‘আমি ফরসা নারী নই’...তো? by ফাতেমা বেগম
মনে পড়ে ছোটবেলায় শোনা কিছু অভিব্যক্তির কথা। ধরা যাক, কাউকে, কোনো মেয়ে দেখতে কেমন জিজ্ঞেস করলাম। তার উত্তর হতে পারে, মেয়েটা সুন্দর কিন্তু কাটিং ভালো না। আবার উত্তর হতে পারে, মেয়েটা দেখতে ময়লা কিন্তু কাটিং ভালো। এখানে ‘সুন্দর’ মানে ফরসা রং বোঝানো হচ্ছে এবং ‘ময়লা’ মানে গায়ের কালো রং বা শ্যামলা রং বোঝানো হচ্ছে। আর কাটিং বলতে বোঝাচ্ছে চেহারার গড়ন। তাই প্রচলিত নিয়মে কোনো মেয়ে দেখতে সুন্দর কি না, তার প্রথম শর্ত হচ্ছে তার গায়ের রং ফরসা হওয়া।
এই মন্তব্যগুলোর সঙ্গে এক ভয়াবহ সামাজিক চিত্র আমাকে ভাবাতে শুরু করে। আর সম্প্রতি খবরের কাগজে একজন স্কুলশিক্ষিকার আত্মহত্যার খবরটি পড়ে মেয়েদের ত্বকের রং ও এর সামাজিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করলাম। খবরটি ছিল ঢাকা শহরের নামকরা মনিপুর স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষিকার আত্মহত্যা প্রসঙ্গে।
২০১১ সালে বিয়ে হওয়ার পরে সুমির স্বামী সুমন হাবিব ও তাঁর পরিবার রীতিমতো মানসিক অত্যাচার শুরু করেছিল সুমির ওপর। দোষ একটাই, ‘সুমি কেন এত কালো?’ কেন সুমি আটা-ময়দা মাখা সুন্দরী না? গর্ভপাত করা হলো চার–চারবার, যাতে কালো সন্তান না আসে ঘরে, দরকার পড়লে ফরসা বাচ্চা দত্তক নেওয়া হবে।
ত্বকের কালো রং কি কেবল নারীদেরই সমস্যা? সম্ভবত তাই। তাই তো আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে বহু যুগ ধরে সুন্দরী নারী মানে দুধে-আলতা বরণ কন্যার বর্ণনাই উঠে এসেছে। নারীর ক্ষেত্রে প্রথমে এবং প্রধানত আসে শারীরিক সৌন্দর্য। আজ নারীরা শিক্ষিত ও কর্মজীবী হওয়ার পরও পুরুষের মতো তাদের শিক্ষা ও পেশাগত মর্যাদা সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ফরসা শব্দটির আভিধানিক ইংরেজি শব্দ হলো ফেয়ার। আভিধানিকভাবে তাই দেখা যায়, ফরসা শব্দটি ইতিবাচক অর্থ ধারণ করে। আমরা খুব ভালো মানুষ বোঝাতে বলি সাদামনের মানুষ। কালো শব্দটির সঙ্গে নেতিবাচক অর্থ সংযুক্ত। অন্ধকার আর কালোকে সমার্থক দেখা হয়। কালো দিবস, কালো পতাকা, কালো রাত, কালো বা অন্ধকার জগৎ, অন্তর কালা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই যে ফরসা আর কালো গায়ের রং, তা বিভিন্ন দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আবার আপেক্ষিক। বাংলাদেশের একজন ফরসা মানুষ যাকে সাদা গোত্রে চিন্তা করা হয়, সে কিন্তু পৃথিবীর সাদা মানুষের কাছে একজন ব্রাউন মানুষ। আবার বাংলাদেশের একজন কালো মানুষ পৃথিবীর কালো জাতির কাছে ব্রাউন হিসেবে গণ্য হয়। উন্নত বিশ্বে কালোদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য কালো ত্বকের মানুষদের আজকাল ডার্ক ব্রাউন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অনেক গুণী একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কালো ত্বকের কারণে বাঙালি নারীর বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখান থেকে মুক্তি পেতে সমাজে কালো ত্বকের সপক্ষে একটি চেতনা বিপ্লব হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের রং যা-ই হোক, নিজের যোগ্যতায় গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
কন্যাসন্তান এমনিতেই অবহেলিত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, তার ওপর যদি ফরসা না হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নিজের পরিবারেই সেই কালো মেয়েটি হীনম্মন্যতার মধ্য দিয়ে সময় কাটায়। বাবা-মায়ের কালো মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন? তাদের ধারণা, এই কালো মেয়ের বিয়ে একটা বিরাট সমস্যা হবে বা অনেক ব্যয়বহুল হবে। যদিওবা বিয়ের সুযোগ হয়, কালো মেয়ের জন্য যৌতুকের পরিমাণ চড়া হয়ে যায়। যৌতুক দেওয়ার জন্য বা যৌতুক না দিতে পারার জন্য কত পরিবারে যে প্রাণহানিসহ করুণ ঘটনা ঘটেছে, তা কম-বেশি সবারই জানা। বিয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয়। কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ভবিষ্যৎ বংশধর কালো হতে পারে, সেই আশঙ্কা!
চিকিৎসাবিজ্ঞান এই ত্বকের পার্থক্য কীভাবে ব্যাখ্যা করছে? চামড়ার কোষে মেলানিন নামক যে রঞ্জক পদার্থ থাকে, সেটার জন্যই মানুষ সাদা বা কালো হয়। যাদের চর্মকোষে মেলানিন রঞ্জক পদার্থ বেশি থাকে, তাদের চর্ম গাঢ় রঙের হয়। সাদা চামড়ার মানুষের চর্মকোষে এই মেলানিনের মাত্রা অনেক কম থাকে। মেলানিনের মাত্রা বেশি থাকাতে চামড়ার রং যদিও গাঢ় হয়, তাহলেও এর একটা বিরাট উপকার আছে। সূর্যালোকে যে অতিবেগুনি রশ্মি থাকে, তা ওই মেলানিন কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে শরীরের ভেতরে ঢোকে না, ফলে তাদের চর্ম ক্যানসার রোগ হয় না। সেই কারণে শীতপ্রধান দেশে যেখানকার মানুষের চামড়া সাদা, তাদের মধ্যে চর্ম ক্যানসারের মাত্রা বহু গুণ বেশি। গাঢ় রং চামড়ার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও বেশি বলে গড় আয়ু হিসাব করলে দেখা যাবে, গাঢ় চামড়াবিশিষ্ট মানুষ সাদা চামড়ার মানুষের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই তথ্য জানার পর ভবিষ্যৎ বংশধরের ত্বক কালো হওয়ার সম্ভাবনা কি একটি হতাশার সংবাদ, নাকি আশার সংবাদ? সুমির স্বামীর পরিবারের মতো অনেক পরিবার কি এই তথ্য জানে?
আমাদের দেশে নাটকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর নাটকের মধ্য দিয়ে সুন্দর নায়ক-নায়িকার ভূমিকা প্রধান হওয়া কমে। এরপর ফারুকী ও তাঁর সহযোগীদের নাটকে আরেকটি বিরাট সংস্কার ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নায়ককে চেহারাকেন্দ্রিক না করে চরিত্রকেন্দ্রিক করা। যেকোনো উচ্চতা, গায়ের রং, চেহারা, আঞ্চলিক ভাষা—সবই গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে এই নতুন ধারার নাটক, টেলিফিল্মগুলোতে। নায়কের বয়স, কম উচ্চতা, ওজন, মাথার টাক, কম শিক্ষাগত যোগ্যতা, কথায় আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব, গায়ের কালো ত্বক—সবকিছুকেই খুব ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। নায়িকারা মুগ্ধ হচ্ছে যেকোনো ধরনের একজন পুরুষ চরিত্রের নায়ককে এবং তাকে ভালোবাসছে। অন্যদিকে, নায়িকাদের ভূমিকা কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে? নায়িকারা কিন্তু থাকছে মূলত সুন্দরী, কম বয়সী নারী চরিত্র হিসেবেই। শেষ পর্যন্ত নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যই কি তার যোগ্যতা আর সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে থেকে যাচ্ছে না?
গল্প, সাহিত্য, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, সিনেমা, গানেও সুন্দর মেয়ের বর্ণনায় নারীর ত্বক সাদা বা ফরসা বলে উল্লেখ
করা হয়। বাংলাদেশের তরুণ জনপ্রিয় মিউজিক কম্পোজার এবং সংগীতশিল্পীর গানেও আমরা পাই, ‘ভালোবাসব, বাসব রে......দুধে-আলতা গায়ের বরণ, রূপ যে তার কাঁচা সোনা...’।
ত্বক নিয়ে এই সংস্কারে লাভবান কারা? দেশি-বিদেশি কসমেটিকস ব্যবসায়ীরা। তাঁরা কালো ত্বকের মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য উপহার দিচ্ছেন রং ফরসা করার দ্রব্যাদি। শুধু কালো নারী নয়, আরও ফরসা হওয়ার জন্য কম কালো নারীরাও তা ব্যবহার করে। এ ছাড়া আছে সাময়িকভাবে ফরসা দেখানোর জন্য দ্রব্যসামগ্রীর বাণিজ্য।
অনেক গুণী একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কালো ত্বকের কারণে বাঙালি নারীর বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখান থেকে মুক্তি পেতে সমাজে কালো ত্বকের সপক্ষে একটি চেতনা বিপ্লব হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের রং যা-ই হোক, নিজের যোগ্যতায় গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কালো ও ফরসা ত্বকের অধিকারী উভয় নারীকেই এই চেতনা বিপ্লবে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। ফরসা ত্বকের নারীরও গর্ব হতে হবে তার যোগ্যতায়, ত্বকের রঙের জন্য নয়। কালো ত্বকের নারী হলে সুমীর মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে একটি অসুস্থ সামাজিক মানসিকতাকে পুষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।
ফাতেমা বেগম: গবেষক।
এই মন্তব্যগুলোর সঙ্গে এক ভয়াবহ সামাজিক চিত্র আমাকে ভাবাতে শুরু করে। আর সম্প্রতি খবরের কাগজে একজন স্কুলশিক্ষিকার আত্মহত্যার খবরটি পড়ে মেয়েদের ত্বকের রং ও এর সামাজিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করলাম। খবরটি ছিল ঢাকা শহরের নামকরা মনিপুর স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষিকার আত্মহত্যা প্রসঙ্গে।
২০১১ সালে বিয়ে হওয়ার পরে সুমির স্বামী সুমন হাবিব ও তাঁর পরিবার রীতিমতো মানসিক অত্যাচার শুরু করেছিল সুমির ওপর। দোষ একটাই, ‘সুমি কেন এত কালো?’ কেন সুমি আটা-ময়দা মাখা সুন্দরী না? গর্ভপাত করা হলো চার–চারবার, যাতে কালো সন্তান না আসে ঘরে, দরকার পড়লে ফরসা বাচ্চা দত্তক নেওয়া হবে।
ত্বকের কালো রং কি কেবল নারীদেরই সমস্যা? সম্ভবত তাই। তাই তো আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতিতে বহু যুগ ধরে সুন্দরী নারী মানে দুধে-আলতা বরণ কন্যার বর্ণনাই উঠে এসেছে। নারীর ক্ষেত্রে প্রথমে এবং প্রধানত আসে শারীরিক সৌন্দর্য। আজ নারীরা শিক্ষিত ও কর্মজীবী হওয়ার পরও পুরুষের মতো তাদের শিক্ষা ও পেশাগত মর্যাদা সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ফরসা শব্দটির আভিধানিক ইংরেজি শব্দ হলো ফেয়ার। আভিধানিকভাবে তাই দেখা যায়, ফরসা শব্দটি ইতিবাচক অর্থ ধারণ করে। আমরা খুব ভালো মানুষ বোঝাতে বলি সাদামনের মানুষ। কালো শব্দটির সঙ্গে নেতিবাচক অর্থ সংযুক্ত। অন্ধকার আর কালোকে সমার্থক দেখা হয়। কালো দিবস, কালো পতাকা, কালো রাত, কালো বা অন্ধকার জগৎ, অন্তর কালা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই যে ফরসা আর কালো গায়ের রং, তা বিভিন্ন দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আবার আপেক্ষিক। বাংলাদেশের একজন ফরসা মানুষ যাকে সাদা গোত্রে চিন্তা করা হয়, সে কিন্তু পৃথিবীর সাদা মানুষের কাছে একজন ব্রাউন মানুষ। আবার বাংলাদেশের একজন কালো মানুষ পৃথিবীর কালো জাতির কাছে ব্রাউন হিসেবে গণ্য হয়। উন্নত বিশ্বে কালোদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য কালো ত্বকের মানুষদের আজকাল ডার্ক ব্রাউন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অনেক গুণী একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কালো ত্বকের কারণে বাঙালি নারীর বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখান থেকে মুক্তি পেতে সমাজে কালো ত্বকের সপক্ষে একটি চেতনা বিপ্লব হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের রং যা-ই হোক, নিজের যোগ্যতায় গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
কন্যাসন্তান এমনিতেই অবহেলিত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, তার ওপর যদি ফরসা না হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নিজের পরিবারেই সেই কালো মেয়েটি হীনম্মন্যতার মধ্য দিয়ে সময় কাটায়। বাবা-মায়ের কালো মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন? তাদের ধারণা, এই কালো মেয়ের বিয়ে একটা বিরাট সমস্যা হবে বা অনেক ব্যয়বহুল হবে। যদিওবা বিয়ের সুযোগ হয়, কালো মেয়ের জন্য যৌতুকের পরিমাণ চড়া হয়ে যায়। যৌতুক দেওয়ার জন্য বা যৌতুক না দিতে পারার জন্য কত পরিবারে যে প্রাণহানিসহ করুণ ঘটনা ঘটেছে, তা কম-বেশি সবারই জানা। বিয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করা হয়। কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ভবিষ্যৎ বংশধর কালো হতে পারে, সেই আশঙ্কা!
চিকিৎসাবিজ্ঞান এই ত্বকের পার্থক্য কীভাবে ব্যাখ্যা করছে? চামড়ার কোষে মেলানিন নামক যে রঞ্জক পদার্থ থাকে, সেটার জন্যই মানুষ সাদা বা কালো হয়। যাদের চর্মকোষে মেলানিন রঞ্জক পদার্থ বেশি থাকে, তাদের চর্ম গাঢ় রঙের হয়। সাদা চামড়ার মানুষের চর্মকোষে এই মেলানিনের মাত্রা অনেক কম থাকে। মেলানিনের মাত্রা বেশি থাকাতে চামড়ার রং যদিও গাঢ় হয়, তাহলেও এর একটা বিরাট উপকার আছে। সূর্যালোকে যে অতিবেগুনি রশ্মি থাকে, তা ওই মেলানিন কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে শরীরের ভেতরে ঢোকে না, ফলে তাদের চর্ম ক্যানসার রোগ হয় না। সেই কারণে শীতপ্রধান দেশে যেখানকার মানুষের চামড়া সাদা, তাদের মধ্যে চর্ম ক্যানসারের মাত্রা বহু গুণ বেশি। গাঢ় রং চামড়ার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও বেশি বলে গড় আয়ু হিসাব করলে দেখা যাবে, গাঢ় চামড়াবিশিষ্ট মানুষ সাদা চামড়ার মানুষের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই তথ্য জানার পর ভবিষ্যৎ বংশধরের ত্বক কালো হওয়ার সম্ভাবনা কি একটি হতাশার সংবাদ, নাকি আশার সংবাদ? সুমির স্বামীর পরিবারের মতো অনেক পরিবার কি এই তথ্য জানে?
আমাদের দেশে নাটকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর নাটকের মধ্য দিয়ে সুন্দর নায়ক-নায়িকার ভূমিকা প্রধান হওয়া কমে। এরপর ফারুকী ও তাঁর সহযোগীদের নাটকে আরেকটি বিরাট সংস্কার ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নায়ককে চেহারাকেন্দ্রিক না করে চরিত্রকেন্দ্রিক করা। যেকোনো উচ্চতা, গায়ের রং, চেহারা, আঞ্চলিক ভাষা—সবই গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে এই নতুন ধারার নাটক, টেলিফিল্মগুলোতে। নায়কের বয়স, কম উচ্চতা, ওজন, মাথার টাক, কম শিক্ষাগত যোগ্যতা, কথায় আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব, গায়ের কালো ত্বক—সবকিছুকেই খুব ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। নায়িকারা মুগ্ধ হচ্ছে যেকোনো ধরনের একজন পুরুষ চরিত্রের নায়ককে এবং তাকে ভালোবাসছে। অন্যদিকে, নায়িকাদের ভূমিকা কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে? নায়িকারা কিন্তু থাকছে মূলত সুন্দরী, কম বয়সী নারী চরিত্র হিসেবেই। শেষ পর্যন্ত নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যই কি তার যোগ্যতা আর সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে থেকে যাচ্ছে না?
গল্প, সাহিত্য, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, সিনেমা, গানেও সুন্দর মেয়ের বর্ণনায় নারীর ত্বক সাদা বা ফরসা বলে উল্লেখ
করা হয়। বাংলাদেশের তরুণ জনপ্রিয় মিউজিক কম্পোজার এবং সংগীতশিল্পীর গানেও আমরা পাই, ‘ভালোবাসব, বাসব রে......দুধে-আলতা গায়ের বরণ, রূপ যে তার কাঁচা সোনা...’।
ত্বক নিয়ে এই সংস্কারে লাভবান কারা? দেশি-বিদেশি কসমেটিকস ব্যবসায়ীরা। তাঁরা কালো ত্বকের মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য উপহার দিচ্ছেন রং ফরসা করার দ্রব্যাদি। শুধু কালো নারী নয়, আরও ফরসা হওয়ার জন্য কম কালো নারীরাও তা ব্যবহার করে। এ ছাড়া আছে সাময়িকভাবে ফরসা দেখানোর জন্য দ্রব্যসামগ্রীর বাণিজ্য।
অনেক গুণী একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কালো ত্বকের কারণে বাঙালি নারীর বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। এখান থেকে মুক্তি পেতে সমাজে কালো ত্বকের সপক্ষে একটি চেতনা বিপ্লব হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের রং যা-ই হোক, নিজের যোগ্যতায় গর্বিত ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। কালো ও ফরসা ত্বকের অধিকারী উভয় নারীকেই এই চেতনা বিপ্লবে সমানভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। ফরসা ত্বকের নারীরও গর্ব হতে হবে তার যোগ্যতায়, ত্বকের রঙের জন্য নয়। কালো ত্বকের নারী হলে সুমীর মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে একটি অসুস্থ সামাজিক মানসিকতাকে পুষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।
ফাতেমা বেগম: গবেষক।
No comments