দুই সন্তান নীতি চাহিদা বাড়াবে by কোই জিন
গত বছরের অক্টোবরে চীন এক সন্তান নীতি
থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। এর মধ্য দিয়ে দেশটি ৩৭ বছরের অনুসৃত নীতির অবসান
ঘটাল, যে কারণে দেশটিতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। দেশটির সরকার
যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিল, তার ফলে সেখানকার মানুষের
গড় উর্বরতা কমে যায়, ১৯৭০ সালে যেখানে শহরের পরিবারগুলোতে গড়ে তিন সন্তান
ছিল, সেখানে ১৯৮২ সালে তা কমে দাঁড়ায় এক-এ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশটির দুই
সন্তান নীতি এক সন্তান নীতির ফলাফল প্রশমন করতে কতটা কার্যকর হবে।
বস্তুত, দুই সন্তান নীতির ফলাফল এক সন্তান নীতির চেয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী ও সার্বিকভাবে অনেকটা ইতিবাচক হবে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে এটা অনেকটাই সত্য হবে, কিন্তু আপেক্ষিকভাবে স্বল্পমেয়াদেও এর প্রভাব দৃশ্যমান হবে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, পরিবারে অতিরিক্ত একটি সন্তান এলে দেশটির সামগ্রিক সঞ্চয় কমে আসবে, যেটা সামষ্টিক অর্থনীতির দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করবে।
বর্তমানে চীনের সঞ্চয়ের হার এত বেশি যে তাকে প্রায়ই বৈশ্বিক ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়, বিশ্বব্যাপী সুদের হার কমার কারণ হিসেবেও এটাকে চিহ্নিত করা হয়। তা ছাড়া চীন যে বর্তমানে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি থেকে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও সেবামুখী অর্থনীতির দিকে যেতে চাইছে, এই নিম্ন সুদের হার তার পথেও বড় একটা বাধা। এই উত্তরণকে ত্বরান্বিত করতে দুই সন্তান নীতি অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে, অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের প্রত্যাশার চেয়েও যে প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে।
এখন পর্যন্ত অর্থনীতিবিদেরা চীনের জনসংখ্যার কাঠামোতে যে পরিবর্তন আসন্ন সেখানেই নজর দিচ্ছেন। এই এক সন্তান নীতির কারণে অনূর্ধ্ব ২০ বছরের মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, ১৯৭০ সালে যারা ছিল জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ, ২০১০ সালের মধ্যে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ শতাংশে। আর এ সময়ের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যাও ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ফলে গড় বয়স ২০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫।
কর্মক্ষম মানুষের চেয়ে অবসরপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাওয়ায় আজকের তরুণ প্রজন্মের ওপর ব্যাপক চাপ পড়বে। বাস্তবে ব্যাপারটা এমন হবে যে ১৯৮০-এর দশকের এক সন্তান নীতির যুগের মানুষের গড়ে দুজন বৃদ্ধ মানুষের ভরণপোষণ করতে হবে। উল্লিখিত তরিকায় হিসাব করলে দেখা যাবে, আজকের দুই সন্তান নীতির যুগের মানুষ যখন মধ্যবয়সী হবেন, তখন তাঁদের গড়ে একজন বৃদ্ধ মানুষের ভরণপোষণ করতে হবে। ফলে বৃদ্ধ মানুষের ভরণপোষণজনিত অর্থনৈতিক যে চাপ তা অনেকটাই কমে আসবে। এর মধ্যে আবার আরেকটি ব্যাপার ঘটবে। এক সন্তান-উত্তর যুগের মানুষের শুধু বৃদ্ধদের নয়, বিপুলসংখ্যক তরুণেরও ভরণপোষণ করতে হবে।
যদিও ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে এক সন্তান নীতির যুগের মানুষের জন্য কঠিন হবে, কিন্তু এর একটি অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যাবে, ভোগের পরিমাণ বেড়ে গেছে। কারণ, তাদের অতিরিক্ত ব্যয় করা ছাড়া আর তেমন কিছু করার সুযোগ থাকবে না। ওই যুগে যাঁদের যমজ সন্তান হয়েছে আর যাঁদের এক সন্তান হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তুলনা করলেই দেখা যাবে, ভোগের ক্ষেত্রে কতটা পরিবর্তন এসেছে। (যদিও যমজ সন্তানদের পিতা-মাতার অক্ষমতার কারণে এটাকে ঠিক যথার্থরূপে প্রতিনিধিত্বশীল বলা যাবে না)।
সঞ্চয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, শহুরে পরিবারগুলোর মধ্যে যাঁদের দুই সন্তান আছে, তাঁরা উপার্জনের ১২ দশমিক ৮ শতাংশ সঞ্চয় করেছেন আর যাঁদের এক সন্তান আছে, তাঁরা ২১ দশমিক ৩ শতাংশ সঞ্চয় করেছেন। আয় যেমনই হোক না কেন, এই পার্থক্যটা কিন্তু বেশ বড়ই। এই দুই সন্তান নীতির কারণে পরিবারের ভোগ বাড়বে, এর প্রভাব নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো খাতের ওপর পড়বে। প্রথমত, অতিরিক্ত একটি সন্তানের জন্য বাবা-মাকে অতিরিক্ত খাতা, খেলনা ও বাইসাইকেল কিনতে হবে। আর এই প্রজন্ম বড় হলে তাদের গৃহায়ণ, ওষুধ ও বিমার চাহিদা অনেকাংশে বাড়বে।
শিক্ষাব্যয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় পার্থক্য সৃষ্টি হবে। ২০০৯ সালে শহুরে পরিবারের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, চীনে যেসব পরিবারে একটি সন্তান রয়েছে, সেই পরিবার শিক্ষায় তাদের মোট আয়ের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় করেছে আর যাদের যমজ সন্তান আছে, তারা ব্যয় করেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দুই সন্তানের পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকলে চীনের সঞ্চয়ের পরিমাণও ৭-১০ শতাংশ কমে আসবে, আজ যেটা ৩০ শতাংশ, আগামী ১০ বছরে তা কমে ২২ শতাংশে নামতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে। অধিক সন্তান মানে কিন্তু সন্তানপ্রতি শিক্ষা বিনিয়োগ কমে যাওয়া, যার মানে দাঁড়ায় মানবীয় পুঁজি অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ, যমজ সন্তানদের বয়স ১৫ হলে তো তাদের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ কমে যায়, এক সন্তানের তুলনায়, যেটা শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করে। এক সন্তানের তুলনায় যমজ সন্তানদের কারিগরি বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার ৪০ শতাংশ বেশি।
এত কিছু সত্ত্বেও চীনের দুই সন্তান নীতি গ্রহণের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা ছিল। তবে সেটা শুধু জনসংখ্যার ভারসাম্য আনার জন্য নয়। এ পথ বন্ধুর হবে, এই তরিকায় অনেক ভুলও থাকবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও চীন যে নিজের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল রাখতে চাইছে, তার জন্য এটা আশীর্বাদ হয়ে আসবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কোই জিন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতির অধ্যাপক।
বস্তুত, দুই সন্তান নীতির ফলাফল এক সন্তান নীতির চেয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী ও সার্বিকভাবে অনেকটা ইতিবাচক হবে। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে এটা অনেকটাই সত্য হবে, কিন্তু আপেক্ষিকভাবে স্বল্পমেয়াদেও এর প্রভাব দৃশ্যমান হবে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, পরিবারে অতিরিক্ত একটি সন্তান এলে দেশটির সামগ্রিক সঞ্চয় কমে আসবে, যেটা সামষ্টিক অর্থনীতির দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করবে।
বর্তমানে চীনের সঞ্চয়ের হার এত বেশি যে তাকে প্রায়ই বৈশ্বিক ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়, বিশ্বব্যাপী সুদের হার কমার কারণ হিসেবেও এটাকে চিহ্নিত করা হয়। তা ছাড়া চীন যে বর্তমানে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি থেকে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও সেবামুখী অর্থনীতির দিকে যেতে চাইছে, এই নিম্ন সুদের হার তার পথেও বড় একটা বাধা। এই উত্তরণকে ত্বরান্বিত করতে দুই সন্তান নীতি অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে, অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের প্রত্যাশার চেয়েও যে প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে।
এখন পর্যন্ত অর্থনীতিবিদেরা চীনের জনসংখ্যার কাঠামোতে যে পরিবর্তন আসন্ন সেখানেই নজর দিচ্ছেন। এই এক সন্তান নীতির কারণে অনূর্ধ্ব ২০ বছরের মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, ১৯৭০ সালে যারা ছিল জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ, ২০১০ সালের মধ্যে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ শতাংশে। আর এ সময়ের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যাও ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ফলে গড় বয়স ২০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫।
কর্মক্ষম মানুষের চেয়ে অবসরপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাওয়ায় আজকের তরুণ প্রজন্মের ওপর ব্যাপক চাপ পড়বে। বাস্তবে ব্যাপারটা এমন হবে যে ১৯৮০-এর দশকের এক সন্তান নীতির যুগের মানুষের গড়ে দুজন বৃদ্ধ মানুষের ভরণপোষণ করতে হবে। উল্লিখিত তরিকায় হিসাব করলে দেখা যাবে, আজকের দুই সন্তান নীতির যুগের মানুষ যখন মধ্যবয়সী হবেন, তখন তাঁদের গড়ে একজন বৃদ্ধ মানুষের ভরণপোষণ করতে হবে। ফলে বৃদ্ধ মানুষের ভরণপোষণজনিত অর্থনৈতিক যে চাপ তা অনেকটাই কমে আসবে। এর মধ্যে আবার আরেকটি ব্যাপার ঘটবে। এক সন্তান-উত্তর যুগের মানুষের শুধু বৃদ্ধদের নয়, বিপুলসংখ্যক তরুণেরও ভরণপোষণ করতে হবে।
যদিও ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে এক সন্তান নীতির যুগের মানুষের জন্য কঠিন হবে, কিন্তু এর একটি অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যাবে, ভোগের পরিমাণ বেড়ে গেছে। কারণ, তাদের অতিরিক্ত ব্যয় করা ছাড়া আর তেমন কিছু করার সুযোগ থাকবে না। ওই যুগে যাঁদের যমজ সন্তান হয়েছে আর যাঁদের এক সন্তান হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তুলনা করলেই দেখা যাবে, ভোগের ক্ষেত্রে কতটা পরিবর্তন এসেছে। (যদিও যমজ সন্তানদের পিতা-মাতার অক্ষমতার কারণে এটাকে ঠিক যথার্থরূপে প্রতিনিধিত্বশীল বলা যাবে না)।
সঞ্চয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, শহুরে পরিবারগুলোর মধ্যে যাঁদের দুই সন্তান আছে, তাঁরা উপার্জনের ১২ দশমিক ৮ শতাংশ সঞ্চয় করেছেন আর যাঁদের এক সন্তান আছে, তাঁরা ২১ দশমিক ৩ শতাংশ সঞ্চয় করেছেন। আয় যেমনই হোক না কেন, এই পার্থক্যটা কিন্তু বেশ বড়ই। এই দুই সন্তান নীতির কারণে পরিবারের ভোগ বাড়বে, এর প্রভাব নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো খাতের ওপর পড়বে। প্রথমত, অতিরিক্ত একটি সন্তানের জন্য বাবা-মাকে অতিরিক্ত খাতা, খেলনা ও বাইসাইকেল কিনতে হবে। আর এই প্রজন্ম বড় হলে তাদের গৃহায়ণ, ওষুধ ও বিমার চাহিদা অনেকাংশে বাড়বে।
শিক্ষাব্যয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় পার্থক্য সৃষ্টি হবে। ২০০৯ সালে শহুরে পরিবারের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, চীনে যেসব পরিবারে একটি সন্তান রয়েছে, সেই পরিবার শিক্ষায় তাদের মোট আয়ের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় করেছে আর যাদের যমজ সন্তান আছে, তারা ব্যয় করেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দুই সন্তানের পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকলে চীনের সঞ্চয়ের পরিমাণও ৭-১০ শতাংশ কমে আসবে, আজ যেটা ৩০ শতাংশ, আগামী ১০ বছরে তা কমে ২২ শতাংশে নামতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে। অধিক সন্তান মানে কিন্তু সন্তানপ্রতি শিক্ষা বিনিয়োগ কমে যাওয়া, যার মানে দাঁড়ায় মানবীয় পুঁজি অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ, যমজ সন্তানদের বয়স ১৫ হলে তো তাদের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ কমে যায়, এক সন্তানের তুলনায়, যেটা শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করে। এক সন্তানের তুলনায় যমজ সন্তানদের কারিগরি বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার ৪০ শতাংশ বেশি।
এত কিছু সত্ত্বেও চীনের দুই সন্তান নীতি গ্রহণের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা ছিল। তবে সেটা শুধু জনসংখ্যার ভারসাম্য আনার জন্য নয়। এ পথ বন্ধুর হবে, এই তরিকায় অনেক ভুলও থাকবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও চীন যে নিজের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল রাখতে চাইছে, তার জন্য এটা আশীর্বাদ হয়ে আসবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কোই জিন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতির অধ্যাপক।
No comments