অসহযোগ থেকে জনগণের রাজ by রেহমান সোবহান
গেল শতকের ষাটের দশকে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’র প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান
খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূচনাপর্বের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বহির্বিশ্বে অগ্রণী
ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন রেহমান সোবহান।
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি তাঁর পর্যবেক্ষেণ উঠে এসেছে, যা প্রথম ছাপা
হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত ফোরাম–এ। তিন কিস্তিতে তাঁর এই ধারাবাহিক রচনাটি
প্রকাশিত হচ্ছে...
বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে, তার নজির ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ইসলামাবাদ সরকারের কাছ থেকে কার্যত ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। না, মহারণ বিজয়ের মাধ্যমে হয়নি, আবার বিদেশিদের হস্তক্ষেপেও হয়নি। আবার শাসকশ্রেণি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, ব্যাপারটা তা–ও নয়। মুখ্যত শান্তিপূর্ণ উপায়েই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু অনেকে বলেন, গত এক সপ্তাহের বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও নিপীড়নের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছে।
এই পরিস্থিতির অনন্য ব্যাপার হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে জনগণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার প্রশ্ন আর নেই। সব স্বাধীনতা সংগ্রামেই অসহযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা অর্থনীতি ও প্রশাসনকে পঙ্গু করে দেয়। শাসকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও দেখা গেছে বেসামরিক প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময়ই রাস্তায় নেমেছেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশকে মাঠে নামতে হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নজিরবিহীন ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামাবাদের শাসকদের সঙ্গে এই অসহযোগ সর্বাত্মক। গত সপ্তাহে প্রশাসনের একজনও ইসলামাবাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রধান সচিব পর্যন্ত সবাই এই কাতারে যোগ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দুনিয়ার কোথাও এমন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
রেডিও পাকিস্তানে এক অসাধারণ ঘটনা ঘটেছে। সেনা সরকার প্রথমে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিলেও পরবর্তীকালে তা প্রত্যাহার করে। প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তানের কর্মীরা সব বন্ধ করে বাড়ি চলে যান। হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ করায় মানুষ ধারণা করে, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত চেক ভাঙানোর অনুমতি দেওয়া হয়। পরবর্তী দিন বেতন ও মজুরি দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়, তবে সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নের সত্যায়ন সাপেক্ষে। সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য এটা করা হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খোলা রাখায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে ব্যাংকিংয়ের সময় অবশ্য বাড়ানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাতে টাকা আর না যায়, সে জন্য এসব করা হয়েছে।
একইভাবে ৯ মার্চের ডিক্রিতে সরকারি কার্যক্রম শুরুর ডিক্রি জারি করা হয়। স্টেট ব্যাংকও প্রয়োজন অনুযায়ী সীমিত আকারে খোলা হয়। কৃষকদের সুবিধার্থে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনও খোলা হয়। পাট ও ধানের চারা বিতরণ শুরু হয়। ১২ মার্চ আরও বৃহৎ এক ডিক্রির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অসহযোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে আমলারা বসে থাকেননি। তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতার পথে হাঁটেন। একদল সমস্যা চিহ্নিত করে শেখ মুজিবের কাছে পেশ করে। নতুন এক সচিবালয় গড়ে ওঠে, যেখানে সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা জড়ো হয়ে সমস্যার সমাধান খোঁজেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবই প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
যা-ই হোক, জনগণের প্রতিনিধিরাই কার্যত দেশ শাসন করতে থাকেন। সচিব, ডিসি, সার্কেল অফিসার, পুলিশ—সবাই তাঁদের নির্দেশে কাজ করতে থাকেন। পুলিশ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কাজ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। মফস্বল এলাকার কর্তৃপক্ষ সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ মেনে কাজ করতে থাকে। সবকিছুর উৎস কিন্তু একটাই—আওয়ামী লীগ।
আমলারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করলেও জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনার কাছে তা কিছুই না। দেখা গেল, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাই তাঁদের কর্মকর্তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। যেখানে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়েছিল, সেখানে তাঁদের অতি উৎসাহে প্রশাসনে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। দলের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেউ যেন অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে তাঁরা এককাট্টা হন। ফলে আমলারা নিজেদের কর্তৃত্ব পনুরুদ্ধারে ৩২ নম্বরে দৌড়ানো শুরু করেন। বেসরকারি ব্যাংক ও কারখানায়ও শ্রমিকেরা বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেন। তাঁদের বড় কর্তারা যাতে কোনো অন্তর্ঘাত করতে না পারেন, সেটা তাঁরা নিশ্চিত করেন।
আওয়ামী লীগের যে সীমিত কর্তৃত্ব ছিল, তা কোনো আদালতে বলবৎযোগ্য ছিল না। আবার তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে বেসরকারি ব্যাংক থেকে তাঁরা টাকা তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে বা অনাদিষ্ট কাজে টাকা না তোলার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও তা বলবৎ করার কেউ ছিল না।
জনগণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সহযোগিতা ও সীমাহীন আনুগত্যের কারণে এটা সম্ভব হয়। পুলিশ প্রতিবেদনে জানা যায়, সে সময় অপরাধের পরিমাণও কমে এসেছিল। অপরাধীরা আওয়ামী লীগের সবুজ টুপিধারী স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কাজ করেছে শুধু সহিংসতা বন্ধ করতে নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। গুলশান ও ধানমন্ডির মধ্যবিত্তরা কিছু ভয়ের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন।
তবে এটা বলা ঠিক হবে না যে বাংলাদেশে এক শান্তিপূর্ণ নির্বাণ নেমে এসেছিল। শোনা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগার ও পিসিএসআই থেকে বন্দুকাধারী ব্যক্তিরা রাসায়নিক ও বিস্ফোরক নিয়ে গেছে। ভিআইপিদের রক্ষীদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সংগ্রামের আরেকটি রূপও ঘনীভূত হচ্ছিল। ভবিষ্যতে কোনো সহিংসতা হলে তা একপক্ষীয় হবে না।
নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিরোধের স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যেও জঙ্গিত্ব দেখিয়েছে। তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও দেখা গেছে, সিলেট ও যশোরে তাদের ঘাঁটিতে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানের রাস্তায় প্রতিবন্ধক তৈরি করেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এমভি সোয়াতে যে পাকিস্তানি সেনা ও অস্ত্রের প্রথম চালানটি আসে, সেটা আংশিক নামানো হয় ওয়াগনে। কিন্তু শ্রমিকেরা নিজের উদ্যোগে মাল খালাস বন্ধ করে দেন। তাঁরা অচল ওয়াগনটি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও আমজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমে আসেন। এটা তাঁদের কাছে ছিল বাঁচার সংগ্রাম।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তাঁর যেকোনো দিন আসার কথা ছিল। লে. জেনারেল ইয়াকুব ৯ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন, তাঁর স্থলাবিষিক্ত হন গভর্নর মর্যাদার লে. জেনারেল টিক্কা খান। জানা যায়, ইয়াকুবের মধ্যে খুনির বৈশিষ্ট্য ছিল না। এ দেশের ভাষা শিখেছিলেন তিনি, এখানকার সংস্কৃতিরও তিনি খুব তারিফ করতেন। নিরাপত্তা বাহিনী সংঘর্ষ এড়াতে ব্যারাকের মধ্যেই ছিল। আকার-ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল, তারা ইয়াহিয়ার আগমনের অপেক্ষায় ছিল।
গত সপ্তাহে ইয়াহিয়ার কৌশল ছিল পুরস্কার ও শাস্তিদানের, যখন যেটা কাজে লাগানো যায়। তাঁর ৬ মার্চের বক্তৃতা বাংলাদেশের প্রতি চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক ছিল। ফলে শর্তহীনভাবে অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ ঘোষণা করার অর্থ ছিল অযৌক্তিক আচরণের স্বীকৃতি দেওয়ার শামিল। কিন্তু তাঁর এলএফওর উল্লেখ ও ইয়াকুবের বদলে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে বসানোর ঘটনায় বোঝা যায়, কোথাও বন্দুক ওঠানো হচ্ছে। তবে টিক্কা খান ঢাকায় আসার পর যথেষ্ট সংযত আচরণ করেছেন।
এরপর আমরা দেখলাম, পিপিপির চেয়ারম্যান ভুট্টো মৃত ব্যক্তিদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছেন আর মুজিবকে পাঠানো তারবার্তায় সমর্থনের ভাষায় কথা বলছেন।
তবে এসব ঘটনায় জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেন, এটা ছিল চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে সময়ক্ষেপণ। ইয়াহিয়া যখন ছয় দফা নাকচ করেছেন, তখন এসব ঘটছে। এর মধ্যে শক্তি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে।
আরেক দল মনে করত, ইয়াহিয়া বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করছেন। কারণ, ইসলামাবাদের হাতে তখন ক্ষমতা নেই। সেটা পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রদেশের প্রতিটি অঞ্চল একটার পর একটা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই অবস্থায় ইয়াহিয়া কার্যত মুজিবের দাবি মেনে নেবেন। তিনি বাংলাদেশে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না। সামরিক আইন প্রয়োগ না করে তিনি সামরিক শাসনের শেষ টানবেন। এর মধ্য দিয়ে যে সদ্বিশ্বাস তৈরি হবে, তা শেখ মুজিবের সংসদে আসার জন্য যথেষ্ট হবে।
তাহলে মুজিবকে ঠিক করতে হবে, কার্যত ক্ষমতার বদলে তাঁর আইনগত ক্ষমতার দাবি সংঘর্ষ এড়াতে যথেষ্ট কি না। এত দিনে তিনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে ইসলামাবাদের হাতে ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ থাকলে তার তেমন আকর্ষণ থাকবে না। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব, বৈদেশিক মুদ্রা ও সহায়তার ওপর তাঁর তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি তাঁর খসড়া পাস করে নিলেও ভেটোর সম্মুখীন হতে পারেন, যদি ইয়াহিয়া না বোঝেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধে ছয় দফাই সবচেয়ে খতরনাক।
মুজিব ছয় দফায় সমর্থন পেলে রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারবেন, বিপ্লবীদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু ইয়াহিয়া আবার ভেটো দিলে বা ভুট্টো আবারও অন্তর্ঘাত করলে তাঁর রাস্তায় নেমে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তখন তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি কি পূর্ণাঙ্গ জনযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন, নাকি জনগণের পরবর্তী ও চূড়ান্ত আন্দোলনে নিজেকে বাড়তি মানুষে পরিণত করবেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র: ফোরাম, ১৩ মার্চ ১৯৭১।
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে, তার নজির ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ইসলামাবাদ সরকারের কাছ থেকে কার্যত ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। না, মহারণ বিজয়ের মাধ্যমে হয়নি, আবার বিদেশিদের হস্তক্ষেপেও হয়নি। আবার শাসকশ্রেণি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, ব্যাপারটা তা–ও নয়। মুখ্যত শান্তিপূর্ণ উপায়েই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু অনেকে বলেন, গত এক সপ্তাহের বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও নিপীড়নের বিনিময়ে এটা সম্ভব হয়েছে।
এই পরিস্থিতির অনন্য ব্যাপার হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে জনগণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার প্রশ্ন আর নেই। সব স্বাধীনতা সংগ্রামেই অসহযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা অর্থনীতি ও প্রশাসনকে পঙ্গু করে দেয়। শাসকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও দেখা গেছে বেসামরিক প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময়ই রাস্তায় নেমেছেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশকে মাঠে নামতে হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নজিরবিহীন ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামাবাদের শাসকদের সঙ্গে এই অসহযোগ সর্বাত্মক। গত সপ্তাহে প্রশাসনের একজনও ইসলামাবাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রধান সচিব পর্যন্ত সবাই এই কাতারে যোগ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দুনিয়ার কোথাও এমন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
রেডিও পাকিস্তানে এক অসাধারণ ঘটনা ঘটেছে। সেনা সরকার প্রথমে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিলেও পরবর্তীকালে তা প্রত্যাহার করে। প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তানের কর্মীরা সব বন্ধ করে বাড়ি চলে যান। হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ করায় মানুষ ধারণা করে, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত চেক ভাঙানোর অনুমতি দেওয়া হয়। পরবর্তী দিন বেতন ও মজুরি দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়, তবে সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নের সত্যায়ন সাপেক্ষে। সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য এটা করা হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য ব্যাংক খোলা রাখায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে ব্যাংকিংয়ের সময় অবশ্য বাড়ানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাতে টাকা আর না যায়, সে জন্য এসব করা হয়েছে।
একইভাবে ৯ মার্চের ডিক্রিতে সরকারি কার্যক্রম শুরুর ডিক্রি জারি করা হয়। স্টেট ব্যাংকও প্রয়োজন অনুযায়ী সীমিত আকারে খোলা হয়। কৃষকদের সুবিধার্থে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনও খোলা হয়। পাট ও ধানের চারা বিতরণ শুরু হয়। ১২ মার্চ আরও বৃহৎ এক ডিক্রির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অসহযোগ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে আমলারা বসে থাকেননি। তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতার পথে হাঁটেন। একদল সমস্যা চিহ্নিত করে শেখ মুজিবের কাছে পেশ করে। নতুন এক সচিবালয় গড়ে ওঠে, যেখানে সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা জড়ো হয়ে সমস্যার সমাধান খোঁজেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবই প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
যা-ই হোক, জনগণের প্রতিনিধিরাই কার্যত দেশ শাসন করতে থাকেন। সচিব, ডিসি, সার্কেল অফিসার, পুলিশ—সবাই তাঁদের নির্দেশে কাজ করতে থাকেন। পুলিশ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কাজ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। মফস্বল এলাকার কর্তৃপক্ষ সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ মেনে কাজ করতে থাকে। সবকিছুর উৎস কিন্তু একটাই—আওয়ামী লীগ।
আমলারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করলেও জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনার কাছে তা কিছুই না। দেখা গেল, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাই তাঁদের কর্মকর্তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। যেখানে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়েছিল, সেখানে তাঁদের অতি উৎসাহে প্রশাসনে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। দলের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেউ যেন অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে তাঁরা এককাট্টা হন। ফলে আমলারা নিজেদের কর্তৃত্ব পনুরুদ্ধারে ৩২ নম্বরে দৌড়ানো শুরু করেন। বেসরকারি ব্যাংক ও কারখানায়ও শ্রমিকেরা বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেন। তাঁদের বড় কর্তারা যাতে কোনো অন্তর্ঘাত করতে না পারেন, সেটা তাঁরা নিশ্চিত করেন।
আওয়ামী লীগের যে সীমিত কর্তৃত্ব ছিল, তা কোনো আদালতে বলবৎযোগ্য ছিল না। আবার তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও ছিল না। ফলে বেসরকারি ব্যাংক থেকে তাঁরা টাকা তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে বা অনাদিষ্ট কাজে টাকা না তোলার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও তা বলবৎ করার কেউ ছিল না।
জনগণের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সহযোগিতা ও সীমাহীন আনুগত্যের কারণে এটা সম্ভব হয়। পুলিশ প্রতিবেদনে জানা যায়, সে সময় অপরাধের পরিমাণও কমে এসেছিল। অপরাধীরা আওয়ামী লীগের সবুজ টুপিধারী স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কাজ করেছে শুধু সহিংসতা বন্ধ করতে নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। গুলশান ও ধানমন্ডির মধ্যবিত্তরা কিছু ভয়ের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন।
তবে এটা বলা ঠিক হবে না যে বাংলাদেশে এক শান্তিপূর্ণ নির্বাণ নেমে এসেছিল। শোনা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগার ও পিসিএসআই থেকে বন্দুকাধারী ব্যক্তিরা রাসায়নিক ও বিস্ফোরক নিয়ে গেছে। ভিআইপিদের রক্ষীদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সংগ্রামের আরেকটি রূপও ঘনীভূত হচ্ছিল। ভবিষ্যতে কোনো সহিংসতা হলে তা একপক্ষীয় হবে না।
নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিরোধের স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যেও জঙ্গিত্ব দেখিয়েছে। তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও দেখা গেছে, সিলেট ও যশোরে তাদের ঘাঁটিতে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানের রাস্তায় প্রতিবন্ধক তৈরি করেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এমভি সোয়াতে যে পাকিস্তানি সেনা ও অস্ত্রের প্রথম চালানটি আসে, সেটা আংশিক নামানো হয় ওয়াগনে। কিন্তু শ্রমিকেরা নিজের উদ্যোগে মাল খালাস বন্ধ করে দেন। তাঁরা অচল ওয়াগনটি সেখান থেকে সরিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও আমজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমে আসেন। এটা তাঁদের কাছে ছিল বাঁচার সংগ্রাম।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তাঁর যেকোনো দিন আসার কথা ছিল। লে. জেনারেল ইয়াকুব ৯ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন, তাঁর স্থলাবিষিক্ত হন গভর্নর মর্যাদার লে. জেনারেল টিক্কা খান। জানা যায়, ইয়াকুবের মধ্যে খুনির বৈশিষ্ট্য ছিল না। এ দেশের ভাষা শিখেছিলেন তিনি, এখানকার সংস্কৃতিরও তিনি খুব তারিফ করতেন। নিরাপত্তা বাহিনী সংঘর্ষ এড়াতে ব্যারাকের মধ্যেই ছিল। আকার-ইঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল, তারা ইয়াহিয়ার আগমনের অপেক্ষায় ছিল।
গত সপ্তাহে ইয়াহিয়ার কৌশল ছিল পুরস্কার ও শাস্তিদানের, যখন যেটা কাজে লাগানো যায়। তাঁর ৬ মার্চের বক্তৃতা বাংলাদেশের প্রতি চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক ছিল। ফলে শর্তহীনভাবে অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ ঘোষণা করার অর্থ ছিল অযৌক্তিক আচরণের স্বীকৃতি দেওয়ার শামিল। কিন্তু তাঁর এলএফওর উল্লেখ ও ইয়াকুবের বদলে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে বসানোর ঘটনায় বোঝা যায়, কোথাও বন্দুক ওঠানো হচ্ছে। তবে টিক্কা খান ঢাকায় আসার পর যথেষ্ট সংযত আচরণ করেছেন।
এরপর আমরা দেখলাম, পিপিপির চেয়ারম্যান ভুট্টো মৃত ব্যক্তিদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছেন আর মুজিবকে পাঠানো তারবার্তায় সমর্থনের ভাষায় কথা বলছেন।
তবে এসব ঘটনায় জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেন, এটা ছিল চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে সময়ক্ষেপণ। ইয়াহিয়া যখন ছয় দফা নাকচ করেছেন, তখন এসব ঘটছে। এর মধ্যে শক্তি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে।
আরেক দল মনে করত, ইয়াহিয়া বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করছেন। কারণ, ইসলামাবাদের হাতে তখন ক্ষমতা নেই। সেটা পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রদেশের প্রতিটি অঞ্চল একটার পর একটা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই অবস্থায় ইয়াহিয়া কার্যত মুজিবের দাবি মেনে নেবেন। তিনি বাংলাদেশে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না। সামরিক আইন প্রয়োগ না করে তিনি সামরিক শাসনের শেষ টানবেন। এর মধ্য দিয়ে যে সদ্বিশ্বাস তৈরি হবে, তা শেখ মুজিবের সংসদে আসার জন্য যথেষ্ট হবে।
তাহলে মুজিবকে ঠিক করতে হবে, কার্যত ক্ষমতার বদলে তাঁর আইনগত ক্ষমতার দাবি সংঘর্ষ এড়াতে যথেষ্ট কি না। এত দিনে তিনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে ইসলামাবাদের হাতে ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ থাকলে তার তেমন আকর্ষণ থাকবে না। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব, বৈদেশিক মুদ্রা ও সহায়তার ওপর তাঁর তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি তাঁর খসড়া পাস করে নিলেও ভেটোর সম্মুখীন হতে পারেন, যদি ইয়াহিয়া না বোঝেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধে ছয় দফাই সবচেয়ে খতরনাক।
মুজিব ছয় দফায় সমর্থন পেলে রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারবেন, বিপ্লবীদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু ইয়াহিয়া আবার ভেটো দিলে বা ভুট্টো আবারও অন্তর্ঘাত করলে তাঁর রাস্তায় নেমে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তখন তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি কি পূর্ণাঙ্গ জনযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন, নাকি জনগণের পরবর্তী ও চূড়ান্ত আন্দোলনে নিজেকে বাড়তি মানুষে পরিণত করবেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র: ফোরাম, ১৩ মার্চ ১৯৭১।
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।
No comments