যখন সকাল হলো by আহমাদ মোস্তফা কামাল
শেষ পর্যন্ত অমিতকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হলো। শঙ্কাটা ছিল আগে থেকেই। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরেই তার আচরণ অস্বাভাবিক লাগছিল বন্ধুদের কাছে। কোনো এক অজানা কারণে ভয় ঢুকেছে অমিতের মনে। তীব্র, অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুভয়। এবং ভয়ের যা স্বভাব, অন্যান্য সব চিন্তা, সব কল্পনা, এমনকি সব বাস্তবতাকেও গ্রাস করে নিয়ে অধিপতির মতো আসন গেড়ে বসে, তার বেলায়ও তেমনটিই ঘটেছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে সে, কাজকর্ম থামিয়ে দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকে। তরুণ বয়সে এ রকম মৃত্যুভয়ে তটস্থ হওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক। এমনও নয় যে সে কোনো জটিল রোগে ভুগছে, বরং বেশ সুঠাম স্বাস্থ্য তার, জ্বর-কাশির মতো সাধারণ অসুখ-বিসুখও তার কাছ থেকে দূরেই থাকে, তবু কেন যে এত ভয় ওর! ভয়ের ধরনটিও ঠিক স্বাভাবিক নয়। কেন যেন তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, বাইরে বেরোলেই সে মারা পড়বে। বন্ধুরা এ রকম ভয়ের কোনো কারণ খুঁজে পায় না। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তারাও দুশ্চিন্তা আর অস্বস্তিতে ভোগে বটে, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে ‘বাইরে গেলেই মরে যাব’ টাইপের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হবে। সকলেই চাকরিজীবী, যাবতীয় শঙ্কা মাথায় নিয়েই প্রতিদিন অফিসে যেতে হচ্ছে, এত ভয় পেলে চলবে কী করে! কিন্তু অমিতকে এসব বোঝাবে কে? তার সবকিছুতেই ভয়। বাসে উঠতে ভয়—যদি পেট্রলবোমায় ঝলসে যায়, রাস্তায় হাঁটতে ভয়—যদি ককটেল এসে পড়ে গায়ের ওপর, এমনকি পেছন থেকে কেউ এসে ঘাড়ের ওপর কোপ বসিয়ে দেবে না—তারই বা নিশ্চয়তা কী? এই তো সেদিন, বইমেলা চলার সময় জনাকীর্ণ রাস্তায় পুলিশের সামনে এক লেখককে কুপিয়ে মেরে ফেলা হলো। ভাবা যায়? এ দেশে এখন অসম্ভব বলে কিছু নেই। ভয় সে পাবে না কেন? এমনকি ঘরের ভেতরে বসেও তার ভয় লাগে, যদি কেউ এসে ধরে নিয়ে যায়! এ রকমও তো ঘটছে অহরহ। কে যে কখন কাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর আর খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না, রহস্যের কূলকিনারা করতে পারছে না কেউ, যদি তার জীবনেও ওরকম ঘটে! বন্ধুরা বোঝায়, ‘শোন, আমরা সবাই অতি সাধারণ মানুষ। ওরকম ঘটনা ঘটে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বেলায়। আমরা কারও সাতে-পাঁচে থাকি না, কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করি, মুখ বুজে সব মেনে নিই, আমরা যে আছি সেটাই তো বোঝার উপায় নেই। একটা টুঁ-শব্দও করি না আমরা, ওদের কাছে আমরা প্রায় মৃত মানুষ, আমাদের মারবে কেন? ওরা মারবে জীবিতদের, যারা কথাটথা বলে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়।’
অমিত উল্টো প্রশ্ন করে, ‘বাসে বোমা ছুড়ে যাদেরকে মারা হচ্ছে, তারাও তো সাধারণ মানুষ; ককটেলে যে আহত হচ্ছে, সেও তো সাধারণ মানুষ; তারা তাহলে মরছে কেন? আর ওই যে বললি “ওরা”, কারা ওরা? যারা বোমা মারে, আর যারা কোপায়, আর যারা ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়, তারা কি সব এক পক্ষ?’
এ প্রশ্নের উত্তর বন্ধুদের কাছে নেই। থাকবেই বা কী করে, রাজনীতি ব্যাপারটাই যে তারা বোঝে না। সে প্রশ্ন করতেই থাকে, বন্ধুরাও উত্তর দিতে না পেরে বিরক্ত হতে শুরু করে। ভাবে, ও থাকুক ওর মৃত্যুভয় নিয়ে, অন্ধকার নিয়ে, আমাদের কী! কিন্তু এ রকম সময়েই ঘটনাটা ঘটে।
এক রাতে অমিত জানায়, তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই ব্যথা বাড়ে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রচণ্ড ব্যথায় আর শ্বাসকষ্টে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। আকস্মিক এই ঘটনায় বিমূঢ় হয়েও তার বন্ধুরা বুদ্ধি হারায় না, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জরুরি বিভাগে তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় সম্ভবত কাজ হয়, জ্ঞান ফেরে, অক্সিজেন মাস্ক থেকে শ্বাস নিয়ে বোধ হয় একটু আরামও পায়। দুদিন কাটে সিসিইউতে, তারপর ডাক্তাররা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে বন্ধুরা চেষ্টাচরিত করে তাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এখানে মরণাপন্ন সব রোগী, দেখতে দেখতে নাকি সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বড় ছেলেমানুষি করেছে অমিত এ কদিন, কিছুতেই থাকতে চায় না হাসপাতালে, কেবিনে গিয়েও তার ছেলেমানুষি কাটে না। নার্সরা ইনজেকশন দিতে এলে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে এলে ‘ব্যথা পাব, ব্যথা পাব’ বলে বাচ্চাদের মতো চেঁচায়। বন্ধুরা কেউ কেউ রেগে যায়—
‘তুই কী শুরু করলি বল তো, এভাবে ট্রিটমেন্ট হবে কী করে?’
‘কিসের ট্রিটমেন্ট? আমার অসুখটা কী?’
‘তোর মাথা! চুপ করে থাক।’
অমিত চুপ করে বটে, তবে চুপ যে থাকবে না বন্ধুরা, সেটা ভালো করেই জানে। সমস্যাটি নিয়ে তারা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘আসলে আপনাদের বন্ধু একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। যেকোনো কারণেই হোক, মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ঠিক আছে, আমি মীরাকে বলব ব্যাপারটা দেখতে। এই ধরনের রোগীদের ও খুব ভালো ডিল করতে পারে।’
মীরা নামের নার্সটি এল এর পরপরই। ইনজেকশন তুলে নিল হাতে, বন্ধুর ধমক খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল অমিত, বাহুতে কারও স্পর্শ পেয়ে বুঝল, আবারও কেউ এসেছে! কিন্তু চুপ করেই রইল সে। নিঃশব্দে ইনজেশন পুশ করল মীরা, সে একটু শব্দও করল না দেখে মীরাই বলল, ‘লাগল ভাইয়া? ব্যথা পেয়েছেন?’
প্রশ্ন শুনেও চোখ খুলল না অমিত, মাথা নেড়ে কেবল জানাল, না লাগেনি। কথা না বললেও, বা চোখ খুলে না দেখলেও কণ্ঠস্বরটি কানে লেগে রইল তার। কেমন ভেজা ভেজা একটা কণ্ঠ, নরম, বিষণ্ন—যেন কান্না জড়ানো আছে ওই কণ্ঠে। অনেক দিন পর মাকে মনে পড়ল তার। মায়ের কণ্ঠস্বরটা ঠিক এ রকম ছিল। এ রকম কান্নাভেজা, কোমল, মায়াময়। আচ্ছা, কারও কারও কণ্ঠস্বর এমন হয় কেন? এরা কি সত্যিই কান্না বয়ে বেড়ায়? মাকে দেখেছে, কেউ কোনো শক্ত কথা বললে উত্তরে কিছুই বলত না, কিন্তু চোখ দুটো টলমল করে উঠত। মায়ের মনে কি অনেক কষ্ট ছিল? অনেক দুঃখ বয়ে বেড়াত? মায়ের মনের খবর নেওয়ার সুযোগই পায়নি সে। কিন্তু এখন মনে হয়, বড় একা ছিল মা, বড় অন্তর্মুখীন। নিজেকে প্রকাশ করত না কখনো, কেউ কখনো তাকে বোঝেনি, বুঝতে চায়নি, মা-ও বোধ হয় বুঝতে দেয়নি। এই যে অদেখা-অচেনা মেয়েটি, সে-ও কি এ রকম? কল্পনায় সে মেয়েটির মুখ আঁকতে চেষ্টা করল। মায়াকাড়া একটা মুখ, চোখ দুটো বড় বড়, ঘনকালো আঁখিপল্লব, চোখে-মুখে বিষণ্নতা। কল্পনার সঙ্গে বাস্তব কতটা মেলে, দেখার জন্য চোখ খুলে সে দেখে—হ্যাঁ, অনেকটাই মিলে গেছে। মেয়েটি খুব যত্ন করে তুলা দিয়ে মুছে দিচ্ছিল সুচ ফোটানোর জায়গাটি। তুলোর মধ্যে কী যেন একটা ওষুধ দেয় ওরা, বেশ আরাম লাগে, একটা শীতল স্পর্শ সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল সারা শরীরে। তার ভালো লাগছিল, ভালো লাগছিল। একবার মনে হলো, মেয়েটিকে একটা শক্ত কথা বলে দেখা যাক, ওর চোখে জল আসে কি না! কিন্তু ইচ্ছেটা দমন করল সে। অচেনা একটা মেয়েকে এভাবে অহেতুক শক্ত কথা বলা যায় নাকি? বরং একটু হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ। একদম ব্যথা পাইনি।’
মেয়েটিও মিষ্টি করে হাসল, ‘ব্যথা পাওয়ার কথাও নয়। সামান্য ব্যাপার।’
‘না না, অনেকে ইচ্ছে করেই ব্যথা দেয়।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, এর আগে একজন দিল! মনে হলো আমার ওপর খুব রাগ, জোর করে ধরে ঘ্যাঁচ করে...’
‘আপনার ওপর রাগ করবে কেন? আপনি তো চমৎকার একজন মানুষ!’
‘আমি কেমন মানুষ তা আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘তা তো বলব না!’
‘ও!’
‘রাগ করলেন?’
‘না। ভাবছি, আবার কে না কে ইনজেকশন দিতে আসে, রক্ত নিতে আসে, এসে নিশ্চয়ই ব্যথা দেবে!’
‘আমি এলে চলবে?’
‘হ্যাঁ, তা চলবে। কিন্তু আপনি যখন থাকবেন না?’
‘থাকব না কেন?’
‘না, মানে আপনি তো আর চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করেন না!’
‘ও এই কথা! না, তা করি না। ঠিক আছে, আমি বলে যাব, আর কেউ যেন ইনজেকশন দিতে না আসে!’
‘থ্যাংক ইউ। আমার হয়েছে কী? কঠিন কোনো অসুখ?’
‘তা তো জানি না! ডাক্তাররা বলতে পারবেন!’
‘আপনি একটু ফাইল-টাইল দেখে বলুন না!’
‘নার্সদের এসব নিয়ে কথা বলা নিষেধ। তবে ফাইলে তো তেমন কিছু দেখলাম না।’
‘মানে বড় কোনো অসুখবিসুখ নেই?’
‘না মনে হয়।’
‘তাহলে হাসপাতালে শুয়ে আছি কেন?’
‘তা আমি কী করে বলব? ডাক্তার এলে জিজ্ঞেস করবেন। আচ্ছা, এখন যাই।’
‘যাবেন? আরেকটু বসুন না! কথা বলতে ভালো লাগছে।’
‘বসে থাকলে চলবে? কাজ আছে না?’
‘হ্যাঁ, তা বটে। আচ্ছা, যান তাহলে।’
মীরা চলে গেলে একটু একা একা লাগে অমিতের। হাসপাতাল একটা ঝামেলাপূর্ণ জায়গা, সে বোঝে। কে কাকে দেখে এখানে, সবাই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। ডাক্তার-নার্স-ওয়ার্ডবয়রা রুটিনমাফিক চলে, একেবারে আবেগহীন, কোনো কিছুতেই যেন কিছু যায়-আসে না তাদের। রোগ-শোক দেখতে দেখতে পাথুরে হৃদয় অর্জন করতে পেরেছে এরা সবাই। নিজের লোক না থাকলে হাসপাতালে থাকা যে কী কঠিন ব্যাপার! কিন্তু তার তো কেউ নেই, কে থাকবে সঙ্গে? সেই কবে, কত বছর আগে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল সে, আর ফেরেনি। কলেজে পড়ার সময় মা চলে গেল হঠাৎ করেই, সেই শোক কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছিল তার। বছর খানেক যেতে না–যেতেই চাচা-ফুফুরা তাকে বোঝাতে এসেছিল, বাবাকে আবার বিয়ে করানো দরকার, একা একা বাকি জীবনটা কাটাবে কীভাবে? বয়স হয়ে যাচ্ছে, দেখাশোনাই বা করবে কে? সে আপত্তি করেনি। চাচা-ফুফুরা নিশ্চয়ই বাবার মতামত নিয়েই বলছে এসব কথা, আপত্তি করে কী লাভ? আর করবেই বা কেন? একা যদি না থাকতে পারেন তিনি, তাহলে সঙ্গী জুটিয়ে নেওয়াই তো ভালো। তার মনের কথা জানতে পারেনি কেউই। সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—একবার এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে আর ফিরবে না কখনো। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরে নিজেকে মুক্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছিল তার। যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসে, সেদিন মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল অমিত, কেঁদেছিল বুক ভাসিয়ে, বলেছিল, ‘চলে যাচ্ছি মা, আর কোনো দিন এ বাড়িতে ফিরব না। তুমি কিন্তু রাগ করো না আমার ওপর। তুমি তো এখন মুক্ত হয়ে গেছ, নিশ্চয়ই এই কবরে শুয়ে থাকো না, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াও! আমি যেখানেই যাই, তুমি কিন্তু আমার পাশে থেকো।’ অনেক দিন পর সেই সব কথা মনে পড়ল তার, কান্নাও পেল খুব, হাসপাতালের বিছানায় একা একা শুয়ে অনেকক্ষণ মন ভরে কাঁদলও!
অমিত উল্টো প্রশ্ন করে, ‘বাসে বোমা ছুড়ে যাদেরকে মারা হচ্ছে, তারাও তো সাধারণ মানুষ; ককটেলে যে আহত হচ্ছে, সেও তো সাধারণ মানুষ; তারা তাহলে মরছে কেন? আর ওই যে বললি “ওরা”, কারা ওরা? যারা বোমা মারে, আর যারা কোপায়, আর যারা ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়, তারা কি সব এক পক্ষ?’
এ প্রশ্নের উত্তর বন্ধুদের কাছে নেই। থাকবেই বা কী করে, রাজনীতি ব্যাপারটাই যে তারা বোঝে না। সে প্রশ্ন করতেই থাকে, বন্ধুরাও উত্তর দিতে না পেরে বিরক্ত হতে শুরু করে। ভাবে, ও থাকুক ওর মৃত্যুভয় নিয়ে, অন্ধকার নিয়ে, আমাদের কী! কিন্তু এ রকম সময়েই ঘটনাটা ঘটে।
এক রাতে অমিত জানায়, তার বুকে ব্যথা হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই ব্যথা বাড়ে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রচণ্ড ব্যথায় আর শ্বাসকষ্টে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। আকস্মিক এই ঘটনায় বিমূঢ় হয়েও তার বন্ধুরা বুদ্ধি হারায় না, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জরুরি বিভাগে তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় সম্ভবত কাজ হয়, জ্ঞান ফেরে, অক্সিজেন মাস্ক থেকে শ্বাস নিয়ে বোধ হয় একটু আরামও পায়। দুদিন কাটে সিসিইউতে, তারপর ডাক্তাররা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে বন্ধুরা চেষ্টাচরিত করে তাকে কেবিনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এখানে মরণাপন্ন সব রোগী, দেখতে দেখতে নাকি সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বড় ছেলেমানুষি করেছে অমিত এ কদিন, কিছুতেই থাকতে চায় না হাসপাতালে, কেবিনে গিয়েও তার ছেলেমানুষি কাটে না। নার্সরা ইনজেকশন দিতে এলে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে এলে ‘ব্যথা পাব, ব্যথা পাব’ বলে বাচ্চাদের মতো চেঁচায়। বন্ধুরা কেউ কেউ রেগে যায়—
‘তুই কী শুরু করলি বল তো, এভাবে ট্রিটমেন্ট হবে কী করে?’
‘কিসের ট্রিটমেন্ট? আমার অসুখটা কী?’
‘তোর মাথা! চুপ করে থাক।’
অমিত চুপ করে বটে, তবে চুপ যে থাকবে না বন্ধুরা, সেটা ভালো করেই জানে। সমস্যাটি নিয়ে তারা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘আসলে আপনাদের বন্ধু একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। যেকোনো কারণেই হোক, মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ঠিক আছে, আমি মীরাকে বলব ব্যাপারটা দেখতে। এই ধরনের রোগীদের ও খুব ভালো ডিল করতে পারে।’
মীরা নামের নার্সটি এল এর পরপরই। ইনজেকশন তুলে নিল হাতে, বন্ধুর ধমক খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল অমিত, বাহুতে কারও স্পর্শ পেয়ে বুঝল, আবারও কেউ এসেছে! কিন্তু চুপ করেই রইল সে। নিঃশব্দে ইনজেশন পুশ করল মীরা, সে একটু শব্দও করল না দেখে মীরাই বলল, ‘লাগল ভাইয়া? ব্যথা পেয়েছেন?’
প্রশ্ন শুনেও চোখ খুলল না অমিত, মাথা নেড়ে কেবল জানাল, না লাগেনি। কথা না বললেও, বা চোখ খুলে না দেখলেও কণ্ঠস্বরটি কানে লেগে রইল তার। কেমন ভেজা ভেজা একটা কণ্ঠ, নরম, বিষণ্ন—যেন কান্না জড়ানো আছে ওই কণ্ঠে। অনেক দিন পর মাকে মনে পড়ল তার। মায়ের কণ্ঠস্বরটা ঠিক এ রকম ছিল। এ রকম কান্নাভেজা, কোমল, মায়াময়। আচ্ছা, কারও কারও কণ্ঠস্বর এমন হয় কেন? এরা কি সত্যিই কান্না বয়ে বেড়ায়? মাকে দেখেছে, কেউ কোনো শক্ত কথা বললে উত্তরে কিছুই বলত না, কিন্তু চোখ দুটো টলমল করে উঠত। মায়ের মনে কি অনেক কষ্ট ছিল? অনেক দুঃখ বয়ে বেড়াত? মায়ের মনের খবর নেওয়ার সুযোগই পায়নি সে। কিন্তু এখন মনে হয়, বড় একা ছিল মা, বড় অন্তর্মুখীন। নিজেকে প্রকাশ করত না কখনো, কেউ কখনো তাকে বোঝেনি, বুঝতে চায়নি, মা-ও বোধ হয় বুঝতে দেয়নি। এই যে অদেখা-অচেনা মেয়েটি, সে-ও কি এ রকম? কল্পনায় সে মেয়েটির মুখ আঁকতে চেষ্টা করল। মায়াকাড়া একটা মুখ, চোখ দুটো বড় বড়, ঘনকালো আঁখিপল্লব, চোখে-মুখে বিষণ্নতা। কল্পনার সঙ্গে বাস্তব কতটা মেলে, দেখার জন্য চোখ খুলে সে দেখে—হ্যাঁ, অনেকটাই মিলে গেছে। মেয়েটি খুব যত্ন করে তুলা দিয়ে মুছে দিচ্ছিল সুচ ফোটানোর জায়গাটি। তুলোর মধ্যে কী যেন একটা ওষুধ দেয় ওরা, বেশ আরাম লাগে, একটা শীতল স্পর্শ সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল সারা শরীরে। তার ভালো লাগছিল, ভালো লাগছিল। একবার মনে হলো, মেয়েটিকে একটা শক্ত কথা বলে দেখা যাক, ওর চোখে জল আসে কি না! কিন্তু ইচ্ছেটা দমন করল সে। অচেনা একটা মেয়েকে এভাবে অহেতুক শক্ত কথা বলা যায় নাকি? বরং একটু হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ। একদম ব্যথা পাইনি।’
মেয়েটিও মিষ্টি করে হাসল, ‘ব্যথা পাওয়ার কথাও নয়। সামান্য ব্যাপার।’
‘না না, অনেকে ইচ্ছে করেই ব্যথা দেয়।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, এর আগে একজন দিল! মনে হলো আমার ওপর খুব রাগ, জোর করে ধরে ঘ্যাঁচ করে...’
‘আপনার ওপর রাগ করবে কেন? আপনি তো চমৎকার একজন মানুষ!’
‘আমি কেমন মানুষ তা আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘তা তো বলব না!’
‘ও!’
‘রাগ করলেন?’
‘না। ভাবছি, আবার কে না কে ইনজেকশন দিতে আসে, রক্ত নিতে আসে, এসে নিশ্চয়ই ব্যথা দেবে!’
‘আমি এলে চলবে?’
‘হ্যাঁ, তা চলবে। কিন্তু আপনি যখন থাকবেন না?’
‘থাকব না কেন?’
‘না, মানে আপনি তো আর চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করেন না!’
‘ও এই কথা! না, তা করি না। ঠিক আছে, আমি বলে যাব, আর কেউ যেন ইনজেকশন দিতে না আসে!’
‘থ্যাংক ইউ। আমার হয়েছে কী? কঠিন কোনো অসুখ?’
‘তা তো জানি না! ডাক্তাররা বলতে পারবেন!’
‘আপনি একটু ফাইল-টাইল দেখে বলুন না!’
‘নার্সদের এসব নিয়ে কথা বলা নিষেধ। তবে ফাইলে তো তেমন কিছু দেখলাম না।’
‘মানে বড় কোনো অসুখবিসুখ নেই?’
‘না মনে হয়।’
‘তাহলে হাসপাতালে শুয়ে আছি কেন?’
‘তা আমি কী করে বলব? ডাক্তার এলে জিজ্ঞেস করবেন। আচ্ছা, এখন যাই।’
‘যাবেন? আরেকটু বসুন না! কথা বলতে ভালো লাগছে।’
‘বসে থাকলে চলবে? কাজ আছে না?’
‘হ্যাঁ, তা বটে। আচ্ছা, যান তাহলে।’
মীরা চলে গেলে একটু একা একা লাগে অমিতের। হাসপাতাল একটা ঝামেলাপূর্ণ জায়গা, সে বোঝে। কে কাকে দেখে এখানে, সবাই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। ডাক্তার-নার্স-ওয়ার্ডবয়রা রুটিনমাফিক চলে, একেবারে আবেগহীন, কোনো কিছুতেই যেন কিছু যায়-আসে না তাদের। রোগ-শোক দেখতে দেখতে পাথুরে হৃদয় অর্জন করতে পেরেছে এরা সবাই। নিজের লোক না থাকলে হাসপাতালে থাকা যে কী কঠিন ব্যাপার! কিন্তু তার তো কেউ নেই, কে থাকবে সঙ্গে? সেই কবে, কত বছর আগে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল সে, আর ফেরেনি। কলেজে পড়ার সময় মা চলে গেল হঠাৎ করেই, সেই শোক কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছিল তার। বছর খানেক যেতে না–যেতেই চাচা-ফুফুরা তাকে বোঝাতে এসেছিল, বাবাকে আবার বিয়ে করানো দরকার, একা একা বাকি জীবনটা কাটাবে কীভাবে? বয়স হয়ে যাচ্ছে, দেখাশোনাই বা করবে কে? সে আপত্তি করেনি। চাচা-ফুফুরা নিশ্চয়ই বাবার মতামত নিয়েই বলছে এসব কথা, আপত্তি করে কী লাভ? আর করবেই বা কেন? একা যদি না থাকতে পারেন তিনি, তাহলে সঙ্গী জুটিয়ে নেওয়াই তো ভালো। তার মনের কথা জানতে পারেনি কেউই। সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—একবার এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে আর ফিরবে না কখনো। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরে নিজেকে মুক্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছিল তার। যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসে, সেদিন মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল অমিত, কেঁদেছিল বুক ভাসিয়ে, বলেছিল, ‘চলে যাচ্ছি মা, আর কোনো দিন এ বাড়িতে ফিরব না। তুমি কিন্তু রাগ করো না আমার ওপর। তুমি তো এখন মুক্ত হয়ে গেছ, নিশ্চয়ই এই কবরে শুয়ে থাকো না, নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াও! আমি যেখানেই যাই, তুমি কিন্তু আমার পাশে থেকো।’ অনেক দিন পর সেই সব কথা মনে পড়ল তার, কান্নাও পেল খুব, হাসপাতালের বিছানায় একা একা শুয়ে অনেকক্ষণ মন ভরে কাঁদলও!
কেঁদে একটু মন হালকাও হলো। ভাবল, কেউ না থাকুক, বন্ধুরা তো আছে। কত দিনের বন্ধুতা ওদের সঙ্গে! ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি। এমনকি পাশ করে বেরোবার পর চার বন্ধু মিলে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছে একসঙ্গে থাকবে বলে। এই শহরে তারা সবাই বহিরাগত, নিজেরাই নিজেদের আপনজন। ছাত্রজীবনে হলে একসঙ্গে থেকেছে, এখনো একসঙ্গেই আছে। বাসাটা সুন্দর। সবারই আলাদা রুম। ড্রয়িং-ডাইনিংও আছে। কিন্তু কারও বউ নেই বলে অ্যাপার্টমেন্টের কোনো শ্রীছাদ নেই। মাথাব্যথাও নেই কারও এ নিয়ে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সবাই বিয়েটিয়ে করে থিতু হবে, তত দিন পর্যন্ত এই রকম উল্টোপাল্টা জীবনই ভালো। দিনশেষে বাসায় ফিরে আড্ডায় মাতে তারা, তাস খেলে, টিভি দেখে, কোনো কোনো দিন বাইরে ডিনার করতে যায় সেজেগুজে। মন্দ নয় জীবনটা। সারা দিন হাসপাতালে থাকার কেউ নেই। এটা অবশ্য সমস্যা নয় অমিতের কাছে। একা একা শুয়ে সে আকাশ-পাতাল ভাবে, ভাবতে ভালো লাগে। কত কথা মনে হয়! বাড়ি ছেড়ে আসার পর এ ক-বছরে বাবা অনেকবার এসেছেন তাকে নিয়ে যেতে, চাচা–ফুফুরাও এসেছেন, সে যায়নি। এমনকি ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবেও যায়নি। কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেনি, সুযোগ পেয়ে দু-কথা শুনিয়ে দেবে, তেমন স্বভাবই নেই তার। সে শুধু হেসে অসম্মতি জানিয়েছে, বলেছে, ‘সময় হলে যাব। আর কেনইবা তোমরা ভাবছ, আমি রাগ করে বাড়িতে যাচ্ছি না? আমার কোনো রাগ নেই কারও ওপরে, অভিমানও নেই।’
আসলেই নেই। অভিমান থাকলে বুক পোড়ে, বুকের ভেতরে হুহু করে। ওরকম অনুভূতি কারও জন্যই হয় না তার। না, হয়, মায়ের জন্য হয়। তবে সেটা অভিমান নয়, অন্য কিছু। ফেলে আসা বাড়ি, মেঠোপথ, ফসলের মাঠ, ছোট্ট নদী, মায়ের কবর, নিজ হাতে লাগানো গাছগুলোর জন্যও মন কেমন করে। ভোরের বাতাস, টিনের চালে টুপটাপ শিশিরের শব্দ, উঠোনের এক পাশে সযত্নে রচিত বাগানে ফুটে থাকা বেলিফুল, ঘাসের ডগায় জমে থাকা টলমলে শিশিরবিন্দু—এসব আর কখনো জীবনে ফিরে আসবে না বলে মন কাঁদে বৈকি! এসব ভাবে সে, আর কখনো মীরা এলে গল্প জুড়ে দেয়। তার জীবনে খুব বেশি গল্প নেই, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই গল্প বারবার বলে। আর মীরা ভাবে, মানুষটা কী অদ্ভুত! শিশুর সারল্য নিয়ে এই নির্মম-রুক্ষ পৃথিবীতে বাস করছে! মায়া লাগে তার, অকারণ মায়া। মনে হয়, যদি সারাক্ষণ বসে থাকা যেত তার কাছে! কিন্তু এ তো সম্ভব নয়! এটা তার চাকরি, কত কাজ তার! আবেগ-মায়া-মমতা সব বাক্সে বন্দী করে এখানে আসতে হয়। তবু সারা দিন অমিত একা থাকে বলে মীরা সুযোগ পেলেই তাকে এসে দেখে যায়, দুদণ্ড বসে গল্প করে। বন্ধুরা কেউ এলে তার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফেরে সে। বন্ধুরা সবাই অফিসে যায়, ফেরে রাতে। তারপর পালাক্রমে কেউ না কেউ রাতে থাকতে আসে। তবে মীরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ওরা অনেকখানি নিশ্চিত,
আসলেই নেই। অভিমান থাকলে বুক পোড়ে, বুকের ভেতরে হুহু করে। ওরকম অনুভূতি কারও জন্যই হয় না তার। না, হয়, মায়ের জন্য হয়। তবে সেটা অভিমান নয়, অন্য কিছু। ফেলে আসা বাড়ি, মেঠোপথ, ফসলের মাঠ, ছোট্ট নদী, মায়ের কবর, নিজ হাতে লাগানো গাছগুলোর জন্যও মন কেমন করে। ভোরের বাতাস, টিনের চালে টুপটাপ শিশিরের শব্দ, উঠোনের এক পাশে সযত্নে রচিত বাগানে ফুটে থাকা বেলিফুল, ঘাসের ডগায় জমে থাকা টলমলে শিশিরবিন্দু—এসব আর কখনো জীবনে ফিরে আসবে না বলে মন কাঁদে বৈকি! এসব ভাবে সে, আর কখনো মীরা এলে গল্প জুড়ে দেয়। তার জীবনে খুব বেশি গল্প নেই, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই গল্প বারবার বলে। আর মীরা ভাবে, মানুষটা কী অদ্ভুত! শিশুর সারল্য নিয়ে এই নির্মম-রুক্ষ পৃথিবীতে বাস করছে! মায়া লাগে তার, অকারণ মায়া। মনে হয়, যদি সারাক্ষণ বসে থাকা যেত তার কাছে! কিন্তু এ তো সম্ভব নয়! এটা তার চাকরি, কত কাজ তার! আবেগ-মায়া-মমতা সব বাক্সে বন্দী করে এখানে আসতে হয়। তবু সারা দিন অমিত একা থাকে বলে মীরা সুযোগ পেলেই তাকে এসে দেখে যায়, দুদণ্ড বসে গল্প করে। বন্ধুরা কেউ এলে তার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফেরে সে। বন্ধুরা সবাই অফিসে যায়, ফেরে রাতে। তারপর পালাক্রমে কেউ না কেউ রাতে থাকতে আসে। তবে মীরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ওরা অনেকখানি নিশ্চিত,
অমিতের ছেলেমানুষি ভাবটা কেটে গেছে, আগের মতো অত ভয়ও পাচ্ছে না। বোধ হয় স্বাভাবিক হয়ে আসছে ক্রমশ। এই মীরা মেয়েটা অন্য রকম—অমিত ভাবে। তার সবকিছুর মধ্যেই বড় মায়া, বড় কোমলতা। আজকাল এসব ব্যাপার বড় দুর্লভ। চারপাশে কেবল রুক্ষতা, চিৎকার, চেঁচামেচি। অসহিষ্ণুতা, উত্তেজনা, নিষ্ঠুরতা। স্বর নিচু করে, মায়াভরা কণ্ঠে কথা বলতে ভুলে গেছে মানুষ। সবারই উচ্চকণ্ঠ, যেন চিৎকার করে কথা বললেই নিজের মতামত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে! আসলে যে তা হয় না, এইটুকু বোঝার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে সবাই। তার মনে হয়, যদি একজন মা থাকত দেশটার, যদি অমন করে কোমল-মায়াভরা কণ্ঠে ভালোবাসার কথা শোনাত, তাহলে চৈত্রের খরদুপুরও হেমন্তের মায়াময় সকাল হয়ে যেত। মীরার সঙ্গে এসব গল্পসল্প করে সে আর মীরার ফের মনে হয়, কী সরল এই মানুষটি, আর কী পবিত্র তার চিন্তার ধরন! এ রকম বিমূঢ় সময়ে এই ধরনের লোকগুলোই সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে থাকে। অমিতের অবশ্য দিনগুলো ভালোই কাটছে। অফিসের তাড়া নেই, বাইরে বেরোবার টেনশন নেই, যেন অফুরন্ত অবসর পেয়ে গেছে হঠাৎ করে। নির্ভার, দুশ্চিন্তাহীন। একদিন সকালে মীরা হাসপাতালে এসেই উঁকি দিয়েছিল অমিতের রুমে, বলেছিল, ‘কেমন আছেন আজকে?’
আর তাকে একনজর দেখেই অমিতের মনে হয়েছিল, আজকে মীরার শাড়ির শাদা রংটি কি একটু অন্য রকম? তার বাগানে ভোরবেলায় যে রকম অজস্র বেলিফুল ফুটে থাকত, সে রকম শুভ্র মনে হচ্ছে ওকে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অমিত বলল, ‘একটু ভেতরে আসবেন?’
মীরা এসে বসল, বিনা কারণে কপালে হাত রাখল, বলল, ‘নাহ্, জ্বরটর নেই।’
অমিত হঠাৎ করেই বলল, ‘আপনারা সব সময় শাদা শাড়ি পরেন কেন? রঙিন শাড়ি পরতে সমস্যা কী?’ ‘এত কিছু কি আমি জানি? রীতি মেনে চলি।’ ‘আপনাকে একদিন অন্য কোনো রঙের শাড়িতে দেখতে ইচ্ছে করে!’
মুখ নিচু করে চুপ করে রইল মীরা।
‘কী হলো?’
‘কী?’
‘কথা বলছেন না যে!’
‘কী রং পছন্দ আপনার?’
‘নীল। ঘন-গভীর নীল। একদিন ওরকম একটা নীল শাড়ি পরে আসবেন?’
‘ও রঙের শাড়ি আমার নেই।’
‘যদি আমি কিনে দিই?’
‘হাসপাতালে কি ওরকম শাড়ি পরে আসা যায় বলুন? এটা আমার চাকরি না? আপনি ভালো হয়ে উঠুন, তারপর...’
আজকে মীরার কণ্ঠস্বরটি যেন আরও নিচু, কোমল, ভেজা ভেজা। যেন টিনের চালে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ছে এমনভাবে শব্দগুলো ওর কণ্ঠ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলে অমিত অবাক হয়ে দেখলো, মীরার দু-চোখে জল টলমল করছে। সেই প্রথম দিন সে ভেবেছিল, একটা শক্ত কথা বলে দেখবে, মেয়েটার চোখে জল আসে কি না। আজকে কি সে নিজের অজান্তেই সে রকম কিছু বলে ফেলেছে? না, তা কেন হবে? নীল শাড়ি পরতে বলায় নিশ্চয়ই আহত হয়নি মেয়েটি! সে দেখল, মীরার টলমল চোখে অশ্রুর ফোঁটা আরেকটু বড় হয়েছে, কিন্তু ঝরে পড়ছে না, আবার শুকিয়েও যাচ্ছে না। গ্রামের কথা মনে পড়ল তার। হেমন্তের সকালে, সূর্য ওঠার আগে আগে, যখন মৃদু কুয়াশায় ভরে থাকে পৃথিবী, তখন ঘাসের ডগায় এ রকম বড় বড় ফোঁটায় শিশিরবিন্দু জমে থাকে। ঝরেও পড়ে না, শুকিয়েও যায় না। রোদ উঠলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কী যে অপরূপ লাগে! এই সব দেখে দেখে বেড়াত সে একসময়। ভাবত, যদি রোদ না উঠত, যদি এই মায়াময় সকাল রয়ে যেত অনন্তকাল, তাহলে এই অপূর্ব দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটত না কখনো। মনে মনে কামনা করত সে, রোদ না উঠুক, অন্তত একদিন পৃথিবীজুড়ে কেবল ভোর থাকুক। সেসব কামনা পূর্ণ হয়নি কখনো। আজকে এই অচেনা-অনাত্মীয় শহরে হঠাৎ-চেনা কোমল-সুন্দর এই মেয়েটির চোখে টলমল অশ্রু দেখে অনেক দিন পর আবার মনে হলো, যেন আকস্মিক কোনো রোদে– হাওয়ায় মিলিয়ে না যায় এই শিশিরবিন্দু। বহুদিন ধরে মায়াময় সকাল হয় না পৃথিবীতে, কেবলই রুক্ষ দুপুর আর রাতের গভীর-কালো অন্ধকার। আজকের এই কোমল সকালটুকু না হয় বেঁচে থাকুক সারাটি দিন।
আর তাকে একনজর দেখেই অমিতের মনে হয়েছিল, আজকে মীরার শাড়ির শাদা রংটি কি একটু অন্য রকম? তার বাগানে ভোরবেলায় যে রকম অজস্র বেলিফুল ফুটে থাকত, সে রকম শুভ্র মনে হচ্ছে ওকে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অমিত বলল, ‘একটু ভেতরে আসবেন?’
মীরা এসে বসল, বিনা কারণে কপালে হাত রাখল, বলল, ‘নাহ্, জ্বরটর নেই।’
অমিত হঠাৎ করেই বলল, ‘আপনারা সব সময় শাদা শাড়ি পরেন কেন? রঙিন শাড়ি পরতে সমস্যা কী?’ ‘এত কিছু কি আমি জানি? রীতি মেনে চলি।’ ‘আপনাকে একদিন অন্য কোনো রঙের শাড়িতে দেখতে ইচ্ছে করে!’
মুখ নিচু করে চুপ করে রইল মীরা।
‘কী হলো?’
‘কী?’
‘কথা বলছেন না যে!’
‘কী রং পছন্দ আপনার?’
‘নীল। ঘন-গভীর নীল। একদিন ওরকম একটা নীল শাড়ি পরে আসবেন?’
‘ও রঙের শাড়ি আমার নেই।’
‘যদি আমি কিনে দিই?’
‘হাসপাতালে কি ওরকম শাড়ি পরে আসা যায় বলুন? এটা আমার চাকরি না? আপনি ভালো হয়ে উঠুন, তারপর...’
আজকে মীরার কণ্ঠস্বরটি যেন আরও নিচু, কোমল, ভেজা ভেজা। যেন টিনের চালে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ছে এমনভাবে শব্দগুলো ওর কণ্ঠ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলে অমিত অবাক হয়ে দেখলো, মীরার দু-চোখে জল টলমল করছে। সেই প্রথম দিন সে ভেবেছিল, একটা শক্ত কথা বলে দেখবে, মেয়েটার চোখে জল আসে কি না। আজকে কি সে নিজের অজান্তেই সে রকম কিছু বলে ফেলেছে? না, তা কেন হবে? নীল শাড়ি পরতে বলায় নিশ্চয়ই আহত হয়নি মেয়েটি! সে দেখল, মীরার টলমল চোখে অশ্রুর ফোঁটা আরেকটু বড় হয়েছে, কিন্তু ঝরে পড়ছে না, আবার শুকিয়েও যাচ্ছে না। গ্রামের কথা মনে পড়ল তার। হেমন্তের সকালে, সূর্য ওঠার আগে আগে, যখন মৃদু কুয়াশায় ভরে থাকে পৃথিবী, তখন ঘাসের ডগায় এ রকম বড় বড় ফোঁটায় শিশিরবিন্দু জমে থাকে। ঝরেও পড়ে না, শুকিয়েও যায় না। রোদ উঠলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কী যে অপরূপ লাগে! এই সব দেখে দেখে বেড়াত সে একসময়। ভাবত, যদি রোদ না উঠত, যদি এই মায়াময় সকাল রয়ে যেত অনন্তকাল, তাহলে এই অপূর্ব দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটত না কখনো। মনে মনে কামনা করত সে, রোদ না উঠুক, অন্তত একদিন পৃথিবীজুড়ে কেবল ভোর থাকুক। সেসব কামনা পূর্ণ হয়নি কখনো। আজকে এই অচেনা-অনাত্মীয় শহরে হঠাৎ-চেনা কোমল-সুন্দর এই মেয়েটির চোখে টলমল অশ্রু দেখে অনেক দিন পর আবার মনে হলো, যেন আকস্মিক কোনো রোদে– হাওয়ায় মিলিয়ে না যায় এই শিশিরবিন্দু। বহুদিন ধরে মায়াময় সকাল হয় না পৃথিবীতে, কেবলই রুক্ষ দুপুর আর রাতের গভীর-কালো অন্ধকার। আজকের এই কোমল সকালটুকু না হয় বেঁচে থাকুক সারাটি দিন।
No comments