ভারতের হাতছাড়া হচ্ছে নেপাল by ট্রেইল ওকিয়া আর অ্যারিয়েল
নেপালের নতুন সংবিধানের ব্যাপারে ভারতের প্রতিক্রিয়ার সাথে পিপলস রিপাবলিক অব চীন গঠনের ব্যাপারে আমেরিকার প্রতিক্রিয়ার মিল রয়েছে।
চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যখন চীনের গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে ১৯৪৯ সালে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না গঠন করে, তখন আমেরিকানরা বিষয়টিকে ‘চীনকে হারানো’ হিসেবে দেখে। আমেরিকান কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদেরা কমিউনিজমের কাছে চীনকে হারানোর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন। যুক্তরাষ্ট্র এই নবগঠিত পিপলস রিপাবলিকের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবুও চীনা কমিউনিস্টরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সব পথ খোলা রাখে।
এ ছাড়াও, চীনের হাতে যাওয়ার পর পণ্ডিত ব্যক্তি ও অন্যরা কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন, অথবা কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন বলে আমেরিকানরা সন্দেহ পোষণ করেন। আমেরিকা ১৯৭০ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তাইওয়ানে জিয়াং জিশির ‘পরাজিত’ সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার যখন হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র তখন চীনের সাথে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করে।
২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধান ঘোষণার পর ভারত যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তার সাথে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠার সময় আমেরিকা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তার সাথে মিল পাওয়া যায়। ভারতীয়দের কারণে নেপাল চীন এবং খ্রিশ্চিয়ানিটির কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু কী কারণে নেপাল হাতছাড়া হয়ে গেছে, তা খুঁজে বের করা এবং নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করার পরিবর্তে ভারত সরকার নেপালের প্রতি অসঙ্গত আচরণ করছে। নেপাল এখন সেসব খেলোয়াড়দের কাছে চলে গেছে যাদের কাছে ভারত হারতে চায়নি। এ জন্য ভারতের নিজেকেই দোষারোপ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র যেমন কমিউনিজমের কারণে চীনকে হারিয়েছিল। জেনারেল জর্জ সি মার্শালের ভুল হিসাব নিকাশ এবং চীনের সাথে আচরণের ব্যাপারে পররাষ্ট্র দফতর ও প্রতিরক্ষা বিভাগের মধ্যে মতপার্থক্য থাকায় এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। গত দেড় দশকে ভারত নেপালকে নিয়ে একের পর এক কৌশলগত ভুল হিসাব করেছেÑ যার কারণে উভয় দেশ পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নেপালের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নির্বাসনে পাঠানÑ যা ছিল একটি মারাত্মক কৌশলগত ভুল। গোয়েন্দাদের নেপালে ভারতের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যত দ্রুত সম্ভব ভারতের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই কৌশল নেয়া হয়। এ জন্য প্রথমে নেপালে ভারতের আজ্ঞাবাহ একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ওই নির্দেশনা অনুসারে ভারত মাওবাদীদের প্রতি সমর্থন দেয়। প্রথমে একদল থেকে অন্য দলে পরিবর্তিতভাবে এবং পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে এই সমর্থন দেয়া হয়। ভারতীয় গোয়েন্দারা উপলব্ধি করতে পারেননি, মাওবাদী পার্টি একটি একক দল নয়। অথবা যদি তারা এটা জানত তাহলে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটির ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্ব দিত না। মাওবাদী দলে বহু উপদল রয়েছে এবং প্রত্যেক উপদলের নেতারা তাদের নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত হন। নেপালের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকেরা অন্যান্য স্থানের কমিউনিস্ট বিপ্লবের ইতিহাস কি পড়েছেন? তারা বুঝতে পারবেন সফল বিপ্লবের পর কোনো কমিউনিস্ট পার্টিই আর অবিভক্ত থাকেনি। কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষপর্যায়ে ভাঙন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নেপালও ব্যতিক্রম নয়। ভারতীয় পক্ষ মনে করেছিল এরা যেহেতু বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে এবং বিদ্রোহী গ্রুপ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১২ দফা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে যেহেতু এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেহেতু নেপালে এরা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু শিগগির ভারতীয়দের এই আশা বর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ ছাড়াও, ব্যক্তিগত ট্রেইটস এবং আমাদের কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের প্রেরণাদায়ক বিষয় পড়তে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় গোয়েন্দারা ও
কূটনীতিকেরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, মাওবাদী পার্টিতে অন্যান্য শক্তি থেকে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে, অথবা উপদলগুলো নিজেরাই অন্যদের কাছে চলে গেছেÑ খুব সম্ভবত এরা চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় স্বার্থের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। মাওবাদী এবং অন্যান্য দল সম্পূর্ণভাবে নৈতিকভাবে, অথবা বস্তুগত সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল নয়।
আবার, নেপালে ভারতের আধিপত্যের ব্যাপারে মুখে অনর্গল বলে গেলেও তাদেরকে ভারতের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। কাঠমান্ডুতে পরবর্তী ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্রাজেন হস্তক্ষেপ করেন। মাওবাদী দল অথবা অন্য যেকোনো দল থেকে আমাদের যেসব নেতা তৈরি করা হয় তারা জনগণের কাছে উচ্চ জাতীয়তাবাদী হিসেবে উপস্থিত হন। নেপাল বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয়রা ‘ভারতের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে’ বলে আবারো ব্যাখ্যা করা হয়।
আমাদের নেতৃবৃন্দও তাদের পছন্দের বিষয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলেন। কেউ কেউ চীনপন্থী, কেউ কেউ ভারতপন্থী এবং কেউ কেউ অন্য কোনো পন্থী। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলগুলোর পছন্দের বিষয় সুস্পষ্ট। ভারত সরকার এসব নেতার সাথে গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত হয় না। চীনপন্থী একজন প্রধানমন্ত্রীকে ভারত আমন্ত্রণ জানায়নি। নতুন প্রধানমন্ত্রী খোলামেলাভাবে ভারতের প্রতি তাকে আমন্ত্রণ জানানোর আহ্বান জানানো সত্ত্বেও নয়াদিল্লি সে আমন্ত্রণ জানায়নি। একই ইনস্টিটিউশনÑ যারা অতীতে ভুল হিসাব করেছে তারাও নেপালের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে গেছে।
২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বে ভারত একটি নতুন সরকার পেয়েছে। বিজেপি দক্ষিণ এশিয়া ও নেপালের সাথে পূর্বসূরির ভুুল শুধরে নেয়ার চেষ্টা করেছে। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসের মধ্যেই নেপাল সফর করেন। তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন যুগ শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। মোদির আন্তরিকতার ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। কিন্তু তিনিও নেপালে ব্যষ্টিক পর্যায়ের সম্পর্ক বজায় রাখা না রাখার আহ্বান প্রতিরোধ করতে পারেননি। মোদি ভারতের ইতিহাসে অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীর মতো নন। মোদি নেপালের হিন্দু-ইজমকে উচ্চকিত করতে চাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে।
ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রধানত হিন্দুদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মের ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট। নেপালের নতুন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ভারত সমর্থন না করার এটা একটা কারণ হতে পারে। সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো গুজব ছড়ায়Ñ ভারত নেপালের নতুন সংবিধানে দেশটি একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা চায়। ভারত এ ব্যাপারে অনড় অবস্থান নেয়। নেপাল ভারতের বিশেষ দূত এস জয়শঙ্করের সাথে যখন শীতল আচরণ করে, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভারত নেপালকে হারাচ্ছে এবং অন্যরা এর সুযোগ নিচ্ছে।
বিজেপির মতো একটি দলের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল মানে বিরোধী দলগুলো ভবিষ্যতে সেখানে একটি ক্ষেত্র খুঁজে পাবে এবং ভারতের জাতীয় নির্বাচনের জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি হাস্যা স্পদ হতে যাচ্ছেÑ কারণ কেবল হিন্দু রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার জন্য নয়। সাথে সাথে নেপালকে অন্যদের কাছে হারানোর জন্য। তাই নেপালকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ভারত হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এ জন্য ভারত কিছু করতেও পারছে না। ক্ষুব্ধ ভারত সরকার একটি বড় ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছে। ভারত সত্যিকার অর্থে নেপালকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইলে নেপালের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে সেখানকার হিন্দুপন্থী ও রাজতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে ভারতের সহায়তা ও সমর্থন দেয়া উচিত ছিল।
নেপালের নতুন সংবিধানকে একটি ক্ষতি হিসেবে দেখার পরিবর্তে বিজেপির উচিত ছিল নেপালের সাথে নতুনভাবে সম্পর্ক শুরুর জন্য এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নেয়া। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্রের ব্যাপারে সিরিয়াস হলে তাদের উচিত ছিল হিন্দুপন্থী ও রাজতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা ও উৎসাহ দেয়াÑ যাতে এরা সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেপালে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু রাষ্ট্র চাইলেÑ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের বিরাট সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগকে বিদায় করে দিয়েছে। কেন এরা এটা করেছে, তা এরাই ভালোভাবে বলতে পারবেন।
গণতন্ত্রকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিলে জনগণ চাইলে অবশ্যই ভবিষ্যতে নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য এবং সাউথ ব্লকের জন্য খারাপ দৃশ্যপট হচ্ছে, নেপালের রাজনীতিতে এরা নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি করতে পারবেন না। এমনকি অধিকতর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমেও সে ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নেপাল ভারতের স্বার্থের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে বা এ নিয়ে সমঝোতায় আগ্রহী নয়।
অনুবাদ : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যখন চীনের গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে ১৯৪৯ সালে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না গঠন করে, তখন আমেরিকানরা বিষয়টিকে ‘চীনকে হারানো’ হিসেবে দেখে। আমেরিকান কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদেরা কমিউনিজমের কাছে চীনকে হারানোর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন। যুক্তরাষ্ট্র এই নবগঠিত পিপলস রিপাবলিকের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবুও চীনা কমিউনিস্টরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সব পথ খোলা রাখে।
এ ছাড়াও, চীনের হাতে যাওয়ার পর পণ্ডিত ব্যক্তি ও অন্যরা কমিউনিস্ট হয়ে গেছেন, অথবা কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন বলে আমেরিকানরা সন্দেহ পোষণ করেন। আমেরিকা ১৯৭০ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তাইওয়ানে জিয়াং জিশির ‘পরাজিত’ সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার যখন হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র তখন চীনের সাথে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করে।
২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধান ঘোষণার পর ভারত যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তার সাথে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠার সময় আমেরিকা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তার সাথে মিল পাওয়া যায়। ভারতীয়দের কারণে নেপাল চীন এবং খ্রিশ্চিয়ানিটির কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু কী কারণে নেপাল হাতছাড়া হয়ে গেছে, তা খুঁজে বের করা এবং নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করার পরিবর্তে ভারত সরকার নেপালের প্রতি অসঙ্গত আচরণ করছে। নেপাল এখন সেসব খেলোয়াড়দের কাছে চলে গেছে যাদের কাছে ভারত হারতে চায়নি। এ জন্য ভারতের নিজেকেই দোষারোপ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র যেমন কমিউনিজমের কারণে চীনকে হারিয়েছিল। জেনারেল জর্জ সি মার্শালের ভুল হিসাব নিকাশ এবং চীনের সাথে আচরণের ব্যাপারে পররাষ্ট্র দফতর ও প্রতিরক্ষা বিভাগের মধ্যে মতপার্থক্য থাকায় এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। গত দেড় দশকে ভারত নেপালকে নিয়ে একের পর এক কৌশলগত ভুল হিসাব করেছেÑ যার কারণে উভয় দেশ পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নেপালের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নির্বাসনে পাঠানÑ যা ছিল একটি মারাত্মক কৌশলগত ভুল। গোয়েন্দাদের নেপালে ভারতের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যত দ্রুত সম্ভব ভারতের স্বার্থ হাসিলের জন্য এই কৌশল নেয়া হয়। এ জন্য প্রথমে নেপালে ভারতের আজ্ঞাবাহ একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ওই নির্দেশনা অনুসারে ভারত মাওবাদীদের প্রতি সমর্থন দেয়। প্রথমে একদল থেকে অন্য দলে পরিবর্তিতভাবে এবং পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে এই সমর্থন দেয়া হয়। ভারতীয় গোয়েন্দারা উপলব্ধি করতে পারেননি, মাওবাদী পার্টি একটি একক দল নয়। অথবা যদি তারা এটা জানত তাহলে তারা এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটির ব্যাপারে এত বেশি গুরুত্ব দিত না। মাওবাদী দলে বহু উপদল রয়েছে এবং প্রত্যেক উপদলের নেতারা তাদের নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত হন। নেপালের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকেরা অন্যান্য স্থানের কমিউনিস্ট বিপ্লবের ইতিহাস কি পড়েছেন? তারা বুঝতে পারবেন সফল বিপ্লবের পর কোনো কমিউনিস্ট পার্টিই আর অবিভক্ত থাকেনি। কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষপর্যায়ে ভাঙন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নেপালও ব্যতিক্রম নয়। ভারতীয় পক্ষ মনে করেছিল এরা যেহেতু বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে এবং বিদ্রোহী গ্রুপ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১২ দফা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে যেহেতু এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেহেতু নেপালে এরা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু শিগগির ভারতীয়দের এই আশা বর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ ছাড়াও, ব্যক্তিগত ট্রেইটস এবং আমাদের কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের প্রেরণাদায়ক বিষয় পড়তে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় গোয়েন্দারা ও
কূটনীতিকেরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, মাওবাদী পার্টিতে অন্যান্য শক্তি থেকে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে, অথবা উপদলগুলো নিজেরাই অন্যদের কাছে চলে গেছেÑ খুব সম্ভবত এরা চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় স্বার্থের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। মাওবাদী এবং অন্যান্য দল সম্পূর্ণভাবে নৈতিকভাবে, অথবা বস্তুগত সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল নয়।
আবার, নেপালে ভারতের আধিপত্যের ব্যাপারে মুখে অনর্গল বলে গেলেও তাদেরকে ভারতের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। কাঠমান্ডুতে পরবর্তী ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্রাজেন হস্তক্ষেপ করেন। মাওবাদী দল অথবা অন্য যেকোনো দল থেকে আমাদের যেসব নেতা তৈরি করা হয় তারা জনগণের কাছে উচ্চ জাতীয়তাবাদী হিসেবে উপস্থিত হন। নেপাল বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয়রা ‘ভারতের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে’ বলে আবারো ব্যাখ্যা করা হয়।
আমাদের নেতৃবৃন্দও তাদের পছন্দের বিষয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলেন। কেউ কেউ চীনপন্থী, কেউ কেউ ভারতপন্থী এবং কেউ কেউ অন্য কোনো পন্থী। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলগুলোর পছন্দের বিষয় সুস্পষ্ট। ভারত সরকার এসব নেতার সাথে গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত হয় না। চীনপন্থী একজন প্রধানমন্ত্রীকে ভারত আমন্ত্রণ জানায়নি। নতুন প্রধানমন্ত্রী খোলামেলাভাবে ভারতের প্রতি তাকে আমন্ত্রণ জানানোর আহ্বান জানানো সত্ত্বেও নয়াদিল্লি সে আমন্ত্রণ জানায়নি। একই ইনস্টিটিউশনÑ যারা অতীতে ভুল হিসাব করেছে তারাও নেপালের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে গেছে।
২০১৪ সালে বিজেপির নেতৃত্বে ভারত একটি নতুন সরকার পেয়েছে। বিজেপি দক্ষিণ এশিয়া ও নেপালের সাথে পূর্বসূরির ভুুল শুধরে নেয়ার চেষ্টা করেছে। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসের মধ্যেই নেপাল সফর করেন। তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন যুগ শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। মোদির আন্তরিকতার ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। কিন্তু তিনিও নেপালে ব্যষ্টিক পর্যায়ের সম্পর্ক বজায় রাখা না রাখার আহ্বান প্রতিরোধ করতে পারেননি। মোদি ভারতের ইতিহাসে অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীর মতো নন। মোদি নেপালের হিন্দু-ইজমকে উচ্চকিত করতে চাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে।
ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রধানত হিন্দুদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মের ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট। নেপালের নতুন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ভারত সমর্থন না করার এটা একটা কারণ হতে পারে। সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো গুজব ছড়ায়Ñ ভারত নেপালের নতুন সংবিধানে দেশটি একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা চায়। ভারত এ ব্যাপারে অনড় অবস্থান নেয়। নেপাল ভারতের বিশেষ দূত এস জয়শঙ্করের সাথে যখন শীতল আচরণ করে, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভারত নেপালকে হারাচ্ছে এবং অন্যরা এর সুযোগ নিচ্ছে।
বিজেপির মতো একটি দলের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল মানে বিরোধী দলগুলো ভবিষ্যতে সেখানে একটি ক্ষেত্র খুঁজে পাবে এবং ভারতের জাতীয় নির্বাচনের জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপি হাস্যা স্পদ হতে যাচ্ছেÑ কারণ কেবল হিন্দু রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার জন্য নয়। সাথে সাথে নেপালকে অন্যদের কাছে হারানোর জন্য। তাই নেপালকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ভারত হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এ জন্য ভারত কিছু করতেও পারছে না। ক্ষুব্ধ ভারত সরকার একটি বড় ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছে। ভারত সত্যিকার অর্থে নেপালকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাইলে নেপালের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে সেখানকার হিন্দুপন্থী ও রাজতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে ভারতের সহায়তা ও সমর্থন দেয়া উচিত ছিল।
নেপালের নতুন সংবিধানকে একটি ক্ষতি হিসেবে দেখার পরিবর্তে বিজেপির উচিত ছিল নেপালের সাথে নতুনভাবে সম্পর্ক শুরুর জন্য এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নেয়া। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্রের ব্যাপারে সিরিয়াস হলে তাদের উচিত ছিল হিন্দুপন্থী ও রাজতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা ও উৎসাহ দেয়াÑ যাতে এরা সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেপালে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু রাষ্ট্র চাইলেÑ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের বিরাট সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগকে বিদায় করে দিয়েছে। কেন এরা এটা করেছে, তা এরাই ভালোভাবে বলতে পারবেন।
গণতন্ত্রকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিলে জনগণ চাইলে অবশ্যই ভবিষ্যতে নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য এবং সাউথ ব্লকের জন্য খারাপ দৃশ্যপট হচ্ছে, নেপালের রাজনীতিতে এরা নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি করতে পারবেন না। এমনকি অধিকতর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমেও সে ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নেপাল ভারতের স্বার্থের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে বা এ নিয়ে সমঝোতায় আগ্রহী নয়।
অনুবাদ : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
No comments