লাশের মিছিলে মুক্তি এলো কই? by কাজী সিরাজ
রাজনৈতিক
পরিস্থিতি দিন দিন আরও ঘোলাটে, আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। সমঝোতা এবং
শান্তিপূর্ণ একটা সমাধানের আশা ক্রমশই যেন তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি
নানা গুরুত্বপূর্ণ মহল বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা
প্রকাশ করে চলেছেন বেশ কিছুদিন ধরে। প্রায়শই তারা বলছেন, এই পরিস্থিতি
গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে অন্তরায়। সহিংসতা, নাশকতা এবং
আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বানই শুধু জানাচ্ছেন না তারা, পথও
বাতলে দিচ্ছেন। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন
২০-দলীয় জোট আহূত লাগাতার অবরোধের ৫৬তম দিন চলছে আজ। সঙ্গে শুক্র-শনিবার
বাদ দিয়ে সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন হরতালও চলছে। অবরোধ-হরতালের ছাতার নিচে
থেকেই চলছে সহিংসতা, নাশকতা। বোমা-পেট্রলবোমার আগুনে জ্বলছে গাড়ি, ঝলসে
যাচ্ছে, দগ্ধ হয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করছে নিরীহ মানুষ। পাশাপাশি এসব নৃশংসতা
রোধের নামে চলছে 'বন্দুকযুদ্ধ' ও 'ক্রসফায়ারে' মৃত্যুর অমানবিক ঘটনা। এ
পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০৯ জন (২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)। সরকার পক্ষের
প্রচারে মনে হতে পারে সব মৃত্যুই বুঝি হয়েছে বোমা-পেট্রলবোমায়। তা কিন্তু
নয়। 'বন্দুকযুদ্ধ'-'ক্রসফায়ার' এবং সংঘর্ষে মারা গেছেন ৩১ জন। এগুলো
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হচ্ছে,
সহিংসতা-নাশকতা-হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না, বন্ধ হওয়ার লক্ষণও তেমন স্পষ্ট
নয়। বিবদমান পক্ষসমূহের আচরণে, উচ্চারণে মনে হচ্ছে, উভয়েই মনে করছে, থেমে
যাওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রতিপক্ষের কাছে হেরে যাওয়া। তাই উভয় পক্ষই প্রতিপক্ষকে
মাঠে হারাতেই যেন বদ্ধপরিকর।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন উভয় পক্ষই ভুল করছে। প্রথমত, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নীতিনির্ধারকদের বোঝা দরকার, তারা শুধু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়ছেন না। যে কোনো পন্থায়-ই হোক, দলটি এখন সরকারে। তারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে এবং বলা চলে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মোটা দাগে তাদের ব্যর্থতা আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ বলে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল কর্তৃক কঠোরভাবে সমালোচিত হলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে তারা সক্ষমতা বা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিচ্ছে। সিভিল প্রশাসন, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা-থানা প্রশাসনের ওপরও তারা যথেষ্ট প্রভাব রাখতে পারছে। দলীয় শক্তির সঙ্গে এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীসমূহের যে সম্মতি শক্তি তার বিরুদ্ধে মাসের পর মাস অবরোধ-হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখা খুবই দুরূহ। সরকারের একটা সুবিধা তো আছে যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ তারা কাজে লাগাতে পারে আইনসম্মতভাবেই। এ ক্ষেত্রে বাহিনীসমূহও সরকারি আদেশ পালনে বাধ্য। ইতিমধ্যে শোনা যাচ্ছে, বিএনপি হাঁফিয়ে উঠেছে। বিএনপি সম্পর্কে যাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ আছে, তারা জানেন, এটি একটি পেটি-বুর্জোয়া উদার গণতান্ত্রিক দল; কট্টর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল নয়, তবে ইসলামপ্রিয়, ধর্মানুরাগী নরমপন্থি সংগঠন। সবচেয়ে বড় কথা বিএনপি একটি নির্বাচনপন্থি দল- কোনো অবস্থাতেই 'বিপ্লবী' কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই দলের কর্মকাণ্ড মেলে না। কিন্তু অবরোধ-হরতালের আবরণে এখন যা হচ্ছে তা কোনো অবস্থাতেই একটি নির্বাচনপন্থি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মকাণ্ড নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অভ্যস্ত থাকার কথা নয়। কম দিন তো হলো না, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘকালীন অবরোধ আন্দোলন ইতিপূর্বে কখনো আর হয়নি। এত রক্তপাত, এত গণদুর্ভোগের পরও সরকার টলছে না। বোঝা দরকার, বিরোধীপক্ষ যে পদ্ধতির আন্দোলনই করুক না কেন, তা মোকাবিলার শক্তি সবসময়ই সরকারের কাছে বেশি থাকে। তবে হ্যাঁ, আন্দোলনে যদি ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ঘটে, যদি গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় সরকারের বিরুদ্ধে, তখন কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীই তার সামনে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু গত ৫৬ দিনের অবরোধ-হরতালে জনগণের কোনো ব্যাপক সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়নি। বিএনপির কোনো পরিচিত নেতাকে ঢাকায় মাঠে দেখা যায়নি। জোটের অন্য কোনো নেতাও মাঠে নামেননি। তবে ঢাকার বাইরের জেলাসমূহে এবার বিএনপিকে মাঠে দেখা গেছে এবং অধিকাংশ স্থানে জামায়াত ছাড়া তারা একাই থেকেছে মাঠে। কিন্তু ঢাকায় যদি কার্যকরভাবে কিছু করা না যায় সরকার পতনের আন্দোলনে চূড়ান্ত কোনো ফল আদায় সম্ভব নয়। কাজেই বিএনপিকে চিন্তা করতে হবে, এভাবে 'জেদের' অবরোধ-হরতালে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব কিনা। তা ছাড়া অবরোধ-হরতালের মধ্যে বোমা-পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মানুষ মারা যাওয়ার প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে তা-ও তাদের অনুধাবন করা উচিত। আগুনে পুড়ে মানুষ মরছে, দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে মানুষ কাতরাচ্ছে, হাজার যানবাহন জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়েছে, আন্দোলন দমনের অজুহাতে ক্রসফায়ার আর সংঘর্ষেও মানুষ মারা যাচ্ছে সমানতালে। লাশের মিছিলে মুক্তি এলো কই? এর প্রতি থোড়াই কেয়ার করছে সরকার ও বিরোধী পক্ষ। সরকার না পারছে মানুষের জানমালের হেফাজত করতে, না পারছে যারা এসব করছে তাদের রুখতে।
সরকার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে মনে হয়, তা হচ্ছে বিএনপিকে গণবিচ্ছিন্ন করা, বিএনপিকে জঙ্গি-সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে আঘাতের পর আঘাত হেনে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীসহ লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসক লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হয় জঙ্গিবাদী রাজনীতিতে বিএনপি জেএমবি-জামায়াতকেও ছাড়িয়ে গেছে! বিএনপিকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে সরকারি প্রচারের উদ্দেশ্য দুটি। এক. জঙ্গি দমনে নিষ্ঠুর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এবং সেই সুযোগে বিএনপি-নির্মূল অভিযান চালানো যায়; দুই. বহির্বিশ্বে যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, বিএনপিকে তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে প্রচার করে এসব দেশের সমর্থন-সহানুভূতি আদায় করা। কিন্তু এ ব্যাপারে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিএনপি যে শ্রেণি-চরিত্রের লোকজন নিয়ে গঠিত এরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ লালন করতে পারে না। এটা তারা ধারণ করতেও অক্ষম। তারা জঙ্গি এটা সরকার জনগণকে বিশ্বাস করাতে পারবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া দেশের যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে, ভালোবাসে তারা কি প্রধানমন্ত্রী এবং তার লোকজনের কথা বিশ্বাস করছে? করবে? আন্তর্জাতিক যে শক্তির সহানুভূতি সরকার আদায় করতে চাচ্ছে বলে বোঝা যায়, বিএনপি সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন তো সরকারের জন্য হতাশাজনকই বলতে হবে। বিএনপিকে তারা মনে করে একটি উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে। বিএনপির গণভিত্তিকেও তারা সমীহ করে। কাজেই সরকার যে পথে বিএনপিকে নির্মূল-নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কথা ভাবে বলে একটা ধারণা বাইরে আছে তা সম্ভব নয়। তাহলে কথা দাঁড়াল এই যে, সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি উভয়ের যে গণভিত্তি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রয়েছে, তাতে কেউ কাউকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে না। তাদের উচিত হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ ও অনুসরণ করা।
মুশকিল হচ্ছে, সরকার বর্তমান সংকট সৃষ্টির মূলে নজর দিতে চাচ্ছে না। বোঝা যায়, সচেতনভাবেই তারা তা করছে। বর্তমান সহিংসতা-নাশকতাকেই তারা দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরছে। অথচ এসব হচ্ছে মূল অসুখের উপসর্গ। মূল অসুখের চিকিৎসা না হলে এক উপসর্গ থেকে আরও নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দশম সংসদ নির্বাচন নিয়েই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বর্তমান তীব্র দ্বন্দ্বের সূচনা এবং তা থেকেই বর্তমান বিরোধ ও সংঘাত। এ ব্যাপারে বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলসমূহের অবস্থান যথার্থ বলেই বিবেচনা করছেন দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী মহল। লীগ সরকার এবং তাদের বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া সবাই বলছেন সেই নির্বাচন ছিল একপক্ষীয় ও বিতর্কিত। কোনো অবস্থাতেই তা আদর্শ নির্বাচন ছিল না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি দলই সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ার জন্য ১৫৩ আসনে প্রত্যক্ষ কোনো নির্বাচনই হয়নি, করতে হয়নি। নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ ৫ জানুয়ারির ১৫ দিন আগেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ নিশ্চিত হয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আবার সরকার গঠিত হচ্ছে। কথা ছিল নিয়ম রক্ষার ওই নির্বাচন শেষে সমঝোতার ভিত্তিতে এই সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। কথা ফিরিয়ে নিয়ে এখন বলা হচ্ছে ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন-'টির্বাচন' হবে না। একটি জনপ্রিয় নির্বাচনপন্থি দল ধৈর্য হারাতেই পারে। তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন দাবি করছে। সরকারকে বলছে এই ব্যাপারে সংলাপ শুরু করতে। সরকার পক্ষ সংলাপে অনীহা তো প্রকাশ করেই যাচ্ছে, ইদানীং সংকট আরও ঘনীভূত করে তুলেছে এই বলে যে, বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনাই হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শান্তির অন্বেষায় সরকারকে তার এ অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমত, সহিংসতা-নাশকতা বন্ধ করে দেশে শান্ত ও স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উভয় পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমেই সমঝোতায় পৌঁছতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, সরকার ও সরকারি দলকে বিএনপির সঙ্গেই সংলাপ করতে হবে। বিএনপি কার সঙ্গে, কাকে নিয়ে রাজনীতি করবে তা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দল ডিকটেট করতে পারে না। ভোটের রাজনীতিতে 'রাজাকার-স্বৈরাচারকে' নিয়ে দুই প্রধান দলই অতীতে যেমন খেলেছে, ভবিষ্যতেও খেলবে না বলা যায় না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সংলাপ ছাড়া শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো বিকল্প পথ নেই। অবরোধ-হরতাল আর দমন-পীড়ন দিয়ে 'মুশকিল আহসান' হবে না। সংলাপটা হতে হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নেওয়ার এবং আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য গোঁ ধরতে পারবে না। ভোটের সময় তারা কোন সমীকরণে এগোবেন তারা বুঝবেন, কিন্তু রাজনৈতিক ফায়সালার নীতিনির্ধারণী বৈঠকে, সংলাপে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়া আর কারও থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।
সরকার যত বড় গলায় বলুক সব কিছু ঠিক আছে, আসলে যে তা নেই মানুষ দেখছে। আত্দ প্রবঞ্চনায় কোনো লাভ হয় না। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার সংকটে আছে। সংকট সৃষ্টি করতে পেরেছে বিরোধী দল। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এই সংকটের নিরসন অপরিহার্য। বিএনপিকেও তা অনুধাবন করতে হবে যে, তারাও আর বেশি দিন এভাবে চালিয়ে যেতে পারবে না। সরকার সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে, বিএনপির বন্দী নেতাদের মুক্তি দিয়ে এবং বিএনপি অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করে আলোচনার একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধানই সম্ভব। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য 'যুদ্ধ' করতে হবে কেন?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন উভয় পক্ষই ভুল করছে। প্রথমত, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নীতিনির্ধারকদের বোঝা দরকার, তারা শুধু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়ছেন না। যে কোনো পন্থায়-ই হোক, দলটি এখন সরকারে। তারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে এবং বলা চলে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মোটা দাগে তাদের ব্যর্থতা আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ বলে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল কর্তৃক কঠোরভাবে সমালোচিত হলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে তারা সক্ষমতা বা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিচ্ছে। সিভিল প্রশাসন, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা-থানা প্রশাসনের ওপরও তারা যথেষ্ট প্রভাব রাখতে পারছে। দলীয় শক্তির সঙ্গে এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীসমূহের যে সম্মতি শক্তি তার বিরুদ্ধে মাসের পর মাস অবরোধ-হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখা খুবই দুরূহ। সরকারের একটা সুবিধা তো আছে যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ তারা কাজে লাগাতে পারে আইনসম্মতভাবেই। এ ক্ষেত্রে বাহিনীসমূহও সরকারি আদেশ পালনে বাধ্য। ইতিমধ্যে শোনা যাচ্ছে, বিএনপি হাঁফিয়ে উঠেছে। বিএনপি সম্পর্কে যাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ আছে, তারা জানেন, এটি একটি পেটি-বুর্জোয়া উদার গণতান্ত্রিক দল; কট্টর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দল নয়, তবে ইসলামপ্রিয়, ধর্মানুরাগী নরমপন্থি সংগঠন। সবচেয়ে বড় কথা বিএনপি একটি নির্বাচনপন্থি দল- কোনো অবস্থাতেই 'বিপ্লবী' কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই দলের কর্মকাণ্ড মেলে না। কিন্তু অবরোধ-হরতালের আবরণে এখন যা হচ্ছে তা কোনো অবস্থাতেই একটি নির্বাচনপন্থি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মকাণ্ড নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অভ্যস্ত থাকার কথা নয়। কম দিন তো হলো না, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘকালীন অবরোধ আন্দোলন ইতিপূর্বে কখনো আর হয়নি। এত রক্তপাত, এত গণদুর্ভোগের পরও সরকার টলছে না। বোঝা দরকার, বিরোধীপক্ষ যে পদ্ধতির আন্দোলনই করুক না কেন, তা মোকাবিলার শক্তি সবসময়ই সরকারের কাছে বেশি থাকে। তবে হ্যাঁ, আন্দোলনে যদি ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ঘটে, যদি গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় সরকারের বিরুদ্ধে, তখন কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীই তার সামনে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু গত ৫৬ দিনের অবরোধ-হরতালে জনগণের কোনো ব্যাপক সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়নি। বিএনপির কোনো পরিচিত নেতাকে ঢাকায় মাঠে দেখা যায়নি। জোটের অন্য কোনো নেতাও মাঠে নামেননি। তবে ঢাকার বাইরের জেলাসমূহে এবার বিএনপিকে মাঠে দেখা গেছে এবং অধিকাংশ স্থানে জামায়াত ছাড়া তারা একাই থেকেছে মাঠে। কিন্তু ঢাকায় যদি কার্যকরভাবে কিছু করা না যায় সরকার পতনের আন্দোলনে চূড়ান্ত কোনো ফল আদায় সম্ভব নয়। কাজেই বিএনপিকে চিন্তা করতে হবে, এভাবে 'জেদের' অবরোধ-হরতালে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব কিনা। তা ছাড়া অবরোধ-হরতালের মধ্যে বোমা-পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মানুষ মারা যাওয়ার প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে তা-ও তাদের অনুধাবন করা উচিত। আগুনে পুড়ে মানুষ মরছে, দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে মানুষ কাতরাচ্ছে, হাজার যানবাহন জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়েছে, আন্দোলন দমনের অজুহাতে ক্রসফায়ার আর সংঘর্ষেও মানুষ মারা যাচ্ছে সমানতালে। লাশের মিছিলে মুক্তি এলো কই? এর প্রতি থোড়াই কেয়ার করছে সরকার ও বিরোধী পক্ষ। সরকার না পারছে মানুষের জানমালের হেফাজত করতে, না পারছে যারা এসব করছে তাদের রুখতে।
সরকার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে মনে হয়, তা হচ্ছে বিএনপিকে গণবিচ্ছিন্ন করা, বিএনপিকে জঙ্গি-সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে আঘাতের পর আঘাত হেনে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীসহ লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং শাসক লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হয় জঙ্গিবাদী রাজনীতিতে বিএনপি জেএমবি-জামায়াতকেও ছাড়িয়ে গেছে! বিএনপিকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে সরকারি প্রচারের উদ্দেশ্য দুটি। এক. জঙ্গি দমনে নিষ্ঠুর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এবং সেই সুযোগে বিএনপি-নির্মূল অভিযান চালানো যায়; দুই. বহির্বিশ্বে যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, বিএনপিকে তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে প্রচার করে এসব দেশের সমর্থন-সহানুভূতি আদায় করা। কিন্তু এ ব্যাপারে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিএনপি যে শ্রেণি-চরিত্রের লোকজন নিয়ে গঠিত এরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ লালন করতে পারে না। এটা তারা ধারণ করতেও অক্ষম। তারা জঙ্গি এটা সরকার জনগণকে বিশ্বাস করাতে পারবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া দেশের যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে, ভালোবাসে তারা কি প্রধানমন্ত্রী এবং তার লোকজনের কথা বিশ্বাস করছে? করবে? আন্তর্জাতিক যে শক্তির সহানুভূতি সরকার আদায় করতে চাচ্ছে বলে বোঝা যায়, বিএনপি সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন তো সরকারের জন্য হতাশাজনকই বলতে হবে। বিএনপিকে তারা মনে করে একটি উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে। বিএনপির গণভিত্তিকেও তারা সমীহ করে। কাজেই সরকার যে পথে বিএনপিকে নির্মূল-নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কথা ভাবে বলে একটা ধারণা বাইরে আছে তা সম্ভব নয়। তাহলে কথা দাঁড়াল এই যে, সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি উভয়ের যে গণভিত্তি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রয়েছে, তাতে কেউ কাউকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে না। তাদের উচিত হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ ও অনুসরণ করা।
মুশকিল হচ্ছে, সরকার বর্তমান সংকট সৃষ্টির মূলে নজর দিতে চাচ্ছে না। বোঝা যায়, সচেতনভাবেই তারা তা করছে। বর্তমান সহিংসতা-নাশকতাকেই তারা দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরছে। অথচ এসব হচ্ছে মূল অসুখের উপসর্গ। মূল অসুখের চিকিৎসা না হলে এক উপসর্গ থেকে আরও নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দশম সংসদ নির্বাচন নিয়েই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বর্তমান তীব্র দ্বন্দ্বের সূচনা এবং তা থেকেই বর্তমান বিরোধ ও সংঘাত। এ ব্যাপারে বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলসমূহের অবস্থান যথার্থ বলেই বিবেচনা করছেন দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী মহল। লীগ সরকার এবং তাদের বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া সবাই বলছেন সেই নির্বাচন ছিল একপক্ষীয় ও বিতর্কিত। কোনো অবস্থাতেই তা আদর্শ নির্বাচন ছিল না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি দলই সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ার জন্য ১৫৩ আসনে প্রত্যক্ষ কোনো নির্বাচনই হয়নি, করতে হয়নি। নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ ৫ জানুয়ারির ১৫ দিন আগেই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ নিশ্চিত হয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আবার সরকার গঠিত হচ্ছে। কথা ছিল নিয়ম রক্ষার ওই নির্বাচন শেষে সমঝোতার ভিত্তিতে এই সংসদ ভেঙে দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। কথা ফিরিয়ে নিয়ে এখন বলা হচ্ছে ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন-'টির্বাচন' হবে না। একটি জনপ্রিয় নির্বাচনপন্থি দল ধৈর্য হারাতেই পারে। তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন দাবি করছে। সরকারকে বলছে এই ব্যাপারে সংলাপ শুরু করতে। সরকার পক্ষ সংলাপে অনীহা তো প্রকাশ করেই যাচ্ছে, ইদানীং সংকট আরও ঘনীভূত করে তুলেছে এই বলে যে, বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনাই হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শান্তির অন্বেষায় সরকারকে তার এ অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমত, সহিংসতা-নাশকতা বন্ধ করে দেশে শান্ত ও স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উভয় পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমেই সমঝোতায় পৌঁছতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, সরকার ও সরকারি দলকে বিএনপির সঙ্গেই সংলাপ করতে হবে। বিএনপি কার সঙ্গে, কাকে নিয়ে রাজনীতি করবে তা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দল ডিকটেট করতে পারে না। ভোটের রাজনীতিতে 'রাজাকার-স্বৈরাচারকে' নিয়ে দুই প্রধান দলই অতীতে যেমন খেলেছে, ভবিষ্যতেও খেলবে না বলা যায় না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সংলাপ ছাড়া শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো বিকল্প পথ নেই। অবরোধ-হরতাল আর দমন-পীড়ন দিয়ে 'মুশকিল আহসান' হবে না। সংলাপটা হতে হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নেওয়ার এবং আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য গোঁ ধরতে পারবে না। ভোটের সময় তারা কোন সমীকরণে এগোবেন তারা বুঝবেন, কিন্তু রাজনৈতিক ফায়সালার নীতিনির্ধারণী বৈঠকে, সংলাপে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়া আর কারও থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।
সরকার যত বড় গলায় বলুক সব কিছু ঠিক আছে, আসলে যে তা নেই মানুষ দেখছে। আত্দ প্রবঞ্চনায় কোনো লাভ হয় না। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার সংকটে আছে। সংকট সৃষ্টি করতে পেরেছে বিরোধী দল। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই এই সংকটের নিরসন অপরিহার্য। বিএনপিকেও তা অনুধাবন করতে হবে যে, তারাও আর বেশি দিন এভাবে চালিয়ে যেতে পারবে না। সরকার সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে, বিএনপির বন্দী নেতাদের মুক্তি দিয়ে এবং বিএনপি অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করে আলোচনার একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধানই সম্ভব। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য 'যুদ্ধ' করতে হবে কেন?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
No comments