মাইরুনা রাগ করে তুরস্ক যায় by দীন ইসলাম
ইসলামিক
স্টেটে (আইএস) যোগ দিতে তুরস্ক যায়নি ফারহিন মাইরুনা। একরোখা মেয়েটি
পরিবারের সঙ্গে রাগ করেই তুরস্ক গেছে। এমনটাই দাবি করেন মাইরুনার বাবা
প্রফেসর ডা. শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাক। গত বৃহস্পতিবার দেশের নামী এক
হসপিটালে বসে মানবজমিন-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন তিনি। তবে
মেয়ের ইসলামপন্থি মনোভাবের চিত্র তার বাবার সঙ্গে আলাপে ফুটে উঠেছে। তিনি
বলেন, আমার মেয়েকে তুরস্কের আতাতুর্ক ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে
ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে। মোবাইল, ল্যাপটপসহ সবকিছু সিজ করে
নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মেয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও তল্লাশি চালানো হয়। এদিকে
শুক্রবার রাতে ফারহিন মাইরুনের ফেসবুক পেইজে গিয়ে ইসলাম বিষয়ক নানা
স্ট্যাটাস দেখা যায়। ৯ই ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে নিয়ে একটি
স্ট্যাটাস দিয়েছে মাইরুনা। এ ছাড়া ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস নিয়েও
স্ট্যাটাস দিয়েছে সে। এ দিবসটি নিয়ে বলা হয়েছে, ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালন করা
ইসলামে জেনা। এ রকম অনেক স্ট্যাটাস রয়েছে। গতকাল তার ফেসবুক পেইজ থেকে এসব
তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। আপনার মেয়ে মাইরুনা আইএসে যোগদানের জন্য তুরস্ক
গিয়েছিল কি? সরকারি কাগজপত্রে তো তাই বলা হয়েছে- এমন প্রশ্নে থামিয়ে ডা.
ইসহাক বলেন, পত্রিকায় আসার পর আমি বিষয়টি সম্পর্কে সরকারকে জানিয়েছি। আমার
একটি ইজ্জত-সম্মান আছে। মেয়ের আইএসে যোগদান সম্পর্কে সরকারের কাছে কোন
এভিডেন্স (প্রমাণ) থাকলে শো করার (দেখানো) জন্য অনুরোধ করেছি। গোয়েন্দা
সংস্থাগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের পর তারা আমাকে বলেছে, পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় থেকে এটা করা হয়েছে। কিন্তু না জেনে একটি মেয়ে সম্পর্কে এটা করা
কি তাদের ঠিক হয়েছে? তিনি বলেন, চরমপন্থি গ্রুপের সঙ্গে আমার মেয়ে
সংশ্লিষ্ট থাকার প্রশ্নই আসে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তদন্ত করে
দেখুক। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্তের পরই ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে আমার
মেয়েকে ছাড়া হয়। আমি, আমার স্ত্রীসহ পরিবারের সবাইকে এয়ারপোর্টে
ইন্টারোগেট (জিজ্ঞাসাবাদ) করা হয়। মেয়ের কাছে থাকা সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসেও তাকে ইন্টারগেট
(জিজ্ঞাসাবাদ) করা হয়। ওর মোবাইল, ল্যাপটপ সবকিছু সিজ করে নিয়েছে। এ ছাড়া
ওর ফেসবুক সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তারা আমাকে জানিয়েছে কিছু
পাননি তারা। আইএসে যোগ দিতে না গেলে তুরস্কে আপনার মেয়ে যাওয়ার কারণ কি?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডা. ইসহাক বলেন, আমার সঙ্গে রাগারাগি করে তুরস্ক চলে যায়
সে। আসলে আমার পরিবারের চারজন একসঙ্গে তুরস্ক যাওয়ার কথা ছিল। ওই দেশে
একটি কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য পরিবারের সবার ভিসা, টিকিট ও ডলার করেছিলাম।
শাশুড়ির অসুস্থতায় সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মেয়ের অনেক দিনের ইচ্ছা তুরস্ক
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে। কিন্তু আমি তাকে টার্কিতে পড়াবো না। মাইরুনা
তুরস্কে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে বলেছি ওকে মালয়েশিয়াতে ভর্তি করাবো।
এরপর থেকে ও জেদ ধরেছিল ইস্তাম্বুলের টার্কি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করবে। এ
লেভেলের ইসলামিক দুটি সাবজেক্টে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। এসব নানা
কারণে তুরস্কে যায় সে। তিনি বলেন, আমার মেয়ে খুব একরোখা স্বভাবের। যা বলে
তাই করে ছাড়ে। কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। যে সাবজেক্টে পড়বে বলে সেই
সাবজেক্টেই পড়বে। আমার বাসার কাছেই লেট হেড গ্রামার স্কুলে ইংলিশ মিডিয়াম
স্কুলে পড়াশোনা করেছে। বৃটিশ কাউন্সিল থেকে দুটি সাবজেক্টে এ লেভেল দিয়েছে।
ওর বন্ধুদের থেকে এক বছর আগে পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছে। ও সবার থেকে এগিয়ে
থাকতে চায়। ওর এমবিশন ভিন্ন। আমার মেয়ের টার্গেট তুর্কি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
পড়ে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকাহ শাস্ত্রে পড়তে। আমার মেয়ে সব সময় বলে,
বাংলাদেশে মেয়েদের নামাজ কালাম হয় না। ফিকাহ শাস্ত্রে পড়াশোনা করে এসে এ
দেশে মেয়েদের নামাজ শেখাবে। আইএসের কর্মকাণ্ডকে আপনি বা আপনার পরিবার কি
চোখে দেখেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ অর্গানাইজেশন আমি বা আমার মেয়েও
পছন্দ করে না। তাদের কর্মকাণ্ড ইসলামবিরোধী বলে আমরা মনে করি। ইসলাম
শান্তির ধর্ম। ইসলামে এসব খোনাখুনি পারমিট করে না। তিনি বলেন, আমরা
স্বাধীনভাবে আমাদের ধর্ম পালন করতে পারছি। তাই এখানে আইএস বা অন্য কিছুতে
জড়ানোর সিচুয়েশন নেই। এ দেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। অন্য ধর্মের লোকদের প্রটেকশন
ইসলামে সবচেয়ে বেশি। ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। ডা.
ইসহাক বলেন, আমার বাসায় সিরাতের বইসহ অনেক ইসলামী বই রয়েছে। ছোটকাল থেকেই
আমার মেয়েকে ওইভাবেই ট্রেইন-আপ করেছি। মেয়ে আমাকে বলেছে, আমাদের দেশের
মানুষের রুকু-সিজদা হয় না। পরে বুখারি শরিফ পড়ে দেখেছি মেয়ের কথাই ঠিক।
অনর্থক এত দিন এ বিষয়ে তাকে বকাবকি করেছি। মেয়ের থেকে আমি ৫০ বছর ভুল নামাজ
পড়েছি। মেয়েই আমাকে শিখিয়েছে রুকু ও সিজদায় কতক্ষণ দাঁড়াতে হয়। কিভাবে
রুকু-সিজদা করতে হয়। তুরস্ক এয়ারপোর্টে আপনার মেয়েকে কি কি জিজ্ঞেস করেছে-
এমন প্রশ্নে বলেন, প্রথমেই বলেছে আব্বু-আম্মুকে না জানিয়ে তুমি কেন এসেছো?
তখন সে বলেছে, আব্বু-আম্মু আমাকে খুব বকাবকি করেছে। আমাকে টার্কিতে পড়াশোনা
করতে দেবে না। এ কারণে রাগ করে চলে এসেছি। ঢাকায় ফিরে আমাদের বলেছে,
তোমাদের দেখাতে গিয়েছি তোমরা না পড়ালেও আমি যে যেতে পারি। আসলে ২০-২৫টি
দেশে আমাদের সঙ্গে সে গিয়েছে। তাই একা যাওয়া কোন অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসের তরফ থেকে মাইরুনা সম্পর্কে আতাতুর্ক
বিমানবন্দরকে চরমপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে কেন জানানো হয়েছে- এমন প্রশ্নে
ডা. ইসহাক বলেন, মাইরুনা তুরস্কে যাওয়ার সময় আমার বন্ধু মেজর জেনারেল আবদুস
সালাম একই ফ্লাইটে ছিল। নিশ্চয়ই কোন ভাল কাজ করেছি। না হলে আমার বন্ধু একই
ফ্লাইটে থাকবে কেন? তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসের আর্মি অ্যাটাচি
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমার বন্ধু। তাই মেয়ের যাওয়ার পর সবার সঙ্গে আমার
যোগাযোগ রয়েছে। সালাম ভাইয়ের ওয়াইফ (ভাবী) সবাইকে ফোন করে বলেছে ইসহাক
ভাইয়ের মেয়ে বাড়ি থেকে রাগ করে চলে গেছে। এরপর এয়ারপোর্টে তাকে আটক করা হয়।
আসলে আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। এ কারণে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব
আছে। তারাই জানানোর বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছে। তুরস্ক থেকে ফেরত আসার পর তার
মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকালে আমার মেয়েকে দেখে মনে
হয়েছে, ওর আত্মহত্যা করার জোগাড়। একটি ইয়াং মেয়ে যা না তা যদি দেখে সবাই
তাকে তাই বানাচ্ছে তাহলে তো আত্মহত্যা করার জোগাড় হবেই। ওকে তো এখন পাহারা
দিয়ে রাখতে হচ্ছে। ওর মন এখন ভেঙে গেছে। এখন কি নিয়ে ব্যস্ত আছে? মেয়ের
বর্তমান কর্মকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ের টার্গেট এ দেশের
মেয়েদের হেদায়েত করবে। তার লক্ষ্য মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তারপর যা
করার করবে। এমনিতেও সে স্কুলে ফ্রি লেকচার দেয়। মানুষদের নামাজ কালাম
শেখায়। ওকে কয়েকটি স্কুল থেকে লেকচার দেয়ার অফারও দেয়া হয়। কিন্তু সে আমাকে
বলেছে আগে হেফজ করে নিই। প্রপার জিনিস শিখে সবকিছু ভাবনা-চিন্তা করা যাবে।
মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ডা. ইসহাক বলেন, মক্কা
ইউনিভার্সিটিতে মাহারামের জন্য দিতে পারি না। বাবা-মা বা স্বামী ছাড়া ওই
ইউনিভার্সিটিতে অ্যালাউ করা হয় না। কিন্তু ওখানে গিয়ে আমাদের থেকে পড়াশোনা
করানো সম্ভব নয়। মন ঠিক করে করবো। আমার বড় ভাইকে অ্যাকসেপ্ট করলে মক্কায়
দেবো। অন্যথায় ভাল ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবো। বিয়ে দিয়ে জামাইকে মাহারাম
বানিয়ে মক্কা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পাঠাবো। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার
মানবজমিনে ফারহিন মাইরুনা আইএসে যোগদান করতে তুরস্কে যায় বলে সংবাদ
প্রকাশিত হয়েছিল।
No comments