আমি বিজয় দেখিনি by আশান উজ জামান
আমাদের গ্রামটা ঠিক একটা দ্বীপের মতো। চারপাশেই পানি। তিন পাশে বিশাল বাঁওড়। আত্মীয়-কুটুমবাড়ি, ইশকুল, মাদ্রাসা, হাট-বাজার—সবই ওপারের গ্রামগুলোয়। আর এক পাশে চিরকেলে বিল। বিল পার হলে মাটির পথ। পথটা পায়ে পায়ে থানা বাজারে গিয়ে উঠেছে। তবে খুব বেশি দরকার না হলে লোকজন ও পথ মাড়ায় না। সব কাজ তাদের ওই বাঁওড়ে। আর বাঁওড়ের ওপারে। আর বিলে। এখন যদি ও গ্রামে কেউ যায় দেখতে পাবে দু-একটা ইটের ছাড়া ঘর, ঠিক সে রকমই ছিল একাত্তরেও। যাতায়াতের জন্য নৌকো আর ডুঙ্গাই ছিল ভরসা। যাদের এসব ছিল না তারা চলত ভেলায়। তবে সে ছিল এক বিরাট ঝক্কি! অধিকাংশ লোকই তাই পারাপার হতো নৌকোয়। ভাড়া দিয়ে। ভাড়া-নৌকোটা ছিল মঈজদ্দি মোড়লের। গ্রামের সবচেয়ে ধনী ছিলেন তিনি। লোকজন তাই মেনেই চলত তাঁকে। ভাড়া খাটা নৌকোটা ছাড়াও পারিবারিক কাজের জন্য আরেকটা নৌকো ছিল তঁার। সেটা চালানোর জন্য একজন লোক রাখা ছিল। নাম আরব আলি। একটা পা খোঁড়া ছিল লোকটার। কেউ কেউ তাকে তাই ‘খোঁড়া মাঝি’ বলেও ডাকত। ওই লোকটাই আমার বাবা।
আমার মা-ও মোড়লবাড়িতে কাজ করত। রান্না আর কাপড়চোপড় ধোয়ার কাজ। আমাদের আসল বাড়ি ছিল বাঁওড়ের ওপারে। খামারপাড়ায়। দাদা-দাদি মারা গেছেন আব্বার ছোটবেলায়। জমি-জায়গা নেই। অচল পা নিয়ে কিছু করারও নেই। এবাড়ি ওবাড়ি চেয়ে খেয়ে দিন কাটে। সেই অসময়ে মঈজদ্দি মোড়লই তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। আশ্রয় দিয়েছিলেন।
সেই থেকে এ বাড়িতেই থাকা। এ গ্রামই আমাদের ঠিকানা।
তখন যুদ্ধের কাল।
শোনা যাচ্ছে, মিলিটারিরা গ্রামে গ্রামে আসছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ মেরে ফেলছে।
সহজে আসার পথ নেই বলে আসতে পারেনি আমাদের গ্রামে। তবু লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে লাগল। মোড়লবাড়ির অনেক কাজের লোকও চলে গেল।
আশপাশের গ্রামের অবস্থা আরও খানিকটা খারাপ হলে মোড়ল বাকি লোকদের ডেকে বললেন, ‘অবস্থা খারাপ হই গেচে। আত্তো থাকা যাবে নাই। কাইল বিয়ান বেলা শিকেরপুর গিরামে হামলা হয়েচে। বাঁওড় পারোয়ে এদিকিও তো চলে আসতি পারে যেদিন সেদিন। আমাদের চলে যাওয়াই উচিত মনে হচ্চে।’ যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল সবাই, রাতের মধ্যেই গোজগাজ সেরে রওনা হয়ে গেল।
মা-বাবাও গুছিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমরা ‘গেলি বাড়িঘর দ্যাখবেনে কিডা? আর গেলিই বা কী? সব গিরামের তো একই হাল। একেনে যেমন, সেকেনেও তেমন। ভালো হয় তুমরা থাকো। ধান চাইল সব থাইকল। দেকেশুনে রাকো। আর সারা জীবনের জন্যি তো যাচ্চিনে। দুদিন পর সব ঠান্ডা হয়ে গেলি আমরা চলে আসবানে।’ আব্বা কখনো মোড়লের কথার ওপর কথা বলে না। এবারও বলল না।
আমরা তাই থেকে গেলাম। সেই একলা গ্রামে, একলা বাড়িতে আমরা একা তিনজন। মা প্রায়ই বলত, ‘চারদিক কেমন ছমছম করচে।’ আব্বা সাহস দিত মাকে, ‘ওরে কিচ্চু হবে নাই। বাঁওড় পারোয়ে আসা ওই শালাগের কম্ম না। এত সহজ নাকি?’ মা তবু সাবধানে থাকতে বলত। আর সারাক্ষণ বিড়বিড় করত। দোয়া পড়লে নাকি বিপদ আসে না।
বিপদের কিছু আমি বুঝতাম না। আমার ভালোই লাগত। আগে কত ঝামেলা ছিল। কত মানুষ, কত কাজ। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত। আব্বাকে তো দিনের বেলা প্রায় দেখতেই পেতাম না। সারা দিন শুধু বাঁওড় আর মাঠ। বিল আর বাজার। কিন্তু ওই সময় বাড়ি থাকত। আমাদের সাথে থাকত।
মাঝে মাঝে আমি কিছু ঝামেলা বাধাতাম। ওরা দুজন মিলেই তা সামলে নিত।
মা আমাকে গান গেয়ে শোনাত। আব্বা বাঁশি বাজাত সন্ধে হলে।
মাঝে মাঝে আমরা বাঁওড়ে যেতাম। নৌকো চড়তাম।
আব্বা চালাত। মা বসে থাকত। আব্বা কথা বলত। মা কথা বলত। কখনো আমার সাথে। কখনো আমাকে নিয়ে।
খুব ভালো লাগত আমার।
মা আমাকে বাঁওড়ের সুন্দর নীল পানি দেখাত। মাছরাঙা আর বক দেখাত। মাছের ঝাঁক দেখাত। আর পানির মধ্যে আকাশের ছবি দেখাত, ‘দেকিচাও, কি সুন্দর পানি! পানির মদ্যি আকাশ কিরাম করে শুয়ে রয়েচে, দ্যাকো!’ আমি দেখতাম। আমার ভালো লাগত।
একদিন দেখি পানিতে একটা লোক ভাসছে। মা অক অক করে উঠল!
সেদিন থেকে আর আমাদের বাঁওড়ে নিয়ে গেল না আব্বা। একা একা বের হতো। ফিরে এসে নানা রকম খবর দিত। ওই গ্রামে এই হয়েছে, ওই হয়েছে। এত মানুষ ধরেছে। এভাবে মেরেছে। অমুক গ্রামে আগুন। তমুক গ্রামে ক্যাম্প। সাত-সতেরো।
খুব ভয় করত আমার।
একদিন দেখি আব্বা একদল লোককে নিয়ে এসেছে। কেমন গরিব-গরিব চেহারা সবার। পিঠে কী একটা করে জিনিস। নলমতো। মা বলল ওটা ওদের অস্ত্র। ওরা মুক্তি।
ওদের জন্য রান্না হলো। ওরা খেলো।
ভেবেছিলাম কুটুম আসার মতো চলে যাবে। কিন্তু গেল না। কাজের মানুষদের থাকার জন্য আমাদের ঘরের পাশে যে ঘরগুলো আছে, ওগুলোতে থাকা শুরু করল।
মা-বাবার ব্যস্ততা গেল বেড়ে। আবার। আগের মতো।
মা সারাক্ষণ রান্নার জোগাড়-যন্ত্র নিয়ে থাকে। আগে আমার সাথে কত কথা বলত, এখন বলতে গেলে বলেই না। গল্প করে না। গান শোনায় না। ওই মুক্তিরাই যেন সব। তার কাজই যেন শুধু রান্না করা আর ওদের খাওয়ানো। খাওয়ানো আর রান্না। আগ বাড়িয়ে আবার দু-একজনের কাপড়ও ধুয়ে দিত। আমার রাগ হতো।
আব্বা তো আরও বেশি! প্রায়ই রাতে ওদের নিয়ে চলে যেত। কোথায় যেত জানি না। মা বলত ‘উরা যুদ্দ কত্তি যায়।’ আব্বা না ফেরা পর্যন্ত মা শুত না। পিদিমটা জ্বালিয়ে কাঁথা সেলাই করত। আর আমার সাথে গল্প করত। নানাবাড়ির গল্প। ভূতের বাড়ির গল্প। আমার ভালো লাগত। সবচেয়ে ভালো লাগত বাঁওড়ের তলায় সোনার দেশের গল্প।
আমাদের বাঁওড়ের তলায় নাকি একটা সোনার দেশ ছিল। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সবই সোনার। সে দেশের মানুষ খুব ভালো। আর দয়াবান। চাইলেই তারা মানুষকে সাহায্য করত। তবে চাইতে হতো কায়দা করে। যেমন কারও মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে বাসনকোসন লাগবে। তাহলে তাকে বাঁওড়ের ধারে ইয়া বড় গাবগাছটার নিচে যেতে হবে। সন্ধ্যার সময়। পূর্ব দিকে মুখ করে চোখ বুজে মনে মনে সোনার দেশের রাজার কাছে অনুরোধ করতে হবে তাকে কিছু প্লেট-গ্লাস দেওয়ার জন্য। পরের দিন ভোরবেলা দেখা যাবে গাবগাছের শিকড়ের ভেতর সোনার বাসন সোনার গ্লাস সোনার বাটি সোনার গয়না থরে থরে সাজানো। কাজ শেষে এসব আবার গুনে গুনে ফেরত দিতে হবে সেখানেই। এবং মনে মনে ধন্যবাদ দিতে হবে। এই ফেরত দিতে গিয়েই একবার কে যেন রেখে দিয়েছিল একটা গ্লাস। তার পর থেকে আর সোনার দেশের লোকেরা মানুষের কথা শোনে না।
ইশ্! যদি এখনো সব আগের মতো থাকত! আমি শুধু দুটো কানের দুল চেয়ে নিতাম। মায়ের এক জোড়া সোনার দুলের খুব শখ। এসব ভাবতে ভাবতে আর গল্প শুনতে শুনতেই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।
মাঝে মাঝে উঠোনে গিয়ে গিয়ে আমরা দেখে আসতাম মুক্তিরা আসছে কি না। তারপর আবার শুরু হতো কথা। মা আমাকে যুদ্ধের কথা বলত, স্বাধীনতার কথা বলত, ‘একদিন স্বাদিনতা আসবে। আমরা স্বাদিন হব। আরেট্টু বড় হলি তুমিও স্বাদিন হবা। তকন তুমাকে নানিবাড়ি নিয়ে যাব। ভূতবাড়ি দেকাব।’
ভূতবাড়ি দেখার খুব শখ আমার। তাই নানিবাড়ি যেতে ইচ্ছে করত খুব। স্বাধীন হতে ইচ্ছে করত। খুব।
মাঝরাতে কখনো, কখনো শেষ রাতে ফিরে আসত বাবা। মুক্তিরা যে যার মতো শুয়ে পড়লে আব্বা আসত আমাদের কাছে। আমাকে একটু আদর করে শুয়ে পড়ত।
সকালে আমার ঘুম ভাঙতেই দেখতাম মা কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমি আবার পর হয়ে গেছি।
আব্বা আর মুক্তিরা উঠত অনেক বেলা করে। গান-বাজনা করত। রেডিও শুনত। ওদের সাথে আব্বা-মাও শুনত। আমিও।
কোনো কোনো দিন খুব খুশি থাকত ওরা। কোনো কোনো দিন মনমরা মা বলত মুক্তিরা সবাই খুব ভালো। আমারও তা-ই মনে হতো। বাড়ির লোকেদের মতো ওরা কেউ আব্বা-মাকে গালাগাল দিত না। বকাবকি করত না। আপনি আপনি করে কথা বলত। আমার ভালো লাগত। একদিন এক মুক্তিকে ধরাধরি করে আনল ওরা। কাপড়ে রক্ত আর রক্ত। সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করল মা। কাপড় বেঁধে দিল। লোকটা কাঁদছে না। কিন্তু চোখে পানি। ভাবলাম মুছে দিই। মা দিতে দিল না। আমি চলে আসতে চাচ্ছিলাম। পারলাম না। মা না আসলে আমি আসি কী করে?
আর একজন লোক এল ও রকম আহত হয়ে।
ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ল মায়ের ওপর। মায়ের ব্যস্ততা আরও বাড়ল।
একটা লোক মারা গেল। মোড়লবাড়ির পেছনে একটা খেজুরবন আছে। ওখানে একটা গর্ত করে তাকে পুঁতে দিল মুক্তিরা। আমার খারাপ লাগছিল খুব। সবাই ওপরে থাকবে আর একটা মানুষ মাটির নিচে! একটা গর্তে একা! ভয় করবে না লোকটার? মা দেখলাম কাঁদছে। ঘরে এসে আমাকে বলল, ‘মরা মানুষের জন্যি ওই গত্তই হচ্চে ঘর। তুমার নানানানিও ওইরাম দুটো ঘরে শুয়ে আচে।’ ঘরটা আবার একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার। মা আর নিয়ে গেল না। শুয়ে শুয়ে কাঁদল। সবাই খুব মনমরা হয়ে থাকল কদিন। তারপর আবার সেই আগের মতো। যাওয়া আর আসা। ঘুম আর যাওয়া।
একদিন রাতে মায়ের কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গিয়েছি। আব্বা কখন এসেছে জানি না। হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি। ঘুম ভেঙে গেল আমার। মায়ের সাথে বাইরে বের হয়ে দেখি অনেক মানুষ। সবার গায়ে একই রকম পোশাক। মাথায় টুপি। পায়ে বুট। হাতে মুক্তিদের মতো অস্ত্র। চারদিকে ধোঁয়া। মুক্তিদের থাকার ঘরে আগুন জ্বলছে। আর ভীষণ শব্দ হচ্ছে। ঠাশ ঠাশ ঠাশ।
মুক্তিরা সব দৌড়াচ্ছে। কারও কাছে অস্ত্র, কারও হাত খালি। কয়েকজন দেখলাম উঠোনে পড়ে আছে।
মা ওদের দিকে যেতে চাইল। আব্বা যেতে দিল না। বলল, ‘পলাও’। মা পালাল না। দাঁড়িয়েই থাকল।
আব্বা চিৎকার করে বলল, ‘বের হও, পলাও তাড়াতাড়ি।’
এরপর মা ছোটা শুরু করল। ঘরের পেছন দিকে গলি দিয়ে। ছুটছে তো ছুটছেই। সঙ্গে আমি।
চারদিক থেকে শব্দ আসছে। চিৎকার-চেঁচামেচি। আর ঠাশ ঠাশ।
আমরা বিলের দিকে যাচ্ছি। মায়ের কষ্ট হচ্ছে খুব। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। আমরা আর পারছি না। সামনেই খেজুরবাগান। বাগানে ঢুকব এমন সময় একটা গুলি এসে লাগল মায়ের গায়ে। মা পড়ে গেল। আমিও পড়ে গিয়েছি। ওঠার চেষ্টা করছি। পারছি না। বাবাকে খুঁজছি । দেখছি না কোথাও।
মা চিৎকার করছে। হাত-পা ছুড়ছে।
একজন লোক এল আমাদের দিকে। লোকটাকে আমি আগেও দেখেছি। আমাদের গ্রামের। তার হাতেও অস্ত্র। কাছে এসে মাকে দেখল। লাথি মারল। অস্ত্রটা দিয়ে খোঁচা দিল। মা ককিয়ে উঠল।
এবার দেখলাম আব্বাকে। খোঁড়া পা-টা টেনে টেনে আসছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাঁদছে। গালি দিচ্ছে।
আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। পেছনের বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। পুড়ে যাচ্ছে সব।
লোকটা আব্বাকে দেখল। আব্বার দিকে চলে গেল। হাতে অস্ত্র। আব্বা আসছেই। থামছে না।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল লোকটাকে ধরতে। থামাতে। মারতে।
কাঁদতে ইচ্ছে করছিল খুব।
ইচ্ছে করছিল মাকে ছেড়ে আসতে। বিজয়ী হতে। স্বাধীন হতে।
পারিনি। কারণ তখনো পারতে শিখিনি।
মার পেটে ছিলাম। সেখানেই থেকে গেলাম।
না হলে হয়তো আমি স্বাধীন হতাম। বিজয় দেখতাম।
আমার মা-ও মোড়লবাড়িতে কাজ করত। রান্না আর কাপড়চোপড় ধোয়ার কাজ। আমাদের আসল বাড়ি ছিল বাঁওড়ের ওপারে। খামারপাড়ায়। দাদা-দাদি মারা গেছেন আব্বার ছোটবেলায়। জমি-জায়গা নেই। অচল পা নিয়ে কিছু করারও নেই। এবাড়ি ওবাড়ি চেয়ে খেয়ে দিন কাটে। সেই অসময়ে মঈজদ্দি মোড়লই তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। আশ্রয় দিয়েছিলেন।
সেই থেকে এ বাড়িতেই থাকা। এ গ্রামই আমাদের ঠিকানা।
তখন যুদ্ধের কাল।
শোনা যাচ্ছে, মিলিটারিরা গ্রামে গ্রামে আসছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষ মেরে ফেলছে।
সহজে আসার পথ নেই বলে আসতে পারেনি আমাদের গ্রামে। তবু লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে লাগল। মোড়লবাড়ির অনেক কাজের লোকও চলে গেল।
আশপাশের গ্রামের অবস্থা আরও খানিকটা খারাপ হলে মোড়ল বাকি লোকদের ডেকে বললেন, ‘অবস্থা খারাপ হই গেচে। আত্তো থাকা যাবে নাই। কাইল বিয়ান বেলা শিকেরপুর গিরামে হামলা হয়েচে। বাঁওড় পারোয়ে এদিকিও তো চলে আসতি পারে যেদিন সেদিন। আমাদের চলে যাওয়াই উচিত মনে হচ্চে।’ যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল সবাই, রাতের মধ্যেই গোজগাজ সেরে রওনা হয়ে গেল।
মা-বাবাও গুছিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমরা ‘গেলি বাড়িঘর দ্যাখবেনে কিডা? আর গেলিই বা কী? সব গিরামের তো একই হাল। একেনে যেমন, সেকেনেও তেমন। ভালো হয় তুমরা থাকো। ধান চাইল সব থাইকল। দেকেশুনে রাকো। আর সারা জীবনের জন্যি তো যাচ্চিনে। দুদিন পর সব ঠান্ডা হয়ে গেলি আমরা চলে আসবানে।’ আব্বা কখনো মোড়লের কথার ওপর কথা বলে না। এবারও বলল না।
আমরা তাই থেকে গেলাম। সেই একলা গ্রামে, একলা বাড়িতে আমরা একা তিনজন। মা প্রায়ই বলত, ‘চারদিক কেমন ছমছম করচে।’ আব্বা সাহস দিত মাকে, ‘ওরে কিচ্চু হবে নাই। বাঁওড় পারোয়ে আসা ওই শালাগের কম্ম না। এত সহজ নাকি?’ মা তবু সাবধানে থাকতে বলত। আর সারাক্ষণ বিড়বিড় করত। দোয়া পড়লে নাকি বিপদ আসে না।
বিপদের কিছু আমি বুঝতাম না। আমার ভালোই লাগত। আগে কত ঝামেলা ছিল। কত মানুষ, কত কাজ। মা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত। আব্বাকে তো দিনের বেলা প্রায় দেখতেই পেতাম না। সারা দিন শুধু বাঁওড় আর মাঠ। বিল আর বাজার। কিন্তু ওই সময় বাড়ি থাকত। আমাদের সাথে থাকত।
মাঝে মাঝে আমি কিছু ঝামেলা বাধাতাম। ওরা দুজন মিলেই তা সামলে নিত।
মা আমাকে গান গেয়ে শোনাত। আব্বা বাঁশি বাজাত সন্ধে হলে।
মাঝে মাঝে আমরা বাঁওড়ে যেতাম। নৌকো চড়তাম।
আব্বা চালাত। মা বসে থাকত। আব্বা কথা বলত। মা কথা বলত। কখনো আমার সাথে। কখনো আমাকে নিয়ে।
খুব ভালো লাগত আমার।
মা আমাকে বাঁওড়ের সুন্দর নীল পানি দেখাত। মাছরাঙা আর বক দেখাত। মাছের ঝাঁক দেখাত। আর পানির মধ্যে আকাশের ছবি দেখাত, ‘দেকিচাও, কি সুন্দর পানি! পানির মদ্যি আকাশ কিরাম করে শুয়ে রয়েচে, দ্যাকো!’ আমি দেখতাম। আমার ভালো লাগত।
একদিন দেখি পানিতে একটা লোক ভাসছে। মা অক অক করে উঠল!
সেদিন থেকে আর আমাদের বাঁওড়ে নিয়ে গেল না আব্বা। একা একা বের হতো। ফিরে এসে নানা রকম খবর দিত। ওই গ্রামে এই হয়েছে, ওই হয়েছে। এত মানুষ ধরেছে। এভাবে মেরেছে। অমুক গ্রামে আগুন। তমুক গ্রামে ক্যাম্প। সাত-সতেরো।
খুব ভয় করত আমার।
একদিন দেখি আব্বা একদল লোককে নিয়ে এসেছে। কেমন গরিব-গরিব চেহারা সবার। পিঠে কী একটা করে জিনিস। নলমতো। মা বলল ওটা ওদের অস্ত্র। ওরা মুক্তি।
ওদের জন্য রান্না হলো। ওরা খেলো।
ভেবেছিলাম কুটুম আসার মতো চলে যাবে। কিন্তু গেল না। কাজের মানুষদের থাকার জন্য আমাদের ঘরের পাশে যে ঘরগুলো আছে, ওগুলোতে থাকা শুরু করল।
মা-বাবার ব্যস্ততা গেল বেড়ে। আবার। আগের মতো।
মা সারাক্ষণ রান্নার জোগাড়-যন্ত্র নিয়ে থাকে। আগে আমার সাথে কত কথা বলত, এখন বলতে গেলে বলেই না। গল্প করে না। গান শোনায় না। ওই মুক্তিরাই যেন সব। তার কাজই যেন শুধু রান্না করা আর ওদের খাওয়ানো। খাওয়ানো আর রান্না। আগ বাড়িয়ে আবার দু-একজনের কাপড়ও ধুয়ে দিত। আমার রাগ হতো।
আব্বা তো আরও বেশি! প্রায়ই রাতে ওদের নিয়ে চলে যেত। কোথায় যেত জানি না। মা বলত ‘উরা যুদ্দ কত্তি যায়।’ আব্বা না ফেরা পর্যন্ত মা শুত না। পিদিমটা জ্বালিয়ে কাঁথা সেলাই করত। আর আমার সাথে গল্প করত। নানাবাড়ির গল্প। ভূতের বাড়ির গল্প। আমার ভালো লাগত। সবচেয়ে ভালো লাগত বাঁওড়ের তলায় সোনার দেশের গল্প।
আমাদের বাঁওড়ের তলায় নাকি একটা সোনার দেশ ছিল। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সবই সোনার। সে দেশের মানুষ খুব ভালো। আর দয়াবান। চাইলেই তারা মানুষকে সাহায্য করত। তবে চাইতে হতো কায়দা করে। যেমন কারও মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে বাসনকোসন লাগবে। তাহলে তাকে বাঁওড়ের ধারে ইয়া বড় গাবগাছটার নিচে যেতে হবে। সন্ধ্যার সময়। পূর্ব দিকে মুখ করে চোখ বুজে মনে মনে সোনার দেশের রাজার কাছে অনুরোধ করতে হবে তাকে কিছু প্লেট-গ্লাস দেওয়ার জন্য। পরের দিন ভোরবেলা দেখা যাবে গাবগাছের শিকড়ের ভেতর সোনার বাসন সোনার গ্লাস সোনার বাটি সোনার গয়না থরে থরে সাজানো। কাজ শেষে এসব আবার গুনে গুনে ফেরত দিতে হবে সেখানেই। এবং মনে মনে ধন্যবাদ দিতে হবে। এই ফেরত দিতে গিয়েই একবার কে যেন রেখে দিয়েছিল একটা গ্লাস। তার পর থেকে আর সোনার দেশের লোকেরা মানুষের কথা শোনে না।
ইশ্! যদি এখনো সব আগের মতো থাকত! আমি শুধু দুটো কানের দুল চেয়ে নিতাম। মায়ের এক জোড়া সোনার দুলের খুব শখ। এসব ভাবতে ভাবতে আর গল্প শুনতে শুনতেই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।
মাঝে মাঝে উঠোনে গিয়ে গিয়ে আমরা দেখে আসতাম মুক্তিরা আসছে কি না। তারপর আবার শুরু হতো কথা। মা আমাকে যুদ্ধের কথা বলত, স্বাধীনতার কথা বলত, ‘একদিন স্বাদিনতা আসবে। আমরা স্বাদিন হব। আরেট্টু বড় হলি তুমিও স্বাদিন হবা। তকন তুমাকে নানিবাড়ি নিয়ে যাব। ভূতবাড়ি দেকাব।’
ভূতবাড়ি দেখার খুব শখ আমার। তাই নানিবাড়ি যেতে ইচ্ছে করত খুব। স্বাধীন হতে ইচ্ছে করত। খুব।
মাঝরাতে কখনো, কখনো শেষ রাতে ফিরে আসত বাবা। মুক্তিরা যে যার মতো শুয়ে পড়লে আব্বা আসত আমাদের কাছে। আমাকে একটু আদর করে শুয়ে পড়ত।
সকালে আমার ঘুম ভাঙতেই দেখতাম মা কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমি আবার পর হয়ে গেছি।
আব্বা আর মুক্তিরা উঠত অনেক বেলা করে। গান-বাজনা করত। রেডিও শুনত। ওদের সাথে আব্বা-মাও শুনত। আমিও।
কোনো কোনো দিন খুব খুশি থাকত ওরা। কোনো কোনো দিন মনমরা মা বলত মুক্তিরা সবাই খুব ভালো। আমারও তা-ই মনে হতো। বাড়ির লোকেদের মতো ওরা কেউ আব্বা-মাকে গালাগাল দিত না। বকাবকি করত না। আপনি আপনি করে কথা বলত। আমার ভালো লাগত। একদিন এক মুক্তিকে ধরাধরি করে আনল ওরা। কাপড়ে রক্ত আর রক্ত। সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করল মা। কাপড় বেঁধে দিল। লোকটা কাঁদছে না। কিন্তু চোখে পানি। ভাবলাম মুছে দিই। মা দিতে দিল না। আমি চলে আসতে চাচ্ছিলাম। পারলাম না। মা না আসলে আমি আসি কী করে?
আর একজন লোক এল ও রকম আহত হয়ে।
ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ল মায়ের ওপর। মায়ের ব্যস্ততা আরও বাড়ল।
একটা লোক মারা গেল। মোড়লবাড়ির পেছনে একটা খেজুরবন আছে। ওখানে একটা গর্ত করে তাকে পুঁতে দিল মুক্তিরা। আমার খারাপ লাগছিল খুব। সবাই ওপরে থাকবে আর একটা মানুষ মাটির নিচে! একটা গর্তে একা! ভয় করবে না লোকটার? মা দেখলাম কাঁদছে। ঘরে এসে আমাকে বলল, ‘মরা মানুষের জন্যি ওই গত্তই হচ্চে ঘর। তুমার নানানানিও ওইরাম দুটো ঘরে শুয়ে আচে।’ ঘরটা আবার একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার। মা আর নিয়ে গেল না। শুয়ে শুয়ে কাঁদল। সবাই খুব মনমরা হয়ে থাকল কদিন। তারপর আবার সেই আগের মতো। যাওয়া আর আসা। ঘুম আর যাওয়া।
একদিন রাতে মায়ের কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গিয়েছি। আব্বা কখন এসেছে জানি না। হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি। ঘুম ভেঙে গেল আমার। মায়ের সাথে বাইরে বের হয়ে দেখি অনেক মানুষ। সবার গায়ে একই রকম পোশাক। মাথায় টুপি। পায়ে বুট। হাতে মুক্তিদের মতো অস্ত্র। চারদিকে ধোঁয়া। মুক্তিদের থাকার ঘরে আগুন জ্বলছে। আর ভীষণ শব্দ হচ্ছে। ঠাশ ঠাশ ঠাশ।
মুক্তিরা সব দৌড়াচ্ছে। কারও কাছে অস্ত্র, কারও হাত খালি। কয়েকজন দেখলাম উঠোনে পড়ে আছে।
মা ওদের দিকে যেতে চাইল। আব্বা যেতে দিল না। বলল, ‘পলাও’। মা পালাল না। দাঁড়িয়েই থাকল।
আব্বা চিৎকার করে বলল, ‘বের হও, পলাও তাড়াতাড়ি।’
এরপর মা ছোটা শুরু করল। ঘরের পেছন দিকে গলি দিয়ে। ছুটছে তো ছুটছেই। সঙ্গে আমি।
চারদিক থেকে শব্দ আসছে। চিৎকার-চেঁচামেচি। আর ঠাশ ঠাশ।
আমরা বিলের দিকে যাচ্ছি। মায়ের কষ্ট হচ্ছে খুব। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। আমরা আর পারছি না। সামনেই খেজুরবাগান। বাগানে ঢুকব এমন সময় একটা গুলি এসে লাগল মায়ের গায়ে। মা পড়ে গেল। আমিও পড়ে গিয়েছি। ওঠার চেষ্টা করছি। পারছি না। বাবাকে খুঁজছি । দেখছি না কোথাও।
মা চিৎকার করছে। হাত-পা ছুড়ছে।
একজন লোক এল আমাদের দিকে। লোকটাকে আমি আগেও দেখেছি। আমাদের গ্রামের। তার হাতেও অস্ত্র। কাছে এসে মাকে দেখল। লাথি মারল। অস্ত্রটা দিয়ে খোঁচা দিল। মা ককিয়ে উঠল।
এবার দেখলাম আব্বাকে। খোঁড়া পা-টা টেনে টেনে আসছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাঁদছে। গালি দিচ্ছে।
আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে আছি। পেছনের বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। পুড়ে যাচ্ছে সব।
লোকটা আব্বাকে দেখল। আব্বার দিকে চলে গেল। হাতে অস্ত্র। আব্বা আসছেই। থামছে না।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল লোকটাকে ধরতে। থামাতে। মারতে।
কাঁদতে ইচ্ছে করছিল খুব।
ইচ্ছে করছিল মাকে ছেড়ে আসতে। বিজয়ী হতে। স্বাধীন হতে।
পারিনি। কারণ তখনো পারতে শিখিনি।
মার পেটে ছিলাম। সেখানেই থেকে গেলাম।
না হলে হয়তো আমি স্বাধীন হতাম। বিজয় দেখতাম।
No comments