‘স্বীকারোক্তি’ আইনের অপব্যবহার by তৈমূর আলম খন্দকার
বিচারব্যস্থাকে
সঠিক পন্থায় প্রয়োগের জন্য ১৮৯৮ সালের ২২ মার্চ ব্রিটিশ শাসিত পাক-ভারত
উপমহাদেশের জন্য ‘ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ ইং’ নামে একটি আইন পাস হয়েছিল, যা
ওই বছর ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়।
ওই আইনের ১৬১ ধারায় সাক্ষীর জবানবন্দী রেকর্ড করার জন্য তদন্তকারী দারোগাকে মতা দেয়া হয়, যা জুডিশিয়াল রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু ওই আইনের ১৬৪ ধারাবলে কোনো জবানবন্দী বা স্বীকারোক্তি যদি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক গৃহীত হয়, তবে তা জুডিশিয়াল রেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বিধায় বিচারামলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সংশ্লিষ্ট আইন ও উচ্চ আদালতের গাইডলাইন মতে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ও বিধিবদ্ধ নিয়মে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। তার পরও এই দায়িত্ব পালনে ও মতা ব্যবহারে ম্যাজিস্ট্রেটরা মতার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগ উঠে থাকে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ স্বীকারোক্তি গ্রহণে ম্যাজিস্ট্রেটদের এহেন কর্মকাণ্ডে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে কোনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তার পরও জজ মিয়ার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার পর বিষয়টি ধরা পড়লেও বোধোদয় হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তি প্রয়োগ না করা পর্যন্ত অজ্ঞতা বা দলবাজি কিংবা প্রভাবান্বিত হওয়া যেকোনো কারণেই হোক কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তি রেকর্ডের অপপ্রয়োগ হয়তো বন্ধ হবে না।
উল্লেখ্য, কার্যবিধির ১৬৪(৩) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে-
১। স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সংশ্লিষ্ট আসামিকে এই মর্মে আশ্বস্ত করতে হবে যে, ‘পুলিশ আবেদন করলেও আসামি স্বীকারোক্তি করতে আইনত বাধ্য নহে।’ এবং
২। তাহার স্বীকারোক্তি বিচারামলে ‘স্বীকারোক্তিকারীর বিরুদ্ধেই সাক্ষী হিসাবে ব্যবহার হতে পারে।’
ওই আইনে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যতণ পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এই মর্মে নিশ্চিত হবেন যে- ‘স্বীকারোক্তিটি স্বেচ্ছায় প্রদান করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ সত্য’ ততণ পর্যন্ত তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) স্বীকারোক্তি রেকর্ড করবেন না। ম্যাজিস্ট্রেট যদি সন্তুষ্ট হন যে, স্বীকারোক্তি প্রদানকারীকে আইনের ভাষা বুঝানো হয়েছে, যা সে বুঝতে পেরে স্বেচ্ছায় সত্য বক্তব্য প্রদান করছে- বিষয়টি তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) নিশ্চিত হয়েই জবানবন্দী রেকর্ড করবেন এবং রেকর্ড করার পর উক্ত আইনের বিধানমতে তিনি নিজে নিম্নবর্ণিত মন্তব্য প্রদানপূর্বক নিজ নাম স্বার করবেন।
"I have explained to (Name) that he is not bound to make a confession and that if he does so, aû confession he may make may be used as evidence against him and I beleve that this confession was voluntarily made. It was taken in my presence and hearing and was read over to the person making it and admitted by him to be correct, and it contains a full and true account of the statement made by him.
-Signed By Magistrate"
বাংলা ভাষায় যা নিম্নরূপ-
‘আমি (আসামির নাম) ....-কে বুঝাইয়া দিয়াছি যে, তিনি দোষ স্বীকার করিতে বাধ্য নহেন এবং যদি তিনি উহা করেন, তাহা হইলে দোষের স্বীকারোক্তি তাহার বিরুদ্ধে স্যা হিসাবে ব্যবহৃত হইতে পারে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, দোষ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে করা হইয়াছে। ইহা আমার উপস্থিতিতে ও শ্রবণে করা হইয়াছে এবং স্বীকারোক্তিকারীকে ইহা পড়িয়া শুনানো হইয়াছে এবং তিনি ইহা নির্ভুল বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন এবং তিনি যে বিবৃতি দিয়াছেন, ইহাতে তাহার পূর্ণাঙ্গ ও সত্য বিবরণ রহিয়াছে।
-ম্যাজিস্ট্রেটের স্বার’
অর্থাৎ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার পর ম্যাজিসস্ট্রেট এই মর্মে প্রত্যয়ন (Memorandum) প্রদান করবেন যে, সংশ্লিষ্ট আসামি স্বীকারোক্তি প্রদান করতে বাধ্য নয় এবং যদি করে তবে স্বীকারোক্তিকারীর বিরুদ্ধে তা স্যা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে (আসামিকে) বুঝিয়েছেন এবং স্বীকারোক্তিটি সত্য ও স্বেচ্ছায় প্রদান করা হচ্ছে মর্মে নিশ্চিত হয়ে লিপিবদ্ধ করে তিনি নিজ নাম স্বার করলেন। তা ছাড়া উচ্চ আদালতের এই মর্মে নির্দেশনা রয়েছে যে, আসামিকে উক্ত আইনি ব্যাখ্যা বুঝানোর পর তিন ঘণ্টা সময় দিতে হবে যাতে আসামি ম্যাজিস্ট্রেটের উক্ত আইনি ব্যাখ্যা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। এ ছাড়া স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার সময় [কার্যবিধির ১৬৪(২) ধারা মোতাবেক] একই আইনের ৩৬৪ ধারার বিধিবিধান অনুসরণ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যা আরো সুস্পষ্ট নির্দেশনামূলক। অধিকন্তু সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে স্যা দিতে বাধ্য করা যাইবে না।’
এ ছাড়া শুধু স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কোনো আসামিকে রিমান্ডে দেয়া যাবে নাÑ এ মর্মেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সংশ্লিষ্ট আইন বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলায় এখন প্রতিপালন করা হচ্ছে না, এ কথা দায়িত্ব নিয়েই বলছি। অভিযোগে প্রকাশ, আসামিকে আইনের ভাষায় সতর্কতা বাণী বুঝানো তো দূরের কথা, পুলিশ যা লিখে এনে দেয় তা হুবহু লিখে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন এবং মন্তব্যে ও ছকে এমনিভাবেই স্বার দিয়ে দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও পুলিশ পুনরায় রিমান্ডে নেয়ার হুমকি দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে, তা ম্যাজিস্ট্রেটের জ্ঞাতসারেই। স্বীকারোক্তি লিখতে যতণ সময় লাগে (বড়জোর ১৫-২০ মিনিট), ততণ আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রাখা হয়। রাজনৈতিক মামলাগুলোতে ইদানীং এটাই দৃশ্যমান। তবে ব্যতিক্রম আছে, যা বিরল ঘটনা। যেমনÑ নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলায় সিআইডির শিখানো মতে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করতে ম্যাজিস্ট্রেট শরীফুর রহমান অস্বীকার করেছিলেন।
বিচারকের আসনে যিনি বসেন তিনি অনেক সম্মানিত আসনে বসেন যা ‘দাঁড়িপাল্লা’ মোহরখচিত। দেশের প্রচলিত আইন এবং সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার কার্যক্রমে ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বাধীন তো বটেই, তদুপরি কাগজকলমে হলো বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হয়েছে। সেখানে জনগণ সরকার বা পুলিশি প্রভাবমুক্ত স্বাধীন কার্যক্রম বিচার বিভাগে যদি দেখতে না পায়, তবে এ স্বাধীনতার অর্থ কী?
স্বীকারোক্তি গ্রহণে জজ মিয়া নাটক ম্যাজিস্ট্রেসির ওপর যে কালিমা লেপন করেছে, তার পরও যদি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের বোধোদয় না হয়, তবে এর প্রতিকার কোথায়, মাননীয় প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ ছাড়া!
ডিঙিয়ে প্রমোশন ও সুবিধামতো পোস্টিংয়ের জন্য প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অনেকেই দলবাজি করেন। কোথাও সরবে, কোথাও নীরবে দলবাজির মহোৎসব বা কমপিটিশন চলছে। প্রমোশন ও পোস্টিংয়ের বিশেষ জেলাভিত্তিক কোটারিজম তো আছেই। তবে বিচারকার্যে ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো দলের প্রতি দুর্বল থাকা উচিত নয়Ñ এ মর্মে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আল্লাহকে তায়ালা আছেন, দেখেন, শোনেন ও সর্বশক্তিমানÑ এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তার কাছে আমি বা আপনি সবাইকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। তার শক্তিই বড় শক্তি। এর প্রমাণ দুনিয়ায় সব শক্তির য় বা পতন হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘আইনের শাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ’। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, ‘হাওয়া দেখে রায় হয়’। জজ মিয়া নাটকে দেশবাসী খুশি হয়নি বরং থুথু দিয়েছে। জানি না, বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে কবে স্বাধীন হবে? জাতির সাথে আমিও এর প্রত্যাশায় রইলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানসিকভাবে স্বাধীন না হলে কাগজে কলমে স্বাধীনতা অর্থহীন, যা অপমানজনক।
লেখক : আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী, সহ-আইন সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপি
ওই আইনের ১৬১ ধারায় সাক্ষীর জবানবন্দী রেকর্ড করার জন্য তদন্তকারী দারোগাকে মতা দেয়া হয়, যা জুডিশিয়াল রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু ওই আইনের ১৬৪ ধারাবলে কোনো জবানবন্দী বা স্বীকারোক্তি যদি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক গৃহীত হয়, তবে তা জুডিশিয়াল রেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বিধায় বিচারামলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সংশ্লিষ্ট আইন ও উচ্চ আদালতের গাইডলাইন মতে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ও বিধিবদ্ধ নিয়মে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। তার পরও এই দায়িত্ব পালনে ও মতা ব্যবহারে ম্যাজিস্ট্রেটরা মতার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগ উঠে থাকে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ স্বীকারোক্তি গ্রহণে ম্যাজিস্ট্রেটদের এহেন কর্মকাণ্ডে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে কোনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তার পরও জজ মিয়ার স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার পর বিষয়টি ধরা পড়লেও বোধোদয় হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তি প্রয়োগ না করা পর্যন্ত অজ্ঞতা বা দলবাজি কিংবা প্রভাবান্বিত হওয়া যেকোনো কারণেই হোক কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তি রেকর্ডের অপপ্রয়োগ হয়তো বন্ধ হবে না।
উল্লেখ্য, কার্যবিধির ১৬৪(৩) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে-
১। স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সংশ্লিষ্ট আসামিকে এই মর্মে আশ্বস্ত করতে হবে যে, ‘পুলিশ আবেদন করলেও আসামি স্বীকারোক্তি করতে আইনত বাধ্য নহে।’ এবং
২। তাহার স্বীকারোক্তি বিচারামলে ‘স্বীকারোক্তিকারীর বিরুদ্ধেই সাক্ষী হিসাবে ব্যবহার হতে পারে।’
ওই আইনে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যতণ পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এই মর্মে নিশ্চিত হবেন যে- ‘স্বীকারোক্তিটি স্বেচ্ছায় প্রদান করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ সত্য’ ততণ পর্যন্ত তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) স্বীকারোক্তি রেকর্ড করবেন না। ম্যাজিস্ট্রেট যদি সন্তুষ্ট হন যে, স্বীকারোক্তি প্রদানকারীকে আইনের ভাষা বুঝানো হয়েছে, যা সে বুঝতে পেরে স্বেচ্ছায় সত্য বক্তব্য প্রদান করছে- বিষয়টি তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) নিশ্চিত হয়েই জবানবন্দী রেকর্ড করবেন এবং রেকর্ড করার পর উক্ত আইনের বিধানমতে তিনি নিজে নিম্নবর্ণিত মন্তব্য প্রদানপূর্বক নিজ নাম স্বার করবেন।
"I have explained to (Name) that he is not bound to make a confession and that if he does so, aû confession he may make may be used as evidence against him and I beleve that this confession was voluntarily made. It was taken in my presence and hearing and was read over to the person making it and admitted by him to be correct, and it contains a full and true account of the statement made by him.
-Signed By Magistrate"
বাংলা ভাষায় যা নিম্নরূপ-
‘আমি (আসামির নাম) ....-কে বুঝাইয়া দিয়াছি যে, তিনি দোষ স্বীকার করিতে বাধ্য নহেন এবং যদি তিনি উহা করেন, তাহা হইলে দোষের স্বীকারোক্তি তাহার বিরুদ্ধে স্যা হিসাবে ব্যবহৃত হইতে পারে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, দোষ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে করা হইয়াছে। ইহা আমার উপস্থিতিতে ও শ্রবণে করা হইয়াছে এবং স্বীকারোক্তিকারীকে ইহা পড়িয়া শুনানো হইয়াছে এবং তিনি ইহা নির্ভুল বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন এবং তিনি যে বিবৃতি দিয়াছেন, ইহাতে তাহার পূর্ণাঙ্গ ও সত্য বিবরণ রহিয়াছে।
-ম্যাজিস্ট্রেটের স্বার’
অর্থাৎ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার পর ম্যাজিসস্ট্রেট এই মর্মে প্রত্যয়ন (Memorandum) প্রদান করবেন যে, সংশ্লিষ্ট আসামি স্বীকারোক্তি প্রদান করতে বাধ্য নয় এবং যদি করে তবে স্বীকারোক্তিকারীর বিরুদ্ধে তা স্যা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে (আসামিকে) বুঝিয়েছেন এবং স্বীকারোক্তিটি সত্য ও স্বেচ্ছায় প্রদান করা হচ্ছে মর্মে নিশ্চিত হয়ে লিপিবদ্ধ করে তিনি নিজ নাম স্বার করলেন। তা ছাড়া উচ্চ আদালতের এই মর্মে নির্দেশনা রয়েছে যে, আসামিকে উক্ত আইনি ব্যাখ্যা বুঝানোর পর তিন ঘণ্টা সময় দিতে হবে যাতে আসামি ম্যাজিস্ট্রেটের উক্ত আইনি ব্যাখ্যা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। এ ছাড়া স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার সময় [কার্যবিধির ১৬৪(২) ধারা মোতাবেক] একই আইনের ৩৬৪ ধারার বিধিবিধান অনুসরণ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যা আরো সুস্পষ্ট নির্দেশনামূলক। অধিকন্তু সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে স্যা দিতে বাধ্য করা যাইবে না।’
এ ছাড়া শুধু স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কোনো আসামিকে রিমান্ডে দেয়া যাবে নাÑ এ মর্মেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সংশ্লিষ্ট আইন বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলায় এখন প্রতিপালন করা হচ্ছে না, এ কথা দায়িত্ব নিয়েই বলছি। অভিযোগে প্রকাশ, আসামিকে আইনের ভাষায় সতর্কতা বাণী বুঝানো তো দূরের কথা, পুলিশ যা লিখে এনে দেয় তা হুবহু লিখে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন এবং মন্তব্যে ও ছকে এমনিভাবেই স্বার দিয়ে দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও পুলিশ পুনরায় রিমান্ডে নেয়ার হুমকি দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে, তা ম্যাজিস্ট্রেটের জ্ঞাতসারেই। স্বীকারোক্তি লিখতে যতণ সময় লাগে (বড়জোর ১৫-২০ মিনিট), ততণ আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রাখা হয়। রাজনৈতিক মামলাগুলোতে ইদানীং এটাই দৃশ্যমান। তবে ব্যতিক্রম আছে, যা বিরল ঘটনা। যেমনÑ নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলায় সিআইডির শিখানো মতে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করতে ম্যাজিস্ট্রেট শরীফুর রহমান অস্বীকার করেছিলেন।
বিচারকের আসনে যিনি বসেন তিনি অনেক সম্মানিত আসনে বসেন যা ‘দাঁড়িপাল্লা’ মোহরখচিত। দেশের প্রচলিত আইন এবং সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার কার্যক্রমে ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বাধীন তো বটেই, তদুপরি কাগজকলমে হলো বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হয়েছে। সেখানে জনগণ সরকার বা পুলিশি প্রভাবমুক্ত স্বাধীন কার্যক্রম বিচার বিভাগে যদি দেখতে না পায়, তবে এ স্বাধীনতার অর্থ কী?
স্বীকারোক্তি গ্রহণে জজ মিয়া নাটক ম্যাজিস্ট্রেসির ওপর যে কালিমা লেপন করেছে, তার পরও যদি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের বোধোদয় না হয়, তবে এর প্রতিকার কোথায়, মাননীয় প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ ছাড়া!
ডিঙিয়ে প্রমোশন ও সুবিধামতো পোস্টিংয়ের জন্য প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অনেকেই দলবাজি করেন। কোথাও সরবে, কোথাও নীরবে দলবাজির মহোৎসব বা কমপিটিশন চলছে। প্রমোশন ও পোস্টিংয়ের বিশেষ জেলাভিত্তিক কোটারিজম তো আছেই। তবে বিচারকার্যে ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো দলের প্রতি দুর্বল থাকা উচিত নয়Ñ এ মর্মে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আল্লাহকে তায়ালা আছেন, দেখেন, শোনেন ও সর্বশক্তিমানÑ এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তার কাছে আমি বা আপনি সবাইকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। তার শক্তিই বড় শক্তি। এর প্রমাণ দুনিয়ায় সব শক্তির য় বা পতন হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘আইনের শাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ’। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, ‘হাওয়া দেখে রায় হয়’। জজ মিয়া নাটকে দেশবাসী খুশি হয়নি বরং থুথু দিয়েছে। জানি না, বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে কবে স্বাধীন হবে? জাতির সাথে আমিও এর প্রত্যাশায় রইলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মানসিকভাবে স্বাধীন না হলে কাগজে কলমে স্বাধীনতা অর্থহীন, যা অপমানজনক।
লেখক : আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী, সহ-আইন সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপি
No comments