মা বনাম জা by মাহবুব তালুকদার
আমাদের
রাজনীতিবিদরা মাঝে মাঝে চমকপ্রদ বক্তব্য দিয়ে পত্রিকার পাতা আলোকিত করে
থাকেন। বিগত ৯ই মে আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী তার
নির্বাচনী এলাকার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলে তিনি জাফর ইকবালকে
চাবুক দিয়ে পেটাতেন’। পত্রিকার এই ভাষ্য যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে মান্যবর
সংসদ সদস্যের কথা আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করে। প্রথমত, কি কারণে
এবং কোন অপরাধে তিনি জাফর ইকবালকে চাবুক দিয়ে পেটাতে চান? দ্বিতীয়ত, জাফর
ইকবাল কে, এত লোক থাকতে কেন তাকেই পেটাতে হবে? তৃতীয়ত, মাননীয় সংসদ সদস্যের
ক্ষমতায় কি ঘাটতি আছে? ‘ক্ষমতা থাকলে’ কথাটি বললেন কেন? চতুর্থত,
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানুষ পেটানোর অধিকার আছে, কিন্তু একজন সংসদ
সদস্যের এই সামান্য অধিকারটুকু নেই কেন? পঞ্চমত, প্রয়োজনে একজন আইনপ্রণেতা
কেন নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবেন না? এই পাঁচটি ছাড়া আরও অনেকগুলো
সম্পূরক প্রশ্ন আছে। তবে আপাতত এই পাঁচটিই যথেষ্ট।
জাফর ইকবালকে মাননীয় সংসদ সদস্যের চাবুক দিয়ে পেটাতে চাওয়ার কারণ আপাতদৃষ্টিতে খুবই যৌক্তিক। পত্রিকায় লেখা হয়েছে- ‘জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে মাহমুদ-উস সামাদের অসন্তোষ তার ‘সিলেট বিদ্বেষী’ মনোভাবের কারণে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, জাফর ইকবালের কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে না। তাদের আটকাতে নানা আইনকানুন তৈরি করে নেন জাফর ইকবাল।’ এহেন অভিযোগ যে অত্যন্ত গুরুতর তাতে সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল সিলেটের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবে- এমন বিধিবিধান করে নিলে ল্যাঠা চুকে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে জাফর ইকবালের আইনকানুন তৈরির জারিজুরি বা তার কোনো অপকৌশল আর খাটবে না।
দ্বিতীয়ত, জাফর ইকবাল কে- এই প্রশ্নের জবাব দান খুবই সহজ। তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তার একটি ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং অর্ধশতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য শিক্ষকের ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। সে হিসেবে তিনি বিশেষ কেউ নন। অবশ্য তিনি একজন লেখক। লেখকদের পদাধিকার বলতে কিছু নেই। তারা কোনো প্রটোকলের মধ্যে পড়েন না। এমতাবস্থায় একজন প্রটোকলবিহীন শিক্ষককে সঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে অভিযুক্ত করা হয়নি। তিনি যদি তেমন কেউ হতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হতো কি না জানি না।
জাফর ইকবাল আসলে একজন ছদ্ম-সিলেটপ্রেমী। ছদ্ম-সিলেটপ্রেমী ও সিলেট বিদ্বেষীর মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ছদ্ম-সিলেটপ্রেমীরা সিলেটের প্রেমের ভান করেন কিন্তু সিলেটের স্বার্থ রক্ষায় তারা আগুয়ান হন না। জাফর ইকবাল সম্পর্কে পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘তার জন্ম এই সিলেটেই। এখানকার সিলেট নগরীর ব্যস্ততম এলাকা মিরাবাজারে তার শৈশব কেটেছে। বাল্যশিক্ষাও এখানে। তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হকের রক্তেও রয়েছে সিলেটের উত্তরাধিকার। ইয়াসমীন হকের জন্ম সিলেটে না হলেও তার নানাবাড়ি এখানেই। সব মিলিয়ে জাফর ইকবালের ঘরজুড়ে সিলেটের মাটির ঘ্রাণ। আর তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসী জীবনের মোহমায়া ছেড়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে ফিরে এসেছেন তার জন্মের শহর সিলেটেই।’ পত্রিকায় যাই লেখা হোক না কেন, জাফর ইকবাল যে সিলেটে জন্মেও সিলেট-বিদ্বেষী হয়েছেন, এটাই সত্য কথা। এক্ষেত্রে তার দুটো অপশন ছিল। এক. সিলেটে না জন্মানো। দুই. সিলেটে জন্মগ্রহণ যেহেতু তার ইচ্ছাধীন ছিল না সেহেতু তার উচিত ছিল সিলেটপ্রেমী হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ না করে সত্যিকার সিলেটপ্রেমিক হয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মাহমদু-উস সামাদের চিন্তা ও আদর্শের আদলে গড়ে তোলায় হাত সম্প্রসারিত করা।
উপরোক্ত ‘আদর্শ’ কথাটার উল্লেখ করে আমি আরেকটা বিপদ ডেকে আনলাম। ৯ই মে’র বক্তৃতায় মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী স্পষ্ট করেছেন জাফর ইকবালের আদর্শও তার পছন্দ নয়। সেদিন জাফর ইকবাল প্রসঙ্গে বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এই লেফটিস্টরা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।’ মাননীয় সংসদ সদস্যদের এই উক্তি প্রণিধানযোগ্য। আমরা লক্ষ্য করেছি, আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতিবিদরা প্রায়ই এহেন আক্ষেপ করে থাকেন। এই আক্ষেপের সঙ্গত কারণও আছে। মধ্যপন্থি মূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে বাম ঘরানা থেকে আসা অনেককে মন্ত্রিত্ব দেয়া হচ্ছে, মূল্যায়ন করা হচ্ছে, এটা মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর। অন্যদিকে অনেকে বলে থাকেন, বর্তমান সরকার মার্কিনিদের পরিহার করে রাশিয়ার দিকে দিনে দিনে ঝুঁকে পড়ছে, এটাও তাদের দুঃখের কারণ। তাই লেফটিস্টদের সম্পর্কে এই আক্ষেপ চিরন্তন। জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকলে তাকে বলতাম, বামপথ পরিত্যাগ করে আপনি ডান দিকে মোচড় দিন। আখেরে যদি আপনি বেত্রাঘাত বা চাবুকের আঘাত এড়াতে চান।
মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরীকে আমি সাধারণ একজন সংসদ সদস্য মনে করি না। তিনি আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ দলের জনপ্রতিনিধি। জাতীয় সংসদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবিল উত্থাপন করে তিনি দেশজুড়ে আলোচিত হন। অন্যদিকে জাফর ইকবালকে কোনক্রমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ব্যক্তি বলে আখ্যা প্রদান করা সম্ভব নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস ‘আমার বন্ধু রাশেদ’-এর লেখক। বইটি দেশব্যাপী স্কুলগুলোতে পড়ানো হয়। এমতাবস্থায় মাননীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরীর সামনে দুটো অপশন আছে। এক. বেত্রাঘাতযোগ্য একজন লেখকের বই স্কুলে পড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বইটিকে বাতিল করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো। দুই. তিনি নিজেই ওই ধরনের একটি বই লিখে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
মাননীয় সংসদ সদস্যের আরেকটি বিষয় জানা আছে কি না জানি না। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাফর ইকবালের পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুরের তৎকালীন এসডিপিও থাকাকালে শহীদ হন। পিতার মৃত্যুর পর এই পরিবারটিকে নানারূপ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। এ জন্য আমার মনে হয়, জাফর ইকবালকে বেত্রাঘাতের সিদ্ধান্ত প্রকাশের ক্ষেত্রে মাননীয় সংসদ সদস্যের আরও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন ছিল।
এবার তৃতীয় বিষয় প্রসঙ্গে আসি। ক্ষমতা থাকলে তিনি জাফর ইকবালকে চাবুক দিয়ে পেটাতেন বলেছেন। ‘ক্ষমতা থাকলে’ কথাটার মধ্যে কিছুটা আক্ষেপ ও হতাশা পরিলক্ষিত হয়েছে। আমার মতে, মাননীয় সংসদ সদস্যগণের ক্ষমতা অবারিত হওয়া উচিত। তাদের ক্ষমতার যদি কিছু ঘাটতি থাকে, তাহলে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সংসদই সদস্যদের ক্ষমতা বর্ধিতকরণ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে পারে। সংসদ সদস্যগণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে আফসোস করবেন, এটা কারও কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। এক সময়ে শিক্ষকদের বেত দ্বারা ছাত্র পেটানোর অধিকার ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশবলে ওই অধিকার, এমনকি ছাত্রদের মারধর করার অধিকারও খর্ব করে। কিন্তু শিক্ষকদের পেটানোর ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো মানা নেই। তাছাড়া, চাবুক দিয়ে শিক্ষক পেটানোর ব্যাপারে কোনো নিষেধজ্ঞা তো নেইই। চাবুক জিনিসটা সাধারণত ফিল্মে দেখা যায়, জমিদার বা মালিকদের হাতে থাকে। আজকাল বাস্তবে চাবুক খুঁজে পাওয়া ভার।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, মানুষ পেটানোর অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হরহামেশাই নির্বিচারে জনগণের ওপর এই অধিকার প্রয়োগ করে থাকে। এটা হচ্ছে তাদের নিম্নতম অধিকার। আজকাল তারা পায়ে গুলি করা ও ক্রসফায়ার পর্যন্ত তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছে। বিস্ময়ের বিষয় এই, একজন সংসদ সদস্যের এই সামান্য অধিকারটুকু পর্যন্ত নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কাউকে পেটানোর জন্য ইউনিফরম পরতে হবে কেন? যদিও আজকাল অনেক জনপ্রতিনিধি জনগণকে কিংবা ব্যক্তি বিশেষকে মারধর করার অধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। সেটা হচ্ছে তাদের ইনফরমাল অ্যাকশন। এ কাজটির ফরমাল রূপদান করা এবং বিধিবদ্ধভাবে তা প্রয়োগ করার ব্যবস্থা থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ইউনিফরম না পরেও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সাদা পোশাকে কাউকে চাবুক দিয়ে পেটানোর অধিকার আইন দ্বারা সংরক্ষিত রাখা উচিত।
সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে, একজন আইনপ্রণেতা কেন প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবেন না? যিনি আইন তৈরি করেন, কেন সেই আইন ক্ষেত্রবিশেষে নিজে প্রয়োগ করতে পারবেন না? এর মধ্যে এক ধরনের পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। আমি যে আইন বানাই, সেটা অন্যে ব্যবহার করতে পারবে, আমি পারবো না কেন? ময়রা মিষ্টি প্রস্তুত করে, কিন্তু সেই মিষ্টি সে নিজে সদ্ব্যবহার করলে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া ‘ডকট্রিন অব নেসিসিটি’ বলে একটা কথা আছে। সেই প্রয়োজন পরিপূণের জন্য একজন আইনপ্রণেতাকে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার দিতে হবে।
তবে মাহমুদ-উস সামাদর বক্তব্যের যে প্রতিবাদ হয়নি, এমন নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ তার জীবনের সর্বশেষ স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে। কলিকালের শিক্ষা একেই বলে।’ নিহত ব্লগার অনন্ত কলিকালের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাখ্যা করার অবকাশ পাননি। তিনিও যে কলিকালের শিক্ষার যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বেঁচে থাকলে এসব অর্বাচীনসুলভ স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য তার কি পরিণতি হতো কে জানে?
পরিশেষে জাফর ইকবালকে বলি, আপনি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেও মনেপ্রাণে সিলেটি হতে পারেননি। মনেপ্রাণে সিলেটি হতে না পারলে সিলেটি ছাত্র ভর্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে সিলেটিদের স্বার্থে আঘাত করলে, আপনাকে বেত্রাঘাত বা চাবুক দ্বারা পেটানো থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। মাননীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী ‘ক্ষমতা থাকলে’ বিষয়টি অনুধাবন করে আপনাকে ছাড় দিয়েছেন। এটা তার মহানুভবতা। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন কারও পাল্লায় পড়ে যাবেন, যিনি ক্ষমতা আছে কি নেই, সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না। তাই বলি, আপনি সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
জাফর ইকবালকে মাননীয় সংসদ সদস্যের চাবুক দিয়ে পেটাতে চাওয়ার কারণ আপাতদৃষ্টিতে খুবই যৌক্তিক। পত্রিকায় লেখা হয়েছে- ‘জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে মাহমুদ-উস সামাদের অসন্তোষ তার ‘সিলেট বিদ্বেষী’ মনোভাবের কারণে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, জাফর ইকবালের কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে না। তাদের আটকাতে নানা আইনকানুন তৈরি করে নেন জাফর ইকবাল।’ এহেন অভিযোগ যে অত্যন্ত গুরুতর তাতে সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল সিলেটের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবে- এমন বিধিবিধান করে নিলে ল্যাঠা চুকে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে জাফর ইকবালের আইনকানুন তৈরির জারিজুরি বা তার কোনো অপকৌশল আর খাটবে না।
দ্বিতীয়ত, জাফর ইকবাল কে- এই প্রশ্নের জবাব দান খুবই সহজ। তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তার একটি ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং অর্ধশতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য শিক্ষকের ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। সে হিসেবে তিনি বিশেষ কেউ নন। অবশ্য তিনি একজন লেখক। লেখকদের পদাধিকার বলতে কিছু নেই। তারা কোনো প্রটোকলের মধ্যে পড়েন না। এমতাবস্থায় একজন প্রটোকলবিহীন শিক্ষককে সঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে অভিযুক্ত করা হয়নি। তিনি যদি তেমন কেউ হতেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হতো কি না জানি না।
জাফর ইকবাল আসলে একজন ছদ্ম-সিলেটপ্রেমী। ছদ্ম-সিলেটপ্রেমী ও সিলেট বিদ্বেষীর মধ্যে মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ছদ্ম-সিলেটপ্রেমীরা সিলেটের প্রেমের ভান করেন কিন্তু সিলেটের স্বার্থ রক্ষায় তারা আগুয়ান হন না। জাফর ইকবাল সম্পর্কে পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘তার জন্ম এই সিলেটেই। এখানকার সিলেট নগরীর ব্যস্ততম এলাকা মিরাবাজারে তার শৈশব কেটেছে। বাল্যশিক্ষাও এখানে। তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হকের রক্তেও রয়েছে সিলেটের উত্তরাধিকার। ইয়াসমীন হকের জন্ম সিলেটে না হলেও তার নানাবাড়ি এখানেই। সব মিলিয়ে জাফর ইকবালের ঘরজুড়ে সিলেটের মাটির ঘ্রাণ। আর তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসী জীবনের মোহমায়া ছেড়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে ফিরে এসেছেন তার জন্মের শহর সিলেটেই।’ পত্রিকায় যাই লেখা হোক না কেন, জাফর ইকবাল যে সিলেটে জন্মেও সিলেট-বিদ্বেষী হয়েছেন, এটাই সত্য কথা। এক্ষেত্রে তার দুটো অপশন ছিল। এক. সিলেটে না জন্মানো। দুই. সিলেটে জন্মগ্রহণ যেহেতু তার ইচ্ছাধীন ছিল না সেহেতু তার উচিত ছিল সিলেটপ্রেমী হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ না করে সত্যিকার সিলেটপ্রেমিক হয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়টিকে মাহমদু-উস সামাদের চিন্তা ও আদর্শের আদলে গড়ে তোলায় হাত সম্প্রসারিত করা।
উপরোক্ত ‘আদর্শ’ কথাটার উল্লেখ করে আমি আরেকটা বিপদ ডেকে আনলাম। ৯ই মে’র বক্তৃতায় মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী স্পষ্ট করেছেন জাফর ইকবালের আদর্শও তার পছন্দ নয়। সেদিন জাফর ইকবাল প্রসঙ্গে বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এই লেফটিস্টরা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।’ মাননীয় সংসদ সদস্যদের এই উক্তি প্রণিধানযোগ্য। আমরা লক্ষ্য করেছি, আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতিবিদরা প্রায়ই এহেন আক্ষেপ করে থাকেন। এই আক্ষেপের সঙ্গত কারণও আছে। মধ্যপন্থি মূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে বাম ঘরানা থেকে আসা অনেককে মন্ত্রিত্ব দেয়া হচ্ছে, মূল্যায়ন করা হচ্ছে, এটা মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর। অন্যদিকে অনেকে বলে থাকেন, বর্তমান সরকার মার্কিনিদের পরিহার করে রাশিয়ার দিকে দিনে দিনে ঝুঁকে পড়ছে, এটাও তাদের দুঃখের কারণ। তাই লেফটিস্টদের সম্পর্কে এই আক্ষেপ চিরন্তন। জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকলে তাকে বলতাম, বামপথ পরিত্যাগ করে আপনি ডান দিকে মোচড় দিন। আখেরে যদি আপনি বেত্রাঘাত বা চাবুকের আঘাত এড়াতে চান।
মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরীকে আমি সাধারণ একজন সংসদ সদস্য মনে করি না। তিনি আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ দলের জনপ্রতিনিধি। জাতীয় সংসদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারবিল উত্থাপন করে তিনি দেশজুড়ে আলোচিত হন। অন্যদিকে জাফর ইকবালকে কোনক্রমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ব্যক্তি বলে আখ্যা প্রদান করা সম্ভব নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস ‘আমার বন্ধু রাশেদ’-এর লেখক। বইটি দেশব্যাপী স্কুলগুলোতে পড়ানো হয়। এমতাবস্থায় মাননীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরীর সামনে দুটো অপশন আছে। এক. বেত্রাঘাতযোগ্য একজন লেখকের বই স্কুলে পড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বইটিকে বাতিল করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো। দুই. তিনি নিজেই ওই ধরনের একটি বই লিখে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
মাননীয় সংসদ সদস্যের আরেকটি বিষয় জানা আছে কি না জানি না। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাফর ইকবালের পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুরের তৎকালীন এসডিপিও থাকাকালে শহীদ হন। পিতার মৃত্যুর পর এই পরিবারটিকে নানারূপ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। এ জন্য আমার মনে হয়, জাফর ইকবালকে বেত্রাঘাতের সিদ্ধান্ত প্রকাশের ক্ষেত্রে মাননীয় সংসদ সদস্যের আরও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন ছিল।
এবার তৃতীয় বিষয় প্রসঙ্গে আসি। ক্ষমতা থাকলে তিনি জাফর ইকবালকে চাবুক দিয়ে পেটাতেন বলেছেন। ‘ক্ষমতা থাকলে’ কথাটার মধ্যে কিছুটা আক্ষেপ ও হতাশা পরিলক্ষিত হয়েছে। আমার মতে, মাননীয় সংসদ সদস্যগণের ক্ষমতা অবারিত হওয়া উচিত। তাদের ক্ষমতার যদি কিছু ঘাটতি থাকে, তাহলে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সংসদই সদস্যদের ক্ষমতা বর্ধিতকরণ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে পারে। সংসদ সদস্যগণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে আফসোস করবেন, এটা কারও কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। এক সময়ে শিক্ষকদের বেত দ্বারা ছাত্র পেটানোর অধিকার ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশবলে ওই অধিকার, এমনকি ছাত্রদের মারধর করার অধিকারও খর্ব করে। কিন্তু শিক্ষকদের পেটানোর ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো মানা নেই। তাছাড়া, চাবুক দিয়ে শিক্ষক পেটানোর ব্যাপারে কোনো নিষেধজ্ঞা তো নেইই। চাবুক জিনিসটা সাধারণত ফিল্মে দেখা যায়, জমিদার বা মালিকদের হাতে থাকে। আজকাল বাস্তবে চাবুক খুঁজে পাওয়া ভার।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, মানুষ পেটানোর অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হরহামেশাই নির্বিচারে জনগণের ওপর এই অধিকার প্রয়োগ করে থাকে। এটা হচ্ছে তাদের নিম্নতম অধিকার। আজকাল তারা পায়ে গুলি করা ও ক্রসফায়ার পর্যন্ত তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের পরিধি বাড়িয়ে নিয়েছে। বিস্ময়ের বিষয় এই, একজন সংসদ সদস্যের এই সামান্য অধিকারটুকু পর্যন্ত নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কাউকে পেটানোর জন্য ইউনিফরম পরতে হবে কেন? যদিও আজকাল অনেক জনপ্রতিনিধি জনগণকে কিংবা ব্যক্তি বিশেষকে মারধর করার অধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। সেটা হচ্ছে তাদের ইনফরমাল অ্যাকশন। এ কাজটির ফরমাল রূপদান করা এবং বিধিবদ্ধভাবে তা প্রয়োগ করার ব্যবস্থা থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ইউনিফরম না পরেও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সাদা পোশাকে কাউকে চাবুক দিয়ে পেটানোর অধিকার আইন দ্বারা সংরক্ষিত রাখা উচিত।
সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে, একজন আইনপ্রণেতা কেন প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবেন না? যিনি আইন তৈরি করেন, কেন সেই আইন ক্ষেত্রবিশেষে নিজে প্রয়োগ করতে পারবেন না? এর মধ্যে এক ধরনের পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। আমি যে আইন বানাই, সেটা অন্যে ব্যবহার করতে পারবে, আমি পারবো না কেন? ময়রা মিষ্টি প্রস্তুত করে, কিন্তু সেই মিষ্টি সে নিজে সদ্ব্যবহার করলে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া ‘ডকট্রিন অব নেসিসিটি’ বলে একটা কথা আছে। সেই প্রয়োজন পরিপূণের জন্য একজন আইনপ্রণেতাকে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার দিতে হবে।
তবে মাহমুদ-উস সামাদর বক্তব্যের যে প্রতিবাদ হয়নি, এমন নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ তার জীবনের সর্বশেষ স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে। কলিকালের শিক্ষা একেই বলে।’ নিহত ব্লগার অনন্ত কলিকালের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাখ্যা করার অবকাশ পাননি। তিনিও যে কলিকালের শিক্ষার যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বেঁচে থাকলে এসব অর্বাচীনসুলভ স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য তার কি পরিণতি হতো কে জানে?
পরিশেষে জাফর ইকবালকে বলি, আপনি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেও মনেপ্রাণে সিলেটি হতে পারেননি। মনেপ্রাণে সিলেটি হতে না পারলে সিলেটি ছাত্র ভর্তিসহ অন্যান্য বিষয়ে সিলেটিদের স্বার্থে আঘাত করলে, আপনাকে বেত্রাঘাত বা চাবুক দ্বারা পেটানো থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। মাননীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী ‘ক্ষমতা থাকলে’ বিষয়টি অনুধাবন করে আপনাকে ছাড় দিয়েছেন। এটা তার মহানুভবতা। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন কারও পাল্লায় পড়ে যাবেন, যিনি ক্ষমতা আছে কি নেই, সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না। তাই বলি, আপনি সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
No comments