রণনীতির সন্ধানে ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম by আবু রূশ্দ
“We
were getting out of touch with reality… and living in an artificial
world of our own creation.” (চীন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পণ্ডিত
জওয়াহেরলাল নেহরুর উক্তি)
১৯৬২ সালে যখন চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু শ্রীলঙ্কা সফরে ব্যস্ত ছিলেন। অবশ্য যাত্রার প্রাক্কালে পালাম বিমানবন্দরে মিডিয়ার কাছে ক্যাজুয়ালি বলেছিলেন, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্ত থেকে ‘চীনাদের বিতাড়িত করার নির্দেশ’ দিয়ে যাচ্ছেন। এ দিকে যুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে তার প্রিয়পাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফÑ সিজিএস লে. জেনারেল বি এম কাউল সব সময় পণ্ডিত নেহরুকে অনবরত ধারণা দিয়ে আসছিলেন যে, পাকিস্তানই ভারতের একমাত্র শত্রু, চীন থেকে ভয়ের কিছু নেই।
চীনা বাহিনীর তাড়া খেয়ে ভারতীয় বাহিনী যখন লেজ গুটিয়ে পশ্চাৎপসারণ করছে তখন পণ্ডিতজী তড়িঘড়ি ফিরে আসেন। তবে এর মাঝেই চীনা সেনাবাহিনী অরুণাচলের বিশাল এলাকা দখল করে আসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনা বাহিনীর হিউম্যান ওয়েভের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, চীন ভারতের ভূখণ্ড দখল করেছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো কারণ না দেখিয়েই তারা আবার হঠাৎ করে সামনে না এগিয়ে দখলকৃত ভূমি ছেড়ে চলে যায়। কেন চীনারা ওভাবে চলে গিয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, চীন যদি আরো সামনে বাড়ত বা ভারতের জায়গা দখল করে রাখত, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো কোরিয়া যুদ্ধের মতো আরেকটি রণক্ষেত্র তৈরি করত চীনের জন্য। হতে পারে, কারণ ভারতের ওই বিপদে মার্কিন পরিবহন বিমান টনকে টন যুদ্ধাস্ত্র ও সমরোপকরণ সরবরাহ করা শুরু করেছিল কলকাতা বিমানবন্দরে। কমিউনিস্ট চীনের সাথে তখন মার্কিনিদের কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিল না। সে সময় আরো কিছু মজার ঘটনা ঘটে এই উপমহাদেশে। তখনকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তান ছিল পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। অন্য দিকে চীনের সাথেও পাকিস্তানের তখন পর্যন্ত কোনো স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি। তার পরও পাকিস্তানের কিছু রাজনীতিবিদ ও জেনারেল ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানকে উৎসাহিত করেছিলেন ভারতের চরম দুর্দিনের সুযোগ নিয়ে কাশ্মির দখল করে ফেলতে। তাদের যুক্তি ছিলÑ এমন ঈশ্বরপ্রদত্ত সময় আর আসবে না, ভারতের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তাই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু আইয়ুব খান তাদের কথায় সাড়া দেননি, বরং তিনি ভারতের কাছে ভিন্ন চ্যানেলে বার্তা পাঠিয়েছিলেনÑ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাদের আক্রান্ত হওয়ার কোনো ভয় নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিও আইয়ুব খানকে ভারতের সহায়তায় এগিয়ে না এলেও সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে সময় পাকিস্তান যদি চাইত, তাহলে সামরিকভাবে কাশ্মির দখল করে নিতে পারত; ভারতের কিছুই করার ছিল না। আইয়ুব খান যে কারণেই হোক, নিষ্ক্রিয় থাকাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
১৯৬২ সালের এই চীন-ভারত যুদ্ধের প্রায় তিন বছর আগে আইয়ুব খান আরো একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারতের সাথে সমঝোতায় আসতে। ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসার পথে দিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতি করেন পাক প্রেসিডেন্ট। সেখানে পণ্ডিত নেহরুর সাথে আলাপকালে আইয়ুব খান দৃঢ়ভাবেই পণ্ডিতজীকে হকচকিত করে প্রস্তাব করেন, ভারতের সাথে পাকিস্তানের জয়েন্ট ডিফেন্সের। প্রস্তাবানুযায়ী দুই দেশের সশস্ত্রবাহিনী এক কমান্ডের আওতায় থাকবে, আর তাতে তা হয়ে উঠবে অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী বাহিনী। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে থাকবে অনাক্রমণ চুক্তি। এমন প্রস্তাব অস্বাভাবিক ও অনেকটা ইউটোপিয়ান হলেও জওয়াহেরলাল নেহরু খুবই ঠাণ্ডাকণ্ঠে বলেনÑ ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম?’ ‘জয়েন্ট ডিফেন্স’ প্রস্তাব তো ভারত গ্রহণ করলই না, বরং আইয়ুবের প্রস্তাবের ওইখানেই ইতি ঘটে। (সূত্র : দি ওয়ার উই লস্ট, বি জি ভারগিস, তেহেলকা ডট কম, ১৩ অক্টোবর ২০১২, ইস্যু ৪১, ভলিউম ৯)।
নেহরু যদি ১৯৫৯ সালে আইয়ুবের ‘জয়েন্ট ডিফেন্স’ প্রস্তাব মেনে নিতেন, তাহলে এ উপমহাদেশের ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতো। চীনের সাথে যুদ্ধে ওরকম মার খেতে হতো না ভারতীয় সেনাবাহিনীকে, ঘটত না ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ; এমনকি ১৯৭১ সালে কী হতো আল্লাহই জানেন! অবশ্য লে. জেনারেল বি এম কাউলের মতো ‘ফুট লিকার’ বা পদলেহনকারী সব সময় সব দেশে ছিল, আছে ও থাকবে এবং এরা এমনই বিশেষ প্রজাতির যে, পণ্ডিত নেহরুর মতো ঝানু স্টেটসম্যানকেও ঘোল খাওয়াতে পারঙ্গম।
যা হোক, পৃথিবীর প্রতিটি দেশ তার রণনীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’ অর্থাৎ প্রতিরক্ষা কার বিরুদ্ধে এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করে। অনেক সময় অনেকের কাছে মনে হতে পারে, অনেক অঞ্চলে পাশাপাশি অনেক দেশ বন্ধুপ্রতিম, যেমনÑ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর বা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। কিন্তু তার পরও তো এদের সবারই সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে, আছে সুনির্দিষ্ট রণনীতি। সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে। খুবই ছোট একটি দেশ। বিপরীতে মালয়েশিয়ার আকার বিশাল। কিন্তু সিঙ্গাপুরের সশস্ত্রবাহিনী যেভাবে অস্ত্রসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত তাতে আজ কোনোভাবেই কারো পক্ষে সিঙ্গাপুরের গায়ে হাত দেয়া সম্ভব নয়। এর বাইরে সিঙ্গাপুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে এমনই সামরিক অ্যালায়েন্স তৈরি করেছে যে, ছোট হলেও তার নিরাপত্তাবলয় অনেক বড় হয়ে গেছে। কারণ তারা বোঝেÔThe fact should be remembered that a little bear can not live with a giant wolf in a totally insecure condition.Õ ( Md. Nuruzzaman, ÔNational security of BangladeshÕ, BIISS Journal Vol.12,No.3, 1991)। মূলত এ কারণেই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো যতটুকু সম্ভব নিজ সামর্থ্য থেকে সশস্ত্রবাহিনীকে সজ্জিত করে ও বৃহৎশক্তির ছত্রছায়া নিয়ে বাকি লুপহোলগুলো দূর করে। অবশ্য জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রেও প্রতিটি দেশের কিছু নিজস্বতা থাকে, স্বকীয় নিরাপত্তানীতি থাকে ও ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’Ñ এ বিষয়টিও থাকে সুনির্দিষ্ট। এসবের ওপর ভিত্তি করেই কোন সূত্র থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করলে ভালো হবে, কোন কোন অস্ত্রশস্ত্র আসলেই প্রয়োজন তার প্রাধিকার তৈরি করে। অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করে অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দিকটি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তবে লোকসংখ্যার দিক দিয়ে ছোট নয়। আবার অর্থনৈতিক বিবেচনায় আমাদের সামর্থ্য এখনো অনেক কম। কিন্তু বিপদের বিষয় হলো, বাংলাদেশের অবস্থান ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল এলাকা’ দক্ষিণ এশিয়ায়। দুই পারমাণবিক শক্তি পাকিস্তান-ভারত ছাড়াও এ অঞ্চলের ঠিক পাশে রয়েছে বিশ্বশক্তি চীন। তবে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বিশ্বের চলতি ক্ষমতার ভারসাম্যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে বে অব বেঙ্গল বা বঙ্গোপসাগরের জন্য। এ শতকে বিশ্বশক্তিগুলোর প্রাধান্য বিস্তারের চারণভূমি হচ্ছে এই বঙ্গোপসাগর এলাকা। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত কেন্দ্রীভূত হতে চলেছে দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা ছাড়িয়ে বে অব বেঙ্গল নিয়ে। এর ব্যাখ্যা অনেক বড়। তবে এ কারণেই বাংলাদেশ ও এর সংশ্লিষ্ট সমুদ্র এলাকা নিয়ে নজর পড়েছে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ রাশিয়ার। এ দিকটিকে সামনে রেখেই বাংলাদেশকে তার প্রতিরক্ষানীতি পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এখানেই এসে যায় ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’ কথাটি। তবে প্রতিরক্ষানীতির ক্ষেত্রে আমাদের আসলেই কখনো কোনো ‘হুম’ ছিল কি না তাই সন্দেহ! পৃথিবীতে হয়তো বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি কয়েক বছর পরপর পরিবর্তিত হয়। এক দল ক্ষমতায় এলে ‘হুম’ হয় একটা, আরেকজন এলে ‘হুম’ কথাটিই গায়েব হয়ে যায়!
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। তিন বাহিনীতে অনেক অবকাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। পদ-পদবির সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। বেড়েছে সুযোগ-সুবিধা, সেনানিবাসগুলোকে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। সৈনিকদের বাসস্থান সমস্যার বেশখানিকটা দূর হয়েছে। অন্য দিকে নতুন অনেক অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে। নৌবাহিনীতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ফ্রিগেট, সার্ভে শিপ, কর্ভেট, মিসাইল ক্রাফট কেনা হয়েছে; সাবমেরিন সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিমানবাহিনীতেও যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ইয়াক-১৩০ গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট, চীন থেকে আনা হয়েছে এফ-৭ জঙ্গিবিমান, কে-৮ প্রশিক্ষণ বিমান। সেনাবাহিনী পেয়েছে বহুপ্রতীক্ষিত মেইন ব্যাটল ট্যাংক এমবিটি-২০০০, সেলফ প্রপেলড হাউইটজার, রাশিয়া ও চীনের অত্যাধুনিক ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরো অনেক কিছু। গঠন করা হয়েছে নতুন দু’টি ডিভিশনÑ একটি সিলেটে, আরেকটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের রামুতে। আরেকটি প্রক্রিয়াধীন। যদিও এই নতুন ডিভিশনগুলোকে পরিপূর্ণরূপে সজ্জিত করতে অনেক অর্থসম্পদ প্রয়োজন, দরকার সময়ের। এ পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। আমরা দুর্বল থাকতে চাই না, চাই শক্তি। কারণ, ÔTo be weak is not virtuous, being prepared is not being provocative.Õ (Quoted in Ashequa Irshad, ÔIndian military Power and PolicyÕ, BIISS Journal, Vol.10.No.4, 1989, p.480)।
আমরা আমাদের সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে গর্বিত। সশস্ত্রবাহিনী সব দেশের গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, মূলত ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো বহিঃশত্রুর হামলা থেকে দেশের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা প্রতিহত করা। মানবতাবোধ এখনো যুদ্ধপ্রবণতাকে পরাজিত করতে পারেনি বলে এবং আন্তর্জাতিক আইন এখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছাড়া আগ্রাসন রোধে অক্ষম বলে প্রতিটি জাতিই তাদের নিজ নিজ সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।’ (নাজিম কামরান চৌধুরী, ‘বাংলাদেশ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও সশস্ত্রবাহিনী’, পৃ. ৪৪-৪৫)। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’? এই ‘হুম’টি কে বা কারা তা ঠিক না করা পর্যন্ত কার্যকর প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেও ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যটি’ থেকে যাবে ধোঁয়ার আড়ালে।
শেষে আবারো ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। সে সময়ের ভারতের লজ্জাজনক পরাজয় নিয়ে লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকা ‘ÔPlain Tales From the HillsÕ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিলÑ ÔWhen the fog cleared, the Chinese were there!Õ আশা করি, আমাদের কখনো সেরূপ অবস্থা হবে না।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স
জার্নাল-এর সম্পাদক
১৯৬২ সালে যখন চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু শ্রীলঙ্কা সফরে ব্যস্ত ছিলেন। অবশ্য যাত্রার প্রাক্কালে পালাম বিমানবন্দরে মিডিয়ার কাছে ক্যাজুয়ালি বলেছিলেন, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সীমান্ত থেকে ‘চীনাদের বিতাড়িত করার নির্দেশ’ দিয়ে যাচ্ছেন। এ দিকে যুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে তার প্রিয়পাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফÑ সিজিএস লে. জেনারেল বি এম কাউল সব সময় পণ্ডিত নেহরুকে অনবরত ধারণা দিয়ে আসছিলেন যে, পাকিস্তানই ভারতের একমাত্র শত্রু, চীন থেকে ভয়ের কিছু নেই।
চীনা বাহিনীর তাড়া খেয়ে ভারতীয় বাহিনী যখন লেজ গুটিয়ে পশ্চাৎপসারণ করছে তখন পণ্ডিতজী তড়িঘড়ি ফিরে আসেন। তবে এর মাঝেই চীনা সেনাবাহিনী অরুণাচলের বিশাল এলাকা দখল করে আসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনা বাহিনীর হিউম্যান ওয়েভের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, চীন ভারতের ভূখণ্ড দখল করেছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো কারণ না দেখিয়েই তারা আবার হঠাৎ করে সামনে না এগিয়ে দখলকৃত ভূমি ছেড়ে চলে যায়। কেন চীনারা ওভাবে চলে গিয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, চীন যদি আরো সামনে বাড়ত বা ভারতের জায়গা দখল করে রাখত, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো কোরিয়া যুদ্ধের মতো আরেকটি রণক্ষেত্র তৈরি করত চীনের জন্য। হতে পারে, কারণ ভারতের ওই বিপদে মার্কিন পরিবহন বিমান টনকে টন যুদ্ধাস্ত্র ও সমরোপকরণ সরবরাহ করা শুরু করেছিল কলকাতা বিমানবন্দরে। কমিউনিস্ট চীনের সাথে তখন মার্কিনিদের কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিল না। সে সময় আরো কিছু মজার ঘটনা ঘটে এই উপমহাদেশে। তখনকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তান ছিল পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। অন্য দিকে চীনের সাথেও পাকিস্তানের তখন পর্যন্ত কোনো স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি। তার পরও পাকিস্তানের কিছু রাজনীতিবিদ ও জেনারেল ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানকে উৎসাহিত করেছিলেন ভারতের চরম দুর্দিনের সুযোগ নিয়ে কাশ্মির দখল করে ফেলতে। তাদের যুক্তি ছিলÑ এমন ঈশ্বরপ্রদত্ত সময় আর আসবে না, ভারতের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তাই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু আইয়ুব খান তাদের কথায় সাড়া দেননি, বরং তিনি ভারতের কাছে ভিন্ন চ্যানেলে বার্তা পাঠিয়েছিলেনÑ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাদের আক্রান্ত হওয়ার কোনো ভয় নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিও আইয়ুব খানকে ভারতের সহায়তায় এগিয়ে না এলেও সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে সময় পাকিস্তান যদি চাইত, তাহলে সামরিকভাবে কাশ্মির দখল করে নিতে পারত; ভারতের কিছুই করার ছিল না। আইয়ুব খান যে কারণেই হোক, নিষ্ক্রিয় থাকাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
১৯৬২ সালের এই চীন-ভারত যুদ্ধের প্রায় তিন বছর আগে আইয়ুব খান আরো একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারতের সাথে সমঝোতায় আসতে। ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসার পথে দিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতি করেন পাক প্রেসিডেন্ট। সেখানে পণ্ডিত নেহরুর সাথে আলাপকালে আইয়ুব খান দৃঢ়ভাবেই পণ্ডিতজীকে হকচকিত করে প্রস্তাব করেন, ভারতের সাথে পাকিস্তানের জয়েন্ট ডিফেন্সের। প্রস্তাবানুযায়ী দুই দেশের সশস্ত্রবাহিনী এক কমান্ডের আওতায় থাকবে, আর তাতে তা হয়ে উঠবে অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী বাহিনী। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে থাকবে অনাক্রমণ চুক্তি। এমন প্রস্তাব অস্বাভাবিক ও অনেকটা ইউটোপিয়ান হলেও জওয়াহেরলাল নেহরু খুবই ঠাণ্ডাকণ্ঠে বলেনÑ ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম?’ ‘জয়েন্ট ডিফেন্স’ প্রস্তাব তো ভারত গ্রহণ করলই না, বরং আইয়ুবের প্রস্তাবের ওইখানেই ইতি ঘটে। (সূত্র : দি ওয়ার উই লস্ট, বি জি ভারগিস, তেহেলকা ডট কম, ১৩ অক্টোবর ২০১২, ইস্যু ৪১, ভলিউম ৯)।
নেহরু যদি ১৯৫৯ সালে আইয়ুবের ‘জয়েন্ট ডিফেন্স’ প্রস্তাব মেনে নিতেন, তাহলে এ উপমহাদেশের ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতো। চীনের সাথে যুদ্ধে ওরকম মার খেতে হতো না ভারতীয় সেনাবাহিনীকে, ঘটত না ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ; এমনকি ১৯৭১ সালে কী হতো আল্লাহই জানেন! অবশ্য লে. জেনারেল বি এম কাউলের মতো ‘ফুট লিকার’ বা পদলেহনকারী সব সময় সব দেশে ছিল, আছে ও থাকবে এবং এরা এমনই বিশেষ প্রজাতির যে, পণ্ডিত নেহরুর মতো ঝানু স্টেটসম্যানকেও ঘোল খাওয়াতে পারঙ্গম।
যা হোক, পৃথিবীর প্রতিটি দেশ তার রণনীতি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’ অর্থাৎ প্রতিরক্ষা কার বিরুদ্ধে এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করে। অনেক সময় অনেকের কাছে মনে হতে পারে, অনেক অঞ্চলে পাশাপাশি অনেক দেশ বন্ধুপ্রতিম, যেমনÑ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর বা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। কিন্তু তার পরও তো এদের সবারই সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে, আছে সুনির্দিষ্ট রণনীতি। সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে। খুবই ছোট একটি দেশ। বিপরীতে মালয়েশিয়ার আকার বিশাল। কিন্তু সিঙ্গাপুরের সশস্ত্রবাহিনী যেভাবে অস্ত্রসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত তাতে আজ কোনোভাবেই কারো পক্ষে সিঙ্গাপুরের গায়ে হাত দেয়া সম্ভব নয়। এর বাইরে সিঙ্গাপুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে এমনই সামরিক অ্যালায়েন্স তৈরি করেছে যে, ছোট হলেও তার নিরাপত্তাবলয় অনেক বড় হয়ে গেছে। কারণ তারা বোঝেÔThe fact should be remembered that a little bear can not live with a giant wolf in a totally insecure condition.Õ ( Md. Nuruzzaman, ÔNational security of BangladeshÕ, BIISS Journal Vol.12,No.3, 1991)। মূলত এ কারণেই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো যতটুকু সম্ভব নিজ সামর্থ্য থেকে সশস্ত্রবাহিনীকে সজ্জিত করে ও বৃহৎশক্তির ছত্রছায়া নিয়ে বাকি লুপহোলগুলো দূর করে। অবশ্য জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রেও প্রতিটি দেশের কিছু নিজস্বতা থাকে, স্বকীয় নিরাপত্তানীতি থাকে ও ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’Ñ এ বিষয়টিও থাকে সুনির্দিষ্ট। এসবের ওপর ভিত্তি করেই কোন সূত্র থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করলে ভালো হবে, কোন কোন অস্ত্রশস্ত্র আসলেই প্রয়োজন তার প্রাধিকার তৈরি করে। অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করে অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দিকটি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। তবে লোকসংখ্যার দিক দিয়ে ছোট নয়। আবার অর্থনৈতিক বিবেচনায় আমাদের সামর্থ্য এখনো অনেক কম। কিন্তু বিপদের বিষয় হলো, বাংলাদেশের অবস্থান ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল এলাকা’ দক্ষিণ এশিয়ায়। দুই পারমাণবিক শক্তি পাকিস্তান-ভারত ছাড়াও এ অঞ্চলের ঠিক পাশে রয়েছে বিশ্বশক্তি চীন। তবে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বিশ্বের চলতি ক্ষমতার ভারসাম্যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে বে অব বেঙ্গল বা বঙ্গোপসাগরের জন্য। এ শতকে বিশ্বশক্তিগুলোর প্রাধান্য বিস্তারের চারণভূমি হচ্ছে এই বঙ্গোপসাগর এলাকা। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত কেন্দ্রীভূত হতে চলেছে দক্ষিণ চীন সাগর এলাকা ছাড়িয়ে বে অব বেঙ্গল নিয়ে। এর ব্যাখ্যা অনেক বড়। তবে এ কারণেই বাংলাদেশ ও এর সংশ্লিষ্ট সমুদ্র এলাকা নিয়ে নজর পড়েছে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ রাশিয়ার। এ দিকটিকে সামনে রেখেই বাংলাদেশকে তার প্রতিরক্ষানীতি পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এখানেই এসে যায় ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’ কথাটি। তবে প্রতিরক্ষানীতির ক্ষেত্রে আমাদের আসলেই কখনো কোনো ‘হুম’ ছিল কি না তাই সন্দেহ! পৃথিবীতে হয়তো বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র, যার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি কয়েক বছর পরপর পরিবর্তিত হয়। এক দল ক্ষমতায় এলে ‘হুম’ হয় একটা, আরেকজন এলে ‘হুম’ কথাটিই গায়েব হয়ে যায়!
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। তিন বাহিনীতে অনেক অবকাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। পদ-পদবির সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। বেড়েছে সুযোগ-সুবিধা, সেনানিবাসগুলোকে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। সৈনিকদের বাসস্থান সমস্যার বেশখানিকটা দূর হয়েছে। অন্য দিকে নতুন অনেক অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে। নৌবাহিনীতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ফ্রিগেট, সার্ভে শিপ, কর্ভেট, মিসাইল ক্রাফট কেনা হয়েছে; সাবমেরিন সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিমানবাহিনীতেও যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ইয়াক-১৩০ গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট, চীন থেকে আনা হয়েছে এফ-৭ জঙ্গিবিমান, কে-৮ প্রশিক্ষণ বিমান। সেনাবাহিনী পেয়েছে বহুপ্রতীক্ষিত মেইন ব্যাটল ট্যাংক এমবিটি-২০০০, সেলফ প্রপেলড হাউইটজার, রাশিয়া ও চীনের অত্যাধুনিক ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরো অনেক কিছু। গঠন করা হয়েছে নতুন দু’টি ডিভিশনÑ একটি সিলেটে, আরেকটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের রামুতে। আরেকটি প্রক্রিয়াধীন। যদিও এই নতুন ডিভিশনগুলোকে পরিপূর্ণরূপে সজ্জিত করতে অনেক অর্থসম্পদ প্রয়োজন, দরকার সময়ের। এ পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। আমরা দুর্বল থাকতে চাই না, চাই শক্তি। কারণ, ÔTo be weak is not virtuous, being prepared is not being provocative.Õ (Quoted in Ashequa Irshad, ÔIndian military Power and PolicyÕ, BIISS Journal, Vol.10.No.4, 1989, p.480)।
আমরা আমাদের সশস্ত্রবাহিনী নিয়ে গর্বিত। সশস্ত্রবাহিনী সব দেশের গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, মূলত ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো বহিঃশত্রুর হামলা থেকে দেশের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা প্রতিহত করা। মানবতাবোধ এখনো যুদ্ধপ্রবণতাকে পরাজিত করতে পারেনি বলে এবং আন্তর্জাতিক আইন এখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছাড়া আগ্রাসন রোধে অক্ষম বলে প্রতিটি জাতিই তাদের নিজ নিজ সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।’ (নাজিম কামরান চৌধুরী, ‘বাংলাদেশ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও সশস্ত্রবাহিনী’, পৃ. ৪৪-৪৫)। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ ‘ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম’? এই ‘হুম’টি কে বা কারা তা ঠিক না করা পর্যন্ত কার্যকর প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেও ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যটি’ থেকে যাবে ধোঁয়ার আড়ালে।
শেষে আবারো ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। সে সময়ের ভারতের লজ্জাজনক পরাজয় নিয়ে লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকা ‘ÔPlain Tales From the HillsÕ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিলÑ ÔWhen the fog cleared, the Chinese were there!Õ আশা করি, আমাদের কখনো সেরূপ অবস্থা হবে না।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স
জার্নাল-এর সম্পাদক
No comments