কে জিতবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে by আসিফ নজরুল
বাংলাদেশে
রাজনৈতিক দলগুলোর মৃত্যু ঘোষণার একটি প্রবণতা আছে। পঁচাত্তরের পর বহুবার
শোনা গেছে যে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আরেকটু ভদ্র যাঁরা, তাঁরা
বলতেন আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগ হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ কখনোই তা হয়নি। বরং
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গ্রহণের পর দলটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছিল, ২০০৯ সালে
গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনে নজিরবিহীন বিশাল বিজয় অর্জন করেছিল। পরের দিকে
এই প্রবণতার শিকার হয়েছে বিএনপি। ১৯৯৪ সালে মাগুরার কুখ্যাত উপনির্বাচন
করার পর বিএনপির রাজনৈতিক মৃত্যু ঘোষিত হয়েছে বারবার। অতিসম্প্রতি ২০১৩-১৪
সালে গণজাগরণ মঞ্চের জোয়ারকালীন বিএনপি কেন এই মঞ্চে শামিল হয়নি, এ নিয়ে
প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। গণমাধ্যমে রাজনীতিবিদেরা তো বটেই, বহু বিশ্লেষক
এমন মন্তব্যও করেছেন যে বিএনপি এ কারণে জনগণের মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অথচ ঠিক সেই সময়েই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দেখা যায় সম্পূর্ণ উল্টো
চিত্র। বিএনপি একের পর এক নির্বাচনে বিজয়ী হতে থাকে, এমনকি আওয়ামী লীগের
একচেটিয়া বিজয়ের অঞ্চল গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তারা বিরাট
ব্যবধানে বিজয়ী হয় ২০১৩ সালে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার পর দলটির আরেক দফা সমালোচনায় মেতে ওঠে গণমাধ্যমের একটি অংশ। বিএনপি বিলুপ্ত হওয়ার পথে—এমন কথা তখনো শোনা যায়। এমন অবস্থায় বিএনপি আবারও ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী হয়। পরবর্তী ধাপগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিএনপি পরাজিত হলেও এসব নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয় বলে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে।
এ বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে না দেওয়ার পর থেকে বিএনপি টানা অবরোধ ও হরতাল পালন করে। এতে পেট্রলবোমাসহ নানা নাশকতায় বহু মানুষের ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। যথেষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই এই মৃত্যুর দায়ভার সরকারের লোকজন এবং সরকারের বিভিন্ন সুবিধাভোগী ব্যক্তি পুরোপুরিভাবে বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে: নাশকতার কারণে বিএনপিকে আর ভোট দেবে না মানুষ, বিলুপ্তির পথে রয়েছে এখন বিএনপি।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের একটি বিশাল অংশের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে বিএনপিবিরোধী এই প্রচারণা হয়তো প্রভাবিত করেছে কিছু কিছু মানুষকে। কয়েক দিন আগে একজন প্রখ্যাত আইনজীবীকে প্রথম আলোয় ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখলাম যে চট্টগ্রামে বিএনপি বিজয়ী হবে, ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনেই জিতবে আওয়ামী লীগ। কেন তাঁর এ ধারণা হলো, এর কোনো ব্যাখ্যা ছিল না সেখানে। তবে সরকারের লোকজনের যেসব বক্তব্য শোনা যায় আজকাল, তাতে মনে হয় তাঁদের ধারণা, বিএনপির পেট্রলবোমার কারণেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতে যাবে আওয়ামী লীগ!
২...
আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর এমন কিছু করেনি, যাতে তারা মানুষের মন জয় করতে পারে। বরং এ সময়ে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং সাধারণ মানুষের হয়রানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণ ও সরকারি নেতাদের লাগামহীন কথাবার্তা অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ডিজিটালাইজেশনের কিছুটা অগ্রগতি ছাড়া ঢাকা বা চট্টগ্রামে নাগরিক সুবিধারও কোনো উন্নতি হয়নি, বরং জনপরিবহন ও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মোট কথা, আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনায় মুগ্ধ হয়ে ভাসমান ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন ভাবার মতো জোরালো কোনো কারণ ঘটেনি দেশে।
সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের জেতার তাই মূল অস্ত্র বা সম্বল হতে পারে পেট্রলবোমার ঘটনায় বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ ভোটারদের নেগেটিভ ভোট। তবে আমার ধারণা, এ ক্ষেত্রে পেট্রলবোমা-সংক্রান্ত প্রচারণার প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করে ভাবা হচ্ছে। প্রথমত, এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে (কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোকজনের বিরুদ্ধেও যে অভিযোগ উঠেছে) গ্রেপ্তারকৃতরা বিএনপি-জামায়াতের লোক হলেও তাঁদের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেক মানুষই সন্দেহ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত একটি ঘটনায়ও পুলিশ কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তকাজ সম্পন্ন করেনি, যাতে এসব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সাধারণ মানুষের সন্দেহ দূরীভূত হতে পারে।
পেট্রলবোমার কারণে তাই লোকে বিএনপির বদলে দলে দলে এসে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা সঠিক ভাবছেন বলে আমার মনে হয় না। অতীতে জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে দোদুল্যমানতা, নির্বাচন বর্জন বা নাশকতা ইস্যুতে ভোটাররা বিএনপিকে বর্জন করবে বলে যেসব বিশ্লেষণ ছিল, তা অনেকাংশে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এবারও তা-ই হতে পারে। তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিএনপি বরং সিটি করপোরেশনে জিততে পারে চিরন্তন অ্যান্টি-এনকাম্বেন্সি (যেকোনো সরকারের প্রতি জনগণের চিরন্তন ক্ষোভ ও হতাশা) ভোটের কারণে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন হয়েছে ওপরের নির্দেশে। আনিসুল হকের পক্ষে কামাল মজুমদার বা সাঈদ খোকনের পক্ষে হাজি সেলিম ইচ্ছা করে বসে যাননি। আনিসুল হক আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাইরের মানুষ বলে ঢাকা উত্তরের বহু ছোট-বড় নেতার তাঁর পক্ষে কাজ করতে অনীহ থাকতে পারেন, ঢাকা দক্ষিণের কিছু অঞ্চলে হাজি সেলিম খুবই প্রভাবশালী। বলে তাঁর লোকজন একই ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। এমন কোন্দলের সুবিধা বিএনপি কীভাবে পায়, তার বহু নজির সাম্প্রতিক কালের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে রয়েছে।
৩...
আওয়ামী লীগের জেতার সম্ভাবনা তাই বলে একেবারে নেই, তা নয়। বিএনপির অপ্রস্তুতি বা বিএনপির প্রার্থীর দোদুল্যমানতার কারণে আওয়ামী লীগ জিততে পারে। তবে তার সম্ভাবনা কম।
আবার আওয়ামী লীগ জিততে পারে অন্যভাবেও। সেটি হচ্ছে কারচুপি, অত্যাচার ও অবিচার করে। আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন আয়োজনে সৎ ও নিরপেক্ষ থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ করার মতো কিছু কারণ ইতিমধ্যে ঘটেছে। যেভাবে সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেভাবে নির্বাচন কমিশন পুলিশের আইজির পরামর্শে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছে, যেভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির পক্ষের দাবিগুলোকে নাকচ করেছেন, যেভাবে আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী হতে পারেন, এটি ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যমুনা রিসোর্টের ইজারা বাতিল করা হয়েছে, তার কোনোটিই স্বস্তিকর বিষয় নয়।
বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী হয় জেলে রয়েছেন বা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঠিকমতো প্রচারণা চালানো দূরের কথা, পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকজন বিএনপি এই পরিস্থিতিতে খুঁজে পাবে কি না, তাই এখনো বলা মুশকিল। এ ধরনের অবস্থায় অনুগত নির্বাচন কমিশন, সাজানো জনপ্রশাসন ও পার্টিজান পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে কারচুপি করা কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় হবে না।
তবে আওয়ামী লীগ এভাবে নির্বাচনে জিতলে এই নির্বাচন বরং রাজনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করবে। বরং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আয়োজন করে সিটি করপোরেশনের তিনটি নির্বাচনে হেরে গেলেও নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলীয় সরকারের সক্ষমতার দাবি জোরালো হবে। আওয়ামী লীগ আবারও বলতে পারবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রয়োজন নেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
মনে রাখতে হবে, বিরোধী দল যখন মনে করে যে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব, তখনই কেবল দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা ঘটে। এই বিশ্বাস ভেঙে গেলে অরাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপ, গৃহযুদ্ধ, এমনকি দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে পৃথিবীতে।
আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাই তখনই হবে শুভকর, যদি তা নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। নির্বাচনে যে ফলাফলই হোক না কেন, তাতে জিতবে গণতন্ত্র।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার পর দলটির আরেক দফা সমালোচনায় মেতে ওঠে গণমাধ্যমের একটি অংশ। বিএনপি বিলুপ্ত হওয়ার পথে—এমন কথা তখনো শোনা যায়। এমন অবস্থায় বিএনপি আবারও ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী হয়। পরবর্তী ধাপগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিএনপি পরাজিত হলেও এসব নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয় বলে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে।
এ বছরের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে না দেওয়ার পর থেকে বিএনপি টানা অবরোধ ও হরতাল পালন করে। এতে পেট্রলবোমাসহ নানা নাশকতায় বহু মানুষের ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। যথেষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই এই মৃত্যুর দায়ভার সরকারের লোকজন এবং সরকারের বিভিন্ন সুবিধাভোগী ব্যক্তি পুরোপুরিভাবে বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে: নাশকতার কারণে বিএনপিকে আর ভোট দেবে না মানুষ, বিলুপ্তির পথে রয়েছে এখন বিএনপি।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের একটি বিশাল অংশের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে বিএনপিবিরোধী এই প্রচারণা হয়তো প্রভাবিত করেছে কিছু কিছু মানুষকে। কয়েক দিন আগে একজন প্রখ্যাত আইনজীবীকে প্রথম আলোয় ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেখলাম যে চট্টগ্রামে বিএনপি বিজয়ী হবে, ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনেই জিতবে আওয়ামী লীগ। কেন তাঁর এ ধারণা হলো, এর কোনো ব্যাখ্যা ছিল না সেখানে। তবে সরকারের লোকজনের যেসব বক্তব্য শোনা যায় আজকাল, তাতে মনে হয় তাঁদের ধারণা, বিএনপির পেট্রলবোমার কারণেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতে যাবে আওয়ামী লীগ!
২...
আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর এমন কিছু করেনি, যাতে তারা মানুষের মন জয় করতে পারে। বরং এ সময়ে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং সাধারণ মানুষের হয়রানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণ ও সরকারি নেতাদের লাগামহীন কথাবার্তা অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ডিজিটালাইজেশনের কিছুটা অগ্রগতি ছাড়া ঢাকা বা চট্টগ্রামে নাগরিক সুবিধারও কোনো উন্নতি হয়নি, বরং জনপরিবহন ও জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মোট কথা, আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনায় মুগ্ধ হয়ে ভাসমান ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন ভাবার মতো জোরালো কোনো কারণ ঘটেনি দেশে।
সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের জেতার তাই মূল অস্ত্র বা সম্বল হতে পারে পেট্রলবোমার ঘটনায় বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ ভোটারদের নেগেটিভ ভোট। তবে আমার ধারণা, এ ক্ষেত্রে পেট্রলবোমা-সংক্রান্ত প্রচারণার প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করে ভাবা হচ্ছে। প্রথমত, এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে (কিছু ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোকজনের বিরুদ্ধেও যে অভিযোগ উঠেছে) গ্রেপ্তারকৃতরা বিএনপি-জামায়াতের লোক হলেও তাঁদের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেক মানুষই সন্দেহ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত একটি ঘটনায়ও পুলিশ কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্তকাজ সম্পন্ন করেনি, যাতে এসব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সাধারণ মানুষের সন্দেহ দূরীভূত হতে পারে।
পেট্রলবোমার কারণে তাই লোকে বিএনপির বদলে দলে দলে এসে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা সঠিক ভাবছেন বলে আমার মনে হয় না। অতীতে জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে দোদুল্যমানতা, নির্বাচন বর্জন বা নাশকতা ইস্যুতে ভোটাররা বিএনপিকে বর্জন করবে বলে যেসব বিশ্লেষণ ছিল, তা অনেকাংশে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এবারও তা-ই হতে পারে। তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিএনপি বরং সিটি করপোরেশনে জিততে পারে চিরন্তন অ্যান্টি-এনকাম্বেন্সি (যেকোনো সরকারের প্রতি জনগণের চিরন্তন ক্ষোভ ও হতাশা) ভোটের কারণে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন হয়েছে ওপরের নির্দেশে। আনিসুল হকের পক্ষে কামাল মজুমদার বা সাঈদ খোকনের পক্ষে হাজি সেলিম ইচ্ছা করে বসে যাননি। আনিসুল হক আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাইরের মানুষ বলে ঢাকা উত্তরের বহু ছোট-বড় নেতার তাঁর পক্ষে কাজ করতে অনীহ থাকতে পারেন, ঢাকা দক্ষিণের কিছু অঞ্চলে হাজি সেলিম খুবই প্রভাবশালী। বলে তাঁর লোকজন একই ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। এমন কোন্দলের সুবিধা বিএনপি কীভাবে পায়, তার বহু নজির সাম্প্রতিক কালের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে রয়েছে।
৩...
আওয়ামী লীগের জেতার সম্ভাবনা তাই বলে একেবারে নেই, তা নয়। বিএনপির অপ্রস্তুতি বা বিএনপির প্রার্থীর দোদুল্যমানতার কারণে আওয়ামী লীগ জিততে পারে। তবে তার সম্ভাবনা কম।
আবার আওয়ামী লীগ জিততে পারে অন্যভাবেও। সেটি হচ্ছে কারচুপি, অত্যাচার ও অবিচার করে। আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন আয়োজনে সৎ ও নিরপেক্ষ থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ করার মতো কিছু কারণ ইতিমধ্যে ঘটেছে। যেভাবে সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেভাবে নির্বাচন কমিশন পুলিশের আইজির পরামর্শে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছে, যেভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির পক্ষের দাবিগুলোকে নাকচ করেছেন, যেভাবে আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী হতে পারেন, এটি ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যমুনা রিসোর্টের ইজারা বাতিল করা হয়েছে, তার কোনোটিই স্বস্তিকর বিষয় নয়।
বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী হয় জেলে রয়েছেন বা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঠিকমতো প্রচারণা চালানো দূরের কথা, পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকজন বিএনপি এই পরিস্থিতিতে খুঁজে পাবে কি না, তাই এখনো বলা মুশকিল। এ ধরনের অবস্থায় অনুগত নির্বাচন কমিশন, সাজানো জনপ্রশাসন ও পার্টিজান পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে কারচুপি করা কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় হবে না।
তবে আওয়ামী লীগ এভাবে নির্বাচনে জিতলে এই নির্বাচন বরং রাজনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করবে। বরং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আয়োজন করে সিটি করপোরেশনের তিনটি নির্বাচনে হেরে গেলেও নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলীয় সরকারের সক্ষমতার দাবি জোরালো হবে। আওয়ামী লীগ আবারও বলতে পারবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রয়োজন নেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
মনে রাখতে হবে, বিরোধী দল যখন মনে করে যে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব, তখনই কেবল দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা ঘটে। এই বিশ্বাস ভেঙে গেলে অরাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপ, গৃহযুদ্ধ, এমনকি দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে পৃথিবীতে।
আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাই তখনই হবে শুভকর, যদি তা নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। নির্বাচনে যে ফলাফলই হোক না কেন, তাতে জিতবে গণতন্ত্র।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments