ধনীর কৃচ্ছ্রসাধন আর নির্ধনের ভোগবিলাস by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
কৃচ্ছ্রসাধনের ভাঙা রেকর্ড দীর্ঘদিন ধরে বাজিয়েই চলেছি। আমাদের ভোগেও ভাটার লক্ষণ নেই, বাজানোর আগ্রহেও কমতি নেই। তবে পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূমির ওপর ২৪ সহস্রাংশ মানুষের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার দায়ভার যে দেশটি পালন করে যাচ্ছে, সেই বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। এর ৮৭ গুণ বেশি ভূমিতে ৭ গুণ কম মানুষের বাসস্থান অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় এটুকু সান্ত্বনা। কোনো সন্দেহ নেই এত মানুষের জীবন এত ক্ষুদ্র আবাসস্থলে নিশ্চিত করে মানবসভ্যতার সবচেয়ে দামি পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ। এই দায়িত্ব আরও সুচারুরূপে, আরও দক্ষতার সঙ্গে পালনের জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভোগের অপসংস্কৃতি আমাদের মধ্যে জেঁকে বসেছে। তাই বিশ্বের বুকে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতির চর্চার প্রয়োজন, ঠিক তেমনি উন্নয়ন প্রতিকূল সংস্কৃতির চর্চা থেকে বিরত থাকাও প্রয়োজন। এই সংস্কৃতি নিয়েই আজকের লেখা।
১.... লন্ডনে যানজটে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে যানবাহনকে টোল বেশি দিতে হয়। তাই যানবাহন ওই এলাকা এড়িয়ে চলার ফলে যানজট সহনীয় পর্যায়ে থাকে। আমাদের এমন ব্যবস্থা নেই। বিআরটিএ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এসব নিয়ম চালু করলে ঢাকাসহ অন্যান্য যানজটপিষ্ট শহরের যাত্রীদের রেহাই দিতে পারে। শ্রেয়তর যাতায়াত–জীবন উপহার দেওয়ার পাশাপাশি এতে করে কর্মসময়, উদ্বেগ, গ্যাস, তেলের শ্রাদ্ধ থেকে দেশও বাঁচতে পারে। তা ছাড়া, গোটা ইউরোপ যেখানে রেলের মতো গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করে, সেখানে এক যাত্রী নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যানজটকে অসহনীয় মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। অপ্রতুল সড়ক কাঠামোতে যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন কঠোর করা তেমন কঠিন কাজ না। টানেল কিংবা রাস্তাঘাট নির্মাণে আমাদের দেশের ব্যয় নাকি উন্নত দেশের থেকেও বেশি। যখন-তখন রাস্তার ডিভাইডার ভাঙা ও গড়ার প্রয়োজনীয়তাও প্রশ্নবিদ্ধ। একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভার তৈরি করে নিচের রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী করে রাখা। অর্থ ও ভৌত অবকাঠামোর এমন অপচয়ের কারণ খুঁজে বের করা উচিত।
২.... সাংহাই থেকে তাইপেই যাচ্ছি। বিমানবালার কাছে পানি চাইলে আগে দেওয়া এককালীন ব্যবহারোপযোগী গ্লাসটি কোথায় জিজ্ঞাসা করল। কৃচ্ছ্রসাধনের মাত্রা দর্শনীয় এবং তা আসছে মাথাপিছু আয় ৩৮ হাজার আমেরিকান ডলারের নাগরিকদের থেকে।
৩. বিশাল জনঘনত্বের দেশে অধিকতর ঘনত্বের রাজধানীতে প্রতিটি বাসায় ওয়াশিং মেশিন, যা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে কিনে আনতে হয় এবং যা সপ্তাহে কেবল আধঘণ্টার জন্য সচল হয়। মূল্যবান সম্পদের এমন অপব্যবহার এবং তা কেবল নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ (তাও আবার নানা ঋণ-সুবিধাদি নিয়ে) জাতির পক্ষে একেবারেই বেমানান। মাথাপিছু ৪৮ হাজার আমেরিকান ডলার আয়ের সুইজারল্যান্ডে যদি একাধিক ভবনের বাসিন্দারা যৌথভাবে ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে পারে, তাহলে অন্তত ঢাকা শহরের ক্যাম্পাসভিত্তিক শিক্ষিত মানুষেরা এই কাজটি করতে পারছে না কেন?
৪.... রাশিয়ার ইকেটেরিনবার্গ শহরে এক রাত নিজের পয়সায় হোটেলে থাকতে হবে। জানতে পারলাম আয়োজকেরা আমাদের যে দামি হোটেলে রাখবে, তারই কাছে সাশ্রয়ী হোটেল আছে। দেখতে গেলাম। রুমের দরজা খুলে দিতেই চারটি খাট সারি করে বসানো আছে। ওপরের দিকে তাকাতেই আরও চারটি দোতলার মতো করে। সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া, যা পৃথিবীর ১১ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে আছে এবং যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৮ দশমিক ৪ জন মানুষ। পক্ষান্তরে আমরা পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূমিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করি ১ হাজার ২২২ মানুষ। তাদের যদি এ রকম হোটেল থাকে, তাহলে আমাদের হোটেলগুলো কী রকম হওয়া উচিত? আমাদের বাসস্থানগুলোতেও কি আমাদের ভূমিশূন্যতার প্রভাব পড়া উচিত না? জানতে পারলাম বিলাতেও নাকি প্রতিটি বাসায় আমাদের মতো ৩/৪/৫টি করে বাথরুম নেই। ভূমির এমন অপব্যবহার আর কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ। একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যতই ধনী হোক না কেন, সর্বোচ্চ জনঘনত্বের দেশে দেশের স্বার্থে কি তার ভূমিসাশ্রয়ী হওয়া উচিত নয়? অবশ্য উচ্চ করের বিনিময়ে কোনো ধনী ব্যক্তিকে অতিরিক্ত ভোগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আমাদের থেকে গণতন্ত্রচর্চায় যারা এগিয়ে, সেখানেও দেশের স্বার্থে ব্যক্তি অধিকারকে সমাজের উপযোগী করে সীমিত করা হয়।
প্রতিবছরই এতগুলো বই ছাপানো হবে এবং তা পরবর্তী বছরে ব্যবহার করা হবে না, কাগজের জন্য বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাবে, তাও কাঙ্ক্ষিত নয়।
৫.... সারা দেশের সড়কব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য যমুনা নদীতে ইতিমধ্যে সেতু স্থাপিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর অনধিকার চর্চাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত আমাদের হৃত সম্মান ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সহায়ক। তবে এই দামি সেতুগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আশপাশের ভূমি যে পতিত রাখতে হচ্ছে এবং সেই জমির মালিকদের পুনর্বাসনের জন্য আবাদযোগ্য ভূমিতে বন্যা ঝড়ে ভেঙে-যাওয়া কুঁড়েঘর তৈরি করে নাগরিকদেরই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার মুখে ফেলা হচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগে যৌথ আবাসনের ব্যবস্থা করে মূল্যবান ও অপর্যাপ্ত ভূমির শ্রেয়তর ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত, যে সংস্কৃতি দেশব্যাপী সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
৬. অতি সম্প্রতি পটুয়াখালী গিয়েছিলাম। কুয়াকাটার পথে তিনটি নদীতে বড় বড় সেতু তৈরি হয়েছে। সম্ভবত আমাদের প্রাযুক্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে। তারপরও ফেরি সার্ভিস চালু আছে। উদ্বোধন না হওয়া পর্যন্ত সেতু ব্যবহার করা যাবে না। সেতু তৈরিতে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে থাকলে ব্যবহার না করলে দৈনিক কম করে হলেও তিন লাখ টাকার সুবিধা গ্রহণ করছি না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের চেন্নাই শহরে ১৩ ফ্লোরসমৃদ্ধ ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন বর্গফুট আয়তনের তথ্যপ্রযুক্তির টাইডেল পার্ক ১৪ মাসে তৈরি হওয়ার পর নামীদামি ২৫-৩০টি কোম্পানি উদ্বোধনের অপেক্ষা না করে কাজ শুরু করে দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি উদ্বোধন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সীমিত ভৌত অবকাঠামোর দেশে সুযোগ-সুবিধা অব্যবহৃত রাখা উন্নয়ন অনুকূল কোনো সংস্কৃতি নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেশের ক্ষতি অনুধাবন করে যথাসময়ে উদ্বোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত।
৭.... একসময়ে ভারত সরকারের অর্থে বিমানভ্রমণ ভারতীয় জাতীয় পতাকাবাহী বিমানে করতে হতো। আমাদের দেশেও তা বাধ্যতামূলক করা উচিত, এমনকি আমাদের বাংলাদেশ বিমানের সেবার মান গ্রহণযোগ্য না হলেও। কয়েক দিন আগে গোটা পলাশীবাজার তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাংলাদেশের তৈরি একটি শেভিং রেজর পাইনি, ভারত কিংবা পাকিস্তানের তৈরি আছে। আমাদের প্রদত্ত সেবা কিংবা তৈরি পণ্যের মান ভালো না হলে বিদেশিরা তা ব্যবহার নাও করতে পারে কিন্তু আমরাই হব যোগ্য সেবাগ্রহণকারী কিংবা পণ্য ব্যবহারকারী।
৮.... আমাদের সরকার প্রতিবছর ৩০-৪০ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে একই বই আমরা বছরের পর বছর পালাক্রমে পড়তাম। পাঠ্যপুস্তক দিবস নিয়ে আমাদের জাতি গর্ববোধ করতেই পারে। তবে প্রতিবছরই এতগুলো বই ছাপানো হবে এবং তা পরবর্তী বছরে ব্যবহার করা হবে না, কাগজের জন্য বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাবে, তাও কাঙ্ক্ষিত নয়। এই বিলাসিতা করা আমাদের ঠিক নয়। কারণ, এখনো আমরা বৈদেশিক ঋণের দিকেও তাকিয়ে থাকি।
শ্রেয়তর অর্থনৈতিক সংস্কৃতি, অপচয় রোধ, স্বদেশি পণ্যের ব্যবহারে গর্ব এবং দেশাত্মবোধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনসংখ্যার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিশ্বদরবারে আমাদের অবস্থান সুসংহত হবে, এটা আমাদের নতুন বছরের কামনা।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
১.... লন্ডনে যানজটে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে যানবাহনকে টোল বেশি দিতে হয়। তাই যানবাহন ওই এলাকা এড়িয়ে চলার ফলে যানজট সহনীয় পর্যায়ে থাকে। আমাদের এমন ব্যবস্থা নেই। বিআরটিএ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এসব নিয়ম চালু করলে ঢাকাসহ অন্যান্য যানজটপিষ্ট শহরের যাত্রীদের রেহাই দিতে পারে। শ্রেয়তর যাতায়াত–জীবন উপহার দেওয়ার পাশাপাশি এতে করে কর্মসময়, উদ্বেগ, গ্যাস, তেলের শ্রাদ্ধ থেকে দেশও বাঁচতে পারে। তা ছাড়া, গোটা ইউরোপ যেখানে রেলের মতো গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করে, সেখানে এক যাত্রী নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যানজটকে অসহনীয় মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। অপ্রতুল সড়ক কাঠামোতে যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন কঠোর করা তেমন কঠিন কাজ না। টানেল কিংবা রাস্তাঘাট নির্মাণে আমাদের দেশের ব্যয় নাকি উন্নত দেশের থেকেও বেশি। যখন-তখন রাস্তার ডিভাইডার ভাঙা ও গড়ার প্রয়োজনীয়তাও প্রশ্নবিদ্ধ। একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভার তৈরি করে নিচের রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী করে রাখা। অর্থ ও ভৌত অবকাঠামোর এমন অপচয়ের কারণ খুঁজে বের করা উচিত।
২.... সাংহাই থেকে তাইপেই যাচ্ছি। বিমানবালার কাছে পানি চাইলে আগে দেওয়া এককালীন ব্যবহারোপযোগী গ্লাসটি কোথায় জিজ্ঞাসা করল। কৃচ্ছ্রসাধনের মাত্রা দর্শনীয় এবং তা আসছে মাথাপিছু আয় ৩৮ হাজার আমেরিকান ডলারের নাগরিকদের থেকে।
৩. বিশাল জনঘনত্বের দেশে অধিকতর ঘনত্বের রাজধানীতে প্রতিটি বাসায় ওয়াশিং মেশিন, যা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে কিনে আনতে হয় এবং যা সপ্তাহে কেবল আধঘণ্টার জন্য সচল হয়। মূল্যবান সম্পদের এমন অপব্যবহার এবং তা কেবল নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ (তাও আবার নানা ঋণ-সুবিধাদি নিয়ে) জাতির পক্ষে একেবারেই বেমানান। মাথাপিছু ৪৮ হাজার আমেরিকান ডলার আয়ের সুইজারল্যান্ডে যদি একাধিক ভবনের বাসিন্দারা যৌথভাবে ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে পারে, তাহলে অন্তত ঢাকা শহরের ক্যাম্পাসভিত্তিক শিক্ষিত মানুষেরা এই কাজটি করতে পারছে না কেন?
৪.... রাশিয়ার ইকেটেরিনবার্গ শহরে এক রাত নিজের পয়সায় হোটেলে থাকতে হবে। জানতে পারলাম আয়োজকেরা আমাদের যে দামি হোটেলে রাখবে, তারই কাছে সাশ্রয়ী হোটেল আছে। দেখতে গেলাম। রুমের দরজা খুলে দিতেই চারটি খাট সারি করে বসানো আছে। ওপরের দিকে তাকাতেই আরও চারটি দোতলার মতো করে। সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া, যা পৃথিবীর ১১ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে আছে এবং যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৮ দশমিক ৪ জন মানুষ। পক্ষান্তরে আমরা পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূমিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করি ১ হাজার ২২২ মানুষ। তাদের যদি এ রকম হোটেল থাকে, তাহলে আমাদের হোটেলগুলো কী রকম হওয়া উচিত? আমাদের বাসস্থানগুলোতেও কি আমাদের ভূমিশূন্যতার প্রভাব পড়া উচিত না? জানতে পারলাম বিলাতেও নাকি প্রতিটি বাসায় আমাদের মতো ৩/৪/৫টি করে বাথরুম নেই। ভূমির এমন অপব্যবহার আর কোনো দেশে আছে কি না সন্দেহ। একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যতই ধনী হোক না কেন, সর্বোচ্চ জনঘনত্বের দেশে দেশের স্বার্থে কি তার ভূমিসাশ্রয়ী হওয়া উচিত নয়? অবশ্য উচ্চ করের বিনিময়ে কোনো ধনী ব্যক্তিকে অতিরিক্ত ভোগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আমাদের থেকে গণতন্ত্রচর্চায় যারা এগিয়ে, সেখানেও দেশের স্বার্থে ব্যক্তি অধিকারকে সমাজের উপযোগী করে সীমিত করা হয়।
প্রতিবছরই এতগুলো বই ছাপানো হবে এবং তা পরবর্তী বছরে ব্যবহার করা হবে না, কাগজের জন্য বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাবে, তাও কাঙ্ক্ষিত নয়।
৫.... সারা দেশের সড়কব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য যমুনা নদীতে ইতিমধ্যে সেতু স্থাপিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর অনধিকার চর্চাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত আমাদের হৃত সম্মান ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সহায়ক। তবে এই দামি সেতুগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আশপাশের ভূমি যে পতিত রাখতে হচ্ছে এবং সেই জমির মালিকদের পুনর্বাসনের জন্য আবাদযোগ্য ভূমিতে বন্যা ঝড়ে ভেঙে-যাওয়া কুঁড়েঘর তৈরি করে নাগরিকদেরই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার মুখে ফেলা হচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগে যৌথ আবাসনের ব্যবস্থা করে মূল্যবান ও অপর্যাপ্ত ভূমির শ্রেয়তর ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত, যে সংস্কৃতি দেশব্যাপী সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
৬. অতি সম্প্রতি পটুয়াখালী গিয়েছিলাম। কুয়াকাটার পথে তিনটি নদীতে বড় বড় সেতু তৈরি হয়েছে। সম্ভবত আমাদের প্রাযুক্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে। তারপরও ফেরি সার্ভিস চালু আছে। উদ্বোধন না হওয়া পর্যন্ত সেতু ব্যবহার করা যাবে না। সেতু তৈরিতে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে থাকলে ব্যবহার না করলে দৈনিক কম করে হলেও তিন লাখ টাকার সুবিধা গ্রহণ করছি না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের চেন্নাই শহরে ১৩ ফ্লোরসমৃদ্ধ ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন বর্গফুট আয়তনের তথ্যপ্রযুক্তির টাইডেল পার্ক ১৪ মাসে তৈরি হওয়ার পর নামীদামি ২৫-৩০টি কোম্পানি উদ্বোধনের অপেক্ষা না করে কাজ শুরু করে দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি উদ্বোধন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সীমিত ভৌত অবকাঠামোর দেশে সুযোগ-সুবিধা অব্যবহৃত রাখা উন্নয়ন অনুকূল কোনো সংস্কৃতি নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেশের ক্ষতি অনুধাবন করে যথাসময়ে উদ্বোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত।
৭.... একসময়ে ভারত সরকারের অর্থে বিমানভ্রমণ ভারতীয় জাতীয় পতাকাবাহী বিমানে করতে হতো। আমাদের দেশেও তা বাধ্যতামূলক করা উচিত, এমনকি আমাদের বাংলাদেশ বিমানের সেবার মান গ্রহণযোগ্য না হলেও। কয়েক দিন আগে গোটা পলাশীবাজার তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাংলাদেশের তৈরি একটি শেভিং রেজর পাইনি, ভারত কিংবা পাকিস্তানের তৈরি আছে। আমাদের প্রদত্ত সেবা কিংবা তৈরি পণ্যের মান ভালো না হলে বিদেশিরা তা ব্যবহার নাও করতে পারে কিন্তু আমরাই হব যোগ্য সেবাগ্রহণকারী কিংবা পণ্য ব্যবহারকারী।
৮.... আমাদের সরকার প্রতিবছর ৩০-৪০ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে একই বই আমরা বছরের পর বছর পালাক্রমে পড়তাম। পাঠ্যপুস্তক দিবস নিয়ে আমাদের জাতি গর্ববোধ করতেই পারে। তবে প্রতিবছরই এতগুলো বই ছাপানো হবে এবং তা পরবর্তী বছরে ব্যবহার করা হবে না, কাগজের জন্য বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাবে, তাও কাঙ্ক্ষিত নয়। এই বিলাসিতা করা আমাদের ঠিক নয়। কারণ, এখনো আমরা বৈদেশিক ঋণের দিকেও তাকিয়ে থাকি।
শ্রেয়তর অর্থনৈতিক সংস্কৃতি, অপচয় রোধ, স্বদেশি পণ্যের ব্যবহারে গর্ব এবং দেশাত্মবোধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনসংখ্যার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়নের মাপকাঠিতে বিশ্বদরবারে আমাদের অবস্থান সুসংহত হবে, এটা আমাদের নতুন বছরের কামনা।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments