হুজুর (সঃ) এর বৈবাহিক জীবন by ইসতিয়াক আহমেদ রাফি

যার জন্য এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত অনেকেই অনেক প্রশ্ন তোলেন । হাদীসে কুদসীতে এরশাদ হয়েছে-”হে আমার হাবীব! আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না” (সিররুল আসসার পৃষ্ঠা-৭০) । আল্লাহ্‌ পাক ঘোষণা করেন, ” তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ্‌ (সঃ)-এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ” (সুরা-৩৩ আহযাব, আয়াত- ২১) ।তার চরিত্র নিয়ে কথা বলেন । তাই একান্তই বন্ধুদের অনুরধে আমি রাসুলের জীবনের কিছু অংশ ধারাবাহিক ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করবো । শুধু আমি না পৃথিবীর কোন মনীষী রাসুলের জীবনী আলোচনা করে শেষ করতে পারবেনা না । আজ শুধুই তার বৈবাহিক জীবনের কথা আলোচনা করবো । আঠার হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানব জাতিই সর্বশ্রেষ্ট। ইহার মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে আমাদের প্রানপ্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা হয়েছে। এ যুগের অনেক বড় বড় মনিষী, যারা মুসলমান ছিলেন না তারাও আমাদের রাসুল (সঃ) কে মহামানব হিসাবে স্বীকার করেছেন। যেমন, Michael Hart নামক একজন নামি দামী লেখক তার “The 100: A Ranking of the Most Influential Persons in History বইতে মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে সর্বোচ্চ স্থানে স্থান দিয়েছেন।
নবী (সঃ)এর উত্তম চরিত্র আলাহ কতৃক স্বীকৃত। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে প্রিয় নবী (সঃ) এর প্রশংসা করে বলেছেন- “ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আযিম”। অর্থাৎ,- “আর নিশ্চয়ই আপনি চরিত্রের উচ্চতম স্তরে রয়েছেন”। (সূরা কলমঃ ৪)।
তাই বোঝা গেল, আমাদের নবীঃ (স:) এর চরিত্র নিয়ে বিরুপ মন্তব্য কেবল একজন খুব নিম্নস্তরের কাফেরের দাঁরাই সম্বব।
আমাদের নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ)বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে একের অধিক বিয়ে করেছেন। হুজুর সঃ আর ৫ জন নবীর মতো ছিলেন না । তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন একজন মানুষ হিসেবে । তিনি ছিলেন পৃথিবী সৃষ্টির উদ্দেশ্য । তিনি না আসলে আল্লাহ্‌ পৃথিবী সৃষ্টি করতেন না । তিনি পৃথিবীতে শুধু ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন নি । তিনি পৃথিবী শাসন করেছেন । তিনি যুদ্ধ করেছেন । তিনি ছিলেন মহা মানব । তিনি যা করেছেন তা পৃথিবীর কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব না । আল্লাহ্‌র পড়ে তিনি ছিলেন সর্ব শ্রেষ্ঠ কৌশলী । তিনি ছিলেন সর্ব শ্রেষ্ঠ পিতা । তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ স্বামী । এমন কোন যায়গা নেই যেখানে তিনি তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করেন নি ।তিনি এমন একটা সময়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন যখন যুগ ছিল আয়ামে জাহেলিতের যুগ । নারীরা ছিল শুধুই ভোগের পণ্য । তিনি কোন স্বাভাবিক সমাজে জন্ম গ্রহন করেন নি । কিন্তু সেই অস্বাভাবিক সমাজকে একামত্র তিনিই স্বাভাবিক করে তুলেছিলেন তার মুহানুভবতা এবং কৌশল দিয়ে । কারন অন্য নবীদের মতো তিনি দৈবিক কোন ক্ষমতা চর্চা করেন নি । একমাত্র বদরের যুদ্ধ ছাড়া তিনি কখনোই আল্লাহ্‌র কাছে দৈবিক কিছু দাবী করেন নি ।  সেই যুগে স্বামী ছাড়া মেয়েরা ছিল অসহায়। বিশেষ করে সেই সময়ে বিভীন্ন যুদ্দ বিগ্রহের কারনে যাদের স্বামী মারা যেত, তাদের অবস্তা ছিল করুন। নবী (সঃ) এর প্রতিটি বিবাহের পিছনে আল্লাহর নির্দেশ ছিল এবং উত্তম কারন ছিল। সেই যুগে নও মুসলমানের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। ইসলাম প্রচারের জন্য, কোরআনের আয়াত মনে রাখার জন্য, হুজুর (সঃ) এর বানী অর্থাৎ হাদিস বর্ণনা করার জন্য সাহসী, মেধাবী, উদার, তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি সম্পন্য মোসলমানের দরকার ছিল। হুজুর (সঃ) এর প্রত্যেকটি বিয়ের পিছনে কারন ছিল ইসলামের প্রচার এবং প্রসার। এখানে কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে তিনি তার শারীরিক অথবা অন্য চাহিদা মেটাতে বিয়ে করেছেন তা ভিত্তিহীন এবং অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই না । তিনি কখনোই কারন ছাড়া বিয়ে করেন নি । স্বামী হারা মহিলাকে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেছেন । শহীদ সাহাবীদের স্ত্রীদের স্ত্রীর মর্যাদা দান করেছেন তাদের ইচ্ছেতে । দাস কে মুক্ত করেছেন স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে । তিনি চাইলেই এদের বিয়ে না করে ভোগ করতে পারতেন । কিন্তু তিনি করেন নি । তিনি স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন । এখানে প্রশ্ন আসে যে ক্যান তিনি ৯ বছরের কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন ?? তিনি ক্যান পোষ্য পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করিছেলেন ??এমন অনেক প্রশ্নই আসে প্রতিনিয়ত ।  আমি শুধু রাসুলের স্ত্রীদের নাম, বয়স এবং উপরোক্ত প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করবো ।
প্রথমেই দেখা যাক তৎকালীন সমাজে বহু বিবাহকে কেমন ভাবে দেখা হত এ ব্যপারে তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল।সত্যকারঅর্থে তখন কার সমাজে বহুবিবাহ ছিল একটি সাধারন ব্যপার।শুধু আরবেই নয় বরং আরব পার্শবতী সকল দেশ এবং প্রচ্যেও বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিল।আর তাই প্রিয়নবীমুহাম্মদ (সাঃ) ১৩ টি বিয়ে করলেও এ ব্যপারে তখন কেও প্রশ্ন তোলেনি।সময়ের আবর্তনে সমাজ থেকে ধীরে ধী্রে বহুবিবাহ প্রথা কমে আসতে থাকে।আমরাও বর্তমানে খুব বেশী কাউকে একের অধিক বিয়ে করতে দেখি না ।আর তাই আমাদের মনে এ ব্যপারে প্রশ্ন যাগে কেন তিনি এত বিয়ে করেছিলেন।আমাদের বর্তমান সমাজে যারা অধিক বিয়ে করেন তাদেরকে আমরা একটু বাকা চোখেই দেখে থাকি।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিবাহ
১/ ২৫ বছর বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ)খাদিজা (রাঃ) কে বিয়ে করেন। এবং এটাই তার প্রথম বিয়ে । এ সময় খাদিজা (রাঃ)এর বয়স ছিল ৪০ বছর এবং ইতিপুর্বে খাদিজা (রাঃ)এর দু দুবার অন্যত্রবিয়ে হয়েছিল।এবং পুর্বের কয়েকজন সন্তান ও ছিল
২/ ২৫ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত নবী (সাঃ)বিবি খাদিজার (রাঃ) সাথে সংসার করেন এবং এ সময়ের মধ্যে তিনি আর কোন বিয়ে করেন নি।
৩/ বিবি খাদিজার (রাঃ)এর ইন্তেকালের ২ বছর পর ৫৩ বছর বয়সে ২য় বিয়ে করেন।
অর্থাৎ–
— ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত নবী সঃ অবিবাহিত ছিলেন
— ২৫ থেকে ৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত নবী সা: এর মাত্র একজন স্ত্রী ছিলেন
— ৫৩ থেকে ৬৩ বছর বয়সের মধ্যে নবীর সা: বাকি বিয়ে গুলো সম্পন্ন হয়।
৪/ মুহাম্মদ (সাঃ)এর স্ত্রীগনের মধ্যে একমাত্র আয়েশা (রাঃ)কুমারী ছিলেন এছাড়া সবাই ছিলেন বিধবা অথবা তালাক প্রাপ্তা ।
৫/ আয়েশা (রাঃ) ছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ)বন্ধু হযরত আবু বকর (রাঃ) এর কন্যা।বিয়ের সময় আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ৬ অথবা ৯ বছ র।তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। আয়েশার স্মরন শক্তিও ছিল অসাধারন।হযরতআয়েশা (রাঃ)হুযুর সাঃ মৃত্যুর প র সবচেয়ে বেশী দিন বেচে ছিলেন এবং তিনিই স্ত্রীগনেরমধ্যে সবচেয়ে বেশী হাদীস বর্ননা ক রে গেছেন।
এখন প্রশ্ন হল মুহাম্মদ কেন মাত্র ৬ অথবা ৯ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন?
মুহাম্মদ সাঃ আয়েশা রাঃ কে প্রাথমিক যে তিন কারণের জন্য বিয়ে করেছিলেনঃ
• আবু বকর রাঃ সাথের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আত্মীয়তার মজবুত বাঁধনে পর্যবেশিত করে রাখা।
• আয়েশা রাঃ ইসলামের বিধি বিধান শিক্ষা এবং তৈরী করা যাতে তিনি ইসলামের বিধি বিধানকে সংরক্ষণ, (বিশেষ করে নারীদের জন্য একান্ত বিষয়াদি) রাসুল সাঃ জীবন ইতিহাস, আল কোরআনের আয়াতের নাজিলের কারণ এবং মানুষকে তাঁর সঠিক শিক্ষাদান করতে পারেন।
• উনাকে সে ভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল যাতে তিনি উনার সম্পূর্ণ সক্ষমতাকে ইসলামের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
হাদিস বর্ণনাকারীদের অন্যতম চারজনের ( আবু হুরাইয়াহ রাঃ, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ, আনাস ইবনে মালিক রাঃ) মধ্যে আয়েশা রাঃ একজন ছিলেন। যিনি একাই ২০০০ হাজারের বেশি হাদিস বর্ণনা করে গেছেন। উনার ২২১০টি হাদিসের মধ্যে থেকে ১৭৪টি হাদিস বুখারী আর মুসলিমে স্থান পেয়েছে।
উরওয়া বিন জুবায়ের বলেছেন-“ আমি কখনও কাউকে পাই নাই যিনি আল কোরআন, হালাল এবং হারামের আদেশ নিষেধ, ইলমুল আনসাব বা নসব-শাস্ত্র এবং আরবি কবিতায় আয়েশা রাঃ এর চেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেই কারণে অনেক বয়োজৈষ্ঠ সাহাবিয়ে কেরামগণ জটিল কোন বিষয় নিরসনে আয়েশা নিরসনে সাহায্য গ্রহণ করতেন।দেখুন- ইবনে কাইম ও ইবনে সা’দ কর্তৃক জালা-উল- আফহাম ভল্যুম ২ এর ২৬ পৃষ্ঠা।
আবু মুসা আল আশারী রাঃ বলেনঃ- আয়েশা রাঃ নিকট নিয়ে যাওয়া কোন সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের কখনো কোন অসুবিধা হয় নাই। দেখুনঃ- সীরাত-ই-আয়েশা, তিরমিজি পৃঃ ১৬৩
আসুন আমরা উপরে বর্ণিত আলোচনার আলোকে ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনকে যাচাই-বাছাই করে দেখি-
স্ত্রীর নাম , বয়স এবং পরিচয়
হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)
নবী (সঃ) এর বয়স যখন ২৫ বছর তখন তিনি ৪০ বছর বয়সের মহিলা খাদিজা (রাঃ)কে বিয়ে করলেন। এই বিবাহ আল্লাহর হূকুমে হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন- “তুমি অর্থহীন ও সম্বলহীন ছিলে, অতঃপর আমি তোমাকে ধনাঢ্য করিলাম অর্থাৎ, ধনাঢ্যা মহিলা খাদিজাকে তোমার স্ত্রী করিয়া দিলাম”। তাছাড়া খাদিজা (রাঃ) আমাদের নবীর চরিত্র এবং সততায় মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজেই আমাদের নবীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর নবী তাকে বিয়ে করেছেন, কারন তিনি ছিলেন বিধবা। আর আল্লাহ এবং তার রাসূলের নিকট বিধবার মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, “তোমরা বিধবাদেরকে বিবাহ কর”। তা ছাড়া খাদিজা (রাঃ) এর অনেক গুণ ছিল, তিনি অনেক বুদ্ধিমতি এবং জ্ঞ্যানী ছিলেন। ওনার দ্বারা তখন ইসলামের অনেক উপকার হয়েছিল।
হযরত সাওদা (রাঃ)
হুজুর (সঃ) এর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হযরত সাওদা (রাঃ)। সারকান বিন আমুরের সহিত তাহার প্রথম বিবাহ হয়, তারা উভয়েই ইসলাম গ্রহন করেন এবং মক্কার আত্মীয়দের অত্যাচারে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। সেখানে তাদের একটি ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহন করেন। আবিসিনিয়া হতে ফেরার কিছুদিন পর স্বামী সারকান ইন্তেকাল করেন। স্বামীর ইন্তেকালের পর তিনি বালক পুত্রকে লইয়া অত্যন্ত দুঃখ কষ্টে দিন যাপন করিতে থাকেন। এই সময় অনুপায় হয়ে তিনি হুজুর (সঃ) এর খালার বাসায় আস্রয় নেন। অন্যদিকে হুজুর (সঃ) খাদিজা (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর মা হারা মাছুম দুই মেয়ে কুলছুম ও ফাতিমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। একদিন হুজুর (সঃ) এর খালা নবী গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিতে পান তিনি নিজ হস্তে থালা বাসন সাফ করছিলেন । তা দেখে খালা অত্যন্ত বিনীতভাবে আরজ করলেন আপনার আপত্তি না থাকলে আমি বিবি সাওদা (রাঃ) কে আপনার স্ত্রী হিসাবে দিতে পারি। তখন হুজুর (সঃ) এর বয়স ছিল ৫১ বছর আর বিবি সাওদা (রাঃ)এর বয়স ছিল ৬০ বছর। হুজুর (সঃ) সাওদা (রাঃ)কে বিয়ে করতে রাজী হলেন কারন তিনি জানতেন বিবি সাওদা বিধবা হয়ে নিতান্ত অসহায় ছিলেন, তাছাড়া, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে আত্মীয়রা তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে। তাই হুজুর (সঃ) তার কল্যাণের চিন্তা-ভাবনা করিয়া বিবাহ করিয়াছেন। বিয়ে করার আগে তিনি সাওদা (রাঃ) এর বাবার অনুমতি চেয়েছেন। ওনার বাবা যদিও খ্রিষ্টান ছিলেন তথাপি কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ট পূরুষ বিশ্বনবী (সঃ)এর সাথে তাহার মেয়ের বিবাহে কোন আপত্তি না করিয়া তিনি রাজী হন এবং ৪০০ দিরহাম মোহর ধার্য করত শুভ বিবাহের কাজ সম্পন্য হয়।
হযরত আয়েশা (রাঃ)
হুজুর (সঃ) এর তৃতীয় স্ত্রীর নাম আয়েশা (রাঃ)। হুজুর (সঃ) এর খালা প্রথম হযরত আয়েশা (রাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব হুজুর (সঃ) এর নিকট পেশ করলে তিনি ওহী অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করতে বললেন। হুজুর (সঃ) একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, একজন ফেরেশ্তা রেশমি রুমালে প্যাকেট অবস্থায় একটি দামি বস্তু হুজুর (সঃ)কে উপহার দিয়া গায়েব হয়ে গেলেন। তিনি তাহা খুলে দেখলেন যে, ইহার মধ্যে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সূরত রয়েছে। বুখারী শরীফের হাদিসে আছে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, হুজুর (সঃ) তাকে বলেছেন, তিনি তাকে স্বপ্নে দেখেছেন এবং একজন ফেরেশ্তা বলিতেছেন তিনি আপনার স্ত্রী। হযরত আয়েশা (রাঃ)কে বিবাহ করিয়া হুজুর (সঃ) দুইটি প্রশ্নের মিমাংসা নিয়াছেন, ১. কুমারী ও কিশোরী মহিলাকেও বিবাহ করিলেন, আর ২. জাহেলী যুগের প্রচলন ছিল তাহারা কথিত ভাইয়ের মেয়ের সংগে বিবাহের সম্পর্ক করিতনা। রাসূল (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)কে বিবাহ করিয়া সেই কুসংস্কার দুর করেলেন। আল্লাহ তায়ালা যা করেন তা মানব জাতির মঙ্গলের জন্যই করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) ছিলেন একজন অসম্ভব প্রতিভাধর মহিলা। স্মরণ শক্তি ছিল অসাধারন। হিজরতের সময় তার বয়স যদিও কম ছিল কিন্তু, হুজুর (সঃ) এর হিজরতের ঘটনা তিনি তাহার স্মৃতিশক্তির দ্বারা এমন নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করেছেন, যা অন্য কোন সাহাবীর দ্বারা সম্বব হয় নাই। যদিও বয়স ছিল কম, তথাপি চন্দ্র বিদীর্ণ হইবার ঘটনাটি তিনি সঠিক ও পূর্ণ বিবরণ দিতে পেরেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ)হুজুর (সঃ)কে অধিক ভালবাসিতেন। ইন্তেকালের সময় হুজুর (সঃ) এর পরনে যে সব পবিত্র বস্ত্র ছিল তিনি তাহা যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছেন এবং সেইগুলো ইন্তেকাল পর্যন্ত নিজের কাছেই রেখেছেন। সর্বদা হুজুর (সঃ) এর কাছাকাছি থাকাকে তিনি ভালবাসিতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) সর্বমোট ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিতেন, হুজুর (সঃ) তাহার প্রসংসা করে বলতেন যে, শরীয়তের অর্ধেক বিদ্যাই তোমরা আয়েশার কাছ হইতে শিখিতে পারিবে। সুন্নতে রাসূল (সঃ) দ্বীনের সূক্ষ তথ্য বিশেষজ্ঞ, পবিত্র কোরআনের শানে নূযূল সম্পর্কে তিনি অনেক বেশি জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন। ইমাম জুহরি (রাঃ) বলিয়াছেন, সকল পুরুষ ও উম্মুল মোমেনদের এলেম একত্রিত করা হইলে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর এলেম সর্বাপেক্ষা বেশী হইবে।
হযরত বিবি হাফছা (রাঃ)
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)এর কন্যা। হযরত ওমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তার পরিবারের সবাই বিনাদ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত বিবি হাফছা তখন বিবাহিতা ছিলেন। তিনি এবং তার স্বামী দুজনেও ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বামী- স্ত্রী উভয়েই মদীনা শরীফ হিজরত করেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস স্বামী বদরের যুদ্দে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত হাফছা (রাঃ) পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসেন। কোন বিধবা যুবতি মেয়ে ঘরে থাকলে যে কোন পিতার মনেই অশান্তি বিরাজ করে। স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েকে অন্যত্র বিবাহ দিবার একান্ত ইচ্ছা পিতার অন্তরে জাগিয়া উঠে। তখন মুসলমানের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।  মুসলমান নয় এমন কারো কাছে বিয়ে দেয়াও সম্ভব নয়। তাই হযরত ওমর (রাঃ)প্রথমেই আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর কাছে বিবাহ দিতে চান। কিন্তু তিনি হ্যাঁ অথবা না কিছুই বললেন না। তারপর তিনি হযরত ওসমান গণী (রাঃ) এর কাছে মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব করলেন। তিনিও কিছু বললেন না। কোন কোন মেয়েরা তাদের পিতার চরিত্র বা খাছলত পাইয়া থাকে। হযরত বিবি হাফছা (রাঃ) ওমর (রাঃ) এর কিছুটা চরিত্র পেয়েছিলেন, অর্থাৎ,- কড়া মেজাজ ছিল যাহা সবার কিছুটা জানা ছিল। এবাবে মেয়ের কোন বিবাহের ব্যবস্থা করতে না পেরে হযরত ওমর (রাঃ) খুবই চিন্তিত ছিলেন। এই সব খবর হুজুর (সঃ) জানতে পেরে তিনি ওমর (রাঃ)কে ডাকিয়া বলিলেন, তোমার আপত্তি না থাকিলে আমি হাফছাকে বিহাহ করিতে চাই। হযরত ওমর (রাঃ) আনন্দে আত্মহারা। তিনি জানিতে চাহিলেন, আপনি আমার মেয়েকে কেন বিবাহ করিতে চাহিলেন? হুজুর (সঃ) উত্তরে বলিলেন, ওমর তোমার দ্বারা ইসলামের বিরাট উপকার হয়েছে। তুমি ইসলামে আসাতে আমি নিরবিগ্নে কাবা ঘরের সম্মুখে প্রান ভরিয়া নামায পড়িবার সুযোগ পেয়েছি। যার দ্বারা ইসলামের এই বিরাট সাফল্য প্রকৃতপক্ষে আমি তোমার জন্য কিছুই করিতে পারি নাই। সতরাং তোমার মেয়েকে বিবাহ করে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া ইসলামের বুনিয়াদকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করতে চাই।
যেখানে হযরত বিবি হাফছা (রাঃ)কে কেউ বিবাহ করিতে রাজী নয়, সেখানে হুজুর (সঃ) তাকে বিবাহ করিয়া তার মর্যাদাকে এত উচ্চ আসনে স্থান করিয়া দিলেন যে, রাসুল (সঃ) এর অন্যান্য স্ত্রীদের সহিত তিনিও জান্নাতে বসবাস করিবেন। বিবি হাফছা (রাঃ) কে বিবাহ করিয়া হুজুর (সঃ) হযরত ওমর (রাঃ) কে বিধবা কন্যার দুশ্চিন্তা হইতে মুক্ত করিলেন।
হযরত হাফছা (রাঃ)এর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। তাহার কারন, তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের সংরক্ষক। বর্তমান বিশ্বে যেই পবিত্র কুরআন কোটি কোটি মুসলিম নর-নারী তিলাওয়াত করছে তা হাফছা (রাঃ) এর অতি যত্নে রাখা কুরআন শরীফেরই মূল কপি।
হযরত যয়নব (রাঃ)
হুজুর (সঃ)এর সাথে বিবাহের পূর্বে তাহার দুইবার বিয়ে হয়। বনিবনা না হওয়ায় প্রথম স্বামী তাকে তালাক দিলে, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাসের সহিত পুনরায় বিয়ে হয়, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস তিনি ওহুদের যুদ্ধে শাহাদাতবরন করেন। হযরত যয়নব (রাঃ)সেই দিন হইতে বিধবা অবস্থায় থাকিয়া যান। উহূদের যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শাহাদাতবরন করেছেন বলে বিধবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিধবা জীবন স্বভাবতই অসহায় হয়ে উঠে। তা ছাড়া ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে নিকটতম আত্মীয়রা পর্যন্ত তাদের উপর অসন্তুষ্ট থাকিত। তাই হুজুর (সঃ) আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বিধবাদিগকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে সাহাবীদিগকে উৎসাহিত করতে থাকেন এবং নিজেও ইহার উপর আমল করিলেন। তিনি বিবি যয়নব (রাঃ) এর কোন গতি হয় নাই জানিতে পারিয়া তাকে ডাকিয়া বলিলেন, তোমার আপত্তি না থাকিলে আমি নিজেই তোমাকে গ্রহণ করিতে চাই। হযরত যয়নব (রাঃ) ইহাতে এতই আনন্দিত হইলেন যে, তিনি বলিলেন, হুজুর (সঃ)আপনি যদি আমাকে গ্রহণ করেন তবে আমি কোন রুপ মোহরানা দাবী করিবনা। হুজুর (সঃ)বলিলেন, কেন? তোমার কী কোন মূল্য নেই? অরপর হুজুর (সঃ)তাহাকে ৪০০ দিরহাম মোহরের বিনিময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিলেন। হযরত যয়নব (রাঃ)জন্মগতভাবেই প্রশস্ত হৃদয় ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। কোন ক্ষুধার্ত বা ভিক্ষুক আসিলে হাতের সামনে যাহা থাকত তাহা সবই দান করিয়া দিতেন। দান খয়রাতের দিক দিয়ে তার হাত ছিল সবার উপর। হুজুর (সঃ)এর সাথে বিবাহের মাত্র তিন মাস পরেই তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন। তাহার ভাগ্য এতই ভাল যে, হুজুর (সঃ)নিজেই তাহার জানাজার ইমামতি করিয়াছেন।
হযরত যয়নব বিনতে জাহাস (রাঃ)
হযরত যয়নব (রাঃ)ছিলেন হুজুর (সঃ)এর আপন ফুফাত বোন। তাহার পিতা তৎকালীন সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন।
হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)হুজুর (সঃ)এর খেদমতের জন্য যায়েদ ইবনে হারেছ নামে এক গোলাম বাজার হইতে খরিদ করে হুজুর (সঃ)এর খেদমতে হাজির করলে মানবতার মুক্তির এক মাত্র দূত রাহমাতুল্লিল আলামীন তাকে মুক্ত বা আজাদ ঘোষনা দিলেন এবং আপন পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করলেন। হুজুর (সঃ)এর এইরুপ ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া হযরত যায়েদ (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং কুরআন ও হাদিছের আলোকে নিজেকে সমৃদ্ধ করিয়া তুললেন।
হুজুর (সঃ) ওনার আপন ফুফাত বোন হযরত যয়নব (রাঃ) কে হযরত যায়েদ (রাঃ) এর সহিত বিবাহ দেন। এই বিয়ের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মানুষের মধ্যে সমতার বিধান জারী করা। ইসলামে ধনী গরীব, সাদা-কাল, গোলাম, আজাদ, বাদশা-ফকীর এর মধ্যে কোন রুপ ভেধাভেদ নেই। ইসলামের এই সাম্য প্রতিষ্টা করতে গিয়াই তিনি সদ্য আজাদপ্রাপ্ত গোলামের সহিত আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের মেয়েকে বিবাহ দেন। কিন্তু খোদার কী মহিমা বিবাহের কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ছোটখাট ঝগড়া শুরু হয়, এমনকি এক পর্যায়ে হযরত যায়েদ (রাঃ)হুজুর (সঃ)এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করিলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আপনার আপত্তি না থাকিলে আমি যয়নবকে তালাক দিতে চাই। হুজুর (সঃ)হযরত যায়েদ (রাঃ)কে আল্লাহর ভয়ভীতি স্মরণ করাইয়া তাহাকে তালাক দেওয়া হইতে বিরত থাকিতে নির্দেশ দেন। কারন তালাক প্রথা ইসলামে যদিও জায়েয কিন্তু এ কাজটি নিকৃষ্টতম এবং সর্বাধিক ঘৃণিত। কিন্তু আল্লাহর কী মহিমা তাহাদের সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হইতে থাকে এবং তাহা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, হযরত যায়েদ (রাঃ) বিবি যয়নব (রাঃ)-কে তালাক দিতে বাধ্য হন।
তালাকের পর জনগণের মধ্যে এই জল্পনা-কল্পনা চলিতে থাকে যে, কৃতদাসের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে কে বিবাহ করিবেন। জাহিলী যুগের প্রথা ছিলে এই যে, পালক পুত্রও আপন পুত্রের ন্যায়, তাই পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা নিশেধ। আল্লাহ পাকের ইচ্ছা এই যে, সকল প্রকার কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করিয়া নির্ভেজাল একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা। তাই আলাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সূরা আল –আহযাবে এই বিয়ে সম্পর্কে আয়াত নাযিল করেন, যেমন, আল্লাহ বলেন,“অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিনত হয়েই থাকে। আল্লাহ নবীর জন্য যা নির্ধারণ করেন তাতে তার কোন বাঁধা নেই……আরও বলেন, মোহাম্মদ তোমাদের কোন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী”।
আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হইবার পর হুজুর (সঃ)আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে বিবি যয়নব (রাঃ)কে বিবাহ করেন। হযরত যয়নব (রাঃ) অনেক সময় গর্ব করিয়া বলিতেন, হে নবীর বিবিগণ! আপনাদিগকে নিজ নিজ আত্মীয়স্বজন রাসূল (সঃ) এর নিকট বিবাহ দিয়েছেন, কিন্তু আমার বিবাহ রাসূল (স)এর সহিত আল্লাহ নিজে সম্পন্য করিয়াছেন।
হযরত যয়নব (রাঃ) অত্যন্ত দ্বীনদার, পরহেযগার, উদার ও সৎ স্বভাবের ছিলেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলিয়াছেন, দ্বীনদার, পরহেযগারী, সত্যবাদীতা, আত্মীয়ের প্রতি সহানূভূতি, দানশীলতা এবং আত্মত্যাগে বিবি যয়নব (রাঃ) এর চাইতে উত্তম মহিলা আমি দেখি নাই।
হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ)
হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) এর পিতার নাম হারেছ। তিনি বনু মুস্তাকিম গোত্রের নেতা ছিলেন। তার পিতা এবং স্বামী উভয়েই ইসলামের ঘোর শত্রু ছিল। শুধু তাই নয়, এই গুত্রের সকল মানুষই ছিল মুসলমানদের চরম শত্রু। তাহারা কোন ক্রমেই রাসূল (সঃ)এবং মুসলমানদিগকে মানিয়া দিতে রাজী ছিলনা। তাই তাহারা রাসূল (সঃ) এবং মুসলমানদের ধবংশ করার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং মদীনা এসে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। মদীনা শরীফ থেকে ১০ মাইল দুরে এই গুত্রের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়, কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতে মুসলিম বাহীনি বিজয় লাভ করেন। বিপক্ষের ১১ জন নিহত এবং ৬০০জন বন্দি হয়। হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ)এর স্বামী এই যুদ্ধে নিহত হয়। যুদ্ধ বন্দিদের সাথে তিনিও বন্দি অবস্থায় ছিলেন। তৎকালীন আরবের প্রথা অনুযায়ী যুদ্ধ বন্দিদিগকে গোলাম হিসাবে রাখা হত। হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ)যেহেতু গোত্র প্রধানের কন্যা তাই দাসত্ব জীবন তিনি মানিয়া নিতে পারেন নাই। তিনি যার দাসী হলেন তার কাছে অর্থের বিনিময়ে মুক্তির আবেদন জানান। কিন্তু সেই লোক এর মোটা অংকের অর্থ দাবী করলেন, বিবি জুয়াইরিয়া (রাঃ)এর পক্ষে তাহা আদায় করা সম্ভব নয়। তাই তিনি এ ব্যপারে সাহায্য চাহিয়া রাসূল (সঃ) এর দরবারে আবেদন পেশ করিলেন। হুজুর (সঃ) এর উত্তরে বলিলেন, হে জুয়াইরিয়া! আমি যদি তোমার পক্ষ হইতে মুক্তিপণ আদায় করিয়া তোমাকে বিবাহ করি তাহা হইলে কি তুমি রাজী হইবে? বিবি জুয়াইরিয়া (রাঃ) নির্দ্বিধায় এই প্রস্তাব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মানিয়া নিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন।
মূলত হুজুর (সঃ)এই বিবাহটি করেছেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারনে। এই শুভবিবাহের কারনে মুসলমানগণ কূটনৈতিক ভাবে বিজয় লাভ করেন। আগেই বলা হয়েছে, বনু মুস্তাকিম গোত্রের সকল মানুষই ছিল মুসলমানদের চরম শত্রু। তাহারা কোন ক্রমেই রাসূল (সঃ)এবং মুসলমানদিগকে মানিয়া দিতে রাজী ছিলনা। কিন্তু মদীনাবাসী সকল মুসলমানেরা যখন জানিতে পারিলেন যে, জুয়াইরিয়া এবং রাসূল (সঃ) এর সহিত শুভ বিবাহ সম্পন্য হইয়াছে তখন তাহারা সকল বন্দিদিগকে হুজুর (সঃ)এর আত্মীয় বিবেচনা করিয়া মুক্তি দিলেন এবং সসম্মানে নিজ দেশে ফেরত পাঠালেন। যহার কারনে শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে তারা সকলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
হুজুর সঃ এর বাকি স্ত্রীদের বিবাহের কারন আমি কোথাও খুজে পাইনি । আমি এই ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছিনা । কারন আমার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই । কারো কাছে তথ্য থাকলে আমাকে দিয়ে সাহায্য করতে পারেন । নইলে আমি পরবর্তীতে দেবার চেষ্টা করবো ।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ই ছিল তাঁর সুবিস্তৃত মিশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর মিশনেরও টার্গেট ছিল সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে পড়া মানুষের কল্পনাপ্রসূত অজ্ঞতাগুলোকে টেনে বের করে সমাজকে আবার তার বিশুদ্ধ ভিত্তির উপর দাঁড় করানো। অনেকটা আগাছাময় ফসলের জমিতে দক্ষ হাতে নিড়ানী দেয়ার মত। অপ্রতিরোধ্য আগাছা যেমন প্রকৃত ফসলকে বাড়তে দেয় না তেমনি অজ্ঞতা নির্ভর সমাজের বুকেও কাজ করে না কোন সত্য বিধান। বরং অজ্ঞতার আগাছাকেই তখন ফসল ভেবে ভুল করতে থাকে সবাই।
নারী-পুরুষের বিয়ে হলো মানব সমাজের যথার্থ বিকাশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক জমিন। বস্তুতঃ এই জমিনের শুদ্ধতার উপরই নির্ভর করে মানুষের অন্য ক্ষেত্রগুলোর শুদ্ধতা ও সফলতা। তাই আল্লাহ পাকের নবীরা যে এই ক্ষেত্রটাকে অজ্ঞতা মুক্ত করতে অগ্রণী হবেন সেটাই স্বাভাবিক। এটা রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্যে ছিল আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর পরে পৃথিবী ধ্বংস অবধি আর কেউ আসবে না নিড়ানী দিয়ে এই জমিন পরিষ্কার করতে। বরং পদার্থ ভিত্তিক সক্ষমতার ব্যপক প্রসারে নবীজী উত্তর এই জমিন হবে এমনই আগাছাময় যে অর্থপূর্ণ জীবনধারণ এখানে ক্রমেই হয়ে পড়বে খালি পায়ে জলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটার মতই দুরূহ ও কষ্টসাধ্য।
আরবের তৎকালীন ভয়ানক অজ্ঞতাময় পরিস্থিতিতে যেখানে কন্যা সন্তানকে জন্মমাত্রই মাটিতে পুঁতে হত্যা করার মত মর্মন্তুদ ঘটনাও ঘটছিল অহরহ সেখানে মেয়েদের বিয়ের বিধানসমূহ যে কি রকম শোষণের হাতিয়ার ছিল তা অনুমান করা যায় সহজেই আর পুরো সমাজের বিরূদ্ধে ও বিপরীতে গিয়ে সেসবের সংস্কার যে ছিল আরও ঝুঁকিপূর্ণ তাও বলাই বাহুল্য। অথচ মানুষের প্রয়োজনে আল্লাহ পাকের সত্য বিধানসমূহের ব্যবহারিক নমুনা সৃষ্টি করতে গিয়ে নবীজী (সাঃ)-কে একক ভাবেই নিতে হয়েছিল সেই সব ঝুঁকি, একাকী দাঁড়াতে হয়েছিল পুরো পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিরূদ্ধে।
আল্লাহ পাকের বিধি-বিধানগুলো স্বয়ং নবীজী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তাঁর বিভিন্ন বিয়ে নিয়ে এখনও যেভাবে প্রশ্ন তোলা হয় তাতে এসব বিয়ের কিছু উদাহরণ যদি নবীজী ছাড়া অন্যান্য সাহাবীদের দিয়ে সৃষ্টি করা হতো তাহলে আমরা আজকের দিনের দুর্বল চিত্তের উম্মতেরা বিবিধ ব্যাখ্যাকারীদের দ্বারা যে কি ভাবে বিভ্রান্ত হতাম তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
আজকের দুনিয়ায় ষোল, আঠারো, একুশ ইত্যাদি বয়সকে ‘সাবালক’ বা ‘ম্যাচিউরিটি এজ’ এবং এর নীচের বয়সকে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ ধরা হয়। অথচ এর কোনই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ বালিকা বয়সের মেয়েরা যদি ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ হয় তা হলে অহরহ তারা মা হচ্ছে কিভাবে? কিশোর ছেলেরা বাবা হচ্ছে কিভাবে? এমনকি অতি সম্প্রতি পৃথিবীর প্রথম কিশোরী নানীরও সন্ধান পাওয়া গেছে পশ্চিমা কোন এক দেশে। অথচ এই দেশগুলোই মূলতঃ এই বয়স ভিত্তিক ‘ম্যাচিউরিটি’ তত্ত্বের প্রবক্তা। এসব দেশে ‘বালিকা মা’-দের ক্রমবর্ধমান আধিক্যই প্রমাণ করে যে এদের এই বেঁধে দেয়া বয়সের সাবালকত্ব বা নাবালকত্ব তত্ত্ব ড্রাইভিং লাইসেন্স বা ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ যোগ্য হলেও অন্ততঃ প্রজননে সক্ষমতার ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বালক-বালিকাদের নাবালকত্ব বা সাবালকত্ব যে ‘কোন নির্দিষ্ট বয়স নির্ভর নয়’ এবং পুরুষের বিয়ের জন্য ‘দায়িত্বশীল বয়সে’ উপনীত হওয়া শর্ত হলেও নারীদের বিয়ের ক্ষেত্রে যে তা অবস্থার প্রেক্ষিতে শীথিলযোগ্য সেটাও বস্তুতঃ পরিষ্কার করা হয়েছে রসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক বালিকা আয়েশা (রাঃ)-কে বিয়ের মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে ছয় বছর বয়সে বিয়ে হলেও হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে তুলে নেয়া হয়েছিল নয় বা দশ বছর বয়সে যা থেকে বোঝা যায় যে স্বামীর ঘরে নেয়া পর্যন্ত বালিকা বধূকে পর্যাপ্ত মানসিক স্থিরতার সুযোগ দেয়া অবশ্যক।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে হযরত আয়শা (রাঃ)-কে বালিকা বয়সে উম্মুল মু’মিনীন করার পেছনে শুধুমাত্র বালিকাদেরকে বিয়ে করার রীতি প্রতিষ্ঠা করাই আল্লাহ পাকের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। বরং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পরও নবীজীর ব্যক্তি, পারিবারিক ও কর্ম জীবন সম্বন্ধে দীর্ঘকাল ব্যাপী যাতে কেউ একজন মানুষের অনুসন্ধিৎসার যথাযথ উত্তর দিতে পারে সেজন্যেও সম্ভবত অনন্য মেধার অধিকারী অল্প বয়সী আয়শা (রাঃ)-কে রাখা হয়েছিল নবীজীর সবচেয়ে কাছে। আর সেই দায়িত্বটা যে হযরত আয়েশা (রাঃ) অতি দক্ষতার সাথেই পালন করেছিলেন তার প্রমাণ মেলে উনার সূত্রে বর্ণিত অগণিত হাদীস এবং সেসবের গুরুত্ব থেকে। আর তাই নবীজীর সাথে আয়েশা (রাঃ) বিয়েকে দুই, একটা সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার কোনই সুযোগ নেই।
এই বিশ্লেষণ থেকে বালিকাদের বিয়ের উদাহরণ পাওয়া গেলেও ছিদ্রান্বেষীদের প্রধান সমস্যা হলো বালিকাদের মা হওয়া নিয়ে, যা কিনা বৈজ্ঞানিক ভাবেও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত। কম বয়সে মেয়েরা মা হলে মা ও শিশু উভয়কেই অনেক ধরনের জটিলায় পড়তে হতে পারে। আমদের দুই-এক প্রজন্ম আগের সমাজেই ব্যপক ছিল তেমন বালিকা বিয়ের প্রথা। সে সময় ‘মিসক্যারেজে’র ঘটনাও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক যা জানা যায় সমাজের বয়স্কদের কাছে থেকে। তাই এটা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয় যে ইসলাম কি তাহলে বালিকাদের মা হওয়া প্রতিরোধ করতে চায় না? এক্ষেত্রে মোক্ষম জবাব হলো আল্লাহ পাক অনুমতি দিয়েছেন বালিকা বিয়ে করার এবং সে মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বিয়েও করেছিলেন হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে, কিন্তু সেই বালিকা বধূকে তিনি কখনই কিন্তু কোন সন্তানের মা করেননি। উল্লেখ্য হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কোন সন্তানাদি ছিল না। অর্থাৎ ইসলামে বিয়ে মানেই ‘ভোগ’, ‘উপভোগ’ নয় বরং দায়িত্ব। যতটুকু ‘সুখের উপভোগ’ সেখানে বিদ্যমান সেটা মূলতঃ কঠিন দায়িত্ববোধেরই প্রতিফল বিশেষ। এই দায়িত্ববোধের আলোকেই বালিকা বধূকে মা না করাই যে উত্তম সেটাও উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে।
এরপরও যদি কোন মুসলমান কোরআন-হাদীসের দোহাই দিয়ে যেনতেন প্রকারে বালিকা বিয়ে করে তাকে বছর বছর সন্তানের মা হতে বাধ্য করে তাহলে ঐ স্বামীকে দোষী সাব্যস্ত করে সামাজিক ভাবে তার বিচার করাই বোধকরি যথার্থ হবে। কিন্তু সে পথে না গিয়ে ঐ সমস্ত ব্যক্তিগত ধান্ধাবাজীর জন্যেও ইসলামকে দোষারোপ করাটা খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ।
এখানে বিশেষ ভাবে আরও উল্লেখ্য যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে প্রায় দশ বছর সংসার করার পরও হযরত আয়েশা (রাঃ) কোন সন্তানাদি না হওয়ার দ্বারা এটাও প্রতিষ্ঠিত হয় যে দম্পতিদের অধিকার আছে নিজেদের প্রয়োজন মাফিক পরিকল্পনা করে সন্তান নেয়া বা না নেয়ার। তবে এজন্যে তাদেরকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে প্রাকৃতিক ‘জন্মনিয়ন্ত্রন’ পদ্ধতি। অতি প্রাকৃতিক তথা কৃত্রিম পদ্ধতির জন্মনিয়ন্ত্রন কার্যক্রম আমদের দেশ যে কি ভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর অনিবার্য সুদূরপ্রসারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের সমাজের যে আজ কি বেহাল অবস্থা হয়েছে তা সাম্প্রতিক কালে পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সরকারি পরিসংখ্যানগুলোতেই স্পষ্ট। অথচ শুরু থেকেই যদি স্ত্রীদের স্বাভাবিক শরীরিক চক্র মেনে প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হতো তা হলে যেমন সাশ্রয় হতো অর্থ ও সময়ের তেমনি ফলাফল হতে পারতো আশানুপাতিক। সর্বোপরি সেটা একটা সহিষ্ণূ সমাজ গড়ার পথেও হতে পারতো খুবই সহায়ক।
আল্লাহর বিধানে বিয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতাই মূখ্য। তারপরও রক্ত মাংসে গড়া মানুষের মনে বিবিধ আকাংখার সৃষ্টি হতে পারে। দায়িত্ববোধ ছাপিয়ে কখনও কখনও কামনা-বাসনাও প্রধান হয়ে উঠতে পারে। কর্মক্ষেত্রে, বিশেষতঃ পুরুষরা যেখানে নারীদের আইনানুগ কর্তা সেখানে দীর্ঘ জানাশোনা বা নিত্য একত্রে ওঠা বসার কারণে সৃষ্টি হতে পারে শারীরিক বা মানসিক চাহিদার। আবার বিয়ের ঝামেলা এড়াতে ছলে, বলে, কৌশলে অধঃস্তন নারীকে ভোগ করার পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে কি হবে উপায়? কি ভাবে ঠেকানো সম্ভব এই ধরনের অনাচার?
উল্লেখ্য যে এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলে অবৈধ পন্থার বিকাশ হতে বাধ্য। যেখানে বিল ক্লিনটনের সম্মানিত সহকর্মী হওয়ার পরও রক্ষা পায়নি মনিকা সেখানে দাসী, ক্রীতদাসী, নারী গৃহকর্মী যারা পুরুষ মনিব বা মালিকের হয়ে কাজ করছে তাদের অবস্থা সহজেই অণুমেয়। এসব ক্ষেত্রে মানুষকে অবৈধ পন্থার দিকে পা বাড়ানো থেকে রক্ষা করতে দয়াময় আল্লাহ পাক বাতলে দিয়েছেন পথ। ঐ রকম পরিস্থিতিতে ইসলামের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়ে করে নেয়াটাকে করেছেন জায়েজ। পূর্ণ দায়িত্ব নেয়া সাপেক্ষে নিজের কর্তৃতাধীন ঐ সব নারীদেরকে তিনি হালাল করেছেন পুরুষদের জন্য (৪:৩,২৫; ২৩:৬)। এখানেও নারীর প্রতি ‘পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ববোধের’ ব্যবস্থাই মূখ্য। কোন ধরনের দায়িত্ব নেবো না, শুধুই ভোগ করবো এমন নারী-পুরুষের সম্পর্ক হলো ‘চূড়ান্ত অবিচার’ এবং ‘নারী জন্য চরম অপমানজনক’ যা আল্লাহর আইনে একেবারেই অসম্ভব।
বর্তমান সমাজে অতি সহজলভ্য অর্থের বিনিময়ে যে ‘নারী ভোগ’ সেখানে ‘ভোগের বিনিময় হিসেবে’ নারীকে যে টাকা-পয়সা প্রদান করা হয় সেটাকে কুযুক্তিবাদীরা ‘নারীর প্রতি দায়িত্ব পালন করা হলো’ বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এরকম শুধু্মাত্র ‘সুখ ভিত্তিক বিনিময়’ আর দুটি মানব জীবনের প্রতিদিনের চাওয়া-পাওয়া পরস্পর ভাগাভাগি নেয়ার যে চিরস্থায়ী ‘বিনিময়’ তা কখনই এক হবার নয়। আর তাই এই সমস্ত ধান্ধাবাজী যুক্তি দিয়ে ‘নারী কেনা-বেচা’ জায়েজ করার কোনই অবকাশ আল্লাহর আইনে নেই।
এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয় যে এই ধরণের অনিবার্য পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষের মাঝে সৃষ্ট দেহ-মনের আশা বা আকাংখাকে আল্লাহ পাক কখনই গায়ের জোরে গলা টিপে হত্যা করেননি বরং তাকে স্বাভাবিক উপায়ে একটা সুন্দর পরিণতির দিকে যেতে পথ করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ পাকের এই বিধানের বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্যেই আল্লাহর নির্দেশ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বিয়ে করতে হয়েছিল তাঁর দাসী হযরত মারিয়া বা মারিয়াম (রাঃ)-কে। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে দুই জন নারী-পুরুষের দেহ-মনে সৃষ্ট আবেগ-অনুভূতিকে শক্তির দ্বারা রুখে দেয়া আল্লাহ পাকের নীতি বিরূদ্ধ। বরং নারী-পুরুষের মধ্যে এমন পরিস্থিতি যাতে শুরুতেই তৈরী হতে না পারে সেজন্যেই বস্তুতঃ ইসলামে পর্দার বিধান এত কঠোর। এমনকি পুরুষের মনে যাতে ‘কোন ধরনের ভাবের’ উদয় হওয়ার সুযোগই না হয় সেজন্যে আল্লাহ পাক নবীজীর স্ত্রীদের মাধ্যমে পরিবার বহির্ভূত পুরুষদের সাথে কথোপকথনেও বিশ্ব নারীকে কোমলতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন (৩৩:৩২)। একই ভাবে দেবরকে ভাবীর জন্য মৃত্যু তুল্য ঘোষণা করে রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিশ্চিত করেছেন যাতে সেখানে কোন অবস্থাতেই ভাবাবেগ তৈরীহওয়ার কোন পরিবেশই সৃষ্টি হতে না পারে (বুখারী)। অবশ্য ভাবীকে যদি কোন সময় হতে হয় মাতৃহীন শিশু দেবরের প্রতিপালক তবে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে আল্লাহ পাকের ঐ আইন যেখানে তিনি নারীদেরকে এমন বালকদের সম্মুখে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন যাদের মধ্যে এখনও সৃষ্টি হয়নি কোন দেহজ অনুভূতি (২৪:৩১)। আবার বয়োঃপ্রাপ্তা নারীদের জন্যেও পর্দা শীথিল যোগ্য (২৪:৬০)।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধানের মূল লক্ষ্যটাই হচ্ছে শুরু থেকেই এমন অবস্থার উদ্ভবই হতে না দেয়া যাতে নারী-পুরুষের মাঝে মনের দেয়া-নেয়া হয়ে যাবে অথচ কোন ভাবেই তাদের মিলন সম্ভবপর হবে না।
বোধকরি এই একই কারণে খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ককে ইসলাম স্বীকৃতি দেয়। কঠোর পর্দার বিধান এই শ্রেনীর ভাই-বোনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হওয়ায় এদের মধ্যে মন দেয়া-নেয়ার সম্ভবনা থাকে খুবই বেশী। তাই এদের মধ্য যদি বিয়ে হারাম করা হতো তাহলে এক্ষেত্রে অবৈধ পন্থার বিস্তার রোধ করা সম্ভব হতো না। আবার অনেক সময় অতি প্রয়োজনীয় পারিবারিক বা বৈষয়িক কারণেও অপরিহার্য হয়ে পড়ে এরকম বিয়ে। আর তাই ইসলাম কর্তৃক নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের স্বীকৃতি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার প্রয়োজনে খুবই বাস্তব সম্মত একটি পদক্ষেপ।
অথচ কেউ কেউ এই ধরনের পারিবারিক বিয়েকে ঘৃণার চোখে দেখেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এমন অনেককে জানি যারা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েকে ঘৃণা করলেও সমকামীতাকে আবার সমর্থন করেন দৃঢ় ভাবে! অথচ সমকামীতা হলো এমনই ঘৃণ্য এক পন্থা যার চর্চা পশু-পাখীদের মধ্যেও দেখা যায় না। অর্থাৎ যারা সমকামীতাকে সমর্থন করেন তারা মূলতঃ সব জেনেশুনেও মানুষকে পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গের চাইতেও নীচে নামিয়ে ছাড়েন। এই সহজ সত্যটাও যে কিভাবে কিছু কিছু মানুষের কাছে অসত্য-অবোধ্য হতে পারে তা বোঝা বড়ই মুশকিল।
এখানে আরও একটা দলের দেখা পাওয়া যায় যারা এই ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক ঠেকাতে সহসা হয়ে ওঠে নর পিশাচ। প্রয়োগ করে থাকে ‘অনার কিলিং’-এর মত পৈশাচিক পদ্ধতি। এরা মুসলমান তো নয়ই এমনকি মানুষও নয়। এরা স্রেফ কিলার। এরা নর ঘাতক। আল কোরআনের ঘোষণা মতে এরা বস্তুতঃ সমগ্র মানব জাতির হত্যাকারী কারণ এদের এইসব পশুত্ব সর্বস্ব বর্বরতা পৃথিবীর সব আইনেই অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত (৫:৩২)।
নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে সবচেয়ে বেশী বাঁধাগ্রস্থ করা হয় যে কারণে তা হলো এই ধরনের বিয়েতে যেহেতু একই পারিবারিক ধারার ‘দুই সেট জিনের’ সম্মিলন ঘটে তাই শারীরিক ও মানসিক ভাবে দুর্বল সন্তান জন্মানোর সম্ভবনা থাকে বেশী। কথাটার মধ্যে বৈজ্ঞানিক সত্য আছে বটে তবে সেটা যে কোন দম্পতির ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। বর-কনের মধ্যে দূরতম সম্পর্ক না থাকার পরও তাদের রক্তের গ্রুপ সাংঘর্ষিক হতে পারে। এমনকি বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষাও গ্যারান্টি দেয় না দূরারোগ্য ব্যধিহীন সন্তান লাভের। কারণ মা-বাবার দেহের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থাকা জেনেটিক রোগ অজ্ঞাত কারণেও প্রকাশ হতে পারে কোন কোন সন্তানের মধ্যে। নিজ উম্মতের কাছে এই বিষয়টা স্বপ্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করতেই সম্ভবতঃ রসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সময় নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বিয়ে হয়েছে বেশী। তিনি নিজে যেমন এ ধরনের বিয়ে করেছেন তেমনি নিজের সন্তানদেরকেও বিয়ে দিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে।
মাত্র বাষোট্টি বছর আয়ুষ্কালের মধ্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শেষ করতে হয়েছিল তাঁর বিশাল মিশন । বলাই বাহুল্য বিশ্বের আর কাউকেই এমন দূরূহ মিশনে নামতে হবে না আর কখনই। তাই এক সাথে চার জনের বেশী স্ত্রী রাখারও আর কোন প্রয়োজন হবে না কারোরই।
তবে যারা সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর খাঁটি বান্দা তারা যে কখনই অপ্রয়োজনে একের অধিক স্ত্রী রাখতে আগ্রহী হবেন না সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই কারণ আল্লাহ পাক খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে একের অধিক স্ত্রী নিতে চাইলে তাদের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে স্বামীকে অবশ্যই সমতা রক্ষা করে চলতে হবে যা কিনা সাধারণ মানুষের পক্ষে দুরূহ, আর তাই মানুষের জন্যে এক স্ত্রীতে সন্তুষ্ট থাকাই উত্তম (৪:৩, ১২৯)।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সমস্ত জীবন, বিশেষত তাঁর পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুরোটা সময়ই ছিল ‘যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি’ তাই তাঁর বিয়েগুলোও ছিল সেই সময়ের বিশেষ বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতি স্বাপেক্ষ। আল্লাহ পাকের রসূল পদে অভিষিক্ত হওয়ার পরপরই নবীজীকে বহু সম্পদের লোভ দেখানো হয়েছে, প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল বড় বড় ঘরে ভাল ভাল অসংখ্য বিয়েরও, শুধু শর্ত ছিল আল্লাহর দ্বীন থেকে সড়ে আসার। সেইসব প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অকাতরে। এসব তথ্য লিখিত দলিল আকারে এখনও বর্তমান ইতিহাসের পাতায়। রসূল পাকের ছিদ্রান্বেষীদের মত অনুযায়ী তিনি যদি সত্যিই তাঁর শারীরিক চাহিদা মেটাতেই দশের অধিক বিয়ে করে থাকেন তা হলে তিনি তা বহু আগেই করতে পারতেন, পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন দরকার ছিল না।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে মানুষের জীবন ও সমাজকে বিচিত্র সব কল্পনা মিশ্রিত কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে এই বিশ্বে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বেঁচে থাকাটাকে মানুষের জন্য সহজ, সাবলিল, সম্মানজনক এবং অর্থপূর্ণ করতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) একক ভাবে যে অবিশ্বাস্য ও অসামান্য অবদান রেখেছেন তার কারণেই তিনি হতে পেরেছেন ‘রাহমাতুল্লিল আল-আমিন’ তথা ‘জগতসমূহের জন্য রহমত’ (২১:১০৭)। স্বয়ং আল্লাহ পাকের কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি পাওয়া কোন সহজ সাধ্য বিষয় নয়।
সুতরাং সময়, কাল, অবস্থা এবং মিশনকে আমলে না নিয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন বা তাঁর তেরো বিয়ে নিয়ে কথা বলা এবং সেই সব খন্ডিত ও অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ সমূহের ভিত্তিতে আজকের সুবিধাজনক সময়ে বসে আল্লাহ পাকের সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহের যেনতেন ব্যাখা করার চেষ্টা করাটা হবে ভয়ানক অন্যায় এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
ইসতিয়াক আহমেদ রাফি
এল,এল,বি (অনার্স) । এল,এল,এম এবং কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.