বিপর্যয়ের মুখে ঢাকা by হারুন-আর-রশিদ
কে
বলে বাংলাদেশের উন্নতি হয়নি? অনেক ‘উন্নতি’ হয়েছে বাংলাদেশের। অনেকেই বলে
উন্নতির চেহারাটা দেখতে তোমাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না। যানজট, মানবজট,
পানিজট ও বর্জ্যজট কি উন্নতি নয়? ৪৪ বছর আগে যা ছিল না সেটা যদি এখন দেখা
যায়- তাহলে তো একে একধরনের ‘উন্নতি’ই বলা যায়। কেউ কেউ রসিকতার সুরে একে
বলেন ডিজিটাল উন্নতি। পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকার ঊর্ধ্বে; এটাও একধরনের
উন্নতি। রাষ্ট্র বলছে- দেশ এখন উন্নতির চরম শিখরে ধাবমান। অর্থাৎ উন্নতির
গতিরোধ করা অসম্ভব।
মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর সাত কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে আধুনিক শহরে বড় জোর ৩০ মিনিট লাগার কথা। বাস্তবে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা। ৬ সেপ্টেম্বর মিনিবাসে মতিঝিল আসতে মোহাম্মদপুর থেকে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। শাপলা চত্বরে এসে যখন পৌঁছি তখন ৩টা ২৫ মিনিট। মোহাম্মদপুর থেকে যাত্রা করেছিলাম দুপুর ১২টায়। কোনো কাজ নিয়ে মতিঝিলে এলে ওই একটি মাত্র কাজ করাও সম্ভব হচ্ছে না যানজটে এত বেশি বিলম্ব ঘটার কারণে। প্রযুক্তির যুগে এটা চরম দুঃখজনক সংবাদ। আমার মতো শত শত মানুষ প্রতিদিন যানজটের বেহাল দশায় আক্রান্ত হয়ে আর্থিকভাবে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আসা-যাওয়ায় সময় লাগার কথা যেখানে এক ঘণ্টা, সেখানে সময় ব্যয় হচ্ছে এমনকি সাত ঘণ্টাও। অতিরিক্ত ছয় ঘণ্টা (৭-১) সময় যে অযথা নষ্ট হচ্ছে এর ক্ষতিটা অপূরণীয়। অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে ছয় ঘণ্টা। ঢাকায় মতিঝিল-গুলশানে প্রতিদিন যারা আসা-যাওয়া করেন সব মিলিয়ে যদি ধরি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ, তাহলে ছয় ঘণ্টা নষ্ট হওয়ার অর্থ কি দাঁড়ায়? অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয় নগরীর অন্তত ৩০ হাজার মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে (৩০,০০০´৬) = ১,৮০,০০০ ঘণ্টা। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতির এ ধাক্কাটা প্রতিদিন যে ঘটছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী মহোদয়রা কি এটা তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করতে পারেন? পারেন না। কারণ তাদের চলাচলের সময় সড়ক যানজটমুক্ত থাকে।
গত ১ সেপ্টেম্বর একটি স্মরণীয় দিন বিশেষ করে ঢাকাবাসীর জন্য। পত্রিকা লিখেছে- পানিপথের আরেক যুদ্ধ : শুক্রাবাদে বুক সমান পানি। ফুটপাথের এক দোকানদার তার বিক্রয়সামগ্রী নিয়ে রিকশায় করে যাত্রা শুরু করেছেন। গন্তব্য কী নিজেও জানেন না। রিকশাওয়ালাকে বললেন, মামা শুকনো কোনো জায়গা পেলে আমার মালসামানসহ আমাকে নামিয়ে দিলে খুশি হবো। ছবিসহ এ ধরনের একটি সংবাদ পত্রিকায় উঠেছে। ঢাকার জলাবদ্ধতার কোনো নিরসন হয়নি। বরং এ সমস্যা আরো জটিল রূপ নিয়েছে। ওই দিনের একটি টিভি চ্যানেলে তিনজন নগরবিশারদ যে বক্তব্য দিয়েছেন- তার সার সংক্ষেপ হলো (১) ঢাকার ১৬টি প্রধান খাল দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। (২) ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। (৩) ৪৮০ কিলোমিটার নালা-নর্দমা প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়নি। ঢাকার সমস্যাগুলো নিয়ে প্রতিদিন পত্রিকায় নিউজ ছাপানো হচ্ছে। নগরবিদদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হচ্ছে। গোলটেবিল বৈঠক, মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ দিন ধরে চলেছে। অথচ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কোনো সরকার নেয়নি। উল্টো দেখা যায়, কিভাবে ঢাকার মৃত্যু ত্বরান্বিত করা যায় সে অপচেষ্টায় আমরা সবাই ব্যস্ত।
তিন ধরনের জট ঢাকাকে ব্যাধির শহরে পরিণত করেছে। এগুলো হলো- যানজট, জলজট এবং মানবজট। একদিন যদি সব যান বন্ধ হয়ে যায় সে দিন ঢাকা পরিণত হয় অধিকতর মানবজটে। এমনিতেই ঢাকায় এখন মানবজট প্রায় জায়গায় পরিলক্ষিত হয়। মতিঝিল অফিসপাড়ায় সব সময় মানবজট লেগে থাকে। মনে হয় যেন মস্ত বড় একটি বাজার। সব কিছুই এখন অফিসপাড়ায় মূল সড়কেও বেচাকেনা হচ্ছে। আজব সব কর্মকাণ্ড মহানগরীর সড়কপথকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে গেলে নীরব। শোনা যায়, এসব অবৈধ ব্যবসায় সরকারি দলের লোকজনদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জড়িত। বহু বছর ধরে সড়ক পথের ব্যস্ত স্থানে এ ধরনের বাণিজ্য চলায় পথচারীর ভোগান্তি কী পরিমাণ বেড়েছে তা সবার জানা। মূল সড়ক পথে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিতেও দেখা যায়। নগরীর ফুটপাথ বহু আগেই ভাসমান হকারদের দখলে। এখন কিছু ফুটপাথে মোটরসাইকেল চলতে দেখা যায়। বড় ফুটপাথে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। গণপরিবহন যেসব সড়কপথে চলে, তা সরু হতে হতে মাত্র ১৫ থেকে ২০ ফুটে পৌঁছেছে। সড়কের ডান বামে সাত ফুট করে (৭´২) ১৪ ফুট জায়গা দখল করে রেখেছেন প্রাইভেট গাড়ির মালিকেরা।
আইন নিজস্ব গতিতে চলার পথে প্রতিবন্ধকদের বিরুদ্ধে আইনের রক্ষকেরাই নীরব। তাহলে আইন কাগজে থাকবে- বাস্তবে থাকবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের বহু আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আইন কার্যকর না থাকার কারণে দেশে যানজট, জলজট, বর্জ্যজট এবং মানবজট চরম আকার ধারণ করেছে।
আমরা নিজের দোষেই নিজে মরছি। দেশের চেয়ে বেশি ভাবছি নিজেকে নিয়ে। আসলে আমরা অদূরদর্শী। রাষ্ট্র ভালো থাকলে যে গোটা রাষ্ট্রের মানুষ ভালো থাকে- আমরা অবিবেচক বলে এ সত্যতা বুঝতে চাচ্ছি না। পৃথিবীর ১৯৪টি রাজধানী শহরের মাঝে ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ঢাকার সৌন্দর্য ৭১-এর আগের চেয়ে নিম্নমানের হওয়ার পেছনে কারণগুলো নিয়ে সরকার শুধু কথাই বলেছে- কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
ঢাকার কোটি মানুষ মাত্র পৌনে চার শত বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাস করছেন। একটি দেশে যত লোক বাস করে না- তা যদি একটি শহরে বাস করে তাহলে সেই দেশের রাজধানী কিভাবে পরিবেশবান্ধব হবে? বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা- সেই কানাডার লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন কোটি। নতুন ঢাকার মেগা পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অবৈধ পথে ক্ষমতায় এসে কয়েকবারই বলেছিলেন, ঢাকার চিত্রকে পাল্টিয়ে দেবো। একটি বেড়িবাঁধ ও কিছু রাস্তা সংস্কার হয়েছে বটে কিন্তু সমস্যার জট কি কমেছে? যদি কমতো তাহলে ঢাকার আজকের চেহারাটা এতো কদর্য হলো কেন। একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে যদি আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাহলে বুঝতে হবে- পরিকল্পনার মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। যেমন ধরুন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রাজধানী ঢাকার রাস্তার পাশে ফেলে রাখা বিশাল ভাগাড়ের কনটেইনারগুলো রাস্তার প্রসারতা কমাচ্ছে- অন্য দিকে দুর্গন্ধ ও দূষিত বায়ু ছড়াচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দীর্ঘ ৪০ বছর কোনো সরকারই করতে পারেনি। এলাকাভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যা দিয়ে সার তৈরি করা যায়- এ রকম কিছু সরকার গড়ে তুলতে পারেনি। এ কারণে ঢাকা আবর্জনার শহরে রূপ নিয়েছে।
জলাবদ্ধতার মূল কারণ নালা-নর্দমা-জলাশয়, খাল ভরাট করে বাণিজ্যে মেতে ওঠা, যা ঢাকাবাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে। পয়ঃনিষ্কাশন, ড্রেনেজ সিস্টেম এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এখনো আধুনিকায়ন করা হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি কাজ স্বল্পমেয়াদি টার্গেট নিয়ে করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে কাজটির টেন্ডার বারবার সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যাবে না। কাজটি নিম্নমানের, কারণ কম খরচে সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু বিলে দেখানো হয় বড় অঙ্কের হিসাব। এভাবেই আমরা সঙ্কীর্ণ স্বার্থে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করছি। জনস্বার্থের কাজটি যখন বাণিজ্যে রূপ নেয় তখন জনগণ ও রাষ্ট্র বঞ্চিত হবে।
ঢাকাকে মেগাসিটি করতে নাকি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, কয়েকটি নতুন ফ্লাইওভার, ঢাকার চার পাশে ২৪ কিলোমিটার নৌরুট নির্মাণের মহাপরিকল্পনার কথা বলছে সরকার। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই অদ্যাবধি পানিজট, যানজট ও মানবজট থেকে ঢাকাকে মুক্ত করতে পারেনি। বাপদাদার আমলে শোনা প্রবাদ বাক্যটি যে সত্য- সেটা বিশ্বাস করতে হয়। অর্থাৎ, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। একসময়ে ঢাকায় খেলার মাঠ ছিল, খোলা জায়গা ছিল। ফুটপাথে হাঁটা যেত। সারা দিন বৃষ্টি হলেও ঢাকায় জলাবদ্ধতার দৃশ্য দেখা যায়নি। এখন কোনো খাল নেই- যা-ও দু-একটি ছিল সেগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে পুরো ঢাকা শহর বলতে গেলে প্রায় সাড়ে তিন শত বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত। বুকসমান পানি ঢাকার কোনো কোনো স্থানে। কেন এর নেই কোনো প্রতিকার?
৪৪ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু ভূখণ্ড এক ছটাকও বাড়েনি। আবাদি জমি কমেছে স্ফীত জনসংখ্যার কারণে। খাল, বিল, জলাশয়, নদী কমেছে। মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের কারণে পরিবেশেরও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঢাকা সিটি এসব বিপর্যয়ের কেন্দ্রভূমি। যে শহরে মানুষ বেশি- সেই শহর দূষণমুক্ত রাখা কঠিন। সুতরাং সরকারের মেগাসিটি পরিকল্পনা অতীতের মতো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। ঢাকার অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ যেকোনো উপায়ে রোধ করতে হবে। ঢাকা শহরে মানুষ কেন আসছে- সেটা চিহ্নিত করে এরপর এর সমস্যার পথ খুঁজতে হবে। এককথায় বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। ঢাকাকেন্দ্রিক বড় বড় অফিস, কলকারখানা, আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, সেক্রেটারিয়েট ভবন যেখানে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ আসে, আদালতপাড়া, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি অপসারণ করতে হবে। নগরীর বাইরে এসব সরিয়ে নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে ব্যক্তিগত ও সরকারি পরিবহন বাড়ছে এবং মূল সড়ক পথকে গাড়ি পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করছে। যানজট ও মানবজট বাড়ার মূল কারণ এগুলো। ঢাকার ধানমন্ডি মাঠ, ওসমানী উদ্যান ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- এসব উদ্যানও এখন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় বড় ইমারত, অফিস কাম শপিং কমপ্লেক্সের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে খেলার মাঠের পাশে।
শিশুদের খেলার মাঠও কর্তৃপক্ষ ‘খেয়ে ফেলেছে’। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন (Neat and clean) শহরের মুখরোচক শব্দ আওড়াবেন, আবার নিজেরাই ঢাকাকে কিভাবে শ্বাসরুদ্ধকর, ভাগাড় ও আবর্জনার শহরে রূপ দেয়া যায়- এর অনুমোদন দেবেন রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষের সহায়তায়। তাহলে তো মেগা সিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবেই। জরিপে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- ঢাকার বর্তমান আয়তন হিসাবে লোকসংখ্যা এক কোটিই যথেষ্ট। এর বেশি জনসংখ্যা হয়েছে বলেই যান, জল ও মানবজট বেড়েছে ঢাকায়। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে মেগা সিটির পরিকল্পনার আগে বিকেন্দ্রীয়করণ পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি জনসচেতনতার উপায় বাতলিয়ে দিতে হবে। ঢাকাকে নিয়ে বাণিজ্য করতে গিয়ে আমরা ঢাকাকে অসুস্থ নগরীতে পরিণত করেছি। রাষ্ট্রকে নিয়ে বাণিজ্য, রাজধানীকে নিয়ে বাণিজ্য- যারা করেছে তারা দেশের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর নয়। এ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সে বচনটি যথার্থ বলেই মনে হলো- মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর সাত কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে আধুনিক শহরে বড় জোর ৩০ মিনিট লাগার কথা। বাস্তবে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা। ৬ সেপ্টেম্বর মিনিবাসে মতিঝিল আসতে মোহাম্মদপুর থেকে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। শাপলা চত্বরে এসে যখন পৌঁছি তখন ৩টা ২৫ মিনিট। মোহাম্মদপুর থেকে যাত্রা করেছিলাম দুপুর ১২টায়। কোনো কাজ নিয়ে মতিঝিলে এলে ওই একটি মাত্র কাজ করাও সম্ভব হচ্ছে না যানজটে এত বেশি বিলম্ব ঘটার কারণে। প্রযুক্তির যুগে এটা চরম দুঃখজনক সংবাদ। আমার মতো শত শত মানুষ প্রতিদিন যানজটের বেহাল দশায় আক্রান্ত হয়ে আর্থিকভাবে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আসা-যাওয়ায় সময় লাগার কথা যেখানে এক ঘণ্টা, সেখানে সময় ব্যয় হচ্ছে এমনকি সাত ঘণ্টাও। অতিরিক্ত ছয় ঘণ্টা (৭-১) সময় যে অযথা নষ্ট হচ্ছে এর ক্ষতিটা অপূরণীয়। অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে ছয় ঘণ্টা। ঢাকায় মতিঝিল-গুলশানে প্রতিদিন যারা আসা-যাওয়া করেন সব মিলিয়ে যদি ধরি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ, তাহলে ছয় ঘণ্টা নষ্ট হওয়ার অর্থ কি দাঁড়ায়? অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয় নগরীর অন্তত ৩০ হাজার মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে (৩০,০০০´৬) = ১,৮০,০০০ ঘণ্টা। জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতির এ ধাক্কাটা প্রতিদিন যে ঘটছে সে ব্যাপারে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী মহোদয়রা কি এটা তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করতে পারেন? পারেন না। কারণ তাদের চলাচলের সময় সড়ক যানজটমুক্ত থাকে।
গত ১ সেপ্টেম্বর একটি স্মরণীয় দিন বিশেষ করে ঢাকাবাসীর জন্য। পত্রিকা লিখেছে- পানিপথের আরেক যুদ্ধ : শুক্রাবাদে বুক সমান পানি। ফুটপাথের এক দোকানদার তার বিক্রয়সামগ্রী নিয়ে রিকশায় করে যাত্রা শুরু করেছেন। গন্তব্য কী নিজেও জানেন না। রিকশাওয়ালাকে বললেন, মামা শুকনো কোনো জায়গা পেলে আমার মালসামানসহ আমাকে নামিয়ে দিলে খুশি হবো। ছবিসহ এ ধরনের একটি সংবাদ পত্রিকায় উঠেছে। ঢাকার জলাবদ্ধতার কোনো নিরসন হয়নি। বরং এ সমস্যা আরো জটিল রূপ নিয়েছে। ওই দিনের একটি টিভি চ্যানেলে তিনজন নগরবিশারদ যে বক্তব্য দিয়েছেন- তার সার সংক্ষেপ হলো (১) ঢাকার ১৬টি প্রধান খাল দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। (২) ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। (৩) ৪৮০ কিলোমিটার নালা-নর্দমা প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়নি। ঢাকার সমস্যাগুলো নিয়ে প্রতিদিন পত্রিকায় নিউজ ছাপানো হচ্ছে। নগরবিদদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হচ্ছে। গোলটেবিল বৈঠক, মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ দিন ধরে চলেছে। অথচ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কোনো সরকার নেয়নি। উল্টো দেখা যায়, কিভাবে ঢাকার মৃত্যু ত্বরান্বিত করা যায় সে অপচেষ্টায় আমরা সবাই ব্যস্ত।
তিন ধরনের জট ঢাকাকে ব্যাধির শহরে পরিণত করেছে। এগুলো হলো- যানজট, জলজট এবং মানবজট। একদিন যদি সব যান বন্ধ হয়ে যায় সে দিন ঢাকা পরিণত হয় অধিকতর মানবজটে। এমনিতেই ঢাকায় এখন মানবজট প্রায় জায়গায় পরিলক্ষিত হয়। মতিঝিল অফিসপাড়ায় সব সময় মানবজট লেগে থাকে। মনে হয় যেন মস্ত বড় একটি বাজার। সব কিছুই এখন অফিসপাড়ায় মূল সড়কেও বেচাকেনা হচ্ছে। আজব সব কর্মকাণ্ড মহানগরীর সড়কপথকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে গেলে নীরব। শোনা যায়, এসব অবৈধ ব্যবসায় সরকারি দলের লোকজনদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জড়িত। বহু বছর ধরে সড়ক পথের ব্যস্ত স্থানে এ ধরনের বাণিজ্য চলায় পথচারীর ভোগান্তি কী পরিমাণ বেড়েছে তা সবার জানা। মূল সড়ক পথে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিতেও দেখা যায়। নগরীর ফুটপাথ বহু আগেই ভাসমান হকারদের দখলে। এখন কিছু ফুটপাথে মোটরসাইকেল চলতে দেখা যায়। বড় ফুটপাথে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। গণপরিবহন যেসব সড়কপথে চলে, তা সরু হতে হতে মাত্র ১৫ থেকে ২০ ফুটে পৌঁছেছে। সড়কের ডান বামে সাত ফুট করে (৭´২) ১৪ ফুট জায়গা দখল করে রেখেছেন প্রাইভেট গাড়ির মালিকেরা।
আইন নিজস্ব গতিতে চলার পথে প্রতিবন্ধকদের বিরুদ্ধে আইনের রক্ষকেরাই নীরব। তাহলে আইন কাগজে থাকবে- বাস্তবে থাকবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের বহু আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আইন কার্যকর না থাকার কারণে দেশে যানজট, জলজট, বর্জ্যজট এবং মানবজট চরম আকার ধারণ করেছে।
আমরা নিজের দোষেই নিজে মরছি। দেশের চেয়ে বেশি ভাবছি নিজেকে নিয়ে। আসলে আমরা অদূরদর্শী। রাষ্ট্র ভালো থাকলে যে গোটা রাষ্ট্রের মানুষ ভালো থাকে- আমরা অবিবেচক বলে এ সত্যতা বুঝতে চাচ্ছি না। পৃথিবীর ১৯৪টি রাজধানী শহরের মাঝে ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ঢাকার সৌন্দর্য ৭১-এর আগের চেয়ে নিম্নমানের হওয়ার পেছনে কারণগুলো নিয়ে সরকার শুধু কথাই বলেছে- কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
ঢাকার কোটি মানুষ মাত্র পৌনে চার শত বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাস করছেন। একটি দেশে যত লোক বাস করে না- তা যদি একটি শহরে বাস করে তাহলে সেই দেশের রাজধানী কিভাবে পরিবেশবান্ধব হবে? বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা- সেই কানাডার লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন কোটি। নতুন ঢাকার মেগা পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অবৈধ পথে ক্ষমতায় এসে কয়েকবারই বলেছিলেন, ঢাকার চিত্রকে পাল্টিয়ে দেবো। একটি বেড়িবাঁধ ও কিছু রাস্তা সংস্কার হয়েছে বটে কিন্তু সমস্যার জট কি কমেছে? যদি কমতো তাহলে ঢাকার আজকের চেহারাটা এতো কদর্য হলো কেন। একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে যদি আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাহলে বুঝতে হবে- পরিকল্পনার মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। যেমন ধরুন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রাজধানী ঢাকার রাস্তার পাশে ফেলে রাখা বিশাল ভাগাড়ের কনটেইনারগুলো রাস্তার প্রসারতা কমাচ্ছে- অন্য দিকে দুর্গন্ধ ও দূষিত বায়ু ছড়াচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দীর্ঘ ৪০ বছর কোনো সরকারই করতে পারেনি। এলাকাভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যা দিয়ে সার তৈরি করা যায়- এ রকম কিছু সরকার গড়ে তুলতে পারেনি। এ কারণে ঢাকা আবর্জনার শহরে রূপ নিয়েছে।
জলাবদ্ধতার মূল কারণ নালা-নর্দমা-জলাশয়, খাল ভরাট করে বাণিজ্যে মেতে ওঠা, যা ঢাকাবাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে। পয়ঃনিষ্কাশন, ড্রেনেজ সিস্টেম এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এখনো আধুনিকায়ন করা হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি কাজ স্বল্পমেয়াদি টার্গেট নিয়ে করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে কাজটির টেন্ডার বারবার সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যাবে না। কাজটি নিম্নমানের, কারণ কম খরচে সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু বিলে দেখানো হয় বড় অঙ্কের হিসাব। এভাবেই আমরা সঙ্কীর্ণ স্বার্থে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করছি। জনস্বার্থের কাজটি যখন বাণিজ্যে রূপ নেয় তখন জনগণ ও রাষ্ট্র বঞ্চিত হবে।
ঢাকাকে মেগাসিটি করতে নাকি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, কয়েকটি নতুন ফ্লাইওভার, ঢাকার চার পাশে ২৪ কিলোমিটার নৌরুট নির্মাণের মহাপরিকল্পনার কথা বলছে সরকার। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই অদ্যাবধি পানিজট, যানজট ও মানবজট থেকে ঢাকাকে মুক্ত করতে পারেনি। বাপদাদার আমলে শোনা প্রবাদ বাক্যটি যে সত্য- সেটা বিশ্বাস করতে হয়। অর্থাৎ, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। একসময়ে ঢাকায় খেলার মাঠ ছিল, খোলা জায়গা ছিল। ফুটপাথে হাঁটা যেত। সারা দিন বৃষ্টি হলেও ঢাকায় জলাবদ্ধতার দৃশ্য দেখা যায়নি। এখন কোনো খাল নেই- যা-ও দু-একটি ছিল সেগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে পুরো ঢাকা শহর বলতে গেলে প্রায় সাড়ে তিন শত বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত। বুকসমান পানি ঢাকার কোনো কোনো স্থানে। কেন এর নেই কোনো প্রতিকার?
৪৪ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু ভূখণ্ড এক ছটাকও বাড়েনি। আবাদি জমি কমেছে স্ফীত জনসংখ্যার কারণে। খাল, বিল, জলাশয়, নদী কমেছে। মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের কারণে পরিবেশেরও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঢাকা সিটি এসব বিপর্যয়ের কেন্দ্রভূমি। যে শহরে মানুষ বেশি- সেই শহর দূষণমুক্ত রাখা কঠিন। সুতরাং সরকারের মেগাসিটি পরিকল্পনা অতীতের মতো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। ঢাকার অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ যেকোনো উপায়ে রোধ করতে হবে। ঢাকা শহরে মানুষ কেন আসছে- সেটা চিহ্নিত করে এরপর এর সমস্যার পথ খুঁজতে হবে। এককথায় বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। ঢাকাকেন্দ্রিক বড় বড় অফিস, কলকারখানা, আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, সেক্রেটারিয়েট ভবন যেখানে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ আসে, আদালতপাড়া, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি অপসারণ করতে হবে। নগরীর বাইরে এসব সরিয়ে নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে ব্যক্তিগত ও সরকারি পরিবহন বাড়ছে এবং মূল সড়ক পথকে গাড়ি পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করছে। যানজট ও মানবজট বাড়ার মূল কারণ এগুলো। ঢাকার ধানমন্ডি মাঠ, ওসমানী উদ্যান ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- এসব উদ্যানও এখন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় বড় ইমারত, অফিস কাম শপিং কমপ্লেক্সের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে খেলার মাঠের পাশে।
শিশুদের খেলার মাঠও কর্তৃপক্ষ ‘খেয়ে ফেলেছে’। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন (Neat and clean) শহরের মুখরোচক শব্দ আওড়াবেন, আবার নিজেরাই ঢাকাকে কিভাবে শ্বাসরুদ্ধকর, ভাগাড় ও আবর্জনার শহরে রূপ দেয়া যায়- এর অনুমোদন দেবেন রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষের সহায়তায়। তাহলে তো মেগা সিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবেই। জরিপে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- ঢাকার বর্তমান আয়তন হিসাবে লোকসংখ্যা এক কোটিই যথেষ্ট। এর বেশি জনসংখ্যা হয়েছে বলেই যান, জল ও মানবজট বেড়েছে ঢাকায়। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে মেগা সিটির পরিকল্পনার আগে বিকেন্দ্রীয়করণ পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি জনসচেতনতার উপায় বাতলিয়ে দিতে হবে। ঢাকাকে নিয়ে বাণিজ্য করতে গিয়ে আমরা ঢাকাকে অসুস্থ নগরীতে পরিণত করেছি। রাষ্ট্রকে নিয়ে বাণিজ্য, রাজধানীকে নিয়ে বাণিজ্য- যারা করেছে তারা দেশের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর নয়। এ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সে বচনটি যথার্থ বলেই মনে হলো- মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
No comments