দুই বাসনা থেকেই বর্তমান সঙ্কটের জন্ম by এ কে এম মহীউদ্দীন
বাংলাদেশে
আজকের এই মহারাজনৈতিক দুর্যোগের পেছনে রয়েছে এ দেশের একটি শক্তিশালী
গোষ্ঠীর সর্বনাশা দু’টি বাসনা। এক. এ দেশকে তারা একমাত্র তাদেরই ভাবে এবং
চায়, যেভাবেই হোক তারাই চিরকাল রাষ্ট্রমতায় থাকবে। সে মতাও হতে হবে
সীমাহীন। দুই. একই সাথে তারা চায় অন্য কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে দেশ থেকে
নির্মূল করতে। ইচ্ছা দু’টি একটি অপরটির পরিপূরক। চিরকাল মতায় থাকতে হলে
যারা এ পথে বাধা হতে পারে তাদের নির্মূল করা প্রয়োজন। আবার নির্মূল করতে
গেলে সীমাহীন রাষ্ট্রমতা ও একচেটিয়া দলীয় কর্তৃত্ব প্রয়োজন। দু’দিক দিয়েই
সুবিধা পেতে চায় গোষ্ঠীটি। তারা চায় এমন একটা শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে,
যাতে ‘গণতান্ত্রিক’ নামের আড়ালে বাস্তব অর্থে একটি একদলীয় রাষ্ট্রই কায়েম
হবে।
আজকের এই চলমান সঙ্ঘাত বেধেছে এ কারণে যে, নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাদের তাদের কেউ খুশি মনে নির্মূল হতে এবং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে চিরকালের মতো রাষ্ট্রমতা ছেড়ে দিতে রাজি হতে পারছে না। তারা এক দিকে নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচতে চায় এবং একই সাথে রাষ্ট্রমতা সবার জন্য যাতে সমানভাবে উন্মুক্ত থাকে, তা নিশ্চিত করতে চায়।
স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্রমতা কুগিত করে রাখা এবং প্রতিপক্ষ নির্মূল করার চিন্তা সক্রিয়। এই চিন্তা থেকেই তখন রীবাহিনীর জন্ম হয়। প্রতিকূল পরিবেশে মাঝখানে কিছু দিন নির্মূল কার্যক্রম স্তিমিত থাকে। কিন্তু চিন্তাটা মনের মধ্যে থেকেই যায়। ১৯৭৫-এর পর প্রথমবার মতায় এসে তারা রাজনীতিতে আবার নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে মতায় আসার ফলে আবার একটা সুযোগ আসে এবং এটা পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়। তারা মতা স্থায়ীকরণ ও নির্মূলকরণের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় দলীয় শক্তির সমন্বিত প্রয়োগ করে তারা। ধাপের পর ধাপ তাদের কার্যক্রম এগিয়ে চলে। মতা হাতে পেয়ে পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রের সব কিছুকে তারা নিজেদের দলীয় কব্জায় নিয়ে আসে। রাষ্ট্র পরিণত হয় একটি স্বেচ্ছাচারী দলীয় প্রতিষ্ঠানে। এরপর নিজেদের মতা আরো পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করতে আনা হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী।
রাষ্ট্রের সব দিক ও বিভাগের ওপর নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার পর হাতে নেয়া হলো তাদের নির্মূল কার্যক্রম। এ জন্য শুরু হয় যারা নির্মূলের ল্য তাদের বিভিন্ন কৌশলে দুর্বল করে ফেলা। স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব করে ফেলা হয়। এ জন্য আইনি-বেআইনি সব রকম অস্ত্রই প্রয়োগ করা হয়। মামলা, হামলা, অপপ্রচার, চলাচলে বাধাÑ কোনো কিছুই বাদ থাকে না। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সব শক্তিই প্রয়োগ করা হয় তাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অবরুদ্ধ করে ফেলা এবং তাদের একেবারে পঙ্গু ও অসহায় বানিয়ে দেয়ার কাজে।
এর পরবর্তী ধাপে ঘটানো হয় ২০১৪ সালের অকল্পনীয় এক নির্বাচন। এখন চলছে ওই প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত জনসমর্থনহীন মতা জোর করে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। যেকোনো মূল্যে মতা ধরে রাখতে গিয়ে এক দিকে দেশের মানুষকে করে ফেলা হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির হাতে বন্দী ও অসহায়; অন্য দিকে নির্মূলের ল্য যারা তাদের জন্য অবস্থাটা হয়ে গেছে তাদের গলা টিপে ধরার মতো। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মরে যাওয়ার আগে তারা বাঁচার একটি চেষ্টা করতে চায়। এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
কিন্তু ‘নির্মূল’ বলতে যা বোঝা যায়, এই ১৬ কোটি অস্থির ও উত্তেজনাপ্রবণ মানুষের দেশে কিভাবে তা সম্ভব হতে পারে? দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ এবং লাখ লাখ প্রাণহানি ছাড়া কি তা সম্ভব হতে পারে? সামনের কাতারের কিছু মানুষকে নির্মূল করলেই কি সবাই নির্মূল হয়ে যাবে? পেছনের কাতারগুলোতে যারা আছে, তাদের সংখ্যা কি একেবারেই কম? কোটি কোটি নয় কি? নির্মূল অভিলাষীদের কথা ও কাজ দেখে মনে হয়, তারা ভাবে সব অসম্ভবই সাধন করতে পারবে তারা।
সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গালাগাল দিয়ে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু খুব বেশি নয়? এ কৌশল পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় অনেকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের কেউ কি খুব বেশি লাভবান হয়েছে? নাকি উল্টো নতুন নতুন এবং আরো কঠিন প্রতিরোধ সামনে চলে এসেছে? নতুন করে কি জঙ্গি সৃষ্টি হয়নি? এই কৌশলে জঙ্গি দমন না হয়ে বরং জঙ্গি উৎপাদিত হয়েছে। মাঝখান থেকে দেশের কী অবস্থা হয়েছে? সঙ্কট কি এতে আরো বিস্তৃত, জটিল ও দীর্ঘায়িত হয়নি? কোনো পই জিততে পারেনি। কিন্তু দেশটা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে আর স্বভাব-চরিত্র বিকৃত হয়ে গেছে। এমনভাবে বিপর্যস্ত ও বিকৃত হয়েছে যে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। মতা কুগিত করে রাখার অভিলাষী নির্মূলওয়ালারা আমাদের এই ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।
এ কথা আজ আর না বলে উপায় নেই যে, এ দেশের একটি গোষ্ঠীর যেকোনো মূল্যে মতায় থাকার এবং যেভাবেই হোক অন্যদের নির্মূলের রাজনীতিই হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ। নির্মূল চিন্তার মানুষগুলোর এবং তাদের একদলীয় রাষ্ট্র বানানোর বাসনার কারণেই স্থিতিশীলতা ও শান্তি আসতে পারছে না বাংলাদেশে। নির্মূলের রাজনীতি এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা যত দিন থাকবে, সঙ্কটও বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকবে এবং ক্রমাগত তা বিস্তৃত, কঠিন ও জটিল হতে থাকবে। মতার একচেটিয়া দখলদারিত্বের বাসনাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই দুই অশুভ বাসনাই হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ।
আজকের এই চলমান সঙ্ঘাত বেধেছে এ কারণে যে, নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাদের তাদের কেউ খুশি মনে নির্মূল হতে এবং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে চিরকালের মতো রাষ্ট্রমতা ছেড়ে দিতে রাজি হতে পারছে না। তারা এক দিকে নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচতে চায় এবং একই সাথে রাষ্ট্রমতা সবার জন্য যাতে সমানভাবে উন্মুক্ত থাকে, তা নিশ্চিত করতে চায়।
স্বাধীনতার পর থেকেই রাষ্ট্রমতা কুগিত করে রাখা এবং প্রতিপক্ষ নির্মূল করার চিন্তা সক্রিয়। এই চিন্তা থেকেই তখন রীবাহিনীর জন্ম হয়। প্রতিকূল পরিবেশে মাঝখানে কিছু দিন নির্মূল কার্যক্রম স্তিমিত থাকে। কিন্তু চিন্তাটা মনের মধ্যে থেকেই যায়। ১৯৭৫-এর পর প্রথমবার মতায় এসে তারা রাজনীতিতে আবার নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে মতায় আসার ফলে আবার একটা সুযোগ আসে এবং এটা পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়। তারা মতা স্থায়ীকরণ ও নির্মূলকরণের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় দলীয় শক্তির সমন্বিত প্রয়োগ করে তারা। ধাপের পর ধাপ তাদের কার্যক্রম এগিয়ে চলে। মতা হাতে পেয়ে পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রের সব কিছুকে তারা নিজেদের দলীয় কব্জায় নিয়ে আসে। রাষ্ট্র পরিণত হয় একটি স্বেচ্ছাচারী দলীয় প্রতিষ্ঠানে। এরপর নিজেদের মতা আরো পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত করতে আনা হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী।
রাষ্ট্রের সব দিক ও বিভাগের ওপর নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার পর হাতে নেয়া হলো তাদের নির্মূল কার্যক্রম। এ জন্য শুরু হয় যারা নির্মূলের ল্য তাদের বিভিন্ন কৌশলে দুর্বল করে ফেলা। স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব করে ফেলা হয়। এ জন্য আইনি-বেআইনি সব রকম অস্ত্রই প্রয়োগ করা হয়। মামলা, হামলা, অপপ্রচার, চলাচলে বাধাÑ কোনো কিছুই বাদ থাকে না। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সব শক্তিই প্রয়োগ করা হয় তাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অবরুদ্ধ করে ফেলা এবং তাদের একেবারে পঙ্গু ও অসহায় বানিয়ে দেয়ার কাজে।
এর পরবর্তী ধাপে ঘটানো হয় ২০১৪ সালের অকল্পনীয় এক নির্বাচন। এখন চলছে ওই প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত জনসমর্থনহীন মতা জোর করে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। যেকোনো মূল্যে মতা ধরে রাখতে গিয়ে এক দিকে দেশের মানুষকে করে ফেলা হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির হাতে বন্দী ও অসহায়; অন্য দিকে নির্মূলের ল্য যারা তাদের জন্য অবস্থাটা হয়ে গেছে তাদের গলা টিপে ধরার মতো। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মরে যাওয়ার আগে তারা বাঁচার একটি চেষ্টা করতে চায়। এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
কিন্তু ‘নির্মূল’ বলতে যা বোঝা যায়, এই ১৬ কোটি অস্থির ও উত্তেজনাপ্রবণ মানুষের দেশে কিভাবে তা সম্ভব হতে পারে? দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ এবং লাখ লাখ প্রাণহানি ছাড়া কি তা সম্ভব হতে পারে? সামনের কাতারের কিছু মানুষকে নির্মূল করলেই কি সবাই নির্মূল হয়ে যাবে? পেছনের কাতারগুলোতে যারা আছে, তাদের সংখ্যা কি একেবারেই কম? কোটি কোটি নয় কি? নির্মূল অভিলাষীদের কথা ও কাজ দেখে মনে হয়, তারা ভাবে সব অসম্ভবই সাধন করতে পারবে তারা।
সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গালাগাল দিয়ে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু খুব বেশি নয়? এ কৌশল পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় অনেকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের কেউ কি খুব বেশি লাভবান হয়েছে? নাকি উল্টো নতুন নতুন এবং আরো কঠিন প্রতিরোধ সামনে চলে এসেছে? নতুন করে কি জঙ্গি সৃষ্টি হয়নি? এই কৌশলে জঙ্গি দমন না হয়ে বরং জঙ্গি উৎপাদিত হয়েছে। মাঝখান থেকে দেশের কী অবস্থা হয়েছে? সঙ্কট কি এতে আরো বিস্তৃত, জটিল ও দীর্ঘায়িত হয়নি? কোনো পই জিততে পারেনি। কিন্তু দেশটা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে আর স্বভাব-চরিত্র বিকৃত হয়ে গেছে। এমনভাবে বিপর্যস্ত ও বিকৃত হয়েছে যে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। মতা কুগিত করে রাখার অভিলাষী নির্মূলওয়ালারা আমাদের এই ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।
এ কথা আজ আর না বলে উপায় নেই যে, এ দেশের একটি গোষ্ঠীর যেকোনো মূল্যে মতায় থাকার এবং যেভাবেই হোক অন্যদের নির্মূলের রাজনীতিই হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ। নির্মূল চিন্তার মানুষগুলোর এবং তাদের একদলীয় রাষ্ট্র বানানোর বাসনার কারণেই স্থিতিশীলতা ও শান্তি আসতে পারছে না বাংলাদেশে। নির্মূলের রাজনীতি এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা যত দিন থাকবে, সঙ্কটও বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকবে এবং ক্রমাগত তা বিস্তৃত, কঠিন ও জটিল হতে থাকবে। মতার একচেটিয়া দখলদারিত্বের বাসনাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই দুই অশুভ বাসনাই হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ।
No comments