বড়লেখায় কিশোরী নাজমাকে নির্যাতন- তোলপাড় by ওয়েছ খছরু
মৌলভীবাজারের
বড়লেখায় নির্যাতিত কাজের মেয়ে নাজমা বেগম ২১ দিন ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে।
তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। বরং দিন দিন পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত
হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাজমাকে বড়লেখা লাকসাম গ্রামে গৃহকর্মী হিসেবে
কাজ করত। টানা এক সপ্তাহ তাকে ‘গরুঘর’-এ আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এ সময়
প্রতিদিন তাকে এক বেলা খাবার দেয়া হতো। বড়লেখা উপজেলার বিছরাবন্দ গ্রামের
গরিব মনছুর আলীর কিশোরী মেয়ে নাজমা। বয়স ১৬ বছর। অভাব অনটনের সংসার কয়েক
মাস আগে নাজমা মাসিক দুই হাজার টাকায় কাজ নেয় লুৎফা বেগমের লাকসামের বাসায়।
সে বাসাতেই চালানো হয় তার ওপর নির্যাতন। সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
৪র্থ তলার ৬নং ওয়ার্ডের ১০নং বেডে চিকিৎসাধীন নাজমার বাম পা প্রায় অচল।
চিকিৎসকরা তার বাম পায়ের উরু এবং হাঁটুর নিচ থেকে পা পর্যন্ত প্লাস্টার করে
দিয়েছেন। চোখ দুটিতে কিলঘুসি মারায় চোখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধেছে।
হাসপাতালে বোনের পাশে থাকা আলেয়া বেগম ও মা ফাতিমা বেগম জানান, নাজমার চোখ
দিয়ে অনেক রক্ত বের হয়েছে। তার চোখ দুটি ভবিষ্যতে অন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে
আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। নাজমাও তার ওপর নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছে। নাজমা
জানায়, লুৎফা বেগমের বাসায় কাজে যাওয়ার পরপরই তারা অবৈধ কাজের প্রস্তাব
দেয়। এভাবে বারবার প্রস্তাব দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। একপর্যায়ে তাদের
কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গৃহকর্ত্রী লুৎফা, ভাই রাফি, সামাদ চোখে
কিলঘুসি মারে এবং কোমরে গরম পানি ঢেলে দেয়। এতে বাম পা ও উরুর কিছু অংশ
ঝলসে যায়। এছাড়াও কাঠের বেলুন দিয়ে ঘাড়ে পিটিয়ে জখম করে। ঘাড়ের মাংস সরে
গিয়ে সেখানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। নাজমা জানায়, যত দিন কু-প্রস্তাবে রাজি
হয়নি ততদিন বাসার রুমে রেখে নির্যাতন চালানো হতো। প্রতিদিন এক বেলা বাসি
খাবার দিতো। সেখানে অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয়
সপ্তাহে লুৎফা, ভাই রাফি ও সামাদ নাজমাকে লাকসাম থেকে পিতার বাড়ি বড়লেখার
সুজাউল বাজারের পাঁচপাড়ার বাড়িতে নিয়ে আসে। এখানে নাজমা বেগমকে গরুঘরে রশি
দিয়ে বেঁধে ৬ দিন ধরে বন্দি রাখে। এদিকে, নাজমার ওপর যখন নির্যাতন চলছিল
তখন তার কোন খোঁজ পাচ্ছিল না হতদরিদ্র মা ও বাবা। নাজমার মা ফাতেমা ও পিতা
মনছুর আলী লুৎফার পিতা সৌদি প্রবাসী আজির উদ্দিনের পাঁচপাড়ার বাড়িতে যান।
তখন তারা লুৎফার মায়ের কাছে নাজমাকে দাবি করেন। বলেন, আমার মেয়ে আপনার কাছে
দিয়েছিলাম। তাকে ফিরিয়ে দিন। একপর্যায়ে তিনি গরুঘরে গিয়ে দেখতে পান নাজমা
সেখানে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। এ সময় নাজমার পিতা-মাতা তাকে উদ্ধার করে
নিয়ে আসে। পরে শরীরে নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন দেখে ২৭শে সেপ্টেম্বর সিলেট
ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। দিনমজুর পিতা মনছুর আলী জানান,
এক বছর আগে বড়লেখা থানার সুজাউল বাজারের পাঁচপাড়ার বাসিন্দা প্রবাসী
আব্দুল মালিক দুদুর স্ত্রী রুবি বেগমের কাছে কাজের জন্য দিয়েছিলেন নাজমাকে।
মাসিক দুই হাজার টাকা বেতনে তাকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রুবি বেগম তার ভাসুর
কন্যা লুৎফার লাকসামস্থ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন নাজমাকে। লুৎফার বাসায় নাজমার
ওপর চালানো হয় নির্যাতন। নাজমার মা ফাতেমা বেগম বলেন, এক বছরের মধ্যে মাত্র
এক মাসের বেতন তারা মেয়েকে দিয়েছে। আর বাদবাকি মাসের বেতন তাকে দেয়নি।
নাজমা এখন হাঁটাচলা করতে পারছে না। এদিকে, নাজমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর
গত ৬ই অক্টোবর নাজমার পিতা মনছুর আলী বড়লেখা থানায় মামলা করেন। ওই মামলায়
প্রথমে লুৎফা বেগম ছাড়াও তার মা রাবেয়া বেগম ও চাচী রুবি বেগমকে আসামি করা
হয়। আর মামলা দায়ের করার দিন পুলিশ অভিযান চালিয়ে রাবেয়া বেগমকে গ্রেপ্তার
করে। রাবেয়া বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। নাজমার পিতা জানান, মামলা রেকর্ডের
সময় রাফি, সামাদসহ নির্যাতনকারী কয়েকজনের নাম বাদ পড়েছে। এ বিষয়টি তিনি
তদন্ত কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন বলে জানান। বড়লেখা থানার ওসি মনিরুজ্জামান
জানান, নাজমার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যাপরে নারী ও শিশু নির্যাতন
দমন সংশোধনী আইনের ধারায় মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এখন আসামিদের গ্রেপ্তারে
অভিযান চলছে। বড়লেখা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সুন্দর
সাংবাদিকদের জানান, যে-ই অপরাধী হোক না কেন তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে
হবে। তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। এদিকে নাজমার পিতা মনছুর আলী গতকালও
সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, নির্যাতনকারীরা প্রভাবশালী মহলের কাছে
নিজেদের বাঁচাতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। নির্যাতনকারীরা নাজমাকে হাসপাতাল
থেকে গুম করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
No comments