পেশাদারিত্ব না দেখালে অর্থনৈতিক সামাজিক অগ্রগতি স্থিতিশীল হবে না by এম জি কিবরিয়া
বর্তমান
সঙ্কট সহিংস নৈরাজ্য হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার আগে অবশ্যই বাংলাদেশে বিবদমান
রাজনৈতিক পক্ষকে অর্থবহ সংলাপে (সিরিয়াস ডায়ালগ) বসে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে
হবে। এর বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি তাদের সংগঠনগুলোতে পেশাদারিত্ব
নিয়ে না আসে এবং দুর্নীতি নির্মূল না করে তাহলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক
অগ্রগতি স্থিতিশীল হবে না। সরকার বিরোধীদের ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষেত্রে সফল
হলেও তাতে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে তা রয়ে যাবে অনেক বছর। তাই দীর্ঘমেয়াদে
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর
ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও বিরোধী দল আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা না করলে তা
অর্জন করা যাবে না। বিরোধী দলীয় নেতাদের হয়রানি করার মাধ্যমে দেশের
অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি শান্ত করার ক্ষেত্রে কোন কাজে আসে নি। ‘ইমপ্লোডিং বাংলাদেশ’- শীর্ষক এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইন্সটিটিউটের সাবেক সিনিয়র উপদেষ্টা এমজি কিবরিয়া।
তিনি বর্তমানে মরগান স্টেট ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর
প্রফেসর। বাংলাদেশে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ডিসটিঙ্গুইশড ফেলো। তার ওই
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন প্রজেস্ট সিন্ডিকেট-এ। চেক প্রজাতন্ত্রের
প্রাগ-ভিত্তিক এই ওয়েবসাইটটির সদস্য ১৫৪টি দেশের ৫ শতাধিক সংবাদপত্র ও
অন্যান্য প্রকাশনা। এটি মূলত মন্তব্যধর্মী ওয়েবসাইট। এতে তিনি লিখেছেন,
বাংলাদেশ কি আরও একবার রাজনৈতিকভাবে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেম বোমা বিস্ফোরণ
থেকে। বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাজধানীতে সহিংস বিক্ষোভ ও অগ্নিসংযোগ ব্যাপকহারে দেখা দিয়েছে। এতে দৃশ্যত
দেশটি ভয়াবহভাবে রসাতলে যাচ্ছে। অবিশ্বাস দীর্ঘদিন বাংলাদেশে রয়েছে মহামারী
আকারে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে রক্তপাতের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন
করে এ দেশটি। তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি
কিসিঞ্জার বিখ্যাত একটি উক্তি করেছিলেন নতুন জন্ম নেয়া এ দেশটির অর্থনীতি
নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, এ দেশের অর্থনীতি হবে দুর্বল। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ
করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্ষতি অর্থনীতি দিয়ে হচ্ছে না, ক্ষতিটা হচ্ছে
অকার্যকর রাজনীতি দিয়ে। বিভিন্ন ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যাত্রার পর
দ্রুততার সঙ্গে উন্নতি করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। গত দু’দশকে বার্ষিক
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে গড়ে শতকরা প্রায় ৬ ভাগ। ভারতের মতো
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর তুলনায় বাংলাদেশের সামাজিক সূচক উল্লেখযোগ্যভাবে
উন্নতি করেছে। এক্ষেত্রে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। যদি রাজনীতি
দীর্ঘমেয়াদে শান্ত থাকতো তাহলে বাংলাদেশ যোগ দিতে পারতো মধ্য আয়ের দেশগুলোর
তালিকায়। উল্টো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে
ফেলছে ঝুঁকিতে। সরকারের বৈধতা প্রশ্নে দেশের সবচেয়ে বড় দু’টি রাজনৈতিক দল
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ভয়াবহ লড়াইয়ে
লিপ্ত। গত ৮ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রায় ১০০ মানুষ নিহত
হয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কোটি কোটি টাকা মূল্যের
সহায়-সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে বা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কৃষি উৎপাদনসহ
ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। স্থানীয় ও বিদেশী নতুন বিনিয়োগ
মারাত্মকভাবে থমকে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো মানব শক্তি ও
তৈরী পোশাক রপ্তানি। এ খাত মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে
মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ ও রাজনৈতিক পরম্পরা নতুন কিছু নয় বাংলাদেশে। দেশটির
জন্মের সময় থেকেই রাজনৈতিক সহিংসতা বার বার ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা
অর্জন করেছে চার দশকেরও বেশি আগে। কিন্তু এখনও কর্ম-উপযোগী গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। যে দেশ জাতিগত ও
ভাষাগত সম্প্রতির জন্য নিজে গর্ব বোধ করে সেখানে এমন বৈরিতা থাকার কারণ
দৃশ্যত নেই বললেই চলে। এ দেশটি পাকিস্তানের কাছ থেকে তৎকালীন পূর্ব-
পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মানুষ লড়াই করে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার
প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে প্রণয়ন করা হয় ১৯৭২ সালের সংবিধান। এত
কোন চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্য না রেখে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়
অতিরিক্ত ক্ষমতা। প্রথমে এ পদে আসেন সবার শ্রদ্ধেয় জাতির জনক শেখ মুজিবুর
রহমান। তড়িঘড়ি করে এমন সংবিধান করাই হতে পারে বাংলাদেশের আসল নীতিবিরুদ্ধ
কাজ। ১৯৭০ এর দশক ও ১৯৮০ এর দশকে দেশটি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের
অভিজ্ঞতা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে বেসামরিক বা সামরিক কর্তৃত্ববাদীদের
লজ্জাজনক পরিস্থিতি লুকানোর জন্য এটা ছিল একটি প্রক্রিয়া। ১৯৯০ এর দশকে
দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দেয়া
হয় প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক পরিবেশের কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৯১
সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী পদে পর্যায়ক্রমে আসা-যাওয়া করছেন দু’ মুসলিম নারী।
তাদের রাজনৈতিক পূর্বসূরিকে হত্যার পর উত্তরাধিকার সূত্রে তারা তাদের
রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকারী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হলেন শেখ
মুজিবুর রহমানের কন্য। শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভ্যুত্থানে হত্যা করা
হয় ১৯৭৫ সালে। তার প্রতিরক্ষ খালেদা জিয়া হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের
স্ত্রী। জিয়াউর রহমানকেও ১৯৮১ সালে একই ভাগ্য বরণ করতে হয়। এ দু’নেত্রীর
মধ্যকার ভালবাসা বা আন্তরিকতা হারিয়েছে সামান্যই। অর্থনৈতিক ও সামাজিক
নীতিতে তাদের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য বা পার্থক্য নেই বললেই চলে। তারা
যেভাবে নিজ নিজ দল চালান তাতেও কোন পার্থক্য নেই। এটা হলো তাদের পারিবারিক
বিষয়। তাদের সরকার সুশীল, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার খর্ব করেছে। ব্যাপক আকারে
বেড়েছে খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মুক্ত মত
প্রকাশের স্বাধীনতা দমন করা হয়েছে, কর্ম পরিবেশ করা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ। যদি
চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্যকে একেবারে মুছে দেয়া হয় তাহলে গণতন্ত্র
সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। যেখানে কর্তৃত্ববাদী কোন প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের
স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে দাম্ভিকতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন। দু’নেত্রীর দলই
সুশাসন ও প্রশাসনের দুর্নীতির ক্ষেত্রে অদক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষ তালিকার খুব কাছাকাছি
বাংলাদেশ। দুর্নীতির কারণে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক দাতা বিশ্বব্যাংক উদ্বেগ
প্রকাশ করেছে। তারা এ কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে
অর্থায়ন বাতিল করেছে।
যখন ক্ষমতায় থাকে তখন প্রতিটি দলই নির্বাচনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। অন্যদের বাইরে রাখে। বর্তমানের সঙ্কট শুরু ২০১১ সালের জুনে। ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন তদারক করছিল। কিন্তু ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধন করিয়ে তা বাতিল করেন। এতে কারচুপি বা জালিয়াতির আশঙ্কায় ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও তার জোট। ফলে পার্লামেন্টের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনের প্রার্থী নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হয়রান করা এবং বিএনপি’র প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার কথায় রাজনৈতিক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি শান্ত করায় কোন কাজে আসেনি। খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে তার দল ও মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করে যাবে। বর্তমান সঙ্কটের ফল যা-ই হোক না কেন, দৃশ্যত পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না। সরকার যদি বিরোধীদের ধ্বংস করে দিতে সফল হয় তাহলে তার ক্ষত যদি কয়েক দশক স্থায়ী না হলেও অনেক বছর থেকে যাবে। যদি দেশের সুশাসনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত না করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমঝোতায় আসে তাহলে হয়তো একটি সাময়িক নিষ্কৃতি মিলবে। দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা না থাকলে তা করা যাবে না।
যখন ক্ষমতায় থাকে তখন প্রতিটি দলই নির্বাচনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। অন্যদের বাইরে রাখে। বর্তমানের সঙ্কট শুরু ২০১১ সালের জুনে। ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচন তদারক করছিল। কিন্তু ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধন করিয়ে তা বাতিল করেন। এতে কারচুপি বা জালিয়াতির আশঙ্কায় ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও তার জোট। ফলে পার্লামেন্টের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনের প্রার্থী নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হয়রান করা এবং বিএনপি’র প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার কথায় রাজনৈতিক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি শান্ত করায় কোন কাজে আসেনি। খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে তার দল ও মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করে যাবে। বর্তমান সঙ্কটের ফল যা-ই হোক না কেন, দৃশ্যত পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না। সরকার যদি বিরোধীদের ধ্বংস করে দিতে সফল হয় তাহলে তার ক্ষত যদি কয়েক দশক স্থায়ী না হলেও অনেক বছর থেকে যাবে। যদি দেশের সুশাসনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত না করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমঝোতায় আসে তাহলে হয়তো একটি সাময়িক নিষ্কৃতি মিলবে। দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা না থাকলে তা করা যাবে না।
No comments