২০ দলীয় জোটে টানাপড়েন by কাফি কামাল
টানাপড়েন
চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জোটের
কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিএনপিতে। খোদ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার
সামনেই সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় প্রশ্ন তুলেছেন দলটির এক সিনিয়র নেতা।
গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে তারই প্রতিধ্বনি করেছেন দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের
এক সদস্যসহ বিএনপির কয়েক নেতা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শরিক দলের নেতাকর্মীরা। গত
তিন দিনে তারা নিজেদের মধ্যে কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন। এখন
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মনোভাব ও বক্তব্যের অপেক্ষা করছেন তারা। তবে
বাস্তবতা বিবেচনায় জোটের কার্যকারিতা নিয়ে তাদের মধ্যেও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
এদিকে বিএনপি যখন আন্দোলন থেকে সরে এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে তখন
নিজেদের মতো করে দল গোছানোর উদ্যোগ নিয়েছে জামায়াত। বিএনপি নেতারাও এখন দল
গোছানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, জোটের প্রধান
দল বিএনপির সঙ্গে পরিষ্কার দূরত্ব তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় প্রধান দল
জামায়াতের। বর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিএনপি একাংশ
চাইছে, জোট ছেড়ে যাক জামায়াত। এমন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের টানাপড়েন চলছে ২০
দলীয় জোটে। জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
এদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম জোটের প্রসঙ্গটি সামনে আনেন। তিনি পরিষ্কার বলেন, জোটের কোন কার্যকারিতা নেই, জোটের আর দরকার নেই। এ জোটের কারণে ৪০-৫০টি আসনে বিএনপির নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে না। কারণ অনেকেই মনে করে, সেসব আসনে জোটের শরিক দলের নেতারাই মনোনয়ন পাবেন। তাই কাজ করে লাভ কি। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানও নির্বাচনী জোট করেছিলেন পরে তিনি সেই জোট ভেঙে বিএনপিতে আসার আহ্বান জানান। সে সময় সমমনা বেশ কিছু দল বিএনপিতে যোগ দিয়েছিল। ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শরিক দলের নেতাকর্মীরা যদি জিয়ার আদর্শ পছন্দ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হন তাহলে তারা বিএনপিতেই যোগ দিতে পারেন। তাদের আওয়ামী লীগও নেবে না, অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই। তার এ বক্তব্যের পর শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক প্রতিবাদ করে বলেন, এসব আলোচনা নির্দিষ্ট ফোরামেই হওয়া উচিত, এমন প্রকাশ্যে নয়। তিনি ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বলেন, এখানে অনেক ধরনের ফুল আছে। সবধরনের ফুল মিলে যেমন সুন্দর একটি তোড়া হয়েছে তেমন ২০টি দল নিয়ে একটি জোট। তোড়া থেকে একটি ফুল টেনে নিলেই এর সৌন্দর্য নষ্ট হবে। তিনি বলেন, গ্রামে অনেক গাছ থাকে, কিন্তু মানুষ বড় বটগাছের নিচেই আশ্রয় নেয়। বিএনপি হলো সেই বটগাছ।
এদিকে আলোচনা সভার পর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এডভোকেট আহমেদ আজম খান জোটের কার্যকারিতা নিয়ে শাহজাহান ওমরের বক্তব্যের সমর্থন করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। এতে হঠাৎ করেই টানাপড়েনটি সামনে চলে আসে। বৃহস্পতিবার সে আলোচনা সভার পর থেকেই জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা নিজেদের মধ্যে একের পর এক বৈঠক করছেন। শরিক দলগুলোর একাধিক নেতা জানান, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শরিক দলগুলোর প্রতি সরকারের বিভিন্ন অফার ছিল। বিশেষ করে যেসব দলের নিবন্ধন আছে। তাদের রাজি করানোর জন্য আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা অনেক তৎপরতাও চালিয়েছেন। ওই সময় ৯ম সংসদের এমপি হিসেবে এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম ও বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থকে মন্ত্রিত্ব, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী ও বাংলাদেশ ন্যাপ সভাপতি জেবেল রহমান গানিকে উপদেষ্টা করাসহ নিবন্ধিত দলগুলোর বেশ কয়েকজনকে এমপি নির্বাচিত করার অফার দেয়া হয়। কয়েকজন নেতাকে বেশ চাপেও ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তারা সরকারের সে অফার গ্রহণ করেননি। জোটের নেতারা জানান, জোটবদ্ধ আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীরবিক্রম, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, শফিউল আলম প্রধান, আহসান হাবিব লিংকন, সাঈদ আহমেদ, সাইফুদ্দিন মনি ও লুৎফর রহমান কারাভোগ করেছেন। মামলার আসামি হয়েছেন- জেবেল রহমান গানি, শাহাদাত হোসেন সেলিম, গোলাম মর্তুজা, গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়াসহ জামায়াত ও শরিকদলের অনেকেই। বরং বিএনপির যেসব নেতা জোটের সমালোচনা করছেন তাদের অনেকেই আন্দোলনের সময় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছেন। শরিক দলের নেতারা জানান, জোটের নেতৃত্বদানকারী দল বিএনপি ও দ্বিতীয় প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে একটি পরিস্কার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করলেও জামায়াত সেটা মানেনি। এর ফল হিসেবে জামায়াত ৫টি কাউন্সিলর পেয়েছে। উপজেলা নির্বাচনেও জামায়াত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থী দিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতের দায় ও অপপ্রচারের শিকার হয়েছে বিএনপি। নেতারা জানান, কেবল বিএনপি নয়- জোটের মধ্যে প্রগতিশীল মনোভাবের কয়েকটি দলের সঙ্গেও জামায়াতের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জোটের শরিক হিসেবে থাকলেও দল গোছাচ্ছে জামায়াত। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতাদের জোট প্রসঙ্গে প্রকাশ্য বক্তব্যে শরিকদলগুলোর জন্য অপমানজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। শরিক দলের নেতারা এতে দারুণভাবে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ছোট ছোট দলগুলোকে আগ্রহের সঙ্গে জোটভুক্ত করেছিল বিএনপি। আন্দোলনে বিএনপির ভুল বা ব্যর্থতার দায় নিয়েছে ছোট দলগুলো। কিন্তু বিএনপি নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। নেতারা বলেন, জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে অনেক দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে ও মেনে নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থিতা দেয়নি। সেখানে প্রার্থী হলে তারা নানাভাবে লাভবান এমনকি দলের পরিচিতি বাড়াতে পারতো। এখন বিএনপি নেতাদের কথায় পরিষ্কার যে, ভবিষ্যতে সুসময় এলে তারা ছোটদলগুলোকে ছুড়ে ফেলবে। আমরা এ বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মনোভাব ও ব্যাখ্যা জানার অপেক্ষায় আছি। এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা বিএনপির ভুল ও ব্যর্থতার দায়িত্ব নিয়েছি। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনসহ সরকারের নানা আহ্বানকে উপেক্ষা করেছি। কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন আমাদের প্রকাশ্যে অপমান-অপদস্ত করছে। এতে আমরা হতাশ এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। সম্মান নষ্ট করে জোট করার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর একজন সিনিয়র রাজনীতিক। কিন্তু স্থান-কাল বিবেচনায় তিনি প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি কিভাবে মনে করেন, অন্য দলগুলো বিএনপিতে যোগ দেবে। এটা তো বিএনপির বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে নীতি তার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।
বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ হলেও কিছু বিষয়ে তারা একমত। জোটের একাধিক শরিক দলের নেতারা জানান, ২০ দলের আন্দোলনের প্রধান ইস্যু ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে আন্দোলন এখন নেই। এমনকি মানবপাচার, ধর্ষণসহ বেশ কিছু ইস্যুতে আশ্চর্যরকম নীরব জোটের রাজনীতি। এখন জোটের তেমন কোন কার্যকারিতা নেই। কার্যকারিতার বিবেচনা করেই জোট গঠন করা উচিত ছিল। কিন্তু বিএনপি সংখ্যাতত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে কিছু নাম ও ব্যক্তিসর্বস্ব দলকে জোটভুক্ত করেছে। এতে জোটের সিদ্ধান্তগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসুবিধার তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ২০দলীয় জোটের ৯টি শরিক দলেরই নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক নিবন্ধন নেই। দলগুলো হচ্ছে- জাতীয় পার্টি (জাফর), এনপিপি, এনডিপি, ইসলামিক পার্টি, পিপলস লীগ, লেবার পার্টি, সাম্যবাদী দল, ডেমক্রেটিক পার্টি ও ন্যাপ ভাসানী। শরিক দলের নেতারা জানান, জোটকে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর করতে বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য কয়েকটি উদ্যোগ নিতে হবে। সেগুলো হচ্ছে- জোটের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি কোর কমিটি গঠন, জেলা পর্যায়ে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন, বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ জোটভুক্ত দলগুলোর মহাসচিবদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে কর্মসূচি প্রণয়ন। শরিক দলের নেতারা মনে করেন, এখন যেহেতু আন্দোলনের ট্র্যাকে নেই তাই জোটভুক্ত দলগুলোর উচিত নিজেদের দল গোছানোর উদ্যোগ নেয়া। জোটের নেতারা জানান, বিএনপির একটি অংশ চাইছেন শরিক দল জামায়াত জোট ছেড়ে যাক। কারণ জামায়াতের কারণে বিএনপি যতটা লাভবান হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জামায়াতের ঐতিহাসিক দায় বিএনপির কাঁধে চেপে বসেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও বিএনপিকে কট্টর ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে জামায়াত ইস্যুতেই। আর ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতের সরে যাওয়ার ব্যাপারে কাজ করছেন অন্য শরিকদলের কিছু নেতাও।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহজাহান ওমর বীরবিক্রম বলেন, আন্দোলন ইস্যুতে জোট গঠন হয়েছিল। এখন আন্দোলন নেই তাই জোটের প্রয়োজনও নেই। নাম ও প্যাড সর্বস্ব দল নিয়ে অনেকেই জোটের শরিক সেজে বসে আছেন। এতে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির মর্যাদাহানি হচ্ছে। বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা জোটের নামসর্বস্বদের জন্য মঞ্চে জায়গা পান না। এতে নেতাকর্মীরা অপমানিতবোধ করেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, আলোচনা সভায় যা বলেছি, বুঝে শুনেই বলেছি। চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান বলেন, রাজনৈতিক দলের মতো জোট কোনদিন স্থায়ী হয় না। আর এটা কোন আদর্শিক জোটও নয়। আন্দোলনের জন্য জোট হয়েছিল এখন আন্দোলন নেই, নিকট ভবিষ্যতে নির্বাচনের লক্ষণ দেখছি না। তাই জোটের প্রয়োজনীয়তাও দেখি না। তিনি বলেন, শরিক দল বা কোন নেতার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে নয়, বাস্তবতা বিবেচনায় আমি এ কথা বলছি। এতে তারা মনোক্ষুন্ন হবেন কেন। এখন সময় এসেছে বিএনপি এবং শরিকদলগুলোরও নিজেদের দল গোছানোর। তারাও দল গোছানোর উদ্যোগ নিক। যখন আবার আন্দোলন শুরু হবে তখন দেখা যাবে জোটের প্রয়োজনীয়তা। আজম খান বলেন, আমার বক্তব্য হচ্ছে- দলের নীতিগত উপলব্ধি এবং প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরাও এই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। তারা আলাপ-আলোচনায় তা বলছেন। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার কেবল বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার।
এদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম জোটের প্রসঙ্গটি সামনে আনেন। তিনি পরিষ্কার বলেন, জোটের কোন কার্যকারিতা নেই, জোটের আর দরকার নেই। এ জোটের কারণে ৪০-৫০টি আসনে বিএনপির নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে না। কারণ অনেকেই মনে করে, সেসব আসনে জোটের শরিক দলের নেতারাই মনোনয়ন পাবেন। তাই কাজ করে লাভ কি। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানও নির্বাচনী জোট করেছিলেন পরে তিনি সেই জোট ভেঙে বিএনপিতে আসার আহ্বান জানান। সে সময় সমমনা বেশ কিছু দল বিএনপিতে যোগ দিয়েছিল। ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শরিক দলের নেতাকর্মীরা যদি জিয়ার আদর্শ পছন্দ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হন তাহলে তারা বিএনপিতেই যোগ দিতে পারেন। তাদের আওয়ামী লীগও নেবে না, অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই। তার এ বক্তব্যের পর শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক প্রতিবাদ করে বলেন, এসব আলোচনা নির্দিষ্ট ফোরামেই হওয়া উচিত, এমন প্রকাশ্যে নয়। তিনি ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বলেন, এখানে অনেক ধরনের ফুল আছে। সবধরনের ফুল মিলে যেমন সুন্দর একটি তোড়া হয়েছে তেমন ২০টি দল নিয়ে একটি জোট। তোড়া থেকে একটি ফুল টেনে নিলেই এর সৌন্দর্য নষ্ট হবে। তিনি বলেন, গ্রামে অনেক গাছ থাকে, কিন্তু মানুষ বড় বটগাছের নিচেই আশ্রয় নেয়। বিএনপি হলো সেই বটগাছ।
এদিকে আলোচনা সভার পর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এডভোকেট আহমেদ আজম খান জোটের কার্যকারিতা নিয়ে শাহজাহান ওমরের বক্তব্যের সমর্থন করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। এতে হঠাৎ করেই টানাপড়েনটি সামনে চলে আসে। বৃহস্পতিবার সে আলোচনা সভার পর থেকেই জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা নিজেদের মধ্যে একের পর এক বৈঠক করছেন। শরিক দলগুলোর একাধিক নেতা জানান, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শরিক দলগুলোর প্রতি সরকারের বিভিন্ন অফার ছিল। বিশেষ করে যেসব দলের নিবন্ধন আছে। তাদের রাজি করানোর জন্য আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা অনেক তৎপরতাও চালিয়েছেন। ওই সময় ৯ম সংসদের এমপি হিসেবে এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম ও বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থকে মন্ত্রিত্ব, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী ও বাংলাদেশ ন্যাপ সভাপতি জেবেল রহমান গানিকে উপদেষ্টা করাসহ নিবন্ধিত দলগুলোর বেশ কয়েকজনকে এমপি নির্বাচিত করার অফার দেয়া হয়। কয়েকজন নেতাকে বেশ চাপেও ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তারা সরকারের সে অফার গ্রহণ করেননি। জোটের নেতারা জানান, জোটবদ্ধ আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীরবিক্রম, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, মওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, শফিউল আলম প্রধান, আহসান হাবিব লিংকন, সাঈদ আহমেদ, সাইফুদ্দিন মনি ও লুৎফর রহমান কারাভোগ করেছেন। মামলার আসামি হয়েছেন- জেবেল রহমান গানি, শাহাদাত হোসেন সেলিম, গোলাম মর্তুজা, গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়াসহ জামায়াত ও শরিকদলের অনেকেই। বরং বিএনপির যেসব নেতা জোটের সমালোচনা করছেন তাদের অনেকেই আন্দোলনের সময় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছেন। শরিক দলের নেতারা জানান, জোটের নেতৃত্বদানকারী দল বিএনপি ও দ্বিতীয় প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে একটি পরিস্কার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করলেও জামায়াত সেটা মানেনি। এর ফল হিসেবে জামায়াত ৫টি কাউন্সিলর পেয়েছে। উপজেলা নির্বাচনেও জামায়াত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থী দিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতের দায় ও অপপ্রচারের শিকার হয়েছে বিএনপি। নেতারা জানান, কেবল বিএনপি নয়- জোটের মধ্যে প্রগতিশীল মনোভাবের কয়েকটি দলের সঙ্গেও জামায়াতের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জোটের শরিক হিসেবে থাকলেও দল গোছাচ্ছে জামায়াত। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতাদের জোট প্রসঙ্গে প্রকাশ্য বক্তব্যে শরিকদলগুলোর জন্য অপমানজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। শরিক দলের নেতারা এতে দারুণভাবে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ছোট ছোট দলগুলোকে আগ্রহের সঙ্গে জোটভুক্ত করেছিল বিএনপি। আন্দোলনে বিএনপির ভুল বা ব্যর্থতার দায় নিয়েছে ছোট দলগুলো। কিন্তু বিএনপি নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। নেতারা বলেন, জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে অনেক দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে ও মেনে নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থিতা দেয়নি। সেখানে প্রার্থী হলে তারা নানাভাবে লাভবান এমনকি দলের পরিচিতি বাড়াতে পারতো। এখন বিএনপি নেতাদের কথায় পরিষ্কার যে, ভবিষ্যতে সুসময় এলে তারা ছোটদলগুলোকে ছুড়ে ফেলবে। আমরা এ বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মনোভাব ও ব্যাখ্যা জানার অপেক্ষায় আছি। এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা বিএনপির ভুল ও ব্যর্থতার দায়িত্ব নিয়েছি। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনসহ সরকারের নানা আহ্বানকে উপেক্ষা করেছি। কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন আমাদের প্রকাশ্যে অপমান-অপদস্ত করছে। এতে আমরা হতাশ এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। সম্মান নষ্ট করে জোট করার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর একজন সিনিয়র রাজনীতিক। কিন্তু স্থান-কাল বিবেচনায় তিনি প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি কিভাবে মনে করেন, অন্য দলগুলো বিএনপিতে যোগ দেবে। এটা তো বিএনপির বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে নীতি তার সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।
বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ হলেও কিছু বিষয়ে তারা একমত। জোটের একাধিক শরিক দলের নেতারা জানান, ২০ দলের আন্দোলনের প্রধান ইস্যু ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে আন্দোলন এখন নেই। এমনকি মানবপাচার, ধর্ষণসহ বেশ কিছু ইস্যুতে আশ্চর্যরকম নীরব জোটের রাজনীতি। এখন জোটের তেমন কোন কার্যকারিতা নেই। কার্যকারিতার বিবেচনা করেই জোট গঠন করা উচিত ছিল। কিন্তু বিএনপি সংখ্যাতত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে কিছু নাম ও ব্যক্তিসর্বস্ব দলকে জোটভুক্ত করেছে। এতে জোটের সিদ্ধান্তগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসুবিধার তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ২০দলীয় জোটের ৯টি শরিক দলেরই নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক নিবন্ধন নেই। দলগুলো হচ্ছে- জাতীয় পার্টি (জাফর), এনপিপি, এনডিপি, ইসলামিক পার্টি, পিপলস লীগ, লেবার পার্টি, সাম্যবাদী দল, ডেমক্রেটিক পার্টি ও ন্যাপ ভাসানী। শরিক দলের নেতারা জানান, জোটকে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর করতে বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য কয়েকটি উদ্যোগ নিতে হবে। সেগুলো হচ্ছে- জোটের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটি কোর কমিটি গঠন, জেলা পর্যায়ে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন, বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ জোটভুক্ত দলগুলোর মহাসচিবদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে কর্মসূচি প্রণয়ন। শরিক দলের নেতারা মনে করেন, এখন যেহেতু আন্দোলনের ট্র্যাকে নেই তাই জোটভুক্ত দলগুলোর উচিত নিজেদের দল গোছানোর উদ্যোগ নেয়া। জোটের নেতারা জানান, বিএনপির একটি অংশ চাইছেন শরিক দল জামায়াত জোট ছেড়ে যাক। কারণ জামায়াতের কারণে বিএনপি যতটা লাভবান হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জামায়াতের ঐতিহাসিক দায় বিএনপির কাঁধে চেপে বসেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও বিএনপিকে কট্টর ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে জামায়াত ইস্যুতেই। আর ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতের সরে যাওয়ার ব্যাপারে কাজ করছেন অন্য শরিকদলের কিছু নেতাও।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহজাহান ওমর বীরবিক্রম বলেন, আন্দোলন ইস্যুতে জোট গঠন হয়েছিল। এখন আন্দোলন নেই তাই জোটের প্রয়োজনও নেই। নাম ও প্যাড সর্বস্ব দল নিয়ে অনেকেই জোটের শরিক সেজে বসে আছেন। এতে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির মর্যাদাহানি হচ্ছে। বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা জোটের নামসর্বস্বদের জন্য মঞ্চে জায়গা পান না। এতে নেতাকর্মীরা অপমানিতবোধ করেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, আলোচনা সভায় যা বলেছি, বুঝে শুনেই বলেছি। চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান বলেন, রাজনৈতিক দলের মতো জোট কোনদিন স্থায়ী হয় না। আর এটা কোন আদর্শিক জোটও নয়। আন্দোলনের জন্য জোট হয়েছিল এখন আন্দোলন নেই, নিকট ভবিষ্যতে নির্বাচনের লক্ষণ দেখছি না। তাই জোটের প্রয়োজনীয়তাও দেখি না। তিনি বলেন, শরিক দল বা কোন নেতার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে নয়, বাস্তবতা বিবেচনায় আমি এ কথা বলছি। এতে তারা মনোক্ষুন্ন হবেন কেন। এখন সময় এসেছে বিএনপি এবং শরিকদলগুলোরও নিজেদের দল গোছানোর। তারাও দল গোছানোর উদ্যোগ নিক। যখন আবার আন্দোলন শুরু হবে তখন দেখা যাবে জোটের প্রয়োজনীয়তা। আজম খান বলেন, আমার বক্তব্য হচ্ছে- দলের নীতিগত উপলব্ধি এবং প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরাও এই প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। তারা আলাপ-আলোচনায় তা বলছেন। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার কেবল বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়ার।
No comments