নিরাপত্তা ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন
যুগান্তর বোর্ডরুমে শনিবার যুগান্তর-যমুনা টিভি আয়োজিত নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সতর্কতা শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত অতিথিরা-যুগান্তর |
দুই
বিদেশী হত্যাসহ সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার
সুযোগ নেই। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের সফরের আগে ঘটনার সূত্রপাত। পূর্বাপর
বিশ্লেষণ করলে এসব ঘটনার মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র পাওয়া সম্ভব। এ ধরনের
পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। শনিবার যুগান্তর ও
যমুনা টেলিভিশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সতর্কতা’
শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, এ দেশে জঙ্গি
সংগঠন নেই- এটা বলা ঠিক হবে না। তবে এটা বলা যায়, তাদের আন্তর্জাতিক
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বক্তারা আরও বলেন, বিচারহীনতা কিংবা
বিচারে বিলম্বের কারণে অপরাধ বাড়ছে। যদি অপরাধীরা গ্রেফতার হয় এবং দেখাতে
পারি যে, আমরা ছাড় দেইনি, তবে বিদেশীদের আস্থা ফিরে আসবে।
গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হেমায়েত উদ্দিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী ও যুগান্তরের সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব কামাল। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন যমুনা টিভির বার্তা বিভাগের প্রধান জাকারিয়া কাজল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন যুগান্তরের কূটনৈতিক রিপোর্টার মাসুদ করিম। যুগান্তর কার্যালয়ে বেলা ১১টায় শুরু হয়ে এই আলোচনা চলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। এ সময় বিশেষজ্ঞদের আলোচনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক পরিস্থিতির আলোকে রাজনীতিবিদদের মধ্যে বেশ খানিকটা প্রাণবন্ত বিতর্কও হয়। এতে পরস্পরের মধ্যে আস্থার সংকটের কথা যেমন উঠে আসে, ঠিক তেমনি বিদেশীদের মধ্যেও আস্থা সৃষ্টির তাগিদ আসে। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে নিরাপত্তা ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
মাহবুবউল আলম হানিফ : আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনা অত্যন্ত পরিকল্পিত। সরকারকে বিব্রত করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা সাদা চোখে দেখা যায়। যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, সরকারের অর্জনকে ম্লান করে দিতে চায় তারা এ ঘটনা ঘটিয়ে বহির্বিশ্বে ভিন্ন বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের নিরাপত্তা সতর্কতা প্রসঙ্গে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, তাদের কাছে যদি তথ্য থেকে থাকে, তারা কেন সেটা দেয়নি? তাহলে সরকার আগে থেকেই সতর্ক হতে পারত। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই জাতীয় ঐক্য দরকার। তবে এই ঐক্য যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে নয়। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নেই, এটা বললে ভুল হবে উল্লেখ করে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, একসময় জামায়াত-শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে বিএনপি এ দেশে জঙ্গিবাদের বীজ বপন করেছিল। তাদের সঙ্গে ঐক্য করে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমরা নিজেরাই যখন জিএসপি সুবিধা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করি, ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দেই তখন বিদেশীরা তো সুযোগ নেবেই। তিনি কোনো বিদেশী কূটনীতিকের কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য নেয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মিডিয়া কর্মীদেরও সরে আসতে বলেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের কোনো কূটনীতিক বিদেশে দায়িত্ব পালনকালে সেদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় নিয়ে নাক গলান না। সেদেশের মিডিয়াকর্মীরাও তাদের কাছে কিছু জানতে চান না। অথচ আমাদের দেশে কোনো বিদেশী এলে মিডিয়াকর্মীরা রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন।’
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর গুরত্ব দিয়ে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আইনের শাসন গড়ে তুলতে হলে আমাদের দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আরও বেশি পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের দুই নেত্রী একে অপরের মুখই দেখেন না। সরকারি দলের হলে আইন এক রকম আর বিরোধী দলের হলে আইন অন্য রকম- এটা মানা যায় না। বর্তমান সরকার ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না অভিযোগ করে এই বিএনপি নেতা বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হোক, স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক, তা সরকারি দল চায় না।’
ড. সা’দত হুসাইন : সাবেক মিন্ত্রপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন বলেন, দু’জন বিদেশী খুনের ঘটনার প্রথমটির পর মনে হয়েছিল বিচ্ছিন্ন কিছু। কিন্তু পরের ঘটনার পরই সন্দেহটা এসে গেল। বিদেশী খুনের ঘটনার টাইমিংটা গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দল থাকতেই ঘটল। তারা সফর স্থগিত করার কথা জানিয়ে গেলেন। এরপর দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল। এরপর অনেক অ্যালার্ট জারি করেছে কয়েকটি রাষ্ট্র। দেখতে হবে তারা কারা। তারা আমাদের ওপর আগে থেকেই কোনো কারণে গোস্বা হয়ে আছে। সে কারণ আমরা সাদা চোখে দেখছি না। এ বিষয়টিকে সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তবে গোস্বা তারা কখন হয়েছে, তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখতে হবে। রাগ হয়েছে অন্য কারণে। যা পরে প্রকাশ পায়। কেউ হয়তো কারও ওপর ফুঁসছি। কিছু বলতে পারছি না। তখন ‘তক্কে তক্কে’ থাকি। ঠিক সুযোগ বুঝে ধরা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটা কিনা দেখতে হবে।
হেমায়েত উদ্দিন : সাবেক সচিব হেমায়েত উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে প্রথম দেখা গেল নিরাপত্তার অজুহাত তুলে প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল বাংলাদেশে না আসার ঘোষণা দিল। একজন বিশেষজ্ঞ এসে অস্ট্রেলিয়া দলের না আসার ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন, এটি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সিদ্ধান্ত নয়, সেদেশের সরকারের সিদ্ধান্ত। এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, এখানে যারা বিদেশী নাগরিক আছেন ২৪ ঘণ্টা তাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এদেশে যারা বিদেশী নাগরিক আছেন তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে তারা কোথায় আছেন, কী কাজ করছে, তা নিজ নিজ দেশের দূতাবাসকে জানিয়ে দেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে কি তা হচ্ছে? এখন একজন বিদেশী নাগরিক যদি প্রশাসন কিংবা তার নিজ দেশের দূতাবাসকে না জানিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন তার নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব?
এম হুমায়ুন কবির : সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে সংঘটিত ঘটনাকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। বেশকিছু শূন্যস্থান তৈরি হয়ে আছে। একটি হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া। আজ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, অপরের মতকে গ্রহণ করা, সবাইকে নিয়ে চলার নীতি ইত্যাদিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কাউকে পছন্দ না করলে তাকে ‘এলিমিনেট’ (বিনাশ) করার চিন্তা দেখা যায়। সর্বক্ষেত্রেই এটা ঘটছে। এ কারণে এই যে সমাজ আজ দেখছি, তা বিশ্বাসের বাইরে বলে মনে হচ্ছে। আজ বহুত্ববাদী সমাজের ধারণা থেকে সিগুলারিটির (একক) দিকে যাচ্ছি। এই ধারা রাষ্ট্রের ভেতরের কার্যক্রমেও দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের ভেতরে বা সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠন তাদের ভূমিকা একসঙ্গে রাখে কিনা, তা আলোচনায় আসে না। এই সিঙ্গুলারিটির ধারণা সমস্যা তৈরিতে সহায়তা করে। এই জায়গা থেকে আমরা না সরলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরও বাড়বে। তৃতীয় প্রেক্ষাপট হচ্ছে, আমরা শুধু বড় জিনিস দেখি। তার প্রেক্ষাপট দেখি না। আইএস নিয়ে আন্তর্জাতিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।
তৌহিদ হোসেন : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি তিনটি বিষয় নোটে রাখতে চাই। যে কোনো দেশের মতোই আমাদের দেশেও কট্টরপন্থী লোক আছে। অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। দুই বিদেশী খুনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তির জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। তবে অর্থনীতির জন্য সম্ভাব্য ক্ষতি আরও বেশি।’ তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ‘পারসেপশন’টা (দৃষ্টিভঙ্গি) জরুরি। ক্ষতি যা হয়েছে হয়তো তার চেয়ে বেশি প্রচার করছি আমরা। তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার রাস্তা কয়েকটি। প্রথমত, অপরাধীদের ধরা ও শাস্তি দেয়া। আস্থার সংকটের কথা বলা হচ্ছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ। গুলশান-বারিধারা এলাকায় সাঁজোয়া বাহিনী বসিয়ে এর সমাধান হবে না। বরং এতে উল্টো বার্তাও যেতে পারে। আস্থার সংকট দূর করার প্রধান উপায় হচ্ছে প্রকৃত তদন্তের মাধ্যমে আসল অপরাধীকে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা। প্রক্রিয়া বিলম্ব হলে অগ্রগতি জানাতে হবে। দেশের ভাবমূর্তির জন্য অগ্রগতি দেখানো জরুরি। আমার বিশ্বাস আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তা পারবে।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী : নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে জঙ্গি সংগঠন নেই এটা বলা ঠিক হবে না। তবে তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। তাদের অনেকেই কারাগারে আছে। তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে। ক্ষুদ্র ইসলামী গোষ্ঠীর শেকড় বাংলাদেশে গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনা ঘটার আগে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এটিকে অবশ্যই সাধুবাদ দতে হবে। তিনি বলেন, এদেশে হরকাতুল জিহাদের জন্ম হয়েছে মাজারকে টার্গেট করে। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জন্ম হয়েছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের টার্গেট করে। তবে আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকলে অনেক ঘটনাই ঘটে যেত। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে যার মিল নেই তাকে মেরে ফেরতে হবে এ ধারণা থেকে বের হতে হবে।
অধ্যাপক জিয়া রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ইতালির নাগরিক খুন হওয়ার পর আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ধারণা করেছিলাম। কিন্তু এর কয়েক দিনের মাথায় রংপুর জাপানি নাগরিক খুন হওয়ার পর ভুল ভাঙে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নেই এটা বললে ভুল হবে। শিবিরের রগকাটা রাজনীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশে জিয়াউর রহমান সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জঙ্গি তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। দুই বিদেশী খুনের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, জিএসপি বন্ধ করে দেয়ার পর যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ তার প্রায় সবকটি পূরণ করেছে। তারপরও জিএসপি ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটা গভীর ষড়যন্ত্র।
ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাস যে শুধু বাংলাদেশে কিংবা এ অঞ্চলে আছে তা নয়। বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের সন্ত্রাস হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে গ্লোবাল সন্ত্রাস। তবে আমরা আমেরিকা কিংবা ইউকের চেয়ে খুব বেশি ভয়ংকর অবস্থায় নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ ধরনের অনেক সন্ত্রাস হচ্ছে। সেগুলো খুব বেশি প্রচার হচ্ছে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, টেরোরিজম মানেই ইসলামিক। ঘটনাটি আসলে তা নয়। এই উপমহাদেশে কেন আমাদের দেশকে বেছে নেয়া হচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি কোনো কোনো রাষ্ট্রের গোস্বা থাকতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক মাহবুব কামাল বলেন, দু’জন বিদেশী হত্যার পেছনে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে ফেলা। বিনিয়োগ বিঘ্নিত করা। নিছক গোষ্ঠীর স্বার্থেও এটা হতে পারে। আবার আন্তর্জাতিক বড় ডিজাইনের অংশ হতে পারে। বর্তমানে অনেকে ইসলামিক মিলিট্যান্টের দিকে ঝুঁকছে। আমার মতে, কেবল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে রিমেডি (প্রতিকার) হবে না।
জাকারিয়া কাজল : স্বাগত বক্তব্যে যমুনা টেলিভিশনের বার্তা বিভাগের প্রধান জাকারিয়া কাজল বলেন, আমরা দেখলাম নিরাপত্তার কথা বলে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল সফর বাতিল করল। এর দু-একদিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঘটনা ঘটল। সেখানে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই এমন ঘটনা ঘটে। তবে পার্থক্য একটাই আমাদের দেশে কিছু হলে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। তবে এসব ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
সাইফুল আলম : গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আমরা নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সতর্কতা নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেছিলাম। তবে আলোচনা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাজনীতির মধ্যেও গড়িয়েছে। আসলে কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথা এসেছে। পূর্বপরিকল্পিত না ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অন্যান্য হিসাব এসেছে তা নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে। এটা ঠিক যে, ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অনেক ঘটনা পরপর সংঘটিত হয়েছে। বিষয়গুলো নতুন নয়। ১৯৭১ সাল থেকে আমরা ধরতে পারি। তারই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। সাম্প্রতিক ঘটনা একটা সতর্কবার্তা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জাতিগতভাবে আমাদের যে পদক্ষেপ নেয়ার কথা তা নিতে হবে। ষড়যন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে। যদিও এর শেষ কোথায় আমরা জানি না। তবে সবাই মিলে রুখে দাঁড়াতে হবে।
গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম। আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হেমায়েত উদ্দিন, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী ও যুগান্তরের সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব কামাল। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন যমুনা টিভির বার্তা বিভাগের প্রধান জাকারিয়া কাজল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন যুগান্তরের কূটনৈতিক রিপোর্টার মাসুদ করিম। যুগান্তর কার্যালয়ে বেলা ১১টায় শুরু হয়ে এই আলোচনা চলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। এ সময় বিশেষজ্ঞদের আলোচনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক পরিস্থিতির আলোকে রাজনীতিবিদদের মধ্যে বেশ খানিকটা প্রাণবন্ত বিতর্কও হয়। এতে পরস্পরের মধ্যে আস্থার সংকটের কথা যেমন উঠে আসে, ঠিক তেমনি বিদেশীদের মধ্যেও আস্থা সৃষ্টির তাগিদ আসে। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে নিরাপত্তা ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
মাহবুবউল আলম হানিফ : আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনা অত্যন্ত পরিকল্পিত। সরকারকে বিব্রত করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা সাদা চোখে দেখা যায়। যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, সরকারের অর্জনকে ম্লান করে দিতে চায় তারা এ ঘটনা ঘটিয়ে বহির্বিশ্বে ভিন্ন বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের নিরাপত্তা সতর্কতা প্রসঙ্গে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, তাদের কাছে যদি তথ্য থেকে থাকে, তারা কেন সেটা দেয়নি? তাহলে সরকার আগে থেকেই সতর্ক হতে পারত। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই জাতীয় ঐক্য দরকার। তবে এই ঐক্য যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে নয়। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নেই, এটা বললে ভুল হবে উল্লেখ করে মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, একসময় জামায়াত-শিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে বিএনপি এ দেশে জঙ্গিবাদের বীজ বপন করেছিল। তাদের সঙ্গে ঐক্য করে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমরা নিজেরাই যখন জিএসপি সুবিধা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করি, ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দেই তখন বিদেশীরা তো সুযোগ নেবেই। তিনি কোনো বিদেশী কূটনীতিকের কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য নেয়ার প্রতিযোগিতা থেকে মিডিয়া কর্মীদেরও সরে আসতে বলেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের কোনো কূটনীতিক বিদেশে দায়িত্ব পালনকালে সেদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় নিয়ে নাক গলান না। সেদেশের মিডিয়াকর্মীরাও তাদের কাছে কিছু জানতে চান না। অথচ আমাদের দেশে কোনো বিদেশী এলে মিডিয়াকর্মীরা রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করে দেন।’
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ : বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর গুরত্ব দিয়ে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আইনের শাসন গড়ে তুলতে হলে আমাদের দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আরও বেশি পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের দুই নেত্রী একে অপরের মুখই দেখেন না। সরকারি দলের হলে আইন এক রকম আর বিরোধী দলের হলে আইন অন্য রকম- এটা মানা যায় না। বর্তমান সরকার ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না অভিযোগ করে এই বিএনপি নেতা বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হোক, স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক, তা সরকারি দল চায় না।’
ড. সা’দত হুসাইন : সাবেক মিন্ত্রপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন বলেন, দু’জন বিদেশী খুনের ঘটনার প্রথমটির পর মনে হয়েছিল বিচ্ছিন্ন কিছু। কিন্তু পরের ঘটনার পরই সন্দেহটা এসে গেল। বিদেশী খুনের ঘটনার টাইমিংটা গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি দল থাকতেই ঘটল। তারা সফর স্থগিত করার কথা জানিয়ে গেলেন। এরপর দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল। এরপর অনেক অ্যালার্ট জারি করেছে কয়েকটি রাষ্ট্র। দেখতে হবে তারা কারা। তারা আমাদের ওপর আগে থেকেই কোনো কারণে গোস্বা হয়ে আছে। সে কারণ আমরা সাদা চোখে দেখছি না। এ বিষয়টিকে সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তবে গোস্বা তারা কখন হয়েছে, তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখতে হবে। রাগ হয়েছে অন্য কারণে। যা পরে প্রকাশ পায়। কেউ হয়তো কারও ওপর ফুঁসছি। কিছু বলতে পারছি না। তখন ‘তক্কে তক্কে’ থাকি। ঠিক সুযোগ বুঝে ধরা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটা কিনা দেখতে হবে।
হেমায়েত উদ্দিন : সাবেক সচিব হেমায়েত উদ্দিন বলেন, আমাদের এখানে প্রথম দেখা গেল নিরাপত্তার অজুহাত তুলে প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল বাংলাদেশে না আসার ঘোষণা দিল। একজন বিশেষজ্ঞ এসে অস্ট্রেলিয়া দলের না আসার ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন, এটি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সিদ্ধান্ত নয়, সেদেশের সরকারের সিদ্ধান্ত। এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, এখানে যারা বিদেশী নাগরিক আছেন ২৪ ঘণ্টা তাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এদেশে যারা বিদেশী নাগরিক আছেন তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে তারা কোথায় আছেন, কী কাজ করছে, তা নিজ নিজ দেশের দূতাবাসকে জানিয়ে দেয়া। কিন্তু আমাদের দেশে কি তা হচ্ছে? এখন একজন বিদেশী নাগরিক যদি প্রশাসন কিংবা তার নিজ দেশের দূতাবাসকে না জানিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন তার নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব?
এম হুমায়ুন কবির : সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে সংঘটিত ঘটনাকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। বেশকিছু শূন্যস্থান তৈরি হয়ে আছে। একটি হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া। আজ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, অপরের মতকে গ্রহণ করা, সবাইকে নিয়ে চলার নীতি ইত্যাদিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কাউকে পছন্দ না করলে তাকে ‘এলিমিনেট’ (বিনাশ) করার চিন্তা দেখা যায়। সর্বক্ষেত্রেই এটা ঘটছে। এ কারণে এই যে সমাজ আজ দেখছি, তা বিশ্বাসের বাইরে বলে মনে হচ্ছে। আজ বহুত্ববাদী সমাজের ধারণা থেকে সিগুলারিটির (একক) দিকে যাচ্ছি। এই ধারা রাষ্ট্রের ভেতরের কার্যক্রমেও দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের ভেতরে বা সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠন তাদের ভূমিকা একসঙ্গে রাখে কিনা, তা আলোচনায় আসে না। এই সিঙ্গুলারিটির ধারণা সমস্যা তৈরিতে সহায়তা করে। এই জায়গা থেকে আমরা না সরলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরও বাড়বে। তৃতীয় প্রেক্ষাপট হচ্ছে, আমরা শুধু বড় জিনিস দেখি। তার প্রেক্ষাপট দেখি না। আইএস নিয়ে আন্তর্জাতিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।
তৌহিদ হোসেন : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি তিনটি বিষয় নোটে রাখতে চাই। যে কোনো দেশের মতোই আমাদের দেশেও কট্টরপন্থী লোক আছে। অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। দুই বিদেশী খুনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তির জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। তবে অর্থনীতির জন্য সম্ভাব্য ক্ষতি আরও বেশি।’ তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ‘পারসেপশন’টা (দৃষ্টিভঙ্গি) জরুরি। ক্ষতি যা হয়েছে হয়তো তার চেয়ে বেশি প্রচার করছি আমরা। তিনি বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার রাস্তা কয়েকটি। প্রথমত, অপরাধীদের ধরা ও শাস্তি দেয়া। আস্থার সংকটের কথা বলা হচ্ছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ। গুলশান-বারিধারা এলাকায় সাঁজোয়া বাহিনী বসিয়ে এর সমাধান হবে না। বরং এতে উল্টো বার্তাও যেতে পারে। আস্থার সংকট দূর করার প্রধান উপায় হচ্ছে প্রকৃত তদন্তের মাধ্যমে আসল অপরাধীকে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা। প্রক্রিয়া বিলম্ব হলে অগ্রগতি জানাতে হবে। দেশের ভাবমূর্তির জন্য অগ্রগতি দেখানো জরুরি। আমার বিশ্বাস আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তা পারবে।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী : নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে জঙ্গি সংগঠন নেই এটা বলা ঠিক হবে না। তবে তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। তাদের অনেকেই কারাগারে আছে। তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে। ক্ষুদ্র ইসলামী গোষ্ঠীর শেকড় বাংলাদেশে গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনা ঘটার আগে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এটিকে অবশ্যই সাধুবাদ দতে হবে। তিনি বলেন, এদেশে হরকাতুল জিহাদের জন্ম হয়েছে মাজারকে টার্গেট করে। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জন্ম হয়েছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের টার্গেট করে। তবে আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকলে অনেক ঘটনাই ঘটে যেত। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে যার মিল নেই তাকে মেরে ফেরতে হবে এ ধারণা থেকে বের হতে হবে।
অধ্যাপক জিয়া রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ইতালির নাগরিক খুন হওয়ার পর আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ধারণা করেছিলাম। কিন্তু এর কয়েক দিনের মাথায় রংপুর জাপানি নাগরিক খুন হওয়ার পর ভুল ভাঙে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নেই এটা বললে ভুল হবে। শিবিরের রগকাটা রাজনীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশে জিয়াউর রহমান সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জঙ্গি তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। দুই বিদেশী খুনের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, জিএসপি বন্ধ করে দেয়ার পর যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ তার প্রায় সবকটি পূরণ করেছে। তারপরও জিএসপি ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটা গভীর ষড়যন্ত্র।
ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী : রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাস যে শুধু বাংলাদেশে কিংবা এ অঞ্চলে আছে তা নয়। বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের সন্ত্রাস হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে গ্লোবাল সন্ত্রাস। তবে আমরা আমেরিকা কিংবা ইউকের চেয়ে খুব বেশি ভয়ংকর অবস্থায় নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ ধরনের অনেক সন্ত্রাস হচ্ছে। সেগুলো খুব বেশি প্রচার হচ্ছে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, টেরোরিজম মানেই ইসলামিক। ঘটনাটি আসলে তা নয়। এই উপমহাদেশে কেন আমাদের দেশকে বেছে নেয়া হচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি কোনো কোনো রাষ্ট্রের গোস্বা থাকতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক মাহবুব কামাল বলেন, দু’জন বিদেশী হত্যার পেছনে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে ফেলা। বিনিয়োগ বিঘ্নিত করা। নিছক গোষ্ঠীর স্বার্থেও এটা হতে পারে। আবার আন্তর্জাতিক বড় ডিজাইনের অংশ হতে পারে। বর্তমানে অনেকে ইসলামিক মিলিট্যান্টের দিকে ঝুঁকছে। আমার মতে, কেবল দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে রিমেডি (প্রতিকার) হবে না।
জাকারিয়া কাজল : স্বাগত বক্তব্যে যমুনা টেলিভিশনের বার্তা বিভাগের প্রধান জাকারিয়া কাজল বলেন, আমরা দেখলাম নিরাপত্তার কথা বলে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল সফর বাতিল করল। এর দু-একদিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঘটনা ঘটল। সেখানে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই এমন ঘটনা ঘটে। তবে পার্থক্য একটাই আমাদের দেশে কিছু হলে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। তবে এসব ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে।
সাইফুল আলম : গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আমরা নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সতর্কতা নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেছিলাম। তবে আলোচনা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাজনীতির মধ্যেও গড়িয়েছে। আসলে কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথা এসেছে। পূর্বপরিকল্পিত না ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অন্যান্য হিসাব এসেছে তা নিয়ে বিশ্লেষণ হচ্ছে। এটা ঠিক যে, ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অনেক ঘটনা পরপর সংঘটিত হয়েছে। বিষয়গুলো নতুন নয়। ১৯৭১ সাল থেকে আমরা ধরতে পারি। তারই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। সাম্প্রতিক ঘটনা একটা সতর্কবার্তা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জাতিগতভাবে আমাদের যে পদক্ষেপ নেয়ার কথা তা নিতে হবে। ষড়যন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে। যদিও এর শেষ কোথায় আমরা জানি না। তবে সবাই মিলে রুখে দাঁড়াতে হবে।
No comments