এই স্বপ্নটা সত্যি হয় না কেন? by আসিফ নজরুল
দেশের রাজনীতিতেও যদি এই আনন্দ ধরে রাখা যেত |
রফিক
সাহেব প্রচণ্ড রেগে আছেন। কিন্তু রাগটা কার ওপর বুঝতে পারছেন না। তাঁর
জীবনের বারোটা বেজে গেছে এত দিনে। সরকার বলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক, কিন্তু
তাঁর অনেক কিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ছোটখাটো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়
চাকরি করেন তিনি। সেই পত্রিকা চলে বিজ্ঞাপনের টাকায়। কিন্তু ব্যবসার
অবস্থা খারাপ বলে এখন কেউ বিজ্ঞাপন দিতে চাইছেন না। রফিক সাহেবদের বেতন
বন্ধ হয়ে আছে কয়েক মাস ধরে। চিন্তায় তাঁর ঘুম আসে না ঠিকমতো। আজকে
ছুটির দিনে অনেকক্ষণ ঘুমানোর ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চার
চিৎকার-চেঁচামেচিতে তা-ও হয়নি। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। এখন সাতসকালে উঠে
তারা সারা বাড়ি ছুটোছুটি করছে। তিনি কষে ধমক দিয়ে সব কটাকে বের করে
দিলেন। পত্রিকা নিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন।
বারান্দায় প্রথম সূর্যের নরম আলো, বাতাসে শেষ শীতের রেশ। রফিক সাহেবের চোখ বুজে এল। কিন্তু পত্রিকার পাতায় চোখ পড়তেই তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এটা কি আজকের পত্রিকা? এত কিছু কবে ঘটল দেশে? তিনি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন প্রধান শিরোনামের দিকে। ‘বিএনপির জনসভায় মানুষের ঢল’। আবরোধ-কর্মসূচি প্রত্যাহার করার পর বিএনপিকে এই জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সারা দেশ থেকে লোক আসতে দেওয়া হয়েছে, সরকার কোথাও বাধা দেয়নি। লোকে লোকারণ্য জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন যে মধ্যবর্তী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে করতে রাজি আছেন তিনি। তবে এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে এবং নির্বাচন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হতে হবে।
রফিক সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। তাঁর বিস্ময় বাড়তে লাগল দিনকে দিন। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দেশের স্বার্থে এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। বিএনপিকে অবরোধ ও সহিংসতা বন্ধের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে। এমনকি পেট্রলবোমা ও ক্রসফায়ার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাবও মেনে নিয়েছে।
রফিক সাহেবের মনে হলো, এগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির নতুন চালাকি। তিনি তো আর কম দেখেননি এ দুই দলের কার্যকলাপ। এরা ক্ষমতায় এলেই হিসাব শুরু করে কীভাবে ছলচাতুরি করে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা যায়। কীভাবে বিরোধী দলকে মেরে-কেটে শেষ করা যায়। কীভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। কীভাবে নিজেদের সম্পদ আর পরিবারকে বিদেশে নিরাপদে রেখে দেশের মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায়। রফিক সাহেব তিক্ত হয়ে ওঠেন এসব ভাবতে ভাবতে। এক দল করবে ভারতের দালালি, আরেক দল আমেরিকা, না হয় পাকিস্তানের। এক দল চেতনার জিকির তুলবে, আরেক দল ধর্মের। এদের আসল জিকির তো নিজেদের নিয়ে! এরা করবে সমঝোতা!
কিন্তু রফিক সাহেবের ভুল ভাংতেই থাকে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, দুই দল মিলে আসলেই একটি সমঝোতা করতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে তোফায়েল আহমেদ আর বিএনপির পক্ষে মওদুদ আহমদ মিলে সমঝোতার রূপরেখা তৈরি করতে পেরেছেন। দুই জোটের তিনজন করে মিলে একটি বাছাই কমিটি হবে। তাঁরা অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কমিশন নির্বাচনকালে নির্বাচনসংক্রান্ত সব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আগে ডেপুটি সেক্রেটারির ওপরে কারও বদলির জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগত। এখন যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নির্বাচন চলাকালে কমিশন বদলি করতে পারবে, অনিয়মের জন্য দ্রুত সময়ে তাদের বিচার করতে পারবে, আইন ভঙ্গ করলে যে কারও প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। দুই দল মিলে নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানও মেনে নিয়েছে।
এর মধ্যে কিছু ঝামেলাও তৈরি হলো। বাম দলগুলো আর সুশীল সমাজ মিলে শুধু নির্বাচন নয়, সুশাসনের লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক সমঝোতার দাবি তুলল। এসব নিয়ে এখন আলোচনা শুরু হলে কয়েক বছর লেগে যাবে বলে কেউ কেউ সাবধান করল। কেউ কেউ সিপিডি বা সুজনের সুশাসনের দলিলের কথা তুলল। অন্যরা সিপিডি বা সুজন কে—এসব প্রশ্ন তুলল। অবশেষে সবাই পুরোনো একটি জিনিস নতুন করে আবিষ্কার করল। সুশাসনের রূপরেখা আসলে অনেক আগেই তৈরি হয়ে আছে। সেটি তৈরি করেছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মিলেই।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে তিন জোটের এই রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোট ও বাম দলগুলোর একটি জোট মিলে। কাজেই এটি পরিপূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক দলিল। এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধও রয়েছে। রফিক সাহেব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, তিন জোটের রূপরেখায় শুধু নির্বাচন নয়, বরং নির্বাচন-পরবর্তী দেশ গঠনের লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যও রয়েছে। যেমন সরকারি রেডিও-টিভির স্বায়ত্তশাসন, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ, সব কালো আইন বাতিলকরণ এবং সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধকরণ। রফিক সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, তিন জোট এমনকি একটি অভিন্ন আচরণবিধিতে ‘ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষপাত থেকে বিরত থাকার’ অঙ্গীকারও করেছিল।
এই দলিল এত দিন কোথায় ছিল? কেন সবাই ভুলে গেল এর কথা? বিএনপি, আওয়ামী লীগ না হয় ভুলেছিল, অন্যরা কেন? দেশের নাগরিক সমাজ কেন? রফিক সাহেব অবাক হয়ে এসব ভাবতে থাকেন। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্য অনেক বিষয়ের ঐকমত্য নিয়ে কথা উঠল। দুই দলের নেতারাই বলেছিলেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা, স্থানীয় শাসন শক্তিশালী করার কথা, দুর্নীতি দমন কমিশন আর মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন করার কথা। মজার বিষয় হচ্ছে, দুই দলই এসব বলেছিল বিরোধী দলে থাকার সময়। তবু বলেছিল তো! কবে কোথায় তারা এসব বলেছে, তা–ই নিয়ে লেখালেখি শুরু হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ এসব লক্ষ্যে সব দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রস্তাব দিল, এমনকি দলের গবেষণা সেল এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের লিখিত দলিল তৈরি করল। বিএনপি আবার পার্লামেন্টারি কমিটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য কিছু লিখিত প্রস্তাব জাতির কাছে পেশ করল। বিএনপি এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার জোরালো অঙ্গীকারও জাতির কাছে প্রকাশ করল।
দেশের মানুষ হতবাক হয়ে এসব লক্ষ করতে লাগল। প্রায় প্রতিদিন আনন্দ মিছিল বের হচ্ছে। অনেক জায়গায় এই মিছিলে সব দলের লোক একাকার হয়ে গেল। এর মধ্যে আগ বাড়িয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রায়ণের কথা তুলল; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করা, তাঁর ক্ষমতা কমিয়ে ভারতের আদলে পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার দাবি তুলল। এরশাদের দল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জোরালো প্রস্তাব পেশ করল, বাম দলগুলো কৃষক-শ্রমিকের অধিকার রক্ষার্থে কিছু আইনগত সংস্কারের কথা তুলল। সবগুলোই খুব ন্যায়সংগত প্রস্তাব। কিন্তু কেন যেন এগুলোতে আর দুই দলের সমর্থন পাওয়া গেল না।
যেসব ক্ষেত্রে সমর্থন পাওয়া গেল, তা-ও বা কম কী? রফিক সাহেবের খুব ইচ্ছা হলো, কেউ একজন বলুক যে দুই নেত্রীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক এবার। যদি কেউ না-ও বলে, তবু তো তাঁরা নোবেল পাওয়ার মতো একটি কাজ করলেন! যদি তাঁরা নোবেল না-ও পান, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া তো পাচ্ছেন। এক জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্য আর কী হতে পারে!
রফিক সাহেবের চোখ ভিজে গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, বাংলাদেশ যেদিন ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান-ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল, নিশাত নামের ছোটখাটো মেয়েটি যেদিন এভারেস্ট জয় করেছিলেন, সেদিনও তিনি এত আনন্দ পাননি।
রফিক সাহেবের ভেজা চোখে একসময় তেজি সূর্যের আলো ঝলসে ওঠে। তিনি আড়মোড়া ভেঙে বসেন। এতক্ষণ কি তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন? নাকি মনে মনে এসব চিন্তা করছিলেন? স্বপ্নও যদি হয়, তাঁর নিজের চিন্তাও যদি হয়, বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ কি একই স্বপ্ন দেখে না?
এত সুন্দর একটি স্বপ্ন সত্যি হয় না কেন?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বারান্দায় প্রথম সূর্যের নরম আলো, বাতাসে শেষ শীতের রেশ। রফিক সাহেবের চোখ বুজে এল। কিন্তু পত্রিকার পাতায় চোখ পড়তেই তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এটা কি আজকের পত্রিকা? এত কিছু কবে ঘটল দেশে? তিনি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন প্রধান শিরোনামের দিকে। ‘বিএনপির জনসভায় মানুষের ঢল’। আবরোধ-কর্মসূচি প্রত্যাহার করার পর বিএনপিকে এই জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সারা দেশ থেকে লোক আসতে দেওয়া হয়েছে, সরকার কোথাও বাধা দেয়নি। লোকে লোকারণ্য জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন যে মধ্যবর্তী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে করতে রাজি আছেন তিনি। তবে এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে এবং নির্বাচন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হতে হবে।
রফিক সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। তাঁর বিস্ময় বাড়তে লাগল দিনকে দিন। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দেশের স্বার্থে এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। বিএনপিকে অবরোধ ও সহিংসতা বন্ধের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছে। এমনকি পেট্রলবোমা ও ক্রসফায়ার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাবও মেনে নিয়েছে।
রফিক সাহেবের মনে হলো, এগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির নতুন চালাকি। তিনি তো আর কম দেখেননি এ দুই দলের কার্যকলাপ। এরা ক্ষমতায় এলেই হিসাব শুরু করে কীভাবে ছলচাতুরি করে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা যায়। কীভাবে বিরোধী দলকে মেরে-কেটে শেষ করা যায়। কীভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ লুটে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। কীভাবে নিজেদের সম্পদ আর পরিবারকে বিদেশে নিরাপদে রেখে দেশের মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায়। রফিক সাহেব তিক্ত হয়ে ওঠেন এসব ভাবতে ভাবতে। এক দল করবে ভারতের দালালি, আরেক দল আমেরিকা, না হয় পাকিস্তানের। এক দল চেতনার জিকির তুলবে, আরেক দল ধর্মের। এদের আসল জিকির তো নিজেদের নিয়ে! এরা করবে সমঝোতা!
কিন্তু রফিক সাহেবের ভুল ভাংতেই থাকে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, দুই দল মিলে আসলেই একটি সমঝোতা করতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে তোফায়েল আহমেদ আর বিএনপির পক্ষে মওদুদ আহমদ মিলে সমঝোতার রূপরেখা তৈরি করতে পেরেছেন। দুই জোটের তিনজন করে মিলে একটি বাছাই কমিটি হবে। তাঁরা অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কমিশন নির্বাচনকালে নির্বাচনসংক্রান্ত সব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আগে ডেপুটি সেক্রেটারির ওপরে কারও বদলির জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগত। এখন যেকোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নির্বাচন চলাকালে কমিশন বদলি করতে পারবে, অনিয়মের জন্য দ্রুত সময়ে তাদের বিচার করতে পারবে, আইন ভঙ্গ করলে যে কারও প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। দুই দল মিলে নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানও মেনে নিয়েছে।
এর মধ্যে কিছু ঝামেলাও তৈরি হলো। বাম দলগুলো আর সুশীল সমাজ মিলে শুধু নির্বাচন নয়, সুশাসনের লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক সমঝোতার দাবি তুলল। এসব নিয়ে এখন আলোচনা শুরু হলে কয়েক বছর লেগে যাবে বলে কেউ কেউ সাবধান করল। কেউ কেউ সিপিডি বা সুজনের সুশাসনের দলিলের কথা তুলল। অন্যরা সিপিডি বা সুজন কে—এসব প্রশ্ন তুলল। অবশেষে সবাই পুরোনো একটি জিনিস নতুন করে আবিষ্কার করল। সুশাসনের রূপরেখা আসলে অনেক আগেই তৈরি হয়ে আছে। সেটি তৈরি করেছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মিলেই।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে তিন জোটের এই রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোট ও বাম দলগুলোর একটি জোট মিলে। কাজেই এটি পরিপূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক দলিল। এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধও রয়েছে। রফিক সাহেব বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, তিন জোটের রূপরেখায় শুধু নির্বাচন নয়, বরং নির্বাচন-পরবর্তী দেশ গঠনের লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যও রয়েছে। যেমন সরকারি রেডিও-টিভির স্বায়ত্তশাসন, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ, সব কালো আইন বাতিলকরণ এবং সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধকরণ। রফিক সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, তিন জোট এমনকি একটি অভিন্ন আচরণবিধিতে ‘ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষপাত থেকে বিরত থাকার’ অঙ্গীকারও করেছিল।
এই দলিল এত দিন কোথায় ছিল? কেন সবাই ভুলে গেল এর কথা? বিএনপি, আওয়ামী লীগ না হয় ভুলেছিল, অন্যরা কেন? দেশের নাগরিক সমাজ কেন? রফিক সাহেব অবাক হয়ে এসব ভাবতে থাকেন। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্য অনেক বিষয়ের ঐকমত্য নিয়ে কথা উঠল। দুই দলের নেতারাই বলেছিলেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা, স্থানীয় শাসন শক্তিশালী করার কথা, দুর্নীতি দমন কমিশন আর মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন করার কথা। মজার বিষয় হচ্ছে, দুই দলই এসব বলেছিল বিরোধী দলে থাকার সময়। তবু বলেছিল তো! কবে কোথায় তারা এসব বলেছে, তা–ই নিয়ে লেখালেখি শুরু হলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ এসব লক্ষ্যে সব দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রস্তাব দিল, এমনকি দলের গবেষণা সেল এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের লিখিত দলিল তৈরি করল। বিএনপি আবার পার্লামেন্টারি কমিটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য কিছু লিখিত প্রস্তাব জাতির কাছে পেশ করল। বিএনপি এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার জোরালো অঙ্গীকারও জাতির কাছে প্রকাশ করল।
দেশের মানুষ হতবাক হয়ে এসব লক্ষ করতে লাগল। প্রায় প্রতিদিন আনন্দ মিছিল বের হচ্ছে। অনেক জায়গায় এই মিছিলে সব দলের লোক একাকার হয়ে গেল। এর মধ্যে আগ বাড়িয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রায়ণের কথা তুলল; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করা, তাঁর ক্ষমতা কমিয়ে ভারতের আদলে পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার দাবি তুলল। এরশাদের দল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের জোরালো প্রস্তাব পেশ করল, বাম দলগুলো কৃষক-শ্রমিকের অধিকার রক্ষার্থে কিছু আইনগত সংস্কারের কথা তুলল। সবগুলোই খুব ন্যায়সংগত প্রস্তাব। কিন্তু কেন যেন এগুলোতে আর দুই দলের সমর্থন পাওয়া গেল না।
যেসব ক্ষেত্রে সমর্থন পাওয়া গেল, তা-ও বা কম কী? রফিক সাহেবের খুব ইচ্ছা হলো, কেউ একজন বলুক যে দুই নেত্রীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হোক এবার। যদি কেউ না-ও বলে, তবু তো তাঁরা নোবেল পাওয়ার মতো একটি কাজ করলেন! যদি তাঁরা নোবেল না-ও পান, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসা আর দোয়া তো পাচ্ছেন। এক জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্য আর কী হতে পারে!
রফিক সাহেবের চোখ ভিজে গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, বাংলাদেশ যেদিন ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান-ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল, নিশাত নামের ছোটখাটো মেয়েটি যেদিন এভারেস্ট জয় করেছিলেন, সেদিনও তিনি এত আনন্দ পাননি।
রফিক সাহেবের ভেজা চোখে একসময় তেজি সূর্যের আলো ঝলসে ওঠে। তিনি আড়মোড়া ভেঙে বসেন। এতক্ষণ কি তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন? নাকি মনে মনে এসব চিন্তা করছিলেন? স্বপ্নও যদি হয়, তাঁর নিজের চিন্তাও যদি হয়, বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ কি একই স্বপ্ন দেখে না?
এত সুন্দর একটি স্বপ্ন সত্যি হয় না কেন?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments