সরকারি নেতাদের কাছে খোলা চিঠি by আনিসুল হক
প্রিয় নেতারা,
আশা করি ভালো আছেন।
আমরা আছি আর কি মোটামুটি। আমাদের ভালো থাকা, মন্দ থাকার বিষয়টা অবশ্য আপনাদের হাতেই। আপনারাই বলুন, কেমন রেখেছেন আপনারা আমাদের?
যখন আমাদের কোনো সহকর্মীর গাড়িতে ককটেল ছোড়া হয়, যখন আমাদের একজন বন্ধুর গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যখন আমাদের একজন সহকর্মী যে বাসে উঠেছেন, সেই বাসেই কেউ পেট্রলবোমা ছোড়ার চেষ্টা করে, তখন কেমন থাকতে পারি আমরা। মানুষ একটা আশ্চর্য আশাবাদী প্রাণী, কিছুটা পলায়নবাদীও। সব সময় মনে হয়, দুর্ঘটনা অন্যের বেলায় ঘটবে, আমার বেলায় নয়। যে প্লেনটা ভেঙে পড়ে, সেই প্লেনে আমি থাকব না; যে বাসে আগুন লাগে, সেই বাসে তো আমি নেই। কিন্তু যখন এক চিকিৎসক দম্পতির শিশুপুত্র শিকার হয় বোমা-সন্ত্রাসের, যখন কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া পরিবারটি পুড়ে যায় পেট্রলবোমায়, যখন নিজের বন্ধুবান্ধব-সহকর্মীরা হামলার শিকার হন, তখন আর বালুতে মুখ গুজে থাকা যায় না, আতঙ্কে-আশঙ্কায় মনটা এতটুকুন হয়ে থাকে, মনে হয়, এই বুঝি প্রাণটা চলে যায়। এই বুঝি নিজেই পড়ে যাই বোমা হামলার খপ্পরে।
অন্যদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে অবরোধ–হরতালের নেতিবাচক প্রভাবের ধকল আমাদের গায়েও এসে লাগতে শুরু করেছে। কৃষকেরা টমেটো নষ্ট করেছেন রাজপথে ফেলে দিয়ে, দুধ ঢেলেছেন রাস্তায় দুগ্ধচাষিরা, আমরা বুঝতে পারি তাঁদের কষ্টটুকুন। কক্সবাজারের হোটেলগুলো ফাঁকা। পর্যটন ব্যবসায় ধস। বইমেলার বিক্রি এবার গতবারের তুলনায় ঢের কম। তা থেকে বুঝতে পারি, আমাদের যখন দুই পায়ে দ্রুত দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন হরতাল-অবরোধ আমাদের এক পা বেঁধে ফেলেছে। আমরা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দৌড়ে পারব কী করে?
এই জন্য দরকার এই হরতাল-অবরোধ থেকে মুক্তি।
বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধ রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। গত শুক্রবার প্রথম আলোর এই কলামে বিএনপির নেতাদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলাম, তাঁদের আবেদন জানিয়েছিলাম, তাঁদের এই কর্মসূচিতে বিরতি দিতে, নতুন করে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে আসতে।
সেই আবেদন এখনো তাঁদের কাছে আমরা করব। কিন্তু তাঁদের ফিরে আসার একটা পথ, একটা সূত্র, একটা উপলক্ষ তো আপনাদেরকেই সৃষ্টি করতে হবে।
যখন আরও অনেক কণ্ঠ একযোগে বিএনপি জোটকে আহ্বান জানাচ্ছিল তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শোনা গেল বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে, তারা জানে না, সালাহ উদ্দিন আহমদ কোথায় আছেন। এই লেখক একজন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সালাহ উদ্দিন আহমদের ব্যাপারটা কী, মন্ত্রী বলেন, এই বিএনপি নেতা নিজেই লুকিয়ে আছেন বলে তাঁর ধারণা। এদিকে সালাহ উদ্দিন আহমদের স্ত্রী জানান, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরাও নাকি বলেছেন, এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই কাজ। আমরা জানি না, আমরা কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করব। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, কারও কথাই আমরা তাই অবিশ্বাস করছি না। তাহলে আমাদের বলতে হবে, সরকার যদি না-ও জানে সালাহ উদ্দিন আহমদ কোথায় আছেন, তাঁকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা ও তাঁর অবস্থান জনগণকে জানানোর দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। তিনি যদি লুকিয়ে থাকেন, তাহলেও তাঁকে খুঁজে বের করে জনগণের সামনে সব রহস্য উন্মোচন করার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
আমাদের আকুল আবেদন, সালাহ উদ্দিন আহমদকে খুঁজে বের করা হোক। এটা যদি তাঁর কিংবা তাঁর দলের আরেকটা চক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই চক্রান্তের মুখোশ উন্মুক্ত করাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। আর যদি এটা কোনো বাহিনীর কাজ হয়ে থাকে, তাহলেও তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হবে শান্তি ও সমঝোতা স্থাপনের পথে এক নম্বর পদক্ষেপ।
মাননীয় নেতারা,
আমরা পেট্রলবোমা চাই না। আমরা বোমাবাজি চাই না। আমরা চাই জীবনের নিরাপত্তা, আমরা চাই নিরাপদে চলাচল করার অধিকার। এটা দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের। আর সেই দায়িত্ব পালনে সরকারগুলো সাধারণত পুলিশি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। দুই হাজারের জায়গায় চার হাজার পুলিশ মোতায়েন করে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান নেই। এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই করতে হবে। এবং সে জন্য আপাতছাড়ের প্রয়োজন হলে তা দিতে হবে। কৌশলী হতে হবে।
এই কৌশলের অংশ হিসেবেই বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। সেই আলোচনার মাধ্যমে বিএনপি ও তার জোটকে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
আর সরকারের কথা, কাজ ও আচরণ হতে হবে গণতান্ত্রিক। সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এর মানে এই নয়, যারা পেট্রলবোমা ছুড়ে সাধারণ শান্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছে, আহত করেছে, তাদের ছাড় দিতে হবে। তাদের বিচার করা হোক, দরকার হলে দ্রুত বিচার আদালতে বিচার করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হলে সেটাকে সব মহল স্বাগত জানাবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গোপনে তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম করে ফেলা, কিংবা ক্রসফায়ারে নেওয়া একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটা সরকারের ও সরকারি নেতাদের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করবে, আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। আপনারা নিশ্চয়ই নিজের ভালো বোঝেন। দলের ভালো বোঝেন। দেশের ভালো বোঝেন। আপনাদের, দলের ও দেশের ভালো হবে, যদি আপনাদের প্রতিটা পদক্ষেপ আইনানুগ হয়, গণতান্ত্রিক হয়।
যে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিরোধী দলে থেকে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করা, সেই আওয়ামী লীগের নেতাদের এ কথা বলারও কি দরকার পড়ে যে দমন-পীড়ন দিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করা যায় না, তা আখেরে দলের জন্য ভালো হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই কথা বহুবার বলেছেন। এমনকি পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।’ বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না, এটা বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তঁার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে রেখেছেন।
আলাপ-আলোচনার মানে এই নয় যে আপনারা পরাজিত হয়ে গেলেন। বিরোধী দলকে আন্দোলন থেকে ফেরাতে পারলেই তো আপনাদের জিত। এটা তো জেদাজেদির প্রশ্ন নয়। এটা হলো ১৬ কোটি মানুষের ভালো থাকা, খারাপ থাকার প্রশ্ন। বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে খুবই ভালো করছে। আমরা উন্নতির পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করবে। আর রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে যাদের আমরা হারিয়েছি, তাদের আর কোনো দিনও ফিরে পাব না। একটা প্রাণও অপচয়িত হতে দেওয়া যায় না। এক টাকার সম্পদও কেন আমরা ধ্বংস হতে দেব? রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের কোটি কোটি শিক্ষার্থী। কাজেই সরকারের উচিত হবে কৌশলগত কারণে বিএনপি ও তার জোটকে আন্দোলন থেকে ফিরে আসার একটা উপলক্ষ জোগানো। সালাহ উদ্দিন আহমদকে উদ্ধার হতে পারে সে লক্ষ্যে প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ হতে পারে, বাগাড়ম্বর বন্ধ করা, গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ চর্চা করা, শীলিত ভাষায় কথা বলা। তৃতীয় ধাপ হবে, বিরোধীদের তাদের দাবি-দাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য একটা পরিসর দেওয়া।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখি, দুটো রাজনৈতিক ধারা পাশাপাশি অবস্থান করে। একটা ‘এ’ দল থাকলে আরেকটা ‘বি’ দল থাকবেই। একটা মধ্য বাম, আরেকটা মধ্য ডান। বাংলাদেশেও এই রকম দুটো ধারাই থাকবে। তা সে যে নামেই থাকুক না কেন। কেউ কাউকে বিনাশ করতে পারবে, নির্মূল করতে পারবে, এই রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের শর্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই হবে সবচেয়ে বাস্তব আর বুদ্ধিমানের কাজ। আর শক্তি প্রয়োগ করে রাজনৈতিক বিরোধীকে নির্মূল করার চেষ্টা হবে আত্মঘাতী, যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী।
আপনাদের বিরোধীদের ভালোর জন্য নয়, বরং নিজেদের ভালোর জন্য হলেও ন্যূনতম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সূত্র আপনারা অন্বেষণ করুন। দেশের মানুষ তাঁকেই বেশি ভালোবাসবে, দেশের জন্য শান্তির পথে যিনি বেশি ছাড় দেবেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আশা করি ভালো আছেন।
আমরা আছি আর কি মোটামুটি। আমাদের ভালো থাকা, মন্দ থাকার বিষয়টা অবশ্য আপনাদের হাতেই। আপনারাই বলুন, কেমন রেখেছেন আপনারা আমাদের?
যখন আমাদের কোনো সহকর্মীর গাড়িতে ককটেল ছোড়া হয়, যখন আমাদের একজন বন্ধুর গাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যখন আমাদের একজন সহকর্মী যে বাসে উঠেছেন, সেই বাসেই কেউ পেট্রলবোমা ছোড়ার চেষ্টা করে, তখন কেমন থাকতে পারি আমরা। মানুষ একটা আশ্চর্য আশাবাদী প্রাণী, কিছুটা পলায়নবাদীও। সব সময় মনে হয়, দুর্ঘটনা অন্যের বেলায় ঘটবে, আমার বেলায় নয়। যে প্লেনটা ভেঙে পড়ে, সেই প্লেনে আমি থাকব না; যে বাসে আগুন লাগে, সেই বাসে তো আমি নেই। কিন্তু যখন এক চিকিৎসক দম্পতির শিশুপুত্র শিকার হয় বোমা-সন্ত্রাসের, যখন কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া পরিবারটি পুড়ে যায় পেট্রলবোমায়, যখন নিজের বন্ধুবান্ধব-সহকর্মীরা হামলার শিকার হন, তখন আর বালুতে মুখ গুজে থাকা যায় না, আতঙ্কে-আশঙ্কায় মনটা এতটুকুন হয়ে থাকে, মনে হয়, এই বুঝি প্রাণটা চলে যায়। এই বুঝি নিজেই পড়ে যাই বোমা হামলার খপ্পরে।
অন্যদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে অবরোধ–হরতালের নেতিবাচক প্রভাবের ধকল আমাদের গায়েও এসে লাগতে শুরু করেছে। কৃষকেরা টমেটো নষ্ট করেছেন রাজপথে ফেলে দিয়ে, দুধ ঢেলেছেন রাস্তায় দুগ্ধচাষিরা, আমরা বুঝতে পারি তাঁদের কষ্টটুকুন। কক্সবাজারের হোটেলগুলো ফাঁকা। পর্যটন ব্যবসায় ধস। বইমেলার বিক্রি এবার গতবারের তুলনায় ঢের কম। তা থেকে বুঝতে পারি, আমাদের যখন দুই পায়ে দ্রুত দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তখন হরতাল-অবরোধ আমাদের এক পা বেঁধে ফেলেছে। আমরা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সঙ্গে দৌড়ে পারব কী করে?
এই জন্য দরকার এই হরতাল-অবরোধ থেকে মুক্তি।
বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধ রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। গত শুক্রবার প্রথম আলোর এই কলামে বিএনপির নেতাদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলাম, তাঁদের আবেদন জানিয়েছিলাম, তাঁদের এই কর্মসূচিতে বিরতি দিতে, নতুন করে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে আসতে।
সেই আবেদন এখনো তাঁদের কাছে আমরা করব। কিন্তু তাঁদের ফিরে আসার একটা পথ, একটা সূত্র, একটা উপলক্ষ তো আপনাদেরকেই সৃষ্টি করতে হবে।
যখন আরও অনেক কণ্ঠ একযোগে বিএনপি জোটকে আহ্বান জানাচ্ছিল তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শোনা গেল বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে, তারা জানে না, সালাহ উদ্দিন আহমদ কোথায় আছেন। এই লেখক একজন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সালাহ উদ্দিন আহমদের ব্যাপারটা কী, মন্ত্রী বলেন, এই বিএনপি নেতা নিজেই লুকিয়ে আছেন বলে তাঁর ধারণা। এদিকে সালাহ উদ্দিন আহমদের স্ত্রী জানান, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরাও নাকি বলেছেন, এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই কাজ। আমরা জানি না, আমরা কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করব। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, কারও কথাই আমরা তাই অবিশ্বাস করছি না। তাহলে আমাদের বলতে হবে, সরকার যদি না-ও জানে সালাহ উদ্দিন আহমদ কোথায় আছেন, তাঁকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা ও তাঁর অবস্থান জনগণকে জানানোর দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। তিনি যদি লুকিয়ে থাকেন, তাহলেও তাঁকে খুঁজে বের করে জনগণের সামনে সব রহস্য উন্মোচন করার দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
আমাদের আকুল আবেদন, সালাহ উদ্দিন আহমদকে খুঁজে বের করা হোক। এটা যদি তাঁর কিংবা তাঁর দলের আরেকটা চক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই চক্রান্তের মুখোশ উন্মুক্ত করাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। আর যদি এটা কোনো বাহিনীর কাজ হয়ে থাকে, তাহলেও তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হবে শান্তি ও সমঝোতা স্থাপনের পথে এক নম্বর পদক্ষেপ।
মাননীয় নেতারা,
আমরা পেট্রলবোমা চাই না। আমরা বোমাবাজি চাই না। আমরা চাই জীবনের নিরাপত্তা, আমরা চাই নিরাপদে চলাচল করার অধিকার। এটা দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের। আর সেই দায়িত্ব পালনে সরকারগুলো সাধারণত পুলিশি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। দুই হাজারের জায়গায় চার হাজার পুলিশ মোতায়েন করে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান নেই। এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই করতে হবে। এবং সে জন্য আপাতছাড়ের প্রয়োজন হলে তা দিতে হবে। কৌশলী হতে হবে।
এই কৌশলের অংশ হিসেবেই বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। সেই আলোচনার মাধ্যমে বিএনপি ও তার জোটকে অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
আর সরকারের কথা, কাজ ও আচরণ হতে হবে গণতান্ত্রিক। সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এর মানে এই নয়, যারা পেট্রলবোমা ছুড়ে সাধারণ শান্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছে, আহত করেছে, তাদের ছাড় দিতে হবে। তাদের বিচার করা হোক, দরকার হলে দ্রুত বিচার আদালতে বিচার করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হলে সেটাকে সব মহল স্বাগত জানাবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গোপনে তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম করে ফেলা, কিংবা ক্রসফায়ারে নেওয়া একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটা সরকারের ও সরকারি নেতাদের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করবে, আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। আপনারা নিশ্চয়ই নিজের ভালো বোঝেন। দলের ভালো বোঝেন। দেশের ভালো বোঝেন। আপনাদের, দলের ও দেশের ভালো হবে, যদি আপনাদের প্রতিটা পদক্ষেপ আইনানুগ হয়, গণতান্ত্রিক হয়।
যে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিরোধী দলে থেকে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করা, সেই আওয়ামী লীগের নেতাদের এ কথা বলারও কি দরকার পড়ে যে দমন-পীড়ন দিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করা যায় না, তা আখেরে দলের জন্য ভালো হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই কথা বহুবার বলেছেন। এমনকি পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে তাকে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।’ বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না, এটা বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তঁার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে রেখেছেন।
আলাপ-আলোচনার মানে এই নয় যে আপনারা পরাজিত হয়ে গেলেন। বিরোধী দলকে আন্দোলন থেকে ফেরাতে পারলেই তো আপনাদের জিত। এটা তো জেদাজেদির প্রশ্ন নয়। এটা হলো ১৬ কোটি মানুষের ভালো থাকা, খারাপ থাকার প্রশ্ন। বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে খুবই ভালো করছে। আমরা উন্নতির পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করবে। আর রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে যাদের আমরা হারিয়েছি, তাদের আর কোনো দিনও ফিরে পাব না। একটা প্রাণও অপচয়িত হতে দেওয়া যায় না। এক টাকার সম্পদও কেন আমরা ধ্বংস হতে দেব? রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের কোটি কোটি শিক্ষার্থী। কাজেই সরকারের উচিত হবে কৌশলগত কারণে বিএনপি ও তার জোটকে আন্দোলন থেকে ফিরে আসার একটা উপলক্ষ জোগানো। সালাহ উদ্দিন আহমদকে উদ্ধার হতে পারে সে লক্ষ্যে প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ হতে পারে, বাগাড়ম্বর বন্ধ করা, গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ চর্চা করা, শীলিত ভাষায় কথা বলা। তৃতীয় ধাপ হবে, বিরোধীদের তাদের দাবি-দাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য একটা পরিসর দেওয়া।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখি, দুটো রাজনৈতিক ধারা পাশাপাশি অবস্থান করে। একটা ‘এ’ দল থাকলে আরেকটা ‘বি’ দল থাকবেই। একটা মধ্য বাম, আরেকটা মধ্য ডান। বাংলাদেশেও এই রকম দুটো ধারাই থাকবে। তা সে যে নামেই থাকুক না কেন। কেউ কাউকে বিনাশ করতে পারবে, নির্মূল করতে পারবে, এই রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের শর্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই হবে সবচেয়ে বাস্তব আর বুদ্ধিমানের কাজ। আর শক্তি প্রয়োগ করে রাজনৈতিক বিরোধীকে নির্মূল করার চেষ্টা হবে আত্মঘাতী, যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী।
আপনাদের বিরোধীদের ভালোর জন্য নয়, বরং নিজেদের ভালোর জন্য হলেও ন্যূনতম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সূত্র আপনারা অন্বেষণ করুন। দেশের মানুষ তাঁকেই বেশি ভালোবাসবে, দেশের জন্য শান্তির পথে যিনি বেশি ছাড় দেবেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments