আলোচনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, সক্রিয়তা by নজরুল ইসলাম
গত মঙ্গলবারের সহিংসতার একপর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের হালদার পাড়া এলাকায় কাপড় ও পর্দার দোকানে অগ্নিসংযোগ করা হয় l প্রথম আলো |
তিন
দিন আগেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছিল অন্য যেকোনো শহরের মতো শান্ত। সোমবার
হঠাৎ করে মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ী, স্থানীয় ছাত্রলীগ ও
যুবলীগের সংঘর্ষ থেকে মঙ্গলবার শহরজুড়ে যে ভয়াবহ সহিংসতা হয়েছে, তাতে
শহরবাসী হতভম্ব, বিষ্মিত।
এই বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সবাই একবাক্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য স্থানীয় পুলিশের ওপর দায় চাপিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে দুই রকম মত পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আরেক পক্ষের অভিযোগ, পুলিশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় এই নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে।
তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দাবি করেছে, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। কারও পক্ষে অবস্থান নেয়নি। যদিও ইতিমধ্যে সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল, হালদারপাড়া এলাকায় সৌখিন পর্দা বিতান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশের গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬ হাজার ৯৪ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের মাস্টার মইদুর রহমান বাদী হয়ে করা মামলায় বলা হয়, অজ্ঞাতনামা ৬০০-৭০০ ব্যক্তি রেলস্টেশনের আড়াই কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করেছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে মাদ্রাসার ছাত্র মাসুদুর রহমানের লাশ শহরের ভাদুঘরে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। যে মাদ্রাসার ছাত্রের মৃত্যু নিয়ে এই তাণ্ডব, সেই জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোবারকউল্লাহ ও মাদ্রাসার ছাত্ররা বলেছেন, পুলিশ মাদ্রাসায় ঢুকে মাসুদকে গুলি ও মারধর করে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছে। আরও অনেক ছাত্র গুলিতে আহত হয়েছে। মাসুদ পরে হাসপাতালে মারা যায়।
ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের আবাসিক সার্জন হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বললেন, নিহত মাসুদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে গুলির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
পুলিশের ভাষ্য, গত সোমবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিএ রোডে জেলা পরিষদ মার্কেট এলাকায় একজন বয়স্ক ইজিবাইকচালকের সঙ্গে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রের বাগ্বিতণ্ডা হয়। তা দেখে মার্কেটের দোকানি রনি আহমেদ ইজিবাইকচালকের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। এর কিছুক্ষণ পর ওই মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে ওই দোকান ভাঙচুর করে। রনি আহমেদের সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠতা থাকায় তারা মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। সংঘর্ষে আহত হাফিজির ছাত্র মাসুদুর রহমান সোমবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে মারা যায়। এর জের ধরে মঙ্গলবার মাদ্রাসার ছাত্ররা শহরজুড়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা রেলস্টেশনে হামলা চালায়। রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পুলিশের প্রসঙ্গই বারবার সামনে আসে। শহরের দক্ষিণ মোড়াইলের বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এত বড় ঘটনা ঘটল।
জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এম এ মাসুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে জানা যাবে। তিনি বলেন, পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। কারও পক্ষে অবস্থান নেয়নি।
গতকাল শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাণ্ডবের চিহ্ন পাওয়া গেলেও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল। দোকানপাট খুলেছে। তবে রেলওয়ে স্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) মো. মাহাবুবর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান। গতকাল তদন্ত কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত রেলস্টেশন পরিদর্শন করে।
মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের দায়িত্বে কোনো অবহেলা ছিল কি না, তা দেখার পাশাপাশি সহিংস ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত চলছে। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়ায় তারা আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। দাবি অনুযায়ী পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। নাসিরনগর উপজেলার ‘হযরত শাহজালাল (রা.) মসজিদ ও কওমি মাদ্রাসা কমপ্লেক্স খুলে দিয়ে সেখানে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিপর্যস্ত রেলস্টেশন: গতকাল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে দেখা যায় ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। সেখানে উত্সুক মানুষ ভিড় করেছে। কেউ আবার মুঠোফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন। দেখা যায়, রেলওয়ে স্টেশনের একটি কক্ষে প্যানেল বোর্ডটি চুরমার হয়ে পড়ে আছে। এটি দিয়ে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও অবস্থান জানা যেত।
ভিআইপি যাত্রীদের বসার ঘরসহ রেলওয়ে স্টেশনের একের পর এক কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব কক্ষের সামনে কাচের টুকরা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রেল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও টিকিট দিতে ব্যবহৃত কম্পিউটারটি।
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা বলেন, তাঁরা দুর্ভোগে আছেন। ট্রেনের অবস্থান ও তথ্য জানতে পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার এস এম মইদুর রহমান বলেন, প্যানেল বোর্ডটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন তিনি ট্রেনের অবস্থান এবং সে সম্পর্কে যাত্রীদের তথ্য দিতে পারছেন না। এ কারণে যাত্রীদের সঙ্গে রেলওয়ে কর্মীদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। কম্পিউটার না থাকায় হাতে লিখে টিকিট দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, হামলার সময় পুলিশ ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাহায্য চেয়ে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কেউ আসেনি। স্বল্পসংখ্যক রেলওয়ে থানার পুলিশ ৬০০-৭০০ হামলাকারী মাদ্রাসার ছাত্রের কাছে যেতে সাহস পায়নি।
দাফন: মাসুদুর রহমানের লাশ শহরের ভাদুঘরে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। গতকাল বিকেলে ওই বাড়িতে গেলে মাসুদুরের মা মোছাম্মৎ তায়িবা বেগম বলেন, তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান। তবে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই তিনি মেনে নেবেন।
আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলন: গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে জেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবে ৭০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দাবি করে বলেন, মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে মিশে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে।
আল মামুন সরকার বলেন, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনের যে ক্ষতি হলো, তা অপূরণীয়। সেখানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ দুর্লভ জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মাদ্রাসায় জেলা ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে এবং সোমবার রাতে জেলা পরিষদ মার্কেটের ব্যবসায়ী একদল যুবককে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে শুনেছেন—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাত-আটজন মুখোশধারী ছাত্রলীগকে দায়ী করতে জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসায় হামলা করেছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী ও জঙ্গিবাদীরা এসব তাণ্ডব চালিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত নয়।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পৌর মেয়র হেলাল উদ্দিন, সহসভাপতি তাজ মোহাম্মদ ইয়াছিনসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এই বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সবাই একবাক্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য স্থানীয় পুলিশের ওপর দায় চাপিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে দুই রকম মত পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আরেক পক্ষের অভিযোগ, পুলিশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় এই নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে।
তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দাবি করেছে, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। কারও পক্ষে অবস্থান নেয়নি। যদিও ইতিমধ্যে সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল, হালদারপাড়া এলাকায় সৌখিন পর্দা বিতান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশের গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬ হাজার ৯৪ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের মাস্টার মইদুর রহমান বাদী হয়ে করা মামলায় বলা হয়, অজ্ঞাতনামা ৬০০-৭০০ ব্যক্তি রেলস্টেশনের আড়াই কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করেছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে মাদ্রাসার ছাত্র মাসুদুর রহমানের লাশ শহরের ভাদুঘরে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। যে মাদ্রাসার ছাত্রের মৃত্যু নিয়ে এই তাণ্ডব, সেই জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোবারকউল্লাহ ও মাদ্রাসার ছাত্ররা বলেছেন, পুলিশ মাদ্রাসায় ঢুকে মাসুদকে গুলি ও মারধর করে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছে। আরও অনেক ছাত্র গুলিতে আহত হয়েছে। মাসুদ পরে হাসপাতালে মারা যায়।
ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের আবাসিক সার্জন হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বললেন, নিহত মাসুদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে গুলির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
পুলিশের ভাষ্য, গত সোমবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিএ রোডে জেলা পরিষদ মার্কেট এলাকায় একজন বয়স্ক ইজিবাইকচালকের সঙ্গে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রের বাগ্বিতণ্ডা হয়। তা দেখে মার্কেটের দোকানি রনি আহমেদ ইজিবাইকচালকের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। এর কিছুক্ষণ পর ওই মাদ্রাসার ছাত্ররা এসে ওই দোকান ভাঙচুর করে। রনি আহমেদের সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠতা থাকায় তারা মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। সংঘর্ষে আহত হাফিজির ছাত্র মাসুদুর রহমান সোমবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে মারা যায়। এর জের ধরে মঙ্গলবার মাদ্রাসার ছাত্ররা শহরজুড়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা রেলস্টেশনে হামলা চালায়। রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পুলিশের প্রসঙ্গই বারবার সামনে আসে। শহরের দক্ষিণ মোড়াইলের বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এত বড় ঘটনা ঘটল।
জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এম এ মাসুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে জানা যাবে। তিনি বলেন, পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। কারও পক্ষে অবস্থান নেয়নি।
গতকাল শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাণ্ডবের চিহ্ন পাওয়া গেলেও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল। দোকানপাট খুলেছে। তবে রেলওয়ে স্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) মো. মাহাবুবর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান। গতকাল তদন্ত কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত রেলস্টেশন পরিদর্শন করে।
মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের দায়িত্বে কোনো অবহেলা ছিল কি না, তা দেখার পাশাপাশি সহিংস ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত চলছে। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়ায় তারা আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। দাবি অনুযায়ী পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। নাসিরনগর উপজেলার ‘হযরত শাহজালাল (রা.) মসজিদ ও কওমি মাদ্রাসা কমপ্লেক্স খুলে দিয়ে সেখানে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিপর্যস্ত রেলস্টেশন: গতকাল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে দেখা যায় ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। সেখানে উত্সুক মানুষ ভিড় করেছে। কেউ আবার মুঠোফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন। দেখা যায়, রেলওয়ে স্টেশনের একটি কক্ষে প্যানেল বোর্ডটি চুরমার হয়ে পড়ে আছে। এটি দিয়ে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও অবস্থান জানা যেত।
ভিআইপি যাত্রীদের বসার ঘরসহ রেলওয়ে স্টেশনের একের পর এক কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব কক্ষের সামনে কাচের টুকরা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রেল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও টিকিট দিতে ব্যবহৃত কম্পিউটারটি।
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা বলেন, তাঁরা দুর্ভোগে আছেন। ট্রেনের অবস্থান ও তথ্য জানতে পারছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার এস এম মইদুর রহমান বলেন, প্যানেল বোর্ডটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন তিনি ট্রেনের অবস্থান এবং সে সম্পর্কে যাত্রীদের তথ্য দিতে পারছেন না। এ কারণে যাত্রীদের সঙ্গে রেলওয়ে কর্মীদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। কম্পিউটার না থাকায় হাতে লিখে টিকিট দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, হামলার সময় পুলিশ ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাহায্য চেয়ে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কেউ আসেনি। স্বল্পসংখ্যক রেলওয়ে থানার পুলিশ ৬০০-৭০০ হামলাকারী মাদ্রাসার ছাত্রের কাছে যেতে সাহস পায়নি।
দাফন: মাসুদুর রহমানের লাশ শহরের ভাদুঘরে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। গতকাল বিকেলে ওই বাড়িতে গেলে মাসুদুরের মা মোছাম্মৎ তায়িবা বেগম বলেন, তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান। তবে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই তিনি মেনে নেবেন।
আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলন: গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে জেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডবে ৭০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দাবি করে বলেন, মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে মিশে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে।
আল মামুন সরকার বলেন, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনের যে ক্ষতি হলো, তা অপূরণীয়। সেখানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ দুর্লভ জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মাদ্রাসায় জেলা ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে এবং সোমবার রাতে জেলা পরিষদ মার্কেটের ব্যবসায়ী একদল যুবককে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে শুনেছেন—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাত-আটজন মুখোশধারী ছাত্রলীগকে দায়ী করতে জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসায় হামলা করেছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী ও জঙ্গিবাদীরা এসব তাণ্ডব চালিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত নয়।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি পৌর মেয়র হেলাল উদ্দিন, সহসভাপতি তাজ মোহাম্মদ ইয়াছিনসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
No comments