পাখির নাম ষষ্ঠিনী by শরীফ খান
সেই ষষ্ঠিনী পাখিটি l ছবি: লেখক |
৪০
বছর পরে দেখলাম এ রকম আশ্চর্য দৃশ্যটি—এক জোড়া পাতিশিয়াল অর্ধভুক্ত একটি
মহিষের বাচ্চা প্রাণপণে টেনে নিয়ে তুলে ফেলতে চাইছে একটা ঝোপের ভেতরে।
পাঁচটি শকুন গোগ্রাসে খেয়ে নিচ্ছে মাংস—দুই পক্ষের মধ্যে একটা টানাটানির
প্রতিযোগিতাও চলছে, শিয়াল দুটি চাইছে মড়িটা ঝোপের ভেতরে নিয়ে আরামসে
খাবে, শকুনরা তা নিতে দেবে না।
দৃশ্যটি দেখলাম এপ্রিলের (২০১৫) দ্বিতীয় সপ্তাহে। গ্রামে ছিলাম। কেউ একজন এসে খবর দিল—খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার একটা গ্রামে ছয়-সাতটি শকুন সে গাছে বসে থাকতে দেখেছে, সঙ্গে একটা মোরগশকুনও আছে। মাথায় আমার চক্কর। মরা পশর নদ থেকে কয়েক কিলোমিটার মাত্র এদিকে—ওই তল্লাটেই সর্বশেষ একটি মোরগশকুন দেখেছিলাম আমরা ১৯৭৮ সালের এক হেমন্ত সকালে। অতএব, মোটেও দেরি না করে দুটি মোটরসাইকেলে চড়ে চারজন আমরা তখনই রওনা হলাম। নির্দিষ্ট গ্রাম পর্যন্ত মোটরসাইকেল গেল না। অতএব, হাঁটা। না, সে গাছে শকুন নেই। ঘণ্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে হতাশ হলাম। বেলা পড়ে আসছে। ফেরার পথেই দেখলাম ৪০ বছর আগে দেখা দৃশ্যের একটা খণ্ডাংশ। চোখ জুড়িয়ে গেল, মনপ্রাণ ভরে গেল একটা অনাবিল আনন্দে। হয়তোবা ওই শকুনগুলোই। কিন্তু মোরগশকুন বা রাজশকুন কই!
ফিরতি পথ ধরলাম। ছোট একটা বিল যখন পাশ কাটিয়ে আসছি আমরা, তখন একটা জায়গায় জনা কয়েক শিশু-কিশোরকে দেখলাম—যাদের হাতে পাখি। বাবুই-চড়ুই হবে ভেবেও এগোলাম আমরা। ওদের হাতে দুটো ষষ্ঠিনী পাখি, একটি বই পাখি ও একটি ভুতুমে চ্যাগা। ছোট জাল পেতে আটকিয়েছে ওরা। বাড়ি নিয়ে মাংস খাবে। আমরা ওদেরকে বার্ড ফ্লুর ভয় দিলাম। ওদের মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে (বাচ্চা) এই পাখিদের বাসায় আছে, মাকে না পেলে বাচ্চাদের কী হবে, ওদের যদি বাবা-মা না থাকে, তাহলে কেমন কষ্ট হবে—ইত্যাকার বোঝানোর পরে ওরা পাখিগুলো আমাদের হাতে দিয়েই দিল। বার্ড ফ্লুর ভয়ে একটি ছেলে তাড়াতাড়ি পাখি দিতে গিয়ে একটি ষষ্ঠিনীকে উড়িয়েই দিল।
ষষ্ঠিনী! এই নামটি আমি জীবনে প্রথম শুনলাম। ফকিরহাট-চিতলমারী-মোল্লাহাটের বেশ কজন বয়সী মানুষও আমাকে ষষ্ঠিনী নামটি বললেন। এক ব্রাহ্মণ তো ব্যাখ্যাই দিয়ে ফেললেন এক কাপ চায়ের বিনিময়ে, এই পাখিটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুবই প্রবল-প্রখর। যেসব মা সন্তানের জন্য খুবই কষ্ট করেন, সন্তানদের দেখেশুনে রাখেন সতর্কভাবে—এরাই ষষ্ঠিনী। তা ছাড়া ‘সাষ্টাঙ্গ প্রণাম’ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, এই পাখি নাকি তাই করে। অন্য কজন বললেন, শারদীয় দুর্গাপূজার শুরুতে দেবীকে ধরাধামে আগমনের আমন্ত্রণ জানিয়ে বেল বা অশ্বত্থতলায় যে ষষ্ঠীপূজার আয়োজন করা হয়, তখন এই পাখিকে দেখা যায়। এভাবেও হতে পারে নামটা, কিংবা জামাইষষ্ঠীর সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। সত্যি-মিথ্যা যা-ই হোক, বিষয়টি দারুণ উপভোগ্য হলো আমার কাছে।
ষষ্ঠিনীর কেতাবি নাম মাঠচড়াই। ইংরেজি নাম Tawny pipit। বৈজ্ঞানিক নাম Anthus campestris। মোট মাপ ১৬ সেন্টিমিটার। শুধু লেজটাই ৭ সেন্টিমিটার। ছোট পাখি। শুকনো মাঠে, নদীর ঘাটে, পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে হেঁটে খাবার খায়। মূল খাদ্য ছোট ছোট পোকা-পতঙ্গ-কীট ও নানান ধরনের বীজ। তাল-খেজুরের রস পান করে, সুযোগ পেলে বড় বড় ফুলের রেণু-মধুও খায়। কর্মচঞ্চল-চতুর-বুদ্ধিমান ও কুশলী পাখি। সমগোত্রীয় অন্য পাখিদের সঙ্গে দলেও চরে। কণ্ঠস্বর মিষ্টি-সুরেলা, মোলায়েম-ধাতব। রাতের আশ্রয় নেয় এরা শেওড়াগাছ-আখখেত, পানের বরজসহ অন্যান্য ঘন পাতাওয়ালা গাছে।
একনজরে বালু-মাটি আর বাদামি বড় ছোপওয়ালা পিঠ ও লেজের উপরিভাগটা, বুক-পেট মেটে-ধূসর-ফিকে। লেজের প্রান্তের পালক মেটে-সাদাটে। চোখের ওপর দিয়ে ঘাড়ের দিকে চওড়া সাদাটে একটা টান বয়ে গেছে। বুজানো অবস্থায় দুই ডানার প্রান্তদেশে ছয়টি কালো ঝুঁটি দেখা যায়। ঠোঁট হলুদাভ ধূসর। পা হলুদাভ। আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখি এরা। ওজন হবে ১৫-২০ গ্রাম। তবু চড়ে যায় রান্নার হাঁড়িতে! তাহলে বড়দের অবস্থাটা কী?
দৃশ্যটি দেখলাম এপ্রিলের (২০১৫) দ্বিতীয় সপ্তাহে। গ্রামে ছিলাম। কেউ একজন এসে খবর দিল—খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার একটা গ্রামে ছয়-সাতটি শকুন সে গাছে বসে থাকতে দেখেছে, সঙ্গে একটা মোরগশকুনও আছে। মাথায় আমার চক্কর। মরা পশর নদ থেকে কয়েক কিলোমিটার মাত্র এদিকে—ওই তল্লাটেই সর্বশেষ একটি মোরগশকুন দেখেছিলাম আমরা ১৯৭৮ সালের এক হেমন্ত সকালে। অতএব, মোটেও দেরি না করে দুটি মোটরসাইকেলে চড়ে চারজন আমরা তখনই রওনা হলাম। নির্দিষ্ট গ্রাম পর্যন্ত মোটরসাইকেল গেল না। অতএব, হাঁটা। না, সে গাছে শকুন নেই। ঘণ্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে হতাশ হলাম। বেলা পড়ে আসছে। ফেরার পথেই দেখলাম ৪০ বছর আগে দেখা দৃশ্যের একটা খণ্ডাংশ। চোখ জুড়িয়ে গেল, মনপ্রাণ ভরে গেল একটা অনাবিল আনন্দে। হয়তোবা ওই শকুনগুলোই। কিন্তু মোরগশকুন বা রাজশকুন কই!
ফিরতি পথ ধরলাম। ছোট একটা বিল যখন পাশ কাটিয়ে আসছি আমরা, তখন একটা জায়গায় জনা কয়েক শিশু-কিশোরকে দেখলাম—যাদের হাতে পাখি। বাবুই-চড়ুই হবে ভেবেও এগোলাম আমরা। ওদের হাতে দুটো ষষ্ঠিনী পাখি, একটি বই পাখি ও একটি ভুতুমে চ্যাগা। ছোট জাল পেতে আটকিয়েছে ওরা। বাড়ি নিয়ে মাংস খাবে। আমরা ওদেরকে বার্ড ফ্লুর ভয় দিলাম। ওদের মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে (বাচ্চা) এই পাখিদের বাসায় আছে, মাকে না পেলে বাচ্চাদের কী হবে, ওদের যদি বাবা-মা না থাকে, তাহলে কেমন কষ্ট হবে—ইত্যাকার বোঝানোর পরে ওরা পাখিগুলো আমাদের হাতে দিয়েই দিল। বার্ড ফ্লুর ভয়ে একটি ছেলে তাড়াতাড়ি পাখি দিতে গিয়ে একটি ষষ্ঠিনীকে উড়িয়েই দিল।
ষষ্ঠিনী! এই নামটি আমি জীবনে প্রথম শুনলাম। ফকিরহাট-চিতলমারী-মোল্লাহাটের বেশ কজন বয়সী মানুষও আমাকে ষষ্ঠিনী নামটি বললেন। এক ব্রাহ্মণ তো ব্যাখ্যাই দিয়ে ফেললেন এক কাপ চায়ের বিনিময়ে, এই পাখিটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুবই প্রবল-প্রখর। যেসব মা সন্তানের জন্য খুবই কষ্ট করেন, সন্তানদের দেখেশুনে রাখেন সতর্কভাবে—এরাই ষষ্ঠিনী। তা ছাড়া ‘সাষ্টাঙ্গ প্রণাম’ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, এই পাখি নাকি তাই করে। অন্য কজন বললেন, শারদীয় দুর্গাপূজার শুরুতে দেবীকে ধরাধামে আগমনের আমন্ত্রণ জানিয়ে বেল বা অশ্বত্থতলায় যে ষষ্ঠীপূজার আয়োজন করা হয়, তখন এই পাখিকে দেখা যায়। এভাবেও হতে পারে নামটা, কিংবা জামাইষষ্ঠীর সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। সত্যি-মিথ্যা যা-ই হোক, বিষয়টি দারুণ উপভোগ্য হলো আমার কাছে।
ষষ্ঠিনীর কেতাবি নাম মাঠচড়াই। ইংরেজি নাম Tawny pipit। বৈজ্ঞানিক নাম Anthus campestris। মোট মাপ ১৬ সেন্টিমিটার। শুধু লেজটাই ৭ সেন্টিমিটার। ছোট পাখি। শুকনো মাঠে, নদীর ঘাটে, পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে হেঁটে খাবার খায়। মূল খাদ্য ছোট ছোট পোকা-পতঙ্গ-কীট ও নানান ধরনের বীজ। তাল-খেজুরের রস পান করে, সুযোগ পেলে বড় বড় ফুলের রেণু-মধুও খায়। কর্মচঞ্চল-চতুর-বুদ্ধিমান ও কুশলী পাখি। সমগোত্রীয় অন্য পাখিদের সঙ্গে দলেও চরে। কণ্ঠস্বর মিষ্টি-সুরেলা, মোলায়েম-ধাতব। রাতের আশ্রয় নেয় এরা শেওড়াগাছ-আখখেত, পানের বরজসহ অন্যান্য ঘন পাতাওয়ালা গাছে।
একনজরে বালু-মাটি আর বাদামি বড় ছোপওয়ালা পিঠ ও লেজের উপরিভাগটা, বুক-পেট মেটে-ধূসর-ফিকে। লেজের প্রান্তের পালক মেটে-সাদাটে। চোখের ওপর দিয়ে ঘাড়ের দিকে চওড়া সাদাটে একটা টান বয়ে গেছে। বুজানো অবস্থায় দুই ডানার প্রান্তদেশে ছয়টি কালো ঝুঁটি দেখা যায়। ঠোঁট হলুদাভ ধূসর। পা হলুদাভ। আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখি এরা। ওজন হবে ১৫-২০ গ্রাম। তবু চড়ে যায় রান্নার হাঁড়িতে! তাহলে বড়দের অবস্থাটা কী?
No comments