জান্নাতি হুর আর দুধ-মধুর নহর বৃত্তান্ত! by গোলাম মাওলা রনি
ইদানীংকালে
বাংলাদেশের অপরাপর শান্তিপ্রিয় মানুষের মতো আমিও দুনিয়ার চাইতে আখেরাত
নিয়ে চিন্তা-ভাবনা বেশি করি। জমিনের দিকে না তাকিয়ে আসমানের দিকে তাকাই।
আসমানের তারা, চাঁদ এবং উড়ন্ত পাখি দেখতে আমার বড়ই ভালো লাগে। আগে কিন্তু
লাগত না। ইতিপূর্বে আমি জমিনের ওপরকার বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, গাছপালা,
বনভূমি এবং পশুপাখির বিচরণ দেখতে দেখতে হৃদয়ে পুলক অনুভব করতাম। সবচেয়ে
বেশি দেখতাম মানুষজন এবং তাদের বাহারি সৃষ্টিগুলোকে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে,
বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীদের চপলতা এবং দুষ্টামি আমার হৃদয়কে প্রশস্ত করত।
মেধাবী মানুষ এবং সুন্দরী নারী আমাকে যতটা না মুগ্ধ করত তারচেয়ে বেশি
মুগ্ধ করত মেধাবী কণ্ঠস্বর। ইদানীংকালে সবকিছুতেই কেমন জানি মড়ক লেগেছে।
কোনো কিছু দেখতে বা শুনতে আর মন সায় দেয় না। নির্ভয়ে কোনো কিছুই শুনতে পারি
না, আর আনন্দচিত্তে দেখতেও পারি না- তাই সময় পেলেই আসমানের দিকে তাকিয়ে
থাকি এবং মনের আনন্দে তারা গুনতে গুনতে আখেরাতের কথা চিন্তা করি।
রাস্তাঘাটে চলতে ভীষণ ভয় হয়। পেট্রলবোমা, ককটেল এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার, ইট-পাটকেল-টিয়ারসেল ও বুলেটের চেয়েও মহাবিপদ হিসেবে উদয় হয়েছে সাম্প্রতিককালের গণপিটুনি এবং পুলিশের সন্দেহ। ভিড়ের মধ্যে কে বা কারা বোমা মেরে চম্পট দেওয়ার সময় জোরে ধর ধর বলে আওয়াজ তোলে। পথচারীরা এমনিতেই ভয়ের চোটে ঠক ঠক করে, তার ওপর বোমার শব্দ হলে তো কথাই নেই- মুখ বন্ধ করে ভো দৌড় মারে। কোনো কিছুতে গুঁতা লেগে পড়ে গেলে ভিন্ন কথা বা কেউ যদি কলার চেপে, হাত ধরে বা অন্য কিছু চেপে ধরে থামায় তাহলে তার মনের অবস্থা হয় আজরাইল (আ.)-এর সামনে পড়ে সবকিছু ভুলে যাওয়ার সময়ের মতো। এ অবস্থায় যদি পুলিশ এসে উদয় হয় তবে তো কথাই নেই- আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে মৃদু কম্পনে পরিধেয় বস্ত্র গন্ধময় করে, তারপর ওল্টাপাল্টা বলতে থাকে অনেকটা বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো। অন্যদিকে পুলিশও মনে মনে বলে- পাইছি ব্যাটারে। চল চানমনি-ডিবি অফিসে চল!
দুটি পৃথক দুর্ঘটনার বাস্তব উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমটি ঘটেছিল বেলা ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে। সচিবালয়ের উল্টোদিকে তোপখানা রোডের বড়সড় একটি ভবনের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে এক যুবক বহুদিন ধরে। ঘটনার দিন সে নিচে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় দড়াম দড়াম বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটার শব্দে শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি, হৈচৈ, গালাগালি এবং পুলিশের লাঠি-বাঁশির শব্দ। যুবকটি ভেবে পাচ্ছিল না তার তখন কী করা উচিত। সে কি অন্যদের মতো দৌড়ে অজানা গন্তব্যের দিকে যাবে নাকি ২০/২৫ ফুট পেছনে ফিরে নিজ অফিস ভবনের নিচতলায় আশ্রয় নেবে। এরই মধ্যে পুলিশও তার কাছাকাছি এসে গেল। দৌড়রত এক বৃদ্ধকে ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসা করল বোমা কে মেরেছে? একে তো বোমার শব্দ, তার ওপর দৌড়াদৌড়ির কারণে বুড়া মিয়ার কলিজায় পানি ছিল না। ফলে পুলিশের মূর্তি দেখে এবং শব্দ শুনে বেচারার জান তখন গলা পেরিয়ে ঠোঁটে চলে এলো। সে কাঁপতে কাঁপতে হাতখানা তুলে দেখিয়ে দিল- ওই ছ্যামড়ায় বোম মারিছে- বুড়ার কথায় শুরু হয়ে গেল রোজ কেয়ামত। দৌড়রত মানুষজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। ধর হালারে- পিডা হালারে! লাত্থি মার! ঘুষা মাইরা হালার নাকের বদনা ফাটাইয়্যা দে, কষাইয়্যা লাত্থি মার- লাত্থি। মাইরা গুয়া ফাটাইয়া দে- ব্যস! ২/৩ মিনিটের মধ্যেই যুবকটি চিৎ পটাং হয়ে পড়ল আর অমনি পুলিশ তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিল আজিমপুরে। ১০/১২ জন যুবক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল হোম ইকোনমিক্স কলেজের সামনে। যুবকদের প্রায় সবাই এসেছিল তাদের বোন অথবা স্ত্রীকে নিয়ে একটি সরকারি চাকরির লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানোর জন্য। চাকরি প্রার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে তারা চা খাওয়ার জন্য ফুটপাথের চায়ের দোকানের সামনে ভিড় করে। হঠাৎ ১০/১২টি মোটরসাইকেলে করে পুলিশের একটি দল এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলে। যুবকরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ শুরু করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল। সবাইকে ধরে সারা শরীরে তল্লাশি করতে করতে শাসাতে থাকে- বোমা কই! বোমা মারছিস কেন। ততক্ষণে যুবকরা আন্দাজ করে ফেলে যে, কিছুক্ষণ আগে তারা যে ঠাস করে একটি ট্রান্সফরমার ফাটার শব্দ শুনেছিল সেই শব্দের সূত্র ধরেই হয়তো পুলিশ এসেছে। একজন যুবক সাহস করে আঙ্গুল উঁচিয়ে পুলিশকে বলল- ভাই! বোমা ফুটেনি। ওইখানে ট্রান্সফরমার ফেটেছে। কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে যখন ঘটনার সত্যতা বুঝতে পারল তখন যুবকদের রেহাই দিল।
দেশের চলমান সহিংস অবস্থার বাস্তব চিত্র নিয়ে হররোজ তৈরি হতে পারে অসংখ্য চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা গীতি কবিতা। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা শুনলে হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়। লোকগুলোর কি আল্লাহ-খোদার ভয় নেই? দেদারসে যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যেসব রক্ষাকবচ জনগণকে অতীতকালে রক্ষা করত তাও আজ বিলীন হতে বসেছে। মজলুম এমনভাবে নিজেকে ছোট এবং অসহায় করে ফেলছে যাতে মনে হতে পারে লোকটি হয়তো তারই মতো কোনো বান্দা বা বান্দিকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করছে। প্রভাবশালীরা এমনভাবে অহংকার করছে, যা দেখে মনে হতে পারে লোকটি হয়তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইয়াদ অর্থাৎ চাদর ধরে টানাটানি করছে। জ্ঞানীরা চুপচাপ বসে আছে- আর মূর্খরা সব আগ বাড়িয়ে কথা বলছে। অভদ্ররা মঞ্চে দাঁড়িয়ে দাপাদাপি করছে এবং ভদ্রলোকেরা সব আড়ালে চলে গেছে।
অস্থির সময়ে বিপদে-আপদে মানুষ আল্লাহ-খোদাকে বেশি ডাকাডাকি করে। অন্যদিকে দরিদ্র লোকজনই দুনিয়ার চেয়ে আখেরাত নিয়ে একটু বেশি চিন্তাভাবনা করে। ধনীরা ধন সম্পদের মোহ এবং কাম-বাসনা চরিতার্থ করার সব উপকরণ হাতের নাগালে পাওয়ার কারণে বাদবাকিতে খুব কমই বিশ্বাস করে। অর্থাৎ চোখের সামনের সহজলভ্য বিত্ত-বিলাসের সামগ্রী বাদ দিয়ে মৃত্যু, তারপর কবর, এরপর কেয়ামত, হাশর, মিজান, এরপর জান্নাতে গিয়ে সবকিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে না। অন্যদিকে দরিদ্ররা যখন ওসব কিছু পায় না তখন সে মনপ্রাণ দিয়ে একান্ত অনুগত বান্দা হিসেবে জান্নাতে গিয়ে সবকিছু পাওয়ার আশায় দিনাতিপাত করতে থাকে।
জান্নাতের নেয়ামতের গুণকীর্তন শেষ করা যাবে না। নেয়ামতের সংখ্যাও অসীম। অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে প্রতিটি পুরুষের জন্য ৭০ জন হুর, সরাবান তহুরা নামক একশ্রেণির পানীয়, দুধ, মধু এবং সুসজ্জিত বিশাল বিশাল বাগান-ঝরনা সমন্বিত প্রাসাদের কথা আমরা ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি। দুনিয়া এবং জান্নাতি নেয়ামতের মধ্যে অনেক গুণগত এবং বস্তুগত পার্থক্য রয়েছে। দুনিয়ার সবকিছু পচে যায়, ক্ষয়ে যায় এবং অধিক ব্যবহারে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। দুনিয়াতে ভোগের মাত্রা সীমিত। মানুষ ইচ্ছা করলেও সারাদিন খেতে পারবে না কিংবা ৭০ জন বিবির সঙ্গে সারাক্ষণ রমণ করতে পারবে না। দুনিয়ার প্রতিটি বস্তুর জন্য ভোগীকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়- দিতে হয় বিনিময় মূল্য। ভোগের পর ক্ষেত্রবিশেষে অভক্তিও এসে যায়। অন্যদিকে জান্নাতে ভোগের ক্ষেত্রে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা নেই। সবকিছু করা যাবে ইচ্ছামতো, সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাজির হবে আকাঙ্ক্ষা করা মাত্র। একটি মানুষ যদি সারাদিন শুধু খেতে চায় কিংবা ঘুমোতে চায় অথবা কোনো ক্রীড়া-কৌতুক করতে চায় তবে সমস্যা নেই। তিনি ইচ্ছামতো সবকিছু করতে পারবেন- কোনো ক্লান্তি অবসাদ অথবা বিরাগ-বিতৃষ্ণা তাকে স্পর্শ করবে না।
ঢাকার কোনো বুদ্ধিমান যুবককে যদি বলা হয় তোমাকে গুলশান এলাকায় ১০/১২ বিঘা বাড়ির ওপর নির্মিত বিশাল একটি প্রাসাদ দেওয়া হলো। প্রাসাদের মধ্যে তোমার জন্য সবকিছু মজুদ রয়েছে, আর রয়েছে ৭০ জন সুন্দরী নারী যাদের তুমি স্ত্রী অথবা দাসী হিসেবে ব্যবহার করতে পার। বুদ্ধিমান যুবকটির মনে প্রশ্ন আসবে বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, কর্মচারীদের বেতন কে দেবে, কতদিন দেবে? ৭০ জন বউ বা দাসী দিয়েইবা সে কী করবে। বহু বিবাহের কুফল এবং স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে ছ্যাচা দেওয়ার বহু কাহিনী তার মনে উদয় হবে। ৭০ জন বিবির যদি ২/৩টা করে বাচ্চা হয় আর যদি তারা সামনে এসে বলে- ও বাজান, কলা খাব! লেবেনচুস খাব- তাহলে তো কথাই নেই! মুহূর্তের মধ্যে উন্মাদ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
মানুষ তার সহজাত অভ্যাস এবং চিরায়ত মনমানসিকতার জন্য সব সময় সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোগের সামগ্রী পেতে চায়। কিন্তু বিনিময়ে পরিশ্রম, দায়িত্ব গ্রহণ, ত্যাগ স্বীকার, সাধনা করতে রাজি নয়। এ জন্য দুনিয়ার নেয়ামত খুব অল্প লোকের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয়। এই দুনিয়ার তাবৎ লোক জীবনযুদ্ধের মাঠে না গিয়ে কিংবা জীবনযুদ্ধের ঝক্কি-ঝামেলার ভয়ে বিকল্প পথে নেয়ামত লাভের চেষ্টা করে। ফলে হঠাৎ লক্ষ্য করা যায় সমাজে কর্মবীরের তুলনায় জান্নাতলোভীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সমাজে যদি গণ্ডগোল, হানাহানি, মারামারি বেশি হয় তাহলে সঙ্গত কারণেই কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। জীবিকার পথ রুদ্ধ হলে মানুষ জীবনসংগ্রামে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মানুষ তখন বেঁচে থাকার পরিবর্তে শয়নে-স্বপনে মৃত্যু কামনা করে। কিন্তু তারা মরতে ভয় পায় দুটি কারণে।
প্রথমত, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তারা জান্নাতি হতে চায়। কিন্তু মানুষ তার কর্মকাণ্ডের কথা গভীরভাবে চিন্তা করলে জাহান্নাম ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পায় না। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে মরার জন্য একটি উপায় হলো আত্দহত্যা। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভয়ানক দুটি বিপত্তি রয়েছে। প্রথমটি হলো- সাহস এবং দুনিয়ার মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা এবং আকর্ষণ ত্যাগ করা যা কিনা বেশির ভাগ লোকেরই থাকবে না। আত্দহত্যা নিঃসন্দেহে একটি ভয়াবহ দুঃসাহসিক ঘটনা। যেনতেন লোক এ কাজ করতে পারে না। দ্বিতীয়টি হলো- জাহান্নামের ভয়। আত্দহত্যা করলে নির্ঘাত জাহান্নামে যেতে হবে এই ভয়ে লোকজন ওমুখো হয় না। কাজেই মানুষ তখন বিকল্প পথে সহজে মরার রাস্তা খোঁজে যে রাস্তার শেষ প্রান্তে জাহান্নামের পরিবর্তে জান্নাতের স্বপ্ন থাকে। জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মানুষ ছাড়াও অলস-ভীরু এবং পরিশ্রমে অনীহা রয়েছে তখন সব নর-নারীও কিন্তু বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যেতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে।
এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি। জীবন মৃত্যু-দুনিয়া আখেরাতের চিন্তা করতে গিয়ে আমার বার বার জান্নাতের নানাবিধ আকর্ষণীয় নেয়ামতের কথা মনে আসছিল। আর এসব আমি চিন্তা করছিলাম সাম্প্রতিককালে ঘটমান বাংলাদেশের সর্বনিকৃষ্ট সন্ত্রাস, মারামারি-হানাহানি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক ও পারিবারিক অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তার কারণে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তবে বাংলাদেশের খুব কমসংখ্যক মানুষই বেঁচে থেকে জীবনযুদ্ধে অংশগ্রহণের কর্মপ্রেরণা দ্বারা পরিচালিত হবে। তারা হুটহাট করে ভবলীলা সাঙ্গ করে সরাসরি জান্নাতে ঢুকে হুর এবং দুধ-মধুর স্বাদ গ্রহণের জন্য সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজবে। কিছু লোক তো সারা দুনিয়ায় সর্বকালেই ছিল- যারা মানুষের এ মানবিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলতে পেরেছিল আইএস, আল-কায়েদা এবং বোকো হারামের মতো সংগঠন। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উচিত অতি দ্রুত দেশের চলমান অবস্থার অবসানকল্পে বিকল্প পথের সন্ধান করে তা জাতির সামনে তুলে ধরা। অন্যথায় আমরা হয়তো আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা নাইজেরিয়ার মতো দুর্ভাগা জাতিতে পরিণত হবো। আর সবাই মিলে কপাল চাপড়ালেও লাভ হবে না।
লেখক : কলামিস্ট
রাস্তাঘাটে চলতে ভীষণ ভয় হয়। পেট্রলবোমা, ককটেল এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার, ইট-পাটকেল-টিয়ারসেল ও বুলেটের চেয়েও মহাবিপদ হিসেবে উদয় হয়েছে সাম্প্রতিককালের গণপিটুনি এবং পুলিশের সন্দেহ। ভিড়ের মধ্যে কে বা কারা বোমা মেরে চম্পট দেওয়ার সময় জোরে ধর ধর বলে আওয়াজ তোলে। পথচারীরা এমনিতেই ভয়ের চোটে ঠক ঠক করে, তার ওপর বোমার শব্দ হলে তো কথাই নেই- মুখ বন্ধ করে ভো দৌড় মারে। কোনো কিছুতে গুঁতা লেগে পড়ে গেলে ভিন্ন কথা বা কেউ যদি কলার চেপে, হাত ধরে বা অন্য কিছু চেপে ধরে থামায় তাহলে তার মনের অবস্থা হয় আজরাইল (আ.)-এর সামনে পড়ে সবকিছু ভুলে যাওয়ার সময়ের মতো। এ অবস্থায় যদি পুলিশ এসে উদয় হয় তবে তো কথাই নেই- আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে মৃদু কম্পনে পরিধেয় বস্ত্র গন্ধময় করে, তারপর ওল্টাপাল্টা বলতে থাকে অনেকটা বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো। অন্যদিকে পুলিশও মনে মনে বলে- পাইছি ব্যাটারে। চল চানমনি-ডিবি অফিসে চল!
দুটি পৃথক দুর্ঘটনার বাস্তব উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমটি ঘটেছিল বেলা ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে। সচিবালয়ের উল্টোদিকে তোপখানা রোডের বড়সড় একটি ভবনের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে এক যুবক বহুদিন ধরে। ঘটনার দিন সে নিচে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় দড়াম দড়াম বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটার শব্দে শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি, হৈচৈ, গালাগালি এবং পুলিশের লাঠি-বাঁশির শব্দ। যুবকটি ভেবে পাচ্ছিল না তার তখন কী করা উচিত। সে কি অন্যদের মতো দৌড়ে অজানা গন্তব্যের দিকে যাবে নাকি ২০/২৫ ফুট পেছনে ফিরে নিজ অফিস ভবনের নিচতলায় আশ্রয় নেবে। এরই মধ্যে পুলিশও তার কাছাকাছি এসে গেল। দৌড়রত এক বৃদ্ধকে ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসা করল বোমা কে মেরেছে? একে তো বোমার শব্দ, তার ওপর দৌড়াদৌড়ির কারণে বুড়া মিয়ার কলিজায় পানি ছিল না। ফলে পুলিশের মূর্তি দেখে এবং শব্দ শুনে বেচারার জান তখন গলা পেরিয়ে ঠোঁটে চলে এলো। সে কাঁপতে কাঁপতে হাতখানা তুলে দেখিয়ে দিল- ওই ছ্যামড়ায় বোম মারিছে- বুড়ার কথায় শুরু হয়ে গেল রোজ কেয়ামত। দৌড়রত মানুষজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। ধর হালারে- পিডা হালারে! লাত্থি মার! ঘুষা মাইরা হালার নাকের বদনা ফাটাইয়্যা দে, কষাইয়্যা লাত্থি মার- লাত্থি। মাইরা গুয়া ফাটাইয়া দে- ব্যস! ২/৩ মিনিটের মধ্যেই যুবকটি চিৎ পটাং হয়ে পড়ল আর অমনি পুলিশ তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছিল আজিমপুরে। ১০/১২ জন যুবক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল হোম ইকোনমিক্স কলেজের সামনে। যুবকদের প্রায় সবাই এসেছিল তাদের বোন অথবা স্ত্রীকে নিয়ে একটি সরকারি চাকরির লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানোর জন্য। চাকরি প্রার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে তারা চা খাওয়ার জন্য ফুটপাথের চায়ের দোকানের সামনে ভিড় করে। হঠাৎ ১০/১২টি মোটরসাইকেলে করে পুলিশের একটি দল এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলে। যুবকরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ শুরু করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল। সবাইকে ধরে সারা শরীরে তল্লাশি করতে করতে শাসাতে থাকে- বোমা কই! বোমা মারছিস কেন। ততক্ষণে যুবকরা আন্দাজ করে ফেলে যে, কিছুক্ষণ আগে তারা যে ঠাস করে একটি ট্রান্সফরমার ফাটার শব্দ শুনেছিল সেই শব্দের সূত্র ধরেই হয়তো পুলিশ এসেছে। একজন যুবক সাহস করে আঙ্গুল উঁচিয়ে পুলিশকে বলল- ভাই! বোমা ফুটেনি। ওইখানে ট্রান্সফরমার ফেটেছে। কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে যখন ঘটনার সত্যতা বুঝতে পারল তখন যুবকদের রেহাই দিল।
দেশের চলমান সহিংস অবস্থার বাস্তব চিত্র নিয়ে হররোজ তৈরি হতে পারে অসংখ্য চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা গীতি কবিতা। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা শুনলে হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়। লোকগুলোর কি আল্লাহ-খোদার ভয় নেই? দেদারসে যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যেসব রক্ষাকবচ জনগণকে অতীতকালে রক্ষা করত তাও আজ বিলীন হতে বসেছে। মজলুম এমনভাবে নিজেকে ছোট এবং অসহায় করে ফেলছে যাতে মনে হতে পারে লোকটি হয়তো তারই মতো কোনো বান্দা বা বান্দিকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করছে। প্রভাবশালীরা এমনভাবে অহংকার করছে, যা দেখে মনে হতে পারে লোকটি হয়তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইয়াদ অর্থাৎ চাদর ধরে টানাটানি করছে। জ্ঞানীরা চুপচাপ বসে আছে- আর মূর্খরা সব আগ বাড়িয়ে কথা বলছে। অভদ্ররা মঞ্চে দাঁড়িয়ে দাপাদাপি করছে এবং ভদ্রলোকেরা সব আড়ালে চলে গেছে।
অস্থির সময়ে বিপদে-আপদে মানুষ আল্লাহ-খোদাকে বেশি ডাকাডাকি করে। অন্যদিকে দরিদ্র লোকজনই দুনিয়ার চেয়ে আখেরাত নিয়ে একটু বেশি চিন্তাভাবনা করে। ধনীরা ধন সম্পদের মোহ এবং কাম-বাসনা চরিতার্থ করার সব উপকরণ হাতের নাগালে পাওয়ার কারণে বাদবাকিতে খুব কমই বিশ্বাস করে। অর্থাৎ চোখের সামনের সহজলভ্য বিত্ত-বিলাসের সামগ্রী বাদ দিয়ে মৃত্যু, তারপর কবর, এরপর কেয়ামত, হাশর, মিজান, এরপর জান্নাতে গিয়ে সবকিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে না। অন্যদিকে দরিদ্ররা যখন ওসব কিছু পায় না তখন সে মনপ্রাণ দিয়ে একান্ত অনুগত বান্দা হিসেবে জান্নাতে গিয়ে সবকিছু পাওয়ার আশায় দিনাতিপাত করতে থাকে।
জান্নাতের নেয়ামতের গুণকীর্তন শেষ করা যাবে না। নেয়ামতের সংখ্যাও অসীম। অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে প্রতিটি পুরুষের জন্য ৭০ জন হুর, সরাবান তহুরা নামক একশ্রেণির পানীয়, দুধ, মধু এবং সুসজ্জিত বিশাল বিশাল বাগান-ঝরনা সমন্বিত প্রাসাদের কথা আমরা ছোটকাল থেকে শুনে এসেছি। দুনিয়া এবং জান্নাতি নেয়ামতের মধ্যে অনেক গুণগত এবং বস্তুগত পার্থক্য রয়েছে। দুনিয়ার সবকিছু পচে যায়, ক্ষয়ে যায় এবং অধিক ব্যবহারে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। দুনিয়াতে ভোগের মাত্রা সীমিত। মানুষ ইচ্ছা করলেও সারাদিন খেতে পারবে না কিংবা ৭০ জন বিবির সঙ্গে সারাক্ষণ রমণ করতে পারবে না। দুনিয়ার প্রতিটি বস্তুর জন্য ভোগীকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়- দিতে হয় বিনিময় মূল্য। ভোগের পর ক্ষেত্রবিশেষে অভক্তিও এসে যায়। অন্যদিকে জান্নাতে ভোগের ক্ষেত্রে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা নেই। সবকিছু করা যাবে ইচ্ছামতো, সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাজির হবে আকাঙ্ক্ষা করা মাত্র। একটি মানুষ যদি সারাদিন শুধু খেতে চায় কিংবা ঘুমোতে চায় অথবা কোনো ক্রীড়া-কৌতুক করতে চায় তবে সমস্যা নেই। তিনি ইচ্ছামতো সবকিছু করতে পারবেন- কোনো ক্লান্তি অবসাদ অথবা বিরাগ-বিতৃষ্ণা তাকে স্পর্শ করবে না।
ঢাকার কোনো বুদ্ধিমান যুবককে যদি বলা হয় তোমাকে গুলশান এলাকায় ১০/১২ বিঘা বাড়ির ওপর নির্মিত বিশাল একটি প্রাসাদ দেওয়া হলো। প্রাসাদের মধ্যে তোমার জন্য সবকিছু মজুদ রয়েছে, আর রয়েছে ৭০ জন সুন্দরী নারী যাদের তুমি স্ত্রী অথবা দাসী হিসেবে ব্যবহার করতে পার। বুদ্ধিমান যুবকটির মনে প্রশ্ন আসবে বাড়ির বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, কর্মচারীদের বেতন কে দেবে, কতদিন দেবে? ৭০ জন বউ বা দাসী দিয়েইবা সে কী করবে। বহু বিবাহের কুফল এবং স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে ছ্যাচা দেওয়ার বহু কাহিনী তার মনে উদয় হবে। ৭০ জন বিবির যদি ২/৩টা করে বাচ্চা হয় আর যদি তারা সামনে এসে বলে- ও বাজান, কলা খাব! লেবেনচুস খাব- তাহলে তো কথাই নেই! মুহূর্তের মধ্যে উন্মাদ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
মানুষ তার সহজাত অভ্যাস এবং চিরায়ত মনমানসিকতার জন্য সব সময় সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোগের সামগ্রী পেতে চায়। কিন্তু বিনিময়ে পরিশ্রম, দায়িত্ব গ্রহণ, ত্যাগ স্বীকার, সাধনা করতে রাজি নয়। এ জন্য দুনিয়ার নেয়ামত খুব অল্প লোকের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয়। এই দুনিয়ার তাবৎ লোক জীবনযুদ্ধের মাঠে না গিয়ে কিংবা জীবনযুদ্ধের ঝক্কি-ঝামেলার ভয়ে বিকল্প পথে নেয়ামত লাভের চেষ্টা করে। ফলে হঠাৎ লক্ষ্য করা যায় সমাজে কর্মবীরের তুলনায় জান্নাতলোভীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সমাজে যদি গণ্ডগোল, হানাহানি, মারামারি বেশি হয় তাহলে সঙ্গত কারণেই কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। জীবিকার পথ রুদ্ধ হলে মানুষ জীবনসংগ্রামে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মানুষ তখন বেঁচে থাকার পরিবর্তে শয়নে-স্বপনে মৃত্যু কামনা করে। কিন্তু তারা মরতে ভয় পায় দুটি কারণে।
প্রথমত, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তারা জান্নাতি হতে চায়। কিন্তু মানুষ তার কর্মকাণ্ডের কথা গভীরভাবে চিন্তা করলে জাহান্নাম ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পায় না। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে মরার জন্য একটি উপায় হলো আত্দহত্যা। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভয়ানক দুটি বিপত্তি রয়েছে। প্রথমটি হলো- সাহস এবং দুনিয়ার মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা এবং আকর্ষণ ত্যাগ করা যা কিনা বেশির ভাগ লোকেরই থাকবে না। আত্দহত্যা নিঃসন্দেহে একটি ভয়াবহ দুঃসাহসিক ঘটনা। যেনতেন লোক এ কাজ করতে পারে না। দ্বিতীয়টি হলো- জাহান্নামের ভয়। আত্দহত্যা করলে নির্ঘাত জাহান্নামে যেতে হবে এই ভয়ে লোকজন ওমুখো হয় না। কাজেই মানুষ তখন বিকল্প পথে সহজে মরার রাস্তা খোঁজে যে রাস্তার শেষ প্রান্তে জাহান্নামের পরিবর্তে জান্নাতের স্বপ্ন থাকে। জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মানুষ ছাড়াও অলস-ভীরু এবং পরিশ্রমে অনীহা রয়েছে তখন সব নর-নারীও কিন্তু বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যেতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে।
এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসি। জীবন মৃত্যু-দুনিয়া আখেরাতের চিন্তা করতে গিয়ে আমার বার বার জান্নাতের নানাবিধ আকর্ষণীয় নেয়ামতের কথা মনে আসছিল। আর এসব আমি চিন্তা করছিলাম সাম্প্রতিককালে ঘটমান বাংলাদেশের সর্বনিকৃষ্ট সন্ত্রাস, মারামারি-হানাহানি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক ও পারিবারিক অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তার কারণে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তবে বাংলাদেশের খুব কমসংখ্যক মানুষই বেঁচে থেকে জীবনযুদ্ধে অংশগ্রহণের কর্মপ্রেরণা দ্বারা পরিচালিত হবে। তারা হুটহাট করে ভবলীলা সাঙ্গ করে সরাসরি জান্নাতে ঢুকে হুর এবং দুধ-মধুর স্বাদ গ্রহণের জন্য সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজবে। কিছু লোক তো সারা দুনিয়ায় সর্বকালেই ছিল- যারা মানুষের এ মানবিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলতে পেরেছিল আইএস, আল-কায়েদা এবং বোকো হারামের মতো সংগঠন। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উচিত অতি দ্রুত দেশের চলমান অবস্থার অবসানকল্পে বিকল্প পথের সন্ধান করে তা জাতির সামনে তুলে ধরা। অন্যথায় আমরা হয়তো আফগানিস্তান, সিরিয়া কিংবা নাইজেরিয়ার মতো দুর্ভাগা জাতিতে পরিণত হবো। আর সবাই মিলে কপাল চাপড়ালেও লাভ হবে না।
লেখক : কলামিস্ট
No comments