রাজনীতিতে সুবাতাসটা কোথায়! by মাসুদ মজুমদার
মন্ত্রী
ওবায়দুল কাদের মনে করেন, বিএনপির আন্দোলন করার শক্তি ও ক্ষমতা নেই।
সুরঞ্জিত বাবুর মন্তব্য, বিএনপি টিকবে কি না সংশয় রয়েছে। হাছান মাহমুদের
বিশ্বাস, জনগণ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মির্জা ফখরুল বললেন, আওয়ামী
লীগ দেউলিয়া হয়ে গেছে। এ ধরনের ‘ব্লেম গেইম’ রাজনীতির সাধারণ ও সনাতনী
চরিত্র। মান ও গুণগত বিবেচনায় এটি হয়তো ভালো বৈশিষ্ট্য নয়। তার পরও দেশীয়
রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্লেম গেইম একটা সহনীয় মাত্রা পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য।
প্রতিপক্ষের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করার জন্য এ ধরনের বক্তব্যকে
অগ্রহণযোগ্য ভাবা হয় না। যদিও এসব বক্তব্য ও মন্তব্য উসকানিমূলক।
বিশ্বরাজনীতিতে ব্লেম গেইম বলে কোনো সাদামাটা শব্দ নেই। সেখানে কূটনৈতিক মারপ্যাঁচের কৌশল ও মারণ খেলা রয়েছে। কোনো দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দীর্ঘ দিন বজায় রাখা সম্ভব হলেও ব্লেম গেইম শেষ হয়ে যায় না। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আসে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের নাম মাথায় নেয়া যায়। এসব দেশে দোষারোপের বিষয়টা ছিদ্রান্বেষণের মধ্যে পড়ে থাকে না, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেত্রীর মতো অসহনীয় শব্দচয়ন করে কেউ কাউকে দেশের বাইরে চলে যেতে পরামর্শ দেয় না। অহরাত্রি গালির ভাষায় কথা বলে না। পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান করে না। রাজনৈতিক ইস্যু নীতিগত অবস্থানে চলে যায়। বিশেষত দ্বিধারাভিত্তিক রাজনীতি ইস্যু কমায়। যেমন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মাত্র কয়েকটি নীতিগত পার্থক্য স্পষ্ট। যারা সরকারে যায়, তারা সেটাকে আরো স্পষ্ট করে তোলে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ক্ষমতাচর্চা ও বিদেশনীতিতে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। যেমন ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস একটি ধারার নেতৃত্ব দেয়। ভারতে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানের মতো, কিংবা আওয়ামী লীগ-বিএনপি ধরনের দল নেই। তবে অন্য ধারায় কোনো না কোনো দল প্রতিদ্বন্দ্বীর কাতারে উঠে আসে।
কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশে বহু দল থাকে। তবে ভোটের রাজনীতি দীর্ঘ দিন চললে দলের সংখ্যা কমে যায়। রাজনৈতিক ইস্যুও মোটাদাগে চিহ্নিত হয়। তখন দলের চেয়ে মেরু ও জোটবদ্ধ রাজনীতি প্রাধান্য পেয়ে যেতে পারে। যেমন এখন ভারতে বিজেপি দ্বিতীয় স্রোত। একসময় বিজেপি ছিল না। তখনো রাজ্য ও কেন্দ্রে কংগ্রেসের আলাদা আলাদা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কনজারভেটিভ এবং লেবার পার্টি ব্রিটেনে দ্বিধারাবিভক্ত রাজনীতির অন্যতম উপমা। পাকিস্তানে মুসলিম লীগ-পিপলস পার্টির দ্রুত বিলুপ্তি ঘটবে এমনটি ধারণা করা যাবে না। মিয়ানমারে সু চি এত দিন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছেন সেনা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দলের সাথে। শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরবে কি না বলা সহজ নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেই পারে। বরং রাজনৈতিক অভিযোগ তোলাই দলীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এসব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া জরুরি। তবে আমাদের দেশে ব্লেম গেইমের সাথে যোগ হয় অনৈতিক অভিযোগ- যার লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করে দেয়ার অজুহাত খাড়া করা। তৈরি করা ডামি মামলায় জড়িয়ে দেয়ার দুষ্কর্ম সফল করা। আমাদের দেশে প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। মন্ত্রীরা পর্যন্ত এই অভিযোগের খেলায় তদন্তের আগে রায় ঘোষণা করে দেন। রায়ের আগে বিচার করে ফেলার প্রবণতাও তীব্রতর। বিচারের আগে রিমান্ড-জুলুম ও অত্যাচারের মাধ্যমে নির্দোষ মানুষকেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে শাস্তি পাইয়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনৈতিক ও মিথ্যা অভিযোগ তোলার মাত্রা সীমাহীন। রাজনৈতিক কৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা নীতিশাস্ত্রে সমর্থন না করলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় মেনে নেয়া হয়। এখন কোনো কৌশল নয়, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছিটানোর জন্য এবং রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লক্ষ্যে মিথ্যা অভিযোগ এমনভাবে তোলা হয়, যা শুধু গর্হিত নয়, অনৈতিক। সরল অর্থে অন্যায্যও। এ ধরনের প্রতিহিংসার রাজনৈতিক চর্চায় প্রায়ই বিরোধী দল সরকারি দলের আক্রমণাত্মক টার্গেটে পড়ে যায়। একইভাবে বিরোধী দল ও সরকারি দলকে আক্রমণাত্মক ভাষায় প্রান্তিক মন্তব্য করে ঘায়েল করতে চায়। এটাও এক ধরনের গণতন্ত্রচর্চা বটে। সাফল্যগাথা প্রচার করা সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি। বিরোধী দলের ভূমিকা হলো জনগণ ও সমর্থকদের মধ্যে উচ্চতর প্রত্যাশা জাগিয়ে রেখে সরকারের ব্যর্থতা ও ত্রুটিগুলো তুলে ধরা। ভুল তথ্য-উপাত্ত ফাঁস করে দিয়ে জনমত সৃষ্টি করা। তাই বিরোধী দল উহ, আহ, গেল, গেল বলে চিৎকার করলে জনগণের সিম্প্যাথি, সহমর্মিতা ও সমর্থন বাড়বে। ‘তথ্য-উপাত্ত’ দিয়ে বাকযুদ্ধ, কলমযুদ্ধ, বক্তব্য-বিবৃতির খিস্তিখেউর গণতন্ত্রের ভাষায় এ জন্যই সিদ্ধ। এটাও গণতন্ত্রে মত প্রকাশ ও জনমত গঠনের একটা সনাতনী প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে তুলোধুনো করলেন। এক দিন পর জাতীয় ভাষণে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরলেন। রওশন এরশাদ বলবেন তথাস্তু। এখন কার্যত বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব হলো সরকারের বক্তব্য খণ্ডন করা।
আমরাও জানি এবং মানি রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সেই ধারায় একধরনের শূন্যতা বিরাজমান। তার স্থলে যোগ হয়েছে ঢালাও মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক অভিযোগ তোলা। উপমা হিসেবে বলা যায়, একসময় সব মন্দ কাজের জন্য মার্কসবাদীদের দায়ী করা স্বাভাবিক ছিল। চারু মজুমদার থেকে হক-তোয়াহা-সিরাজ শিকদার পর্যন্ত সব রাজনৈতিক হত্যার জন্য তাদের গলা কাটার রাজনীতিকে দায়ী করা হতো। গণবাহিনী অভিযুক্ত হতো একটা সময় পর্যন্ত। বাস্তবে সব সময় মানুষ হত্যার পেছনে মার্কস ও মাওবাদীরা ছিল না, তখন সমস্যা দাঁড়িয়েছিল ভাই ভাইকে সম্পত্তির কারণে খুন করেও সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে আঙুল তুলত। এর মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগ প্রচার পেত। প্রকৃত অপরাধী আড়ালে থেকে যেত। এরপর সব ব্যাপারে জেএমবিসহ কিছু সংগঠনের নাম দিয়ে হত্যাকাণ্ড আড়াল করা হতো। তারপর দেখতাম সব কিছুর জন্য আঙুল তোলা হচ্ছে কয়েকটি দলের বিরুদ্ধে। অনেক পরে দেখা যেত ডাকাতের হাতে খুন হওয়া মানুষটির জন্য রাজনীতির নোংরা খেলা প্রাধান্য পেয়েছে। বিগত ক’বছর ধরে সব অকাজের জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী, মানবতাবিরোধী মামলার বিচার ঠেকানোর কৌশল বলে প্রচারিত হয়েছে। বাস্তবে বিচারও ঠেকেনি। অপকর্মটি বিএনপি-জামায়াতও করেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, রাষ্ট্র তার সন্তানতুল্য নাগরিককে ক্রসফায়ারে দিয়ে বন্দুকযুদ্ধ ও এনকাউন্টারের গল্প সাজায়। রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য নিয়ে অপহরণ করা হয়। সাদা পোশাকে গ্রেফতার করে কিংবা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক’দিন গুম করে রাখা হয়। তাহলে রাজনীতির কাছে আমরা সহিষ্ণুতা ও সংযম আশা করব কিভাবে!
এক সময়কার জাসদ রাজনীতির সুহৃদ হওয়ার সুবাদে কাজী আরিফ হত্যা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। এমনিতে সব হত্যাকে অসহনীয় ভাবি। মানুষ খুন সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেননি। এই অপকর্মকে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও বড় মাপের পাপ বলেছেন। তাৎক্ষণিক অভিযোগ তোলা হলো- কাজটি মৌলবাদীদের। অংশত বিশ্বাসও করলাম। ভাবলাম, হতেও তো পারে। মনে ক্ষোভও জাগল। শেষ পর্যন্ত বিচার হলো, তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হলো। তাদের কেউ মৌলবাদী নন। সবাই কথিত প্রগতিশীল বাম ঘরানার রাজনৈতিক ক্যাডার! অথচ প্রচারণা ও প্রতারণার ধূম্রজালে প্রকৃত অপরাধী দীর্ঘ দিন আড়ালে ছিল। এ ধরনের শত শত উপমা দেয়া যাবে। তাৎক্ষণিক আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
কূটনীতির রাজ্যে ব্লেম গেইমে নতুন করে জড়াল বাংলাদেশ-পাকিস্তান, ইরান-সৌদি আরব, তুরস্ক-রাশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া। পাক-ভারত ব্লেম গেইম তো নিত্যদিনের ঘটনা। দিল্লিতে মশা উড়লে ভারতীয়রা বলে এটি পাকিস্তানি চর। পাকিস্তানে যেকোনো নাশকতার দায় বর্তায় ভারতীয় সাউথ ব্লক এবং র-এর ওপর। প্রতিবেশী দু’টি দেশের মধ্যকার এই মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক যুদ্ধে আমাদের পোঁ ধরার কোনো মানে হয় না। ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের প্রতিবেশী, আবার প্রতিদ্বন্দ্বীও। পরমাণু শক্তিধর এই দুটো দেশের ব্যাপারে পড়শিদের সাথে রাখা ভারতের নিজস্ব কৌশল, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
মহিলা কূটনীতিক নিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলাটা উপভোগ্য, কিন্তু পরিপক্ব কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়। তবুও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ ধরনের কূটনৈতিক গেইম মেনে নেয়া হয়। ইরান যখন সৌদি আরবকে দায়ী করে আর সৌদি আরব যখন ইরানকে অভিযুক্ত করে, তখন আমরা উদ্বিগ্ন হই, উৎকণ্ঠিত হই, ব্যথিত হই; কিন্তু অস্বাভাবিক মনে করি না। এর কারণ, সার্বভৌম দুই দেশের মধ্যে স্বার্থের টানাপড়েন থাকবে। জাতিরাষ্ট্্েরর ধারণায় এটা বিলুপ্ত হবে না। কিন্তু নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বদেশের জনগণের সাথে মিথ্যাচার ও ধোঁকা দেয়া অন্যায়। বিএনপি যেমন এ দেশের মানুষের দ্বারা পরিচালিত বড় রাজনৈতিক দল; তেমনি আওয়ামী লীগও। দুটো দলের মৌল নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার নিয়ে কোনো বড় বিরোধ নেই। যে বিরোধ প্রচারণায় ঠাঁই পাচ্ছে তা রাজনৈতিক, দলান্ধ ভাবনার ফসল। জনগণের স্বার্থে, জনগণের জন্য সেসব অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ গুরুত্বহীন।
দেশের স্বার্থে বড় দু’টি রাজনৈতিক স্রোতধারা পরস্পরকে মেনে নেয়া, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে রাজনৈতিক সুস্থ সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগ চাইলেই বিএনপিকে নাই করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। বিএনপিও আওয়ামী লীগকে অস্বীকার করে রাজনীতি করতে পারবে না। ক্ষমতা উনিশ সাল পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে, না ষোলো সালেই এর যবনিকাপাত ঘটবে তা আগামী দিনের রাজনীতিই ঠিক করে দেবে। কারণ, ক্ষমতা ও মর্যাদা আল্লাহ দেন। আল্লাহই কেড়ে নেন। অনেক সময় দুর্বিনীত শাসকের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘ করার মধ্যেও খোদায়ি কুদরত নিহিত থাকে। তাই সব দুঃশাসন শুধু গজব নয়, রাজনৈতিক ভুলের মাশুলও হতে পারে। রাজনৈতিক ভুলের মাশুল বা খেসারত রাজনৈতিকভাবে দিতে হয়। এর জন্য আদালতে আখেরাতের অপেক্ষা করতে হয় না। এর প্রমাণ অসংখ্য। ইতিহাসের দলিলও অকাট্য।
বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখন নিয়তিবাদী। কারণ সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান বাস্তবে অকার্যকর ও নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ববাদী ছোবল কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা বোঝার জন্য প্রধান বিচারপতির মন্তব্য আমলে নেয়াই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা বলব, ইতোমধ্যে অনেক ক্ষমতা কেড়েও নিয়েছে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া আস্থার সঙ্কটে পড়েছে। সরকার পড়েছে বৈধতার সঙ্কটে। বিরোধী দলের সামনে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের সৃষ্টি করা পরিস্থিতির প্রতিকূলতা। শত মামলার বেড়াজাল তো আছেই। যারা রাজনীতিতে সুবাতাসের আলামত দেখছেন, তারা ভুলের মধ্যে রয়েছেন, না নিয়তিবাদীরা তাদের পিছু টানছেন- সেটা মূল্যায়ন করে ভবিষ্যৎ দেখা ও দেখানোর দায়িত্ব দূরদর্শী নেতৃত্বের। বাংলাদেশের মূল সঙ্কট জনগণ নয়, নেতৃত্বের। প্রত্যাশার জায়গায়ও রয়েছেন নেতৃত্ব। ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার মতো কারণ অনেক, তার মধ্যে রাজনৈতিক ইসলাম নির্মূল করতে গিয়ে সরকার অসংখ্য চরমপন্থীর জন্ম দিয়েছে। অসংখ্য মনে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার ওপর ব্যর্থতার গ্লানিও কম নেই। অন্য দিকে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় ধৈর্যের সাথে এগোনোর চেষ্টা করছে। আত্মস্থ করার ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। জেল-জুলুমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। রাজনীতিতে যোগ্যতমদের টিকে থাকার যে প্রাথমিক পরীক্ষা, সে ক্ষেত্রেও তারা পাস মার্ক পেয়েছে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিকে ‘না’ বলার যে সৎ সাহস বিএনপি নেত্রী দেখিয়েছেন, সেটাও দলটির অর্জনের খাতায় আরো কিছু নাম্বার বাড়িয়েছে। মোদ্দাকথা মির্জা ফখরুল বলেই দিয়েছেন, চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে কিছু হবে না। তাই আওয়ামী লীগের নেতিবাচক রাজনীতির সব সুফল বিএনপি ঘরে তুলবে, যদি সক্ষমতা প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও ভবিষ্যৎ ভাবনা বিবেচনায় নিয়েছেন বলে মনে হয়। তা না হলে বিএনপি নেত্রী ও নেতৃত্ব এখন সরকারের একক ‘টার্গেট’ হতো না। এটা যে পরিবর্তনকামী মানুষের ভরসাকেন্দ্রে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাই যদি রাজনীতির সুবাতাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়- কারো দ্বিমত পোষণের সুযোগ থাকার কথা নয়। তবে একটি-দু’টি সভা করতে দেয়া, দন্তনখরহীন বিরোধী দলের পোষমানা অবস্থান এবং সরকারি দলের তর্জন-গর্জন সুবাতাসের লক্ষণ নয়। বাংলাদেশকে নিয়ে শাসন-শোষণের মায়াবী জাল যেমন কম নয়, তেমনি খেলোয়াড়ের সংখ্যাও একজন নয়। আবার সব খেলোয়াড় একই ধরনের খেলায় অভ্যস্ত হয় না। সব ঘটনা একই মাত্রায় কিংবা একই ধরনের পরিণতিও ডেকে আনে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিও ধরন-ধারণ পাল্টায়।
masud2151@gmail.com
বিশ্বরাজনীতিতে ব্লেম গেইম বলে কোনো সাদামাটা শব্দ নেই। সেখানে কূটনৈতিক মারপ্যাঁচের কৌশল ও মারণ খেলা রয়েছে। কোনো দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দীর্ঘ দিন বজায় রাখা সম্ভব হলেও ব্লেম গেইম শেষ হয়ে যায় না। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আসে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের নাম মাথায় নেয়া যায়। এসব দেশে দোষারোপের বিষয়টা ছিদ্রান্বেষণের মধ্যে পড়ে থাকে না, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেত্রীর মতো অসহনীয় শব্দচয়ন করে কেউ কাউকে দেশের বাইরে চলে যেতে পরামর্শ দেয় না। অহরাত্রি গালির ভাষায় কথা বলে না। পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান করে না। রাজনৈতিক ইস্যু নীতিগত অবস্থানে চলে যায়। বিশেষত দ্বিধারাভিত্তিক রাজনীতি ইস্যু কমায়। যেমন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মাত্র কয়েকটি নীতিগত পার্থক্য স্পষ্ট। যারা সরকারে যায়, তারা সেটাকে আরো স্পষ্ট করে তোলে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ক্ষমতাচর্চা ও বিদেশনীতিতে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। যেমন ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস একটি ধারার নেতৃত্ব দেয়। ভারতে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানের মতো, কিংবা আওয়ামী লীগ-বিএনপি ধরনের দল নেই। তবে অন্য ধারায় কোনো না কোনো দল প্রতিদ্বন্দ্বীর কাতারে উঠে আসে।
কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশে বহু দল থাকে। তবে ভোটের রাজনীতি দীর্ঘ দিন চললে দলের সংখ্যা কমে যায়। রাজনৈতিক ইস্যুও মোটাদাগে চিহ্নিত হয়। তখন দলের চেয়ে মেরু ও জোটবদ্ধ রাজনীতি প্রাধান্য পেয়ে যেতে পারে। যেমন এখন ভারতে বিজেপি দ্বিতীয় স্রোত। একসময় বিজেপি ছিল না। তখনো রাজ্য ও কেন্দ্রে কংগ্রেসের আলাদা আলাদা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কনজারভেটিভ এবং লেবার পার্টি ব্রিটেনে দ্বিধারাবিভক্ত রাজনীতির অন্যতম উপমা। পাকিস্তানে মুসলিম লীগ-পিপলস পার্টির দ্রুত বিলুপ্তি ঘটবে এমনটি ধারণা করা যাবে না। মিয়ানমারে সু চি এত দিন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছেন সেনা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দলের সাথে। শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরবে কি না বলা সহজ নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেই পারে। বরং রাজনৈতিক অভিযোগ তোলাই দলীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এসব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া জরুরি। তবে আমাদের দেশে ব্লেম গেইমের সাথে যোগ হয় অনৈতিক অভিযোগ- যার লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করে দেয়ার অজুহাত খাড়া করা। তৈরি করা ডামি মামলায় জড়িয়ে দেয়ার দুষ্কর্ম সফল করা। আমাদের দেশে প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। মন্ত্রীরা পর্যন্ত এই অভিযোগের খেলায় তদন্তের আগে রায় ঘোষণা করে দেন। রায়ের আগে বিচার করে ফেলার প্রবণতাও তীব্রতর। বিচারের আগে রিমান্ড-জুলুম ও অত্যাচারের মাধ্যমে নির্দোষ মানুষকেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে শাস্তি পাইয়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনৈতিক ও মিথ্যা অভিযোগ তোলার মাত্রা সীমাহীন। রাজনৈতিক কৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা নীতিশাস্ত্রে সমর্থন না করলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় মেনে নেয়া হয়। এখন কোনো কৌশল নয়, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছিটানোর জন্য এবং রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লক্ষ্যে মিথ্যা অভিযোগ এমনভাবে তোলা হয়, যা শুধু গর্হিত নয়, অনৈতিক। সরল অর্থে অন্যায্যও। এ ধরনের প্রতিহিংসার রাজনৈতিক চর্চায় প্রায়ই বিরোধী দল সরকারি দলের আক্রমণাত্মক টার্গেটে পড়ে যায়। একইভাবে বিরোধী দল ও সরকারি দলকে আক্রমণাত্মক ভাষায় প্রান্তিক মন্তব্য করে ঘায়েল করতে চায়। এটাও এক ধরনের গণতন্ত্রচর্চা বটে। সাফল্যগাথা প্রচার করা সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি। বিরোধী দলের ভূমিকা হলো জনগণ ও সমর্থকদের মধ্যে উচ্চতর প্রত্যাশা জাগিয়ে রেখে সরকারের ব্যর্থতা ও ত্রুটিগুলো তুলে ধরা। ভুল তথ্য-উপাত্ত ফাঁস করে দিয়ে জনমত সৃষ্টি করা। তাই বিরোধী দল উহ, আহ, গেল, গেল বলে চিৎকার করলে জনগণের সিম্প্যাথি, সহমর্মিতা ও সমর্থন বাড়বে। ‘তথ্য-উপাত্ত’ দিয়ে বাকযুদ্ধ, কলমযুদ্ধ, বক্তব্য-বিবৃতির খিস্তিখেউর গণতন্ত্রের ভাষায় এ জন্যই সিদ্ধ। এটাও গণতন্ত্রে মত প্রকাশ ও জনমত গঠনের একটা সনাতনী প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে তুলোধুনো করলেন। এক দিন পর জাতীয় ভাষণে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরলেন। রওশন এরশাদ বলবেন তথাস্তু। এখন কার্যত বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব হলো সরকারের বক্তব্য খণ্ডন করা।
আমরাও জানি এবং মানি রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সেই ধারায় একধরনের শূন্যতা বিরাজমান। তার স্থলে যোগ হয়েছে ঢালাও মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিমূলক অভিযোগ তোলা। উপমা হিসেবে বলা যায়, একসময় সব মন্দ কাজের জন্য মার্কসবাদীদের দায়ী করা স্বাভাবিক ছিল। চারু মজুমদার থেকে হক-তোয়াহা-সিরাজ শিকদার পর্যন্ত সব রাজনৈতিক হত্যার জন্য তাদের গলা কাটার রাজনীতিকে দায়ী করা হতো। গণবাহিনী অভিযুক্ত হতো একটা সময় পর্যন্ত। বাস্তবে সব সময় মানুষ হত্যার পেছনে মার্কস ও মাওবাদীরা ছিল না, তখন সমস্যা দাঁড়িয়েছিল ভাই ভাইকে সম্পত্তির কারণে খুন করেও সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে আঙুল তুলত। এর মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগ প্রচার পেত। প্রকৃত অপরাধী আড়ালে থেকে যেত। এরপর সব ব্যাপারে জেএমবিসহ কিছু সংগঠনের নাম দিয়ে হত্যাকাণ্ড আড়াল করা হতো। তারপর দেখতাম সব কিছুর জন্য আঙুল তোলা হচ্ছে কয়েকটি দলের বিরুদ্ধে। অনেক পরে দেখা যেত ডাকাতের হাতে খুন হওয়া মানুষটির জন্য রাজনীতির নোংরা খেলা প্রাধান্য পেয়েছে। বিগত ক’বছর ধরে সব অকাজের জন্য বিএনপি-জামায়াত দায়ী, মানবতাবিরোধী মামলার বিচার ঠেকানোর কৌশল বলে প্রচারিত হয়েছে। বাস্তবে বিচারও ঠেকেনি। অপকর্মটি বিএনপি-জামায়াতও করেনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, রাষ্ট্র তার সন্তানতুল্য নাগরিককে ক্রসফায়ারে দিয়ে বন্দুকযুদ্ধ ও এনকাউন্টারের গল্প সাজায়। রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য নিয়ে অপহরণ করা হয়। সাদা পোশাকে গ্রেফতার করে কিংবা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক’দিন গুম করে রাখা হয়। তাহলে রাজনীতির কাছে আমরা সহিষ্ণুতা ও সংযম আশা করব কিভাবে!
এক সময়কার জাসদ রাজনীতির সুহৃদ হওয়ার সুবাদে কাজী আরিফ হত্যা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। এমনিতে সব হত্যাকে অসহনীয় ভাবি। মানুষ খুন সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করেননি। এই অপকর্মকে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও বড় মাপের পাপ বলেছেন। তাৎক্ষণিক অভিযোগ তোলা হলো- কাজটি মৌলবাদীদের। অংশত বিশ্বাসও করলাম। ভাবলাম, হতেও তো পারে। মনে ক্ষোভও জাগল। শেষ পর্যন্ত বিচার হলো, তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হলো। তাদের কেউ মৌলবাদী নন। সবাই কথিত প্রগতিশীল বাম ঘরানার রাজনৈতিক ক্যাডার! অথচ প্রচারণা ও প্রতারণার ধূম্রজালে প্রকৃত অপরাধী দীর্ঘ দিন আড়ালে ছিল। এ ধরনের শত শত উপমা দেয়া যাবে। তাৎক্ষণিক আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
কূটনীতির রাজ্যে ব্লেম গেইমে নতুন করে জড়াল বাংলাদেশ-পাকিস্তান, ইরান-সৌদি আরব, তুরস্ক-রাশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া। পাক-ভারত ব্লেম গেইম তো নিত্যদিনের ঘটনা। দিল্লিতে মশা উড়লে ভারতীয়রা বলে এটি পাকিস্তানি চর। পাকিস্তানে যেকোনো নাশকতার দায় বর্তায় ভারতীয় সাউথ ব্লক এবং র-এর ওপর। প্রতিবেশী দু’টি দেশের মধ্যকার এই মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক যুদ্ধে আমাদের পোঁ ধরার কোনো মানে হয় না। ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের প্রতিবেশী, আবার প্রতিদ্বন্দ্বীও। পরমাণু শক্তিধর এই দুটো দেশের ব্যাপারে পড়শিদের সাথে রাখা ভারতের নিজস্ব কৌশল, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
মহিলা কূটনীতিক নিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলাটা উপভোগ্য, কিন্তু পরিপক্ব কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়। তবুও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ ধরনের কূটনৈতিক গেইম মেনে নেয়া হয়। ইরান যখন সৌদি আরবকে দায়ী করে আর সৌদি আরব যখন ইরানকে অভিযুক্ত করে, তখন আমরা উদ্বিগ্ন হই, উৎকণ্ঠিত হই, ব্যথিত হই; কিন্তু অস্বাভাবিক মনে করি না। এর কারণ, সার্বভৌম দুই দেশের মধ্যে স্বার্থের টানাপড়েন থাকবে। জাতিরাষ্ট্্েরর ধারণায় এটা বিলুপ্ত হবে না। কিন্তু নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বদেশের জনগণের সাথে মিথ্যাচার ও ধোঁকা দেয়া অন্যায়। বিএনপি যেমন এ দেশের মানুষের দ্বারা পরিচালিত বড় রাজনৈতিক দল; তেমনি আওয়ামী লীগও। দুটো দলের মৌল নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার নিয়ে কোনো বড় বিরোধ নেই। যে বিরোধ প্রচারণায় ঠাঁই পাচ্ছে তা রাজনৈতিক, দলান্ধ ভাবনার ফসল। জনগণের স্বার্থে, জনগণের জন্য সেসব অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ গুরুত্বহীন।
দেশের স্বার্থে বড় দু’টি রাজনৈতিক স্রোতধারা পরস্পরকে মেনে নেয়া, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে রাজনৈতিক সুস্থ সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। আওয়ামী লীগ চাইলেই বিএনপিকে নাই করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। বিএনপিও আওয়ামী লীগকে অস্বীকার করে রাজনীতি করতে পারবে না। ক্ষমতা উনিশ সাল পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে, না ষোলো সালেই এর যবনিকাপাত ঘটবে তা আগামী দিনের রাজনীতিই ঠিক করে দেবে। কারণ, ক্ষমতা ও মর্যাদা আল্লাহ দেন। আল্লাহই কেড়ে নেন। অনেক সময় দুর্বিনীত শাসকের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘ করার মধ্যেও খোদায়ি কুদরত নিহিত থাকে। তাই সব দুঃশাসন শুধু গজব নয়, রাজনৈতিক ভুলের মাশুলও হতে পারে। রাজনৈতিক ভুলের মাশুল বা খেসারত রাজনৈতিকভাবে দিতে হয়। এর জন্য আদালতে আখেরাতের অপেক্ষা করতে হয় না। এর প্রমাণ অসংখ্য। ইতিহাসের দলিলও অকাট্য।
বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখন নিয়তিবাদী। কারণ সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান বাস্তবে অকার্যকর ও নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ববাদী ছোবল কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা বোঝার জন্য প্রধান বিচারপতির মন্তব্য আমলে নেয়াই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা বলব, ইতোমধ্যে অনেক ক্ষমতা কেড়েও নিয়েছে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া আস্থার সঙ্কটে পড়েছে। সরকার পড়েছে বৈধতার সঙ্কটে। বিরোধী দলের সামনে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের সৃষ্টি করা পরিস্থিতির প্রতিকূলতা। শত মামলার বেড়াজাল তো আছেই। যারা রাজনীতিতে সুবাতাসের আলামত দেখছেন, তারা ভুলের মধ্যে রয়েছেন, না নিয়তিবাদীরা তাদের পিছু টানছেন- সেটা মূল্যায়ন করে ভবিষ্যৎ দেখা ও দেখানোর দায়িত্ব দূরদর্শী নেতৃত্বের। বাংলাদেশের মূল সঙ্কট জনগণ নয়, নেতৃত্বের। প্রত্যাশার জায়গায়ও রয়েছেন নেতৃত্ব। ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার মতো কারণ অনেক, তার মধ্যে রাজনৈতিক ইসলাম নির্মূল করতে গিয়ে সরকার অসংখ্য চরমপন্থীর জন্ম দিয়েছে। অসংখ্য মনে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার ওপর ব্যর্থতার গ্লানিও কম নেই। অন্য দিকে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় ধৈর্যের সাথে এগোনোর চেষ্টা করছে। আত্মস্থ করার ক্ষমতাও বাড়িয়েছে। জেল-জুলুমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। রাজনীতিতে যোগ্যতমদের টিকে থাকার যে প্রাথমিক পরীক্ষা, সে ক্ষেত্রেও তারা পাস মার্ক পেয়েছে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিকে ‘না’ বলার যে সৎ সাহস বিএনপি নেত্রী দেখিয়েছেন, সেটাও দলটির অর্জনের খাতায় আরো কিছু নাম্বার বাড়িয়েছে। মোদ্দাকথা মির্জা ফখরুল বলেই দিয়েছেন, চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে কিছু হবে না। তাই আওয়ামী লীগের নেতিবাচক রাজনীতির সব সুফল বিএনপি ঘরে তুলবে, যদি সক্ষমতা প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও ভবিষ্যৎ ভাবনা বিবেচনায় নিয়েছেন বলে মনে হয়। তা না হলে বিএনপি নেত্রী ও নেতৃত্ব এখন সরকারের একক ‘টার্গেট’ হতো না। এটা যে পরিবর্তনকামী মানুষের ভরসাকেন্দ্রে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাই যদি রাজনীতির সুবাতাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়- কারো দ্বিমত পোষণের সুযোগ থাকার কথা নয়। তবে একটি-দু’টি সভা করতে দেয়া, দন্তনখরহীন বিরোধী দলের পোষমানা অবস্থান এবং সরকারি দলের তর্জন-গর্জন সুবাতাসের লক্ষণ নয়। বাংলাদেশকে নিয়ে শাসন-শোষণের মায়াবী জাল যেমন কম নয়, তেমনি খেলোয়াড়ের সংখ্যাও একজন নয়। আবার সব খেলোয়াড় একই ধরনের খেলায় অভ্যস্ত হয় না। সব ঘটনা একই মাত্রায় কিংবা একই ধরনের পরিণতিও ডেকে আনে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিও ধরন-ধারণ পাল্টায়।
masud2151@gmail.com
No comments