আমলা বনাম শিক্ষক by আসিফ নজরুল
আমার
বাবা ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের প্রকৌশলী। একজন ‘ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড
অফিসার’। এ নিয়ে তাঁর গর্বের অন্ত ছিল না। কোনো বিষয়ে মতভেদ হলে তিনি
আমাদের বলতেন, ‘আগে ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার হও, পরে তোমার কথা শুনব।’
আমি ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করলাম, ট্যালেন্টপুল স্কলারশিপ পেলাম,
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেলাম, পরে বিচিত্রায় কাজ করার সময় তুমুল
আলোচিত নানা কাভার স্টোরি লিখলাম। কিছুই তাঁকে মুগ্ধ করতে পারে না। তর্ক
হলে একই কথা তাঁর, ‘আগে অফিসার হও, তখন কথা বোলো আমার সঙ্গে।’ কী
কর্মকর্তা হতে হবে? তিনি জানালেন, সবচেয়ে ডাকসাইটে হচ্ছে বিসিএসের
(প্রশাসন) কর্মকর্তা। পারব আমি ম্যাজিস্ট্রেট হতে?
নিতান্ত বিরক্ত হয়ে বিচিত্রায় কাজ করার সময় আমি নবম বিসিএস পরীক্ষা দিই। কোনো প্রস্তুতি না, কোনো পরিকল্পনা না। জাস্ট পরীক্ষার হলে গেলাম, লিখতে শুরু করলাম। বিসিএস প্রশাসন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে আমি বাবাকে বললাম, হলাম এবার ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার। তিনি হেসে বললেন, না হয়নি, আমাকে জয়েন করতে হবে!
১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে অবশেষে আমি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা (ম্যাজিস্ট্রেট) হিসেবে সিরাজগঞ্জে যোগদান করি। একসময় নিশ্চিত হই, এই চাকরি আমার জন্য না। বাবাকে না জানিয়ে সরকারি চাকরি ছেড়ে আবার বিচিত্রায় যোগ দিই। তাঁর ভয়ে ঢাকায় একা বাসা নিয়ে লুকিয়ে থাকি। কয়েক মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। বাবা কি মেনে নেবেন তা?
একদিন দোয়াদরুদ পড়ে বাসায় গেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার বাবা চিরদিন স্বপ্ন দেখতেন আমি সরকারি কর্মকর্তা হব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া তাঁর কাছে এর চেয়েও অনেক সম্মানের কিছু! আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এল।
এই আনন্দ আমি সারা জীবন বহন করেছি। আমার বন্ধুরা হাইকোর্টের জজ হয়েছেন, মেজর জেনারেল হয়েছেন, পুরোপুরি সচিব হয়ে গেছেন দু-একজন। আমার স্নেহাস্পদরা কেউ কেউ সাংসদ বা মন্ত্রী হয়েছেন, একজন এমনকি স্পিকার হয়েছেন। আমার ঘনিষ্ঠ বহু মানুষ হতদরিদ্র অবস্থা থেকে শতকোটি টাকার মালিক পর্যন্ত হয়েছেন। এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ, কোনো অনুযোগ নেই আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া এসবের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আমার বাবার চোখে শুধু নয়, বহু মানুষের কাছে আমি তা-ই দেখেছি।
দুই.
কিন্তু এত দিনে প্রথম আমার এই বিশ্বাস হোঁচট খেতে চলেছে। সরকার নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করেছে। সেই স্কেল অনুসারে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হব সর্বোচ্চ তৃতীয় গ্রেডের বেতনভোগী। আমার বন্ধুদের যাঁরা প্রশাসনে বা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেছেন, তাঁরা হবেন সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণির বেতনভোগী। আমার বন্ধুদের অধিকাংশের চেয়ে সারা জীবন আমি ভালো রেজাল্ট করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমি বিদেশে পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ করেছি, আমার ডিপার্টমেন্টে ৯০ শতাংশ শিক্ষক তা-ই করেছেন। প্রশাসনে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই মাস্টার্সের পর আর পড়াশোনা করেননি। তবু আমরা তৃতীয় আর তাঁরা প্রথম গ্রেড!
নতুন বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে অনেক। তার চেয়ে বেশি বেড়েছে প্রশাসনের লোকজনের। নতুন স্কেলের আগে থেকে তাঁদের জন্য ছিল নানা ধরনের অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধাও। যুগ্ম সচিব পর্যায় থেকে তাঁদের শুধু গাড়ি ভাতা বাবদ যে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো, তা-ই ছিল আমাদের অধ্যাপকদের মূল বেতনের বেশি। অথচ পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি যে পাকিস্তানের নাম শুনে আমরা নাক সিটকাই, সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আমলাদের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা শিক্ষকেরা এ নিয়ে অনুযোগ করতাম। অথচ এবার আমাদের বরং নামিয়ে দেওয়া হলো আরও দুই ধাপ নিচে। আমাদের কষ্টটা তবু বেতন নিয়ে নয়। মূল বিষয়টি সম্মানের, আত্মমর্যাদার। কেন আমরা তৃতীয়, কেন আমাদের চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম যোগ্যতর ব্যক্তিরা হবেন প্রথম! কেন?
শিক্ষকেরাই ক্লাস নেন, অন্যরা নেন না? আমি নিজে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেখানে আইন বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (খণ্ডকালীন) আছেন মাত্র পাঁচজন, আর সরকারি কর্মকর্তা আছেন সাতজন! বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা!
তিন.
তৃতীয় ধাপে নামিয়ে দেওয়ার পর আমাদের বিরুদ্ধে কিছু অপপ্রচারও হচ্ছে একে যৌক্তিক করার জন্য। এসব অভিযোগ আগেও উচ্চারিত হয়েছে কমবেশি। আমাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, আমরা নাকি ক্লাস নিই না। কারও কারও ক্ষেত্রে এটি সত্যি হতে পারে, কিন্তু সিংহভাগের বিরুদ্ধে নয়। তা ছাড়া আমাদের কর্মঘণ্টা ক্লাসের হিসাবে মাপলে হবে না। আমরা নিয়মিত পরীক্ষা হলে ডিউটি, পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্র ব্যবস্থাপনা, খাতা দেখা, টেবুলেশন করা, বিভিন্ন কমিটিতে পরামর্শ করাসহ বহু ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকি। রাত-বিরাতেও ব্যস্ত থাকি ক্লাস লেকচার তৈরির জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে জ্ঞান তৈরি করা। আমরা তা-ও করি দিন-রাত। জ্ঞান তৈরি যদি আমরা না করে থাকি, তাহলে শত শত পিএইচডি আমরা পেলাম কেমন করে, প্রতিবছর হাজার খানেক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয় কীভাবে, কেমন করে সরকারেরই বিভিন্ন প্রজেক্টে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করে আমাদের? সবচেয়ে বড় কথা, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন না করলে আমলারা তৈরি হলেন কাদের শিক্ষাদান থেকে?
আমাদের মধ্যে ফাঁকিবাজ আছেন, কম যোগ্যতাসম্পন্ন আছেন, তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীও আছেন। আমার প্রশ্ন, কোন পেশায় তা নেই? প্রশাসনে নেই? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নয়। আমাদের প্রশাসন কি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়? কিংবা আমাদের অন্য কোনো ক্যাডার?
আমাদের দোষ, আমরা নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় দিই। আমার প্রশ্ন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আমরা না পড়াই, তাহলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর জন্য শিক্ষক পাবেন কোথায়? আর পেলে আমাদের কেন নেওয়া হয়? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে টাকা পাই বলে, নাকি সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে আমাদের বেতন কম হওয়াই জায়েজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষকেরাই ক্লাস নেন, অন্যরা নেন না? আমি নিজে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেখানে আইন বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (খণ্ডকালীন) আছেন মাত্র পাঁচজন, আর সরকারি কর্মকর্তা আছেন সাতজন! বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা!
আমরা রাজনীতি করি, দলবাজি করি! হ্যাঁ সত্যি। আমলারা তা করেন না? না করলে কেন এক আমলের শত শত ডাকসাইটে কর্মকর্তা আরেক আমলে ওএসডি হন? কেন অধিকতর যোগ্যদের ডিঙিয়ে দলবাজদের বসানো হয় বড় বড় পদে? আমরা রাজনীতি করি বলেই না স্বাধীনতাসংগ্রামে আমরাই শহীদ হই, সামরিক শাসক আর ওয়ান-ইলেভেন আমলে নির্যাতিত হই আমরা শিক্ষকেরাই, আমলারা নন।
আমাদের কিছু রাজনীতি অবশ্যই অত্যন্ত লজ্জাজনক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আমলে তাই আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকেরা আর বিএনপি আমলে বিএনপিপন্থীরা বিজয়ী হন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধুলোয় মিশিয়ে আমরাও অনেক ক্ষেত্রে হয়ে গেছি প্রো-এসটাবলিশমেন্ট শক্তি।
কিন্তু আমাদের এই অপরাজনীতির নাটাইটা তো প্রধান দুই দলের হাতে। চরম অনুগত উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য কারা নিয়োগ দেয়? সিনেট সিন্ডিকেট ও নির্বাচনী কমিটিতে অনির্বাচিত পদগুলোতে চরম দলবাজদের কারা মনোনীত করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় একাডেমিক কমিটিগুলোর সুপারিশকৃতদের বাদ দিয়ে দলবাজদের নিয়োগের এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পদোন্নতির প্রবণতা কাদের আমলে শুরু হলো? এই অশুভ চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করেন বড়জোর এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক, তাঁদের জন্য বাকিদের নিয়তিও কেন হবে তৃতীয় গ্রেড!
চার.
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের জন্য বহু পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, উপাচার্য কর্তৃক একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার ক্ষমতা বন্ধ করে, ডিনসহ বিভিন্ন পদে দলভিত্তিক নির্বাচন সম্পূর্ণ বন্ধ করে, ডিনস কমিটি নামে একটি প্রশ্নবিদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি নিষিদ্ধ করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের পদোন্নতি পাওয়ার যে সুযোগ রিস্ট্রাকচারিং পদ্ধতিতে রয়েছে, তা আরও জবাবদিহিমূলক ও কঠোর করে এবং ছাত্রদের কর্তৃক শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের বহু সুযোগ রয়েছে। সরকার চাইলেই তা করতে পারে। সেসব না করে শিক্ষকদের বেতন আর মর্যাদা হ্রাস করার অজুহাত হিসেবে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢালাওভাবে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
তা ছাড়া কোনো যুক্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওপর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের স্থান নির্ধারিত হতে পারে না। অধ্যাপকের সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে, বিশেষ গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ অন্তত তার মধ্যে থেকে ১০ শতাংশের জন্য হলেও উন্মুক্ত রাখুন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাঠদান অপছন্দ হলে ভারত, শ্রীলঙ্কার মতো দেশের অনুরূপ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা আগে তাঁদের জন্য করুন, শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমার তুলনায় আমলাদের বেশি কম মনে হলে আমলাদেরটিও বাড়িয়ে দিন। কিন্তু কোনো যুক্তিতেই অধ্যাপকদের অপমান ও অবনমন করা ঠিক হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপমান করা মানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও তার ছাত্রছাত্রীদেরও অপমান করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপমান করা মানে সমাজে উচ্চশিক্ষার মর্যাদাকে অপমান করা।
সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের মনঃকষ্ট বোঝার চেষ্টা করুন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নিতান্ত বিরক্ত হয়ে বিচিত্রায় কাজ করার সময় আমি নবম বিসিএস পরীক্ষা দিই। কোনো প্রস্তুতি না, কোনো পরিকল্পনা না। জাস্ট পরীক্ষার হলে গেলাম, লিখতে শুরু করলাম। বিসিএস প্রশাসন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে আমি বাবাকে বললাম, হলাম এবার ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার। তিনি হেসে বললেন, না হয়নি, আমাকে জয়েন করতে হবে!
১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে অবশেষে আমি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা (ম্যাজিস্ট্রেট) হিসেবে সিরাজগঞ্জে যোগদান করি। একসময় নিশ্চিত হই, এই চাকরি আমার জন্য না। বাবাকে না জানিয়ে সরকারি চাকরি ছেড়ে আবার বিচিত্রায় যোগ দিই। তাঁর ভয়ে ঢাকায় একা বাসা নিয়ে লুকিয়ে থাকি। কয়েক মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। বাবা কি মেনে নেবেন তা?
একদিন দোয়াদরুদ পড়ে বাসায় গেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার বাবা চিরদিন স্বপ্ন দেখতেন আমি সরকারি কর্মকর্তা হব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া তাঁর কাছে এর চেয়েও অনেক সম্মানের কিছু! আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এল।
এই আনন্দ আমি সারা জীবন বহন করেছি। আমার বন্ধুরা হাইকোর্টের জজ হয়েছেন, মেজর জেনারেল হয়েছেন, পুরোপুরি সচিব হয়ে গেছেন দু-একজন। আমার স্নেহাস্পদরা কেউ কেউ সাংসদ বা মন্ত্রী হয়েছেন, একজন এমনকি স্পিকার হয়েছেন। আমার ঘনিষ্ঠ বহু মানুষ হতদরিদ্র অবস্থা থেকে শতকোটি টাকার মালিক পর্যন্ত হয়েছেন। এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ, কোনো অনুযোগ নেই আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া এসবের চেয়ে অনেক বড় কিছু। আমার বাবার চোখে শুধু নয়, বহু মানুষের কাছে আমি তা-ই দেখেছি।
দুই.
কিন্তু এত দিনে প্রথম আমার এই বিশ্বাস হোঁচট খেতে চলেছে। সরকার নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করেছে। সেই স্কেল অনুসারে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হব সর্বোচ্চ তৃতীয় গ্রেডের বেতনভোগী। আমার বন্ধুদের যাঁরা প্রশাসনে বা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেছেন, তাঁরা হবেন সর্বোচ্চ প্রথম শ্রেণির বেতনভোগী। আমার বন্ধুদের অধিকাংশের চেয়ে সারা জীবন আমি ভালো রেজাল্ট করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমি বিদেশে পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ করেছি, আমার ডিপার্টমেন্টে ৯০ শতাংশ শিক্ষক তা-ই করেছেন। প্রশাসনে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই মাস্টার্সের পর আর পড়াশোনা করেননি। তবু আমরা তৃতীয় আর তাঁরা প্রথম গ্রেড!
নতুন বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে অনেক। তার চেয়ে বেশি বেড়েছে প্রশাসনের লোকজনের। নতুন স্কেলের আগে থেকে তাঁদের জন্য ছিল নানা ধরনের অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধাও। যুগ্ম সচিব পর্যায় থেকে তাঁদের শুধু গাড়ি ভাতা বাবদ যে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো, তা-ই ছিল আমাদের অধ্যাপকদের মূল বেতনের বেশি। অথচ পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি যে পাকিস্তানের নাম শুনে আমরা নাক সিটকাই, সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আমলাদের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা শিক্ষকেরা এ নিয়ে অনুযোগ করতাম। অথচ এবার আমাদের বরং নামিয়ে দেওয়া হলো আরও দুই ধাপ নিচে। আমাদের কষ্টটা তবু বেতন নিয়ে নয়। মূল বিষয়টি সম্মানের, আত্মমর্যাদার। কেন আমরা তৃতীয়, কেন আমাদের চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম যোগ্যতর ব্যক্তিরা হবেন প্রথম! কেন?
শিক্ষকেরাই ক্লাস নেন, অন্যরা নেন না? আমি নিজে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেখানে আইন বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (খণ্ডকালীন) আছেন মাত্র পাঁচজন, আর সরকারি কর্মকর্তা আছেন সাতজন! বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা!
তিন.
তৃতীয় ধাপে নামিয়ে দেওয়ার পর আমাদের বিরুদ্ধে কিছু অপপ্রচারও হচ্ছে একে যৌক্তিক করার জন্য। এসব অভিযোগ আগেও উচ্চারিত হয়েছে কমবেশি। আমাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, আমরা নাকি ক্লাস নিই না। কারও কারও ক্ষেত্রে এটি সত্যি হতে পারে, কিন্তু সিংহভাগের বিরুদ্ধে নয়। তা ছাড়া আমাদের কর্মঘণ্টা ক্লাসের হিসাবে মাপলে হবে না। আমরা নিয়মিত পরীক্ষা হলে ডিউটি, পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্র ব্যবস্থাপনা, খাতা দেখা, টেবুলেশন করা, বিভিন্ন কমিটিতে পরামর্শ করাসহ বহু ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকি। রাত-বিরাতেও ব্যস্ত থাকি ক্লাস লেকচার তৈরির জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে জ্ঞান তৈরি করা। আমরা তা-ও করি দিন-রাত। জ্ঞান তৈরি যদি আমরা না করে থাকি, তাহলে শত শত পিএইচডি আমরা পেলাম কেমন করে, প্রতিবছর হাজার খানেক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয় কীভাবে, কেমন করে সরকারেরই বিভিন্ন প্রজেক্টে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করে আমাদের? সবচেয়ে বড় কথা, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন না করলে আমলারা তৈরি হলেন কাদের শিক্ষাদান থেকে?
আমাদের মধ্যে ফাঁকিবাজ আছেন, কম যোগ্যতাসম্পন্ন আছেন, তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীও আছেন। আমার প্রশ্ন, কোন পেশায় তা নেই? প্রশাসনে নেই? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নয়। আমাদের প্রশাসন কি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়? কিংবা আমাদের অন্য কোনো ক্যাডার?
আমাদের দোষ, আমরা নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় দিই। আমার প্রশ্ন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আমরা না পড়াই, তাহলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর জন্য শিক্ষক পাবেন কোথায়? আর পেলে আমাদের কেন নেওয়া হয়? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে টাকা পাই বলে, নাকি সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে আমাদের বেতন কম হওয়াই জায়েজ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষকেরাই ক্লাস নেন, অন্যরা নেন না? আমি নিজে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেখানে আইন বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (খণ্ডকালীন) আছেন মাত্র পাঁচজন, আর সরকারি কর্মকর্তা আছেন সাতজন! বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা!
আমরা রাজনীতি করি, দলবাজি করি! হ্যাঁ সত্যি। আমলারা তা করেন না? না করলে কেন এক আমলের শত শত ডাকসাইটে কর্মকর্তা আরেক আমলে ওএসডি হন? কেন অধিকতর যোগ্যদের ডিঙিয়ে দলবাজদের বসানো হয় বড় বড় পদে? আমরা রাজনীতি করি বলেই না স্বাধীনতাসংগ্রামে আমরাই শহীদ হই, সামরিক শাসক আর ওয়ান-ইলেভেন আমলে নির্যাতিত হই আমরা শিক্ষকেরাই, আমলারা নন।
আমাদের কিছু রাজনীতি অবশ্যই অত্যন্ত লজ্জাজনক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আমলে তাই আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকেরা আর বিএনপি আমলে বিএনপিপন্থীরা বিজয়ী হন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধুলোয় মিশিয়ে আমরাও অনেক ক্ষেত্রে হয়ে গেছি প্রো-এসটাবলিশমেন্ট শক্তি।
কিন্তু আমাদের এই অপরাজনীতির নাটাইটা তো প্রধান দুই দলের হাতে। চরম অনুগত উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য কারা নিয়োগ দেয়? সিনেট সিন্ডিকেট ও নির্বাচনী কমিটিতে অনির্বাচিত পদগুলোতে চরম দলবাজদের কারা মনোনীত করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় একাডেমিক কমিটিগুলোর সুপারিশকৃতদের বাদ দিয়ে দলবাজদের নিয়োগের এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পদোন্নতির প্রবণতা কাদের আমলে শুরু হলো? এই অশুভ চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করেন বড়জোর এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক, তাঁদের জন্য বাকিদের নিয়তিও কেন হবে তৃতীয় গ্রেড!
চার.
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের জন্য বহু পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, উপাচার্য কর্তৃক একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার ক্ষমতা বন্ধ করে, ডিনসহ বিভিন্ন পদে দলভিত্তিক নির্বাচন সম্পূর্ণ বন্ধ করে, ডিনস কমিটি নামে একটি প্রশ্নবিদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি নিষিদ্ধ করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের পদোন্নতি পাওয়ার যে সুযোগ রিস্ট্রাকচারিং পদ্ধতিতে রয়েছে, তা আরও জবাবদিহিমূলক ও কঠোর করে এবং ছাত্রদের কর্তৃক শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের বহু সুযোগ রয়েছে। সরকার চাইলেই তা করতে পারে। সেসব না করে শিক্ষকদের বেতন আর মর্যাদা হ্রাস করার অজুহাত হিসেবে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢালাওভাবে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
তা ছাড়া কোনো যুক্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওপর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের স্থান নির্ধারিত হতে পারে না। অধ্যাপকের সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে, বিশেষ গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ অন্তত তার মধ্যে থেকে ১০ শতাংশের জন্য হলেও উন্মুক্ত রাখুন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাঠদান অপছন্দ হলে ভারত, শ্রীলঙ্কার মতো দেশের অনুরূপ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা আগে তাঁদের জন্য করুন, শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমার তুলনায় আমলাদের বেশি কম মনে হলে আমলাদেরটিও বাড়িয়ে দিন। কিন্তু কোনো যুক্তিতেই অধ্যাপকদের অপমান ও অবনমন করা ঠিক হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপমান করা মানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার ও তার ছাত্রছাত্রীদেরও অপমান করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপমান করা মানে সমাজে উচ্চশিক্ষার মর্যাদাকে অপমান করা।
সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের মনঃকষ্ট বোঝার চেষ্টা করুন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments