সরকারি বেতন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি বাড়বে কি? by ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রায়
১৩ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গ্রেডে প্রায় দ্বিগুণ এবং
অন্যান্য গ্রেডে বিভিন্ন অনুপাতে ৮৭ থেকে ১০১ শতাংশ পর্যন্ত বেতন
বাড়ানোর সুপারিশ-সংবলিত বেতন ও চাকরি কমিশনের রিপোর্ট গৃহীত হওয়ার পর
আগামী অর্থবছরের (২০১৫–১৬) প্রথম দিন থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে পরিবর্তিত
বেতনকাঠামো। উল্লেখ্য, নতুন বেতনকাঠামো কার্যকর করতে বেতন-ভাতা বাবদ
সরকারের ব্যয় বাড়বে ৬৪ শতাংশ। এই বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আশঙ্কার
সৃষ্টি হয়েছে যে এর ফলে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে কি না। কারণ, সরকার
ঘোষিত এই নতুন বেতনকাঠামোর উল্লম্ফনের ফলে একদিকে যেমন সরকারের ব্যয়
বেড়ে বাজারে সঞ্চারিত হবে নতুন অর্থ, তেমনি বেতন বৃদ্ধির খবরে বাড়িভাড়া
থেকে শুরু করে নানান মহলে শুরু হবে মূল্যবৃদ্ধির তোড়জোড়।
অতীতে বিভিন্ন বেতন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর থেকেই এ-জাতীয় প্রবণতা দেখা গেছে। হয়তো যদিও সেসব বাজার প্রতিক্রিয়া খুব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী হয়নি। কিন্তু সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমে চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির কোনো অর্থনৈতিক বা মুদ্রানৈতিক ফলাফল নেই—সে কথাও খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্তমান বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, আর নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন করার পর এই ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে আরও ২৬ হাজার কোটি টাকা। কেবল সরকারি খাত থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা এক বছরে বাজারে যুক্ত হলে তার কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটবে না, সেটি আশা করা যায় না।
আমরা সবাই জানি, মুদ্রাস্ফীতির বহুবিধ কারণের পেছনে সরকারের খরচ বৃদ্ধি, নতুন টাকা ছাপানো—এসবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বর্ণমানের বিপরীতে টাকা ইস্যু করার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার ফলে টাকা ছেপে সরকারের ব্যয় নির্বাহ করার সুযোগটা অবারিত হয়ে যায়। কারণ, স্বর্ণমান বজায় রেখে টাকা ছাপানোর পদ্ধতি চালু থাকা অবস্থায় সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ সরবরাহ করার স্বাধীনতা থাকে না। সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাই স্বর্ণমান মুদ্রা ব্যবস্থার অধীনে বাজারে চালু করা কাগজের মুদ্রার বিপরীতে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমপরিমাণ স্বর্ণ মজুত রাখার নিশ্চয়তা দিত। তখন বাজারে সঞ্চালিত মুদ্রার পরিমাণ নির্ভর করত দেশে বিদ্যমান স্বর্ণ এবং পরবর্তীকালে রৌপ্যের পরিমাণের ওপর। ফলে যথেষ্ট স্বর্ণ বা রৌপ্যের মজুত না থাকলে সরকারের পেÿক্ষ টাকা ছাপানো সম্ভব হতো না।
স্বর্ণমানের কথা উঠলই যখন, তার পেছনের কথাটাও পাঠকের জানা উচিত। প্রাচীনকালে মানুষ নিরাপত্তার জন্য তাদের স্বর্ণ এবং স্বর্ণমুদ্রা গচ্ছিত রাখত স্বর্ণকারদের কাছে। বিনিময়ে স্বর্ণকারেরা একটা নির্দিষ্ট হারে ফি আদায় করে জমাদানকারীকে একটা রসিদ দিত, যাতে জমাকারীরা প্রয়োজনমতো তাদের গচ্ছিত সম্পদ ফিরিয়ে নিতে পারে। এই রসিদের নির্ভরযোগ্যতার কারণে এটিকেই মানুষ টাকার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় কাগজের মুদ্রার প্রচলন। কাগজের মুদ্রার ওপর ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ৫০, ১০০, ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে’ লেখা অঙ্গীকারের প্রচলনও শুরু হয় এভাবে। অর্থাৎ এই রসিদটির বাহককে সমপরিমাণ স্বর্ণ দিতে বাধ্য থাকার অঙ্গীকার ছিল এটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের ধাক্কায় এক দেশের মুদ্রাকে অন্য দেশের মুদ্রায় বিনিময় করার পদ্ধতি চালু হলে স্বর্ণমান সংরক্ষণ করার বিষয়টি আর মুখ্য থাকে না। ঠিক এ সময় মার্কিন ডলার বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে উঠে আসে। অবশেষে ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্বর্ণমান সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতার বিষয়টির অবসান ঘটে। অনেক অর্থনীতিবিদ মুদ্রাস্ফীতির জন্য কাগজের মুদ্রা ছাপানোর অবিমৃশ্যকারিতাকে দায়ী করলেও বিপরীতভাবে অনেকেই অভিযোগ করেন যে ১৯২৯ সালের মহামন্দার জন্য মূলত দায়ী ছিল কঠোর স্বর্ণমান বজায় রাখার পদ্ধতি। কারণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার জন্য সামান্য মাত্রার মুদ্রা সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করা দোষের কিছু নয়। অথচ সেই মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে সরকারি ঘাটতিকে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যখন প্রাণের স্পন্দন আনার জন্য প্রয়োজন ছিল মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ কঠোরভাবে স্বর্ণমান বজায় রাখছিল বলে অর্থনীতি মন্দা থেকে উঠে আসার জন্য সরকার কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে পারেনি। অন্যদিকে ১৯২০-এর দশকে অর্থনীতিবিদ কেইনস এই স্বর্ণমানের বিরোধিতা করলেও ব্রিটিশ সরকার তাঁর নীতি থেকে সরে আসেনি, ফলে ব্রিটিশ অর্থনীতিতেও নেমে আসে অর্থনৈতিক দুর্যোগ ও বেকারত্ব।
অতএব বোঝা যায়, কাগজের মুদ্রা ছাপানোর প্রবণতায় বাজারে অর্থ এবং ঋণের সরবরাহ বেড়ে গেলে তার বিপরীতে পণ্য ও সেবার সরবরাহ আনুপাতিক হারে না বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। মুদ্রাস্ফীতির প্রধানতম কুফল হচ্ছে পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি। কারণ, বাজারে অর্থের সরবরাহ বেড়ে গেলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, ফলে যে পরিমাণ পণ্য আগে যত টাকা দিয়ে কেনা যেত, সেই পরিমাণ পণ্য কিনতে এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। সরকার যখন বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, তখন ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটে। ফলে বাজারে সরবরাহকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে গেলেও সেই বাড়তি টাকা দিয়ে আনুপাতিক হারে বাড়তি সেবা বা পণ্য কেনা সম্ভব হয় না, কারণ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। অর্থাৎ একই পরিমাণ সেবা ও পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। এই সেবা ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধিই বাজারে বাড়তি অর্থ সরবরাহের সরাসরি প্রতিক্রিয়া।
সাধারণভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। কোনো পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের অসামঞ্জস্যতার কারণে সেটির মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে, তবে তা মুদ্রাস্ফীতি নয়। কোনো কারণে খাদ্যমূল্য কিংবা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বটে, যাকে মূল্যস্ফীতি বলা যেতে পারে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি নয়। শেষোক্তটি ঘটে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি এবং তার কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণে।
বেতন ও চাকরি কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে কি না, এই বিতর্কে সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে। সংবাদ সংস্থার খবরে জানা যায় তিনি পর্যায়ক্রমে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির পক্ষে, যাতে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিতে তেমন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে না। তিনি বলেছেন, পাঁচ বছর পরপর সরকারি বেতন বৃদ্ধি করা হয়। এবারের বেতন বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিষয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে, তার ফলাফল অতি নগণ্য। তিনি সরকারি কর্মচারীদের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং অতীত প্রবণতার দিকে নজর রাখতে বলেছেন। আমাদের অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যে, একসময় বাংলাদেশে অর্থ ও পরিকল্পনা নামের একটিই মন্ত্রণালয় ছিল, ফলে অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন একজনই। এখন অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর বিপরীতমুখী ভাষ্য দেখে কৌতূহল জাগে এই দুটি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে থাকলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসেবে মন্ত্রী কী বলতেন?
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবও কার্যকর হতে যাচ্ছে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে। এ কারণে ভারতীয় অর্থনীতিবিদেরা আগাম পূর্বাভাস করছেন এক ধাপ মুদ্রাস্ফীতির।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বেতন বৃদ্ধির ফলে কোনো মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা করছে না। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে (জানুয়ারি—জুন ২০১৫) আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে প্রস্তাবিত নতুন বেতনকাঠামোর কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে না। দেখানো হয়েছে অতীতের বিভিন্ন পে–স্কেল বাস্তবায়নের কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতি ঘটেনি, যদিও পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম পে–স্কেল বাস্তবায়নের পর মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল, কিন্তু তার কোনোটিই বাড়তি বেতনের জন্য নয়, বরং তা ঘটেছিল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি, ঋণ সম্প্রসারণ, সরকারের অত্যধিক ঋণ গ্রহণ এবং টাকার অবমূল্যায়নের ফলে। অতএব অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এই আশাবাদ সফল হতে পারে যদি সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে এই বাড়তি খরচের জোগান দিতে পারে। কিন্তু যদি নতুন মুদ্রা ছেপে কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এই খরচ মেটানো হয়, তাহলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে অবশ্যম্ভাবী মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে।
সরকার কেবল তার ১৩ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবছে, কিন্তু নতুন সরকারি বেতনকাঠামো বাস্তবায়িত হলে আধা সরকারি, বেসরকারিসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বেতন বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে, ফলে বাজারে সঞ্চারিত বাড়তি অর্থের সরবরাহ সরকারি পূর্বাভাস ছাড়িয়ে যেতে পারে, এবং তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা বা হিসাব করা হয়েছে কি না, জানা যায় না। এমনকি বিভিন্ন সেক্টরে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দানা বাঁধতে পারে আন্দোলন, যার রাজনৈতিক তাৎপর্যও অস্বীকার করা যায় না।
তাই এ বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সর্বক্ষেত্রে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম হাতছাড়া হয়ে না যায়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কেবল সরকারি কর্মচারীদের তুষ্টির চেয়ে বেশি প্রয়োজন বেতনবহির্ভূত জনগণের স্বস্তি, যা বিগত কয়েক বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
অতীতে বিভিন্ন বেতন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর থেকেই এ-জাতীয় প্রবণতা দেখা গেছে। হয়তো যদিও সেসব বাজার প্রতিক্রিয়া খুব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী হয়নি। কিন্তু সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমে চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির কোনো অর্থনৈতিক বা মুদ্রানৈতিক ফলাফল নেই—সে কথাও খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্তমান বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, আর নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন করার পর এই ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে আরও ২৬ হাজার কোটি টাকা। কেবল সরকারি খাত থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা এক বছরে বাজারে যুক্ত হলে তার কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটবে না, সেটি আশা করা যায় না।
আমরা সবাই জানি, মুদ্রাস্ফীতির বহুবিধ কারণের পেছনে সরকারের খরচ বৃদ্ধি, নতুন টাকা ছাপানো—এসবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বর্ণমানের বিপরীতে টাকা ইস্যু করার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার ফলে টাকা ছেপে সরকারের ব্যয় নির্বাহ করার সুযোগটা অবারিত হয়ে যায়। কারণ, স্বর্ণমান বজায় রেখে টাকা ছাপানোর পদ্ধতি চালু থাকা অবস্থায় সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ সরবরাহ করার স্বাধীনতা থাকে না। সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাই স্বর্ণমান মুদ্রা ব্যবস্থার অধীনে বাজারে চালু করা কাগজের মুদ্রার বিপরীতে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমপরিমাণ স্বর্ণ মজুত রাখার নিশ্চয়তা দিত। তখন বাজারে সঞ্চালিত মুদ্রার পরিমাণ নির্ভর করত দেশে বিদ্যমান স্বর্ণ এবং পরবর্তীকালে রৌপ্যের পরিমাণের ওপর। ফলে যথেষ্ট স্বর্ণ বা রৌপ্যের মজুত না থাকলে সরকারের পেÿক্ষ টাকা ছাপানো সম্ভব হতো না।
স্বর্ণমানের কথা উঠলই যখন, তার পেছনের কথাটাও পাঠকের জানা উচিত। প্রাচীনকালে মানুষ নিরাপত্তার জন্য তাদের স্বর্ণ এবং স্বর্ণমুদ্রা গচ্ছিত রাখত স্বর্ণকারদের কাছে। বিনিময়ে স্বর্ণকারেরা একটা নির্দিষ্ট হারে ফি আদায় করে জমাদানকারীকে একটা রসিদ দিত, যাতে জমাকারীরা প্রয়োজনমতো তাদের গচ্ছিত সম্পদ ফিরিয়ে নিতে পারে। এই রসিদের নির্ভরযোগ্যতার কারণে এটিকেই মানুষ টাকার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় কাগজের মুদ্রার প্রচলন। কাগজের মুদ্রার ওপর ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে ৫০, ১০০, ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে’ লেখা অঙ্গীকারের প্রচলনও শুরু হয় এভাবে। অর্থাৎ এই রসিদটির বাহককে সমপরিমাণ স্বর্ণ দিতে বাধ্য থাকার অঙ্গীকার ছিল এটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের ধাক্কায় এক দেশের মুদ্রাকে অন্য দেশের মুদ্রায় বিনিময় করার পদ্ধতি চালু হলে স্বর্ণমান সংরক্ষণ করার বিষয়টি আর মুখ্য থাকে না। ঠিক এ সময় মার্কিন ডলার বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে উঠে আসে। অবশেষে ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্বর্ণমান সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতার বিষয়টির অবসান ঘটে। অনেক অর্থনীতিবিদ মুদ্রাস্ফীতির জন্য কাগজের মুদ্রা ছাপানোর অবিমৃশ্যকারিতাকে দায়ী করলেও বিপরীতভাবে অনেকেই অভিযোগ করেন যে ১৯২৯ সালের মহামন্দার জন্য মূলত দায়ী ছিল কঠোর স্বর্ণমান বজায় রাখার পদ্ধতি। কারণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখার জন্য সামান্য মাত্রার মুদ্রা সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করা দোষের কিছু নয়। অথচ সেই মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে সরকারি ঘাটতিকে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য যখন প্রাণের স্পন্দন আনার জন্য প্রয়োজন ছিল মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ কঠোরভাবে স্বর্ণমান বজায় রাখছিল বলে অর্থনীতি মন্দা থেকে উঠে আসার জন্য সরকার কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে পারেনি। অন্যদিকে ১৯২০-এর দশকে অর্থনীতিবিদ কেইনস এই স্বর্ণমানের বিরোধিতা করলেও ব্রিটিশ সরকার তাঁর নীতি থেকে সরে আসেনি, ফলে ব্রিটিশ অর্থনীতিতেও নেমে আসে অর্থনৈতিক দুর্যোগ ও বেকারত্ব।
অতএব বোঝা যায়, কাগজের মুদ্রা ছাপানোর প্রবণতায় বাজারে অর্থ এবং ঋণের সরবরাহ বেড়ে গেলে তার বিপরীতে পণ্য ও সেবার সরবরাহ আনুপাতিক হারে না বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। মুদ্রাস্ফীতির প্রধানতম কুফল হচ্ছে পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি। কারণ, বাজারে অর্থের সরবরাহ বেড়ে গেলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, ফলে যে পরিমাণ পণ্য আগে যত টাকা দিয়ে কেনা যেত, সেই পরিমাণ পণ্য কিনতে এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। সরকার যখন বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, তখন ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটে। ফলে বাজারে সরবরাহকৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে গেলেও সেই বাড়তি টাকা দিয়ে আনুপাতিক হারে বাড়তি সেবা বা পণ্য কেনা সম্ভব হয় না, কারণ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। অর্থাৎ একই পরিমাণ সেবা ও পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। এই সেবা ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধিই বাজারে বাড়তি অর্থ সরবরাহের সরাসরি প্রতিক্রিয়া।
সাধারণভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। কোনো পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের অসামঞ্জস্যতার কারণে সেটির মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে, তবে তা মুদ্রাস্ফীতি নয়। কোনো কারণে খাদ্যমূল্য কিংবা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বটে, যাকে মূল্যস্ফীতি বলা যেতে পারে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি নয়। শেষোক্তটি ঘটে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি এবং তার কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণে।
বেতন ও চাকরি কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে কি না, এই বিতর্কে সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে। সংবাদ সংস্থার খবরে জানা যায় তিনি পর্যায়ক্রমে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির পক্ষে, যাতে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিতে তেমন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে না। তিনি বলেছেন, পাঁচ বছর পরপর সরকারি বেতন বৃদ্ধি করা হয়। এবারের বেতন বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিষয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে, তার ফলাফল অতি নগণ্য। তিনি সরকারি কর্মচারীদের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং অতীত প্রবণতার দিকে নজর রাখতে বলেছেন। আমাদের অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যে, একসময় বাংলাদেশে অর্থ ও পরিকল্পনা নামের একটিই মন্ত্রণালয় ছিল, ফলে অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক মন্ত্রীও ছিলেন একজনই। এখন অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর বিপরীতমুখী ভাষ্য দেখে কৌতূহল জাগে এই দুটি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে থাকলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসেবে মন্ত্রী কী বলতেন?
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবও কার্যকর হতে যাচ্ছে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে। এ কারণে ভারতীয় অর্থনীতিবিদেরা আগাম পূর্বাভাস করছেন এক ধাপ মুদ্রাস্ফীতির।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বেতন বৃদ্ধির ফলে কোনো মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা করছে না। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে (জানুয়ারি—জুন ২০১৫) আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে প্রস্তাবিত নতুন বেতনকাঠামোর কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে না। দেখানো হয়েছে অতীতের বিভিন্ন পে–স্কেল বাস্তবায়নের কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতি ঘটেনি, যদিও পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম পে–স্কেল বাস্তবায়নের পর মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল, কিন্তু তার কোনোটিই বাড়তি বেতনের জন্য নয়, বরং তা ঘটেছিল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি, ঋণ সম্প্রসারণ, সরকারের অত্যধিক ঋণ গ্রহণ এবং টাকার অবমূল্যায়নের ফলে। অতএব অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এই আশাবাদ সফল হতে পারে যদি সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে এই বাড়তি খরচের জোগান দিতে পারে। কিন্তু যদি নতুন মুদ্রা ছেপে কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এই খরচ মেটানো হয়, তাহলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে অবশ্যম্ভাবী মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে।
সরকার কেবল তার ১৩ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবছে, কিন্তু নতুন সরকারি বেতনকাঠামো বাস্তবায়িত হলে আধা সরকারি, বেসরকারিসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বেতন বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে, ফলে বাজারে সঞ্চারিত বাড়তি অর্থের সরবরাহ সরকারি পূর্বাভাস ছাড়িয়ে যেতে পারে, এবং তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা বা হিসাব করা হয়েছে কি না, জানা যায় না। এমনকি বিভিন্ন সেক্টরে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দানা বাঁধতে পারে আন্দোলন, যার রাজনৈতিক তাৎপর্যও অস্বীকার করা যায় না।
তাই এ বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সর্বক্ষেত্রে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম হাতছাড়া হয়ে না যায়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কেবল সরকারি কর্মচারীদের তুষ্টির চেয়ে বেশি প্রয়োজন বেতনবহির্ভূত জনগণের স্বস্তি, যা বিগত কয়েক বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
No comments