একই ঝুড়িতে সকল ডিম by হাসান ফেরদৌস
মাহবুবুর
রব সাদী ঠিক আমাদের চেনা রাজনীতিকদের একজন নন। স্বাধীনচেতা মানুষ তিনি,
স্রোতের বিপরীতে যাওয়াই তাঁর অভ্যাস। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার স্বীকৃতি
হিসেবে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন, কিন্তু সরকারের সঙ্গে নীতিগত মতৈক্য
না হওয়ায় সে খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
সাদী এখন আর রাজনীতির কেন্দ্রে নেই। বলতে গেলে একরকম অবসরেই চলে গেছেন। ছেলেমেয়ের কাছে আমেরিকায় থাকছেন, যদিও স্থায়ীভাবে থাকার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। দুই সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে এসেছিলেন, নিজেই আমাদের খুঁজে বের করে জানালেন তাঁর কিছু বলার আছে।
দেশের চলতি রাজনৈতিক স্থবিরতায় সাদী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। একসময় যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, ক্রমশ সে স্বপ্ন ধূসর হয়ে আসছে। পেশাদার রাজনীতিকদের ক্ষীণদৃষ্টি রাজনীতির ফলে আমরা ক্রমশই এক গভীর অন্ধকার কূপে তলিয়ে যাচ্ছি।
সাদী মনে করেন, এ মুহূর্তে খুব জরুরি তিনটি ব্যাপারে সাধারণ মতৈক্য অর্জন। সেগুলো হলো: ১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্কের অবসান এবং রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সর্বজনীন স্বীকৃতি। ২. যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে মতৈক্য। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা ঠেকাতে হবে এবং তাদের বিচারের প্রশ্নটি সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে সুনিশ্চিত করতে হবে। ৩. ভবিষ্যৎ নির্বাচন পরিচালনার সব দায়দায়িত্ব সমর্পণ করতে হবে একটি প্রকৃত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের হাতে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমন একজনকে নির্বাচন করতে হবে, যাঁর ব্যক্তিগত সততা, নিয়মনিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতা হবে তর্কাতীত। তাঁর চোখে সে রকম একজন আদর্শ নির্বাচন কমিশনার ছিলেন ভারতের টি এন সেশন। ভারত সরকারের এই সাবেক সচিব ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সে দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতে যে আজ মোটের ওপর স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, নির্বাচনের পর কারচুপি বা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ নিয়ে কেউ জল ঘোলা করে না, তার ভূমি তৈরির জন্য প্রধান কৃতিত্ব টি এন সেশনের, এ কথা অনেকেই বলেন।
খুব যে নতুন কোনো কথা বলেছেন মাহবুবুর রব সাদী, আমার তা মনে হয় না। সবাই তাঁর প্রস্তাবিত ফর্মুলার সঙ্গে একমত হবেন, তা-ও মনে হয় না। সে কথা তিনি জানেন, কিন্তু তিনি এ কথাও জানেন যে, কোথাও না কোথাও, কাউকে না কাউকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নে একটি ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে। সমাধানের সর্বজনগ্রাহ্য একটি ফর্মুলা সেই সংলাপ বা জাতীয় মতৈক্য থেকেই উঠে আসবে। একা কোনো ব্যক্তি, কোনো দল বা এমনকি কোনো উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত থেকে প্রকৃত সমাধান আসবে না। তাঁর যুক্তি—আসুন, কথা বলি, তা থেকেই ভালো কোনো ফর্মুলা বেরিয়ে আসবে।
সাদীর প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যাক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নটি নতুন করে তোলার বিপক্ষে সাদী। আমরা জানি, এই প্রশ্নে ইতিমধ্যে আদালত তাঁর রায় দিয়েছেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী বলে রায় দেন, যদিও তাঁদের পরামর্শ ছিল পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হোক। সে বছরই, আদালতের রায়ের ভিত্তিতে, আওয়ামী লীগনিয়ন্ত্রিত সংসদ ২৯১-১ ভোটে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে সে সিদ্ধান্তের স্থায়ী রূপ দেয়। এমন বিপুল সংখ্যাধিক্যে এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কারণ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সে সময় সংসদ বয়কট করছিল।
সাদী মনে করেন, বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই, বাংলাদেশেও থাকা উচিত নয়। যেকোনো ক্ষমতাসীন সরকার তার মেয়াদ পেরোবার আগেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, তবে সে নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব থাকবে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ওপর। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকার কোনো রকম নাক গলাবে না।
কথাটা ঠিক, ‘স্বাভাবিক’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য ওপর থেকে বসিয়ে দেওয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রচলন নেই। কিন্তু সে তো ‘স্বাভাবিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থায়, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বাভাবিক এমন জিনিস খুব কমই আছে। নিজেরা না জিতলে সে নির্বাচনকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এমনকি যখন সারা দেশ ও দেশের বাইরের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা জানান নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তখনো নয়। আমাদের রাজনীতিকেরা ধরেই নেন, তঁাদের চোখে যা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ, এমন নির্বাচন হলে তাঁরাই জিতবেন ও সরকার গঠন করবেন। বস্তুত, আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি, নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর পরাজিত নেতা কখনো বিজয়ী নেতাকে মৌখিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়েছেন, এমনকি সাংসদ হিসেবে প্রাপ্য ভাতা ও অন্য সব সুবিধা নেওয়ার পরেও দিনের পর দিন সংসদ বয়কট করে চলেছেন, এ তো আমাদের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ডিএনএর ভেতর ঢুকে গেছে।
অন্য কথায়, আমাদের রাজনীতির কোনোটাই ঠিক ‘স্বাভাবিক’ নয়।
এই চূড়ান্ত অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারণে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা একটি যৌক্তিক বিকল্প হতে পারে। বাংলাদেশের উদাহরণ সামনে রেখে পাকিস্তানে ও নেপালে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা চালু হয়েছে। জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় আশি ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেও কার্যত একধরনের তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা। ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও শূন্য স্থান পূরণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। যেমন বেলজিয়ামে ২০১০ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করা সম্ভব না হলে দেশ পরিচালনার ভার পড়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর।
সাদী বলেছেন তিনি একজন টি এন সেশনের অপেক্ষায় আছেন। অপেক্ষায় আমরাও, কিন্তু কোথায় সেই মহাত্মা, যিনি আত্মগোপন করে আছেন? নিজের গায়ে দলবাজির নামাবলি চড়েনি, এমন কোনো সর্বজনমান্য লোক নেই তা নয়, কিন্তু কে সেই লোক, জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর মেলেনি। যদি ধরে নিই তেমন লোক আছেন, কিন্তু তাঁকে যে বিনা তর্কে গ্রহণ করা হবে, এ কথা যাঁরা ভাবেন, তাঁরা সম্ভবত মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। বুদ্ধিজীবী বলুন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলুন, আর আমলাদের কথাই বলুন, আজকের বাংলাদেশে প্রায় সবাই হয় দাগের এই ধারে, নয় ওই ধারে।
সাদী যদি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং প্রকৃত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার দাবি না করে সোনার পাথরবাটি দাবি করতেন, সেটা বোধ হয় অধিক সহজলভ্য হতো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে সাদীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো কারণ নেই। কিন্তু দেশের প্রধান বিরোধী দল যেখানে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত একটি দলের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে রেখেছে, সেখানে এই প্রশ্নে জাতীয় মতৈক্য স্বতঃসিদ্ধ বা ‘অটোমেটিক’, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। এই প্রশ্ন রাজনৈতিক নয়, নৈতিক। কিন্তু সেই নৈতিক স্বতঃসিদ্ধতা অর্জনের জন্য এই প্রশ্ন থেকে তার দলীয় রাজনৈতিক চরিত্র বিচ্ছিন্ন করা দরকার। আমার মনে হয় না এই বিচ্ছিন্নতা অর্জিত হয়েছে বা তা অর্জনে আমরা সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ।
সাদীর উদ্বেগের কারণ আমরা বুঝি, তাঁর উদ্দেশ্যের সাধুতা নিয়েও আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। বস্তুত, এই প্রস্তাবসমূহকে তাদের ‘মুখ-মূল্যে’ যদি আমরা গ্রহণ করে নিই, তাহলে ব্যাপক জাতীয় সংলাপের জন্য এটি একটি প্রাথমিক কাঠামো হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তেমন কোনো জাতীয় সংলাপের জন্য ডাকটি দেবেন কে? আর ডাক দিলে তাতে সাড়া মিলবে—এমন অদ্ভুত কথাই বা কে বলল! আমাদের দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বিবাদ ও তিক্ততা এত তীব্র ও এমন ব্যক্তিগত যে তাঁরা কখনো একই টেবিলের এপাশ-ওপাশ বসবেন, তা আশা করা বোকামি।
আশার কথা, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। চারদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হাওয়া। দুই দিন আগেও যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে গররাজি বা নিমরাজি ছিলেন, এখন তাঁরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নির্বাচনী রাজনীতিতে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তো সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। তিন মাসের টানা হানাহানিতে অসংখ্য মৃত্যুর পাহাড় ডিঙিয়ে আমরা একটি সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এই পৌঁছানো এখন পর্যন্ত কেবল সম্ভাবনার অর্থে, তাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার দায়িত্ব পেশাদার রাজনীতিকদের। যদি সবাই শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকান্তিক থাকেন, তাহলে অবিশ্বাস ও ঘৃণার চলতি বদ হাওয়াটা হয়তো পাল্টানো যাবে।
আপাতত সে সম্ভাবনার ঝুড়িতে আমরা সকল ডিম রাখছি।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
সাদী এখন আর রাজনীতির কেন্দ্রে নেই। বলতে গেলে একরকম অবসরেই চলে গেছেন। ছেলেমেয়ের কাছে আমেরিকায় থাকছেন, যদিও স্থায়ীভাবে থাকার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। দুই সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কে এসেছিলেন, নিজেই আমাদের খুঁজে বের করে জানালেন তাঁর কিছু বলার আছে।
দেশের চলতি রাজনৈতিক স্থবিরতায় সাদী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। একসময় যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, ক্রমশ সে স্বপ্ন ধূসর হয়ে আসছে। পেশাদার রাজনীতিকদের ক্ষীণদৃষ্টি রাজনীতির ফলে আমরা ক্রমশই এক গভীর অন্ধকার কূপে তলিয়ে যাচ্ছি।
সাদী মনে করেন, এ মুহূর্তে খুব জরুরি তিনটি ব্যাপারে সাধারণ মতৈক্য অর্জন। সেগুলো হলো: ১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্কের অবসান এবং রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সর্বজনীন স্বীকৃতি। ২. যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে মতৈক্য। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা ঠেকাতে হবে এবং তাদের বিচারের প্রশ্নটি সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে সুনিশ্চিত করতে হবে। ৩. ভবিষ্যৎ নির্বাচন পরিচালনার সব দায়দায়িত্ব সমর্পণ করতে হবে একটি প্রকৃত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের হাতে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এমন একজনকে নির্বাচন করতে হবে, যাঁর ব্যক্তিগত সততা, নিয়মনিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতা হবে তর্কাতীত। তাঁর চোখে সে রকম একজন আদর্শ নির্বাচন কমিশনার ছিলেন ভারতের টি এন সেশন। ভারত সরকারের এই সাবেক সচিব ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সে দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতে যে আজ মোটের ওপর স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, নির্বাচনের পর কারচুপি বা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ নিয়ে কেউ জল ঘোলা করে না, তার ভূমি তৈরির জন্য প্রধান কৃতিত্ব টি এন সেশনের, এ কথা অনেকেই বলেন।
খুব যে নতুন কোনো কথা বলেছেন মাহবুবুর রব সাদী, আমার তা মনে হয় না। সবাই তাঁর প্রস্তাবিত ফর্মুলার সঙ্গে একমত হবেন, তা-ও মনে হয় না। সে কথা তিনি জানেন, কিন্তু তিনি এ কথাও জানেন যে, কোথাও না কোথাও, কাউকে না কাউকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নে একটি ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে। সমাধানের সর্বজনগ্রাহ্য একটি ফর্মুলা সেই সংলাপ বা জাতীয় মতৈক্য থেকেই উঠে আসবে। একা কোনো ব্যক্তি, কোনো দল বা এমনকি কোনো উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত থেকে প্রকৃত সমাধান আসবে না। তাঁর যুক্তি—আসুন, কথা বলি, তা থেকেই ভালো কোনো ফর্মুলা বেরিয়ে আসবে।
সাদীর প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যাক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নটি নতুন করে তোলার বিপক্ষে সাদী। আমরা জানি, এই প্রশ্নে ইতিমধ্যে আদালত তাঁর রায় দিয়েছেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী বলে রায় দেন, যদিও তাঁদের পরামর্শ ছিল পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হোক। সে বছরই, আদালতের রায়ের ভিত্তিতে, আওয়ামী লীগনিয়ন্ত্রিত সংসদ ২৯১-১ ভোটে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে সে সিদ্ধান্তের স্থায়ী রূপ দেয়। এমন বিপুল সংখ্যাধিক্যে এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কারণ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সে সময় সংসদ বয়কট করছিল।
সাদী মনে করেন, বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই, বাংলাদেশেও থাকা উচিত নয়। যেকোনো ক্ষমতাসীন সরকার তার মেয়াদ পেরোবার আগেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, তবে সে নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব থাকবে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ওপর। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকার কোনো রকম নাক গলাবে না।
কথাটা ঠিক, ‘স্বাভাবিক’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য ওপর থেকে বসিয়ে দেওয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রচলন নেই। কিন্তু সে তো ‘স্বাভাবিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থায়, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বাভাবিক এমন জিনিস খুব কমই আছে। নিজেরা না জিতলে সে নির্বাচনকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এমনকি যখন সারা দেশ ও দেশের বাইরের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা জানান নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তখনো নয়। আমাদের রাজনীতিকেরা ধরেই নেন, তঁাদের চোখে যা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ, এমন নির্বাচন হলে তাঁরাই জিতবেন ও সরকার গঠন করবেন। বস্তুত, আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি, নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর পরাজিত নেতা কখনো বিজয়ী নেতাকে মৌখিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়েছেন, এমনকি সাংসদ হিসেবে প্রাপ্য ভাতা ও অন্য সব সুবিধা নেওয়ার পরেও দিনের পর দিন সংসদ বয়কট করে চলেছেন, এ তো আমাদের প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ডিএনএর ভেতর ঢুকে গেছে।
অন্য কথায়, আমাদের রাজনীতির কোনোটাই ঠিক ‘স্বাভাবিক’ নয়।
এই চূড়ান্ত অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারণে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা একটি যৌক্তিক বিকল্প হতে পারে। বাংলাদেশের উদাহরণ সামনে রেখে পাকিস্তানে ও নেপালে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা চালু হয়েছে। জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় আশি ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকটি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেও কার্যত একধরনের তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা। ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও শূন্য স্থান পূরণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। যেমন বেলজিয়ামে ২০১০ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করা সম্ভব না হলে দেশ পরিচালনার ভার পড়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর।
সাদী বলেছেন তিনি একজন টি এন সেশনের অপেক্ষায় আছেন। অপেক্ষায় আমরাও, কিন্তু কোথায় সেই মহাত্মা, যিনি আত্মগোপন করে আছেন? নিজের গায়ে দলবাজির নামাবলি চড়েনি, এমন কোনো সর্বজনমান্য লোক নেই তা নয়, কিন্তু কে সেই লোক, জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর মেলেনি। যদি ধরে নিই তেমন লোক আছেন, কিন্তু তাঁকে যে বিনা তর্কে গ্রহণ করা হবে, এ কথা যাঁরা ভাবেন, তাঁরা সম্ভবত মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। বুদ্ধিজীবী বলুন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলুন, আর আমলাদের কথাই বলুন, আজকের বাংলাদেশে প্রায় সবাই হয় দাগের এই ধারে, নয় ওই ধারে।
সাদী যদি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং প্রকৃত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার দাবি না করে সোনার পাথরবাটি দাবি করতেন, সেটা বোধ হয় অধিক সহজলভ্য হতো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে সাদীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো কারণ নেই। কিন্তু দেশের প্রধান বিরোধী দল যেখানে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত একটি দলের সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে রেখেছে, সেখানে এই প্রশ্নে জাতীয় মতৈক্য স্বতঃসিদ্ধ বা ‘অটোমেটিক’, তা ভাবারও কোনো কারণ নেই। এই প্রশ্ন রাজনৈতিক নয়, নৈতিক। কিন্তু সেই নৈতিক স্বতঃসিদ্ধতা অর্জনের জন্য এই প্রশ্ন থেকে তার দলীয় রাজনৈতিক চরিত্র বিচ্ছিন্ন করা দরকার। আমার মনে হয় না এই বিচ্ছিন্নতা অর্জিত হয়েছে বা তা অর্জনে আমরা সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ।
সাদীর উদ্বেগের কারণ আমরা বুঝি, তাঁর উদ্দেশ্যের সাধুতা নিয়েও আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। বস্তুত, এই প্রস্তাবসমূহকে তাদের ‘মুখ-মূল্যে’ যদি আমরা গ্রহণ করে নিই, তাহলে ব্যাপক জাতীয় সংলাপের জন্য এটি একটি প্রাথমিক কাঠামো হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তেমন কোনো জাতীয় সংলাপের জন্য ডাকটি দেবেন কে? আর ডাক দিলে তাতে সাড়া মিলবে—এমন অদ্ভুত কথাই বা কে বলল! আমাদের দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বিবাদ ও তিক্ততা এত তীব্র ও এমন ব্যক্তিগত যে তাঁরা কখনো একই টেবিলের এপাশ-ওপাশ বসবেন, তা আশা করা বোকামি।
আশার কথা, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। চারদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হাওয়া। দুই দিন আগেও যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে গররাজি বা নিমরাজি ছিলেন, এখন তাঁরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নির্বাচনী রাজনীতিতে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তো সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। তিন মাসের টানা হানাহানিতে অসংখ্য মৃত্যুর পাহাড় ডিঙিয়ে আমরা একটি সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এই পৌঁছানো এখন পর্যন্ত কেবল সম্ভাবনার অর্থে, তাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার দায়িত্ব পেশাদার রাজনীতিকদের। যদি সবাই শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকান্তিক থাকেন, তাহলে অবিশ্বাস ও ঘৃণার চলতি বদ হাওয়াটা হয়তো পাল্টানো যাবে।
আপাতত সে সম্ভাবনার ঝুড়িতে আমরা সকল ডিম রাখছি।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments