়া কনসালট্যান্ট। তার উল্লেখযোগ্য বই : সার্চিং জেনিন, দ্য সেকেন্ড প্যালেস্টাইনিয়ান ইন্তিফাদা এবং সর্বশেষ লেখা- মাই ফাদার ওয়াজ অ্যা ফ্রিডম ফাইটার : গাজাস আনটোল্ড স্টোরি।’
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
লেখক : ড. রামজি বারুদ ২০ বছর ধরে লিখছেন মধ্যপ্রাচ্যের ওপর। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত কলামিস্ট, গ্রন্থকার ও মিডিয়া কনসালট্যান্ট। তার উল্লেখযোগ্য বই : সার্চিং জেনিন, দ্য সেকেন্ড প্যালেস্টাইনিয়ান ইন্তিফাদা এবং সর্বশেষ লেখা- মাই ফাদার ওয়াজ অ্যা ফ্রিডম ফাইটার : গাজাস আনটোল্ড স্টোরি।’
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
No comments